- বইয়ের নামঃ মেঘ বলেছে যাব যাব
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অবসর প্রকাশনা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
মেঘ বলেছে যাব যাব
একদল হাঁসের সঙ্গে সে হাঁটছে।
তার মানেটা কী? সে হাঁসদের সঙ্গে হাঁটবে কেন? সে তো হাঁস না। সে মানুষ। তার নাম হাসানুর রহমান। বয়স আটাশ। মোটামুটি সুদৰ্শন। লাল রঙের শার্ট পরলে তাকে খুব মানায়। সে কেন হাঁসদের সঙ্গে ঘুরছে?
হাঁসের দল জলা জায়গায় নেমে পড়ল। সেও তাদের সঙ্গে নামল। হাঁসিরা শামুক গুগলি জাতীয় খাবার খাচ্ছে। সেও খাচ্ছে। কপি কপি করে খাচ্ছে। ঝিনুকের খোল খুলতে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা হাঁস তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হাঁসটার চোখ মানুষের চোখের মতো বড় বড়। কাজল পরানো। হচ্ছেটা কী? এটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন? দুঃস্বপ্ন তো বটেই।
হাসান প্ৰাণপণ চেষ্টা করতে লাগল দুঃস্বপ্নটা থেকে জাগতে। হাঁস না, তাকে স্বাভাবিক মানুষ হতে হবে। শামুক খেতে তার অসহ্য লাগছে। দুঃস্বপ্নটা কাটছে নাবরং আরো গাঢ় হচ্ছে। জলা জায়গাটা এখন নদীর মতো হয়ে গেছে। নদীতে প্রবল স্রোত। সে স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে না। স্থির হয়ে ভাসছে–যদিও সে সাঁতার জানে না। ব্যাপারটা তাহলে স্বপ্ন। স্বপ্লেই মানুষ আকাশে উড়তে পারে, প্ৰবল স্রোতেও স্থির হয়ে ভাসতে পারে।
আহ্ এই দুঃস্বপ্নের ঘুম ভঙে না কেন? হাসান পাশ ফিরল। পাশ ফিরতেই সিগারেট লাইটারের খোঁচা লাগল। পিঠে। সে চোখ মেলল। ভাগ্যিস পাশ ফিরেছিল। পাশ ফেরার কারণে ঘুম ভাঙল।
স্বপ্নের কর্মকাণ্ডের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। স্বপ্ন নিয়ে রাগ করারও কোনো মানে হয় না। কিন্তু হাসানের রাগ লাগছে। এমন উদ্ভট স্বপ্ন সে কেন দেখবে?
তার জীবনে উদ্ভট ব্যাপার অবশ্যি মাঝেমধ্যেই ঘটে। ঢাকা শহরে নিশ্চয়ই ঠেলাগাড়ির নিচে কেউ পড়ে নি। সে পড়েছে। মালিবাগ রেলক্রসিঙের কাছে হঠাৎ হুড়মুড় করে একটা ঠেলাগাড়ি তার গায়ে উঠে গেল। এক সময় সে বিস্মিত হয়ে দেখে ঠেলাগাড়ির দুই চাকার মাঝখানে সে প্রায় গিন্টু পাকিয়ে পড়ে আছে। চারপাশে প্রচণ্ড ভিড়। ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। পুলিশের সার্জেন্ট বাঁশি বাজাচ্ছে। ঠেলাগাড়ির নিচ থেকে তাকে বের করা মোটেই সহজ হয় নি। গাড়ি বোঝাই লোহার রড। সব রড নামিয়ে লোকজন ধরাধরি করে ঠেলাগাড়ি উঁচু করল, তারপরও সে বেরোতে পারল না। কারণ তার বা পা ভেঙে গেছে। তাকে পুরো এক মাস পায়ে প্লাস্টার বেঁধে শুয়ে থাকতে হলো। তার এম.এ. পরীক্ষা দেয়া হলো না। সেই পরীক্ষা এখনো দেয়া হয় নি। আবার কখনো দেয়া হবে–সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
হাসান বিছানায় উঠে বসল। তার ইচ্ছে করছে আগুনগরম এক কাপ চা খেতে। সবার বাড়িতে যদি খানিকটা হোটেল ভাব থাকত তাহলে ভালো হতো। খাটের পাশে টেলিফোন। টেলিফোন তুলে গষ্ঠীর গলায় বলা–হ্যালো রুম সার্ভিস! এক কাপ আগুনগরম চা৷
এ বাড়িতে সকালবেলা এক কাপ চা পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। নাশতা খাওয়া শেষ হবার পর সবার জন্যে যখন গণ-চা হবে তখনই পাওয়া যাবে। তার আগে না।
রান্নাঘরে দু বার্নারের একটা গ্যাসের চুল। সকালবেলা গ্যাসের চাপ কমে যায়। একটা চুলা অনেক কষ্টে ধিকি ধিকি করে জ্বলে। সেই চুলায় নাশতা তৈরি হয়। রুটি-ভাজি, কিংবা রুটি-হালুয়া। হাসানের বড় ভাই তারেক ভাত খেয়ে অফিসে যান। তার জন্যে ভাত রান্না হয়। তারেকের দুই পুত্রের স্কুলের টিফিন বানানো হয়। চুলা কখনো খালি থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে সকালে বেড-টি চাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবার কথা।
কোনো একটা ব্যাপার মাথার ভেতর ঢুকে গেলে সেটা আর বেরোতে চায় না। গ্রামোফোনের কাটা রেকর্ডের মতো বাজতেই থাকে। ‘এক কাপ আগুনগরম চা–এই বাক্য হাসানের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। হাসান বিছানা থেকে নামল। বাসার সামনের রাস্ত পার হলেই ইস্কান্দর মিয়ার চায়ের দোকান। এক কাপ চা চট করে খেয়ে আসা যায়। সকাল বেলার বিরক্তিকর কর্মকাণ্ড, যেমন–দাঁত ব্ৰাশ, দাড়ি কামানো আপাতত স্থগিত থাকুক।
হাসান লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরল। লুঙ্গি পরে বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। রীনা ভাবি একগাদা কথা শুনিয়ে দেবে। রীনা ভাবির প্রেস্টিজজ্ঞান খুব বেশি।
বারান্দায় বের হতেই হাসান রীনার মুখোমুখি হয়ে গেল। রানার হাতে লাল রঙের প্লাষ্টিকের বালতি। বালতিভর্তি কাপড়। এই কাপড়ে সে নিজ হাতে সাবান মাখিয়ে কলতলায় রেখে আসবে। কাজের মানুষের হাতে সাবান ছেড়ে দিলে দুদিনে একটা করে সাবান লাগবে।
রীনা শান্ত গলায় বলল, হাসান তুমি আজ অবশ্যই তোমার কোটিপতি বন্ধু রহমানের বাড়িতে যাবে। তার দাদি খুব অসুস্থ। তিনি তোমাকে দেখতে চান।
আচ্ছা।
আচ্ছা না, অবশ্যই যাবে। রহমান কাল সন্ধ্যাবেলা এসে বলে গেছে। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। রহমানের দাদির ব্যাপারটা কী? উনি প্রায়ই তোমাকে দেখতে চান কেন?
জানি না ভাবি।
তোমার বন্ধু আজ যে গাড়ি নিয়ে এসেছিল, সেই গাড়ি গলি দিয়ে ঢোকে না। গলির মোড়ে রেখে আসতে হয়েছিল।
হাসান হাসল, কিছু বলল না। রীনা কলতলার দিকে রওনা হতে গিয়েও হলো না। হাসিমুখে বলল, আমি নতুন একটা শাড়ি পরেছি, তুমি তো কিছু বললে না।
নতুন শাড়ি?
হ্যাঁ। ছেলেদের নতুন শার্ট-প্যান্ট আর মেয়েদের নতুন শাড়ি আলাদা ব্যাপার। মেয়েদের নতুন শাড়ি পরা মানে একটা বিশেষ ঘটনা। সেই ঘটনা যখন ঘটে তখন লক্ষ করতে হয়।
তোমাকে নতুন শাড়িতে খুবই সুন্দর লাগছে ভাবি।
রীনা এমনিতেই সুন্দর। আজ আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ঘুম থেকে উঠেই সে গোসল করেছে। সুন্দর করে সেজেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে। কাজলদানিতে কাজল ছিল না। থাকলে কাজলও দিত।
রীনা বলল, সুন্দর মানুষকে সুন্দর লাগবে না?
তুমি রাজকন্যা সেজে ধোপানীর মতো কাপড় ধুতে যাচ্ছে–এটা মানাচ্ছে না।
মালচন্দন নিয়ে কদমগাছের নিচে বসে থাকলে মানাত—-তাই না?
রীনা হাসতে হাসতে কলতলার দিকে চলে গেল। যদিও সে হাসছে কিন্তু তার মনটা খুব খারাপ। আজ একটা বিশেষ উপলক্ষে সে নতুন শাড়ি পরেছে। আজ তাদের বিয়ের সে ভুরু কুঁচকে খবরের কাগজ পড়ছে। রীনা আজকের দিনের ব্যাপারটা কায়দা করে মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে–বলেছে, তুমি তো রোজই শার্ট-প্যান্ট পরে অফিসে যাও। আজ এক কাজ কর, পায়জামাপাঞ্জাবি পরে যাও। তোমার জন্যে একটা পাঞ্জাবি কিনেছি। তারেক খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বিরক্ত গলায় বলেছে–অফিস কি শ্বশুর বাড়ি নাকি যে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে চোখে সুরমা দিয়ে যাব? মাঝে মাঝে কী অদ্ভুত কথা যে তুমি বল!
রীনার মুখে কঠিন কিছু কথা এসে গিয়ছিল, সে নিজেকে সামলাল। কী দরকার কঠিন কথা বলার? আজ সারাদিন সে মেজাজ খারাপ করবে না। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। রাতে পোলাও রান্না করবে। হঠাৎ পোলাও কেন জিজ্ঞেস করলে বলবে–বাচ্চারা অনেকদিন থেকেই পোলাওয়ের জন্যে ঘ্যানঘ্যান করছিল, ওদের ঘ্যানঘ্যাননি থামানোর জন্যে পোলাও। মিথ্যা বলা হবে না, তার দুটা বাচ্চাই পোলাওয়ের জন্যে পাগল। রোজই খেতে বসে বলবে–মা, পোলাও খাব।
চায়ের স্টলে ঢুকতে গিয়ে হাসান ছোটখাটো একটা ধাক্কার মতো খেল। তার বাবা রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন অফিসার জনাব আশরাফুজ্জামান সাহেব চায়ের স্টলে বসে আছেন। তিনি বেশ আরাম করে পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছেন। তাঁর সামনে দুটা বাটিএকটায় সবজি, অন্যটায় রসে ডোবানো একটা রসগোল্লা। আশরাফুজ্জামান চোখ মেলে ছেলেকে দেখলেন। অপ্ৰস্তুত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়েও নিলেন। মনে হলো তাঁর গলায় পরোটা বেজেও গেল। তিনি খুক খুক করে কাশতে লাগলেন।
বয়সের সঙ্গে মানুষ কত দ্রুত বদলায় বাবাকে দেখে হাসান ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। এক সময় এই মানুষটার সংসার অন্ত প্ৰাণ ছিল–ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার আগে নফল রোজা করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার আগে তারা যেন রাত দুটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে জন্যে নিজে ঘুম ঘুম চোখে পাশে বসে থাকতেন।
সেই মানুষের এখন আর কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। বড় ছেলের বাসায় তাঁর একটা ঘর আছে, তিনি সেখানে বাস করছেন–এই তো যথেষ্ট। ছেলেদের কার চাকরি আছে, কার নেই তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় হয়ে গেছে, এখন শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবা যায়। ক্ষিধে লাগলে চুপিচুপি চায়ের স্টলে বসে–পরোটা রসগোল্লা দিয়ে নাশতা। মন্দ কী?
আশরাফুজ্জামান বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, কী-রে চা খাবি?
হাসান কিছু বলল না। তার উচিত চলে যাওয়া, যাতে তিনি আরাম করে খাওয়াটা শেষ করতে পারেন। কিছু না বলে চলে যেতেও অস্বস্তি লাগছে। আশরাফুজ্জামান বললেন, মর্নিং ওয়াক শেষ করে এমন ক্ষিধে লাগিল–বাসার নাশতা কখন হয় তার নেই ঠিক। গরম গরম পরোটা আছে খা-না। আমি দাম দিচ্ছি।
হাসান বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। এ কী অদ্ভুত কথা–আমি দাম দিচ্ছি। হাসান বাবার সামনে বসল। একই বাড়িতে দুজন বাস করে, কিন্তু দু’জন এখন কত দ্রুত দুদিকে চলে যাচ্ছে! এই দূরত্ব এখন বোধহয় আর দূর হবার নয়।
আশরাফুজ্জামান আনন্দিত গলায় বললেন, পরোটা কী দিয়ে খাবি? মুরগির লটপটি দিয়ে খাবি? বেশ ভালো।
মুরগির লটপটিটা কী?
কলিজা গিলা পাখনা এইসব দিয়ে ঝোলের মতো বানায়। বেশ ভালো।
তুমি কি প্রায়ই এখানে নাশতা কর?
মাঝে মাঝে খাই। বৃদ্ধ বয়সে রুচি নষ্ট হয়ে যায়। তখন রুচি বদলের জন্যে হোটেল মোটেলের খাবার খাওয়া। রসগোল্লা খাবি?
তুমি কি নিয়মিত রসগোল্লাও খাচ্ছ? তোমার ভয়াবহ ডায়াবেটিস…
শেষ সময় এখন আর ডায়াবেটিস নিয়ে ভেবে কী হবে? তোকে একটা রসগোল্লা দিতে বলব?
বল।
এখানে যে নাশতা করি।—বউমা যেন না শোনে। রাগ করবে। মেয়েরা অগ্র-পশ্চাৎ ধ্ৰুরা না করেই রাগ করে। এদের সঙ্গে তর্ক করাও বৃথা। তুই আরেকটা পরোটা নিবি?
না।
নাশতা শেষ করে হাসান বাসায় ফিরল না। বেকার মানুষ একবার ঘর ছেড়ে বেরোলে রাত গভীর না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরতে পারে না। সে রওনা হলো রহমানদের বাসার দিকে। রহমানরা থাকে উত্তরায়–সকালবেলা ওইদিকে আরাম করে যাওয়া যায়। বাস ফাঁকা থাকে। জানালার পাশে একটা সিটি দখল করে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া। সমস্যা হচ্ছে-যেতে ইচ্ছা করছে না। না যাবার মতো কোনো অজুহাত যদি থাকত। বাস ড্রাইভার্স এসোসিয়েশন স্ট্রাইক ডেকেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে বন্ধ। রহমানকে বলা যাবে–খুব ইচ্ছা ছিল, বাস নেই, করব কী?
সমস্যা হচ্ছে হাসান মিথ্যা কথা বলতে পারে না। একেবারেই পারে না। দু’ ধরনের মানুষ মিথ্যা বলতে পারে না। সবল মনের মানুষ এবং দুর্বল মনের মানুষ। হাসানের ধারণা সে দুর্বল মনের মানুষ। রহমানদের বাড়িতে তার যেতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু সে জানে শেষ পর্যন্ত সে উপস্থিত হবে। দুর্বল মনের মানুষরা তাই করে।
রহমানের দাদি আম্বিয়া খাতুনের বয়স প্রায় নব্বই। গত পাঁচ বছর প্যারালিসিস হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। চোখে দেখেন না, তবে কান এবং নাক অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। আম্বিয়া খাতুন হাসানকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কেন করেন। সেই কারণ খুব স্পষ্ট না। হাসান নিজেও কারণ খুঁজতে যায় নি। স্নেহমমতার পেছনে কারণ খুঁজতে যাওয়ার মধ্যে ছোটলোকামি আছে। হাসান দুর্বল মনের মানুষ হলেও ছোটলোক না।
রহমানের বাবা সেকান্দর আলি পুলিশের সাবইন্সপেক্টর ছিলেন। ঘুস খাবার অপরাধে তাঁর চাকরি চলে যায়। তিনি ব্যবসা শুরু করেন এবং দেখতে দেখতে ফুলে ফোঁপে একাকার হয়ে যান। উত্তরায় দশ কাঠা প্লটে তিনি যে বাড়ি করেছেন তা দেখলে পুলিশের সব সাবইন্সপেক্টরই ভাববে–ঘুস খাবার অপরাধে কেন আমাদের চাকরি যাচ্ছে না।
টাকা-পয়সার সঙ্গে মানুষের রুচি এবং মানসিকতা বদলায়। সেকান্দর আলি সাহেবের পরিবারের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি ঘটেনি। তারা আগে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড বাড়ির সদস্যরা যদি নাভিতে সরিষার তেল দিয়ে রোদে শুয়ে থাকে তাহলে কেমন যেন মানায় না। সেকান্দর আলী সাহেবের পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকালে মনে হয় তারা সবাই যেন নীরবে বলছে-দূর ভালো লাগে না, আগে যখন গরিব ছিলাম। তখনই ভালো ছিলাম।
হাসান রহমানদের রাজপ্রাসাদে পৌঁছাে সকাল এগারটায়। পোজপাজ আগে যা ছিল তার চেয়েও বেড়েছে। পোশাক পরা দুই দারোয়ান— একজনের হাতে ব্যাটন।
রহমান বাসায় ছিল না। সেটা কোনো সমস্যা না। হাসানকে এ বাড়ির সবাই চেনে। সে যে আজ আসবে, এটাও সবাই জানে। সেকান্দর আলি সাহেব বিরক্ত মুখে বারান্দার সোফায় বসে আছেন। তাঁর খালি গা। বিশাল ভূঁড়ি ওঠানামা করছে। সকালবেলা দেখার মতো কোনো সুন্দর দৃশ্য না। সেকান্দর আলি সাহেব তাকে দেখে বললেন, যাও দেখা দিয়ে আসা। তোমার জন্যে দম আটকে আছে কি না কে জানে; পরশু থেকে তোমার কথা বলছে। আধাপাগল তো, একবার মাথায় কিছু ঢুকে গেলে আর বের হয় না।
এখন অবস্থা কী?
অবস্থা আর কী, অক্সিজেন চলছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। কাল রাত তিনটায় শ্বাস উঠল— আমি ভাবলাম ঘটনা বুঝি ঘটেই যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে আনালাম। ভোরবেলা আবার দেখি সামলে উঠেছেন। দুঃখ-কষ্টে মানুষ হয়েছেন তো, শক্ত শরীর।
হাসান কিছু বলল না। সেকান্দর আলি বিরক্ত গলায় বললেন, গত তিন দিন ধরে কাজকর্ম বাদ দিয়ে ঘরে বসে আছি। কোনো একটা কাজে যাব–মারি দম বের হয়ে যাবে। শেষ সময়ে দেখা হবে না। ঠিক বললাম না?
জ্বি ঠিক বলেছেন।
তুমি যাও দেখা করে আস।
উনার জ্ঞান আছে তো?
জ্ঞান আছে মানে? টনটনা জ্ঞান। এখনো তার সাথে তুমি কথায় পারবে না। তুমি একটা কথা বললে তোমাকে দশটা কথা শুনিয়ে দেবে।
আম্বিয়া খাতুন বোধহয় ঘুমোচ্ছিলেন। সাধারণত তাঁর ঘরে পা দেয়ামাত্র তিনি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কে? আজ একেবারে বিছানার পাশে এসে দাড়াবার পর বললেন, কে?
হাসান বলল, দাদিমা আমি হাসান।
তোকে খবর দিয়েছে কখন?
কাল সন্ধ্যায়।
এখন বাজে কয়টা?
এগারটা।
কতক্ষণ পর দেখা করতে এলি?
সতের ঘণ্টা পর।
এত দেরি হলো কেন?
দাদিমা আমি খবর পেয়েছি আজ সকালে।
তোর চাকরি বাকরি এখনো কিছু হয় নি?
না।
ব্যবসা পাতি করবি?
না।
না কেন? ব্যবসা কি খারাপ? আমাদের নবীজী কি ব্যবসা করেন নি?
আমি তো তাঁর মতো না দাদিমা। সাধারণ মানুষ।
সাধারণ মানুষ না। তুই গাধামানুষ।
হতে পারে।
তোর বন্ধুবান্ধব সব চাকরি বাকরি পেয়ে গেল তুই পেলি না। এটা কেমন কথা!
পেয়ে যাব।
কবে পাবি? খবরটা তো শুনেও যেতে পারব না যে তোর চাকরি হয়েছে। দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বিছানার পাশে বোস-নাকি রোগীর বিছানায় বসতে ঘেন্না লাগে!
হাসান বসল। বৃদ্ধ এক হাতে হাসানের হাত ধরলেন, ক্লান্ত গলায় বললেন, ব্যবসাপাতি যদি করতে চাস, বল, আমি সেকান্দরকে বলব। সেকান্দর আমার কথা ফেলবে না। পাপী ছেলে তো এই জন্যেই ফেলবে না। পাপী ছেলেপুলে বেশি মাতৃভক্ত হয়। তাদের মন থাকে দুর্বল। সব সময় মনে করে–মা মনে কষ্ট পেলে সর্বনাশ হবে। আসলে হয় না কিছুই। আল্লাহপাক কপালে যা লিখে রেখেছেন তাই হয়। মাকে ভক্তি করলেও হয়, মাকে ভক্তি না করলেও হয়। হাসান!
জ্বি।
দুপুরে খেয়ে যাবি। ওরা আজ আমার রোগমুক্তির জন্যে ফকির খাওয়াচ্ছে। খিচুড়ি রান্না হয়েছে। দুই পদের খিচুড়ি হয়েছে –ফকির মিসকিনদের জন্যে ইরি চালের খিচুড়ি, আর ঘরের মানুষের খাবারের জন্যে কালিজিরা চালের খিচুড়ি।
আমি কোন খিচুড়ি খাব?
তুই তো ফকির মিসকিনের মতোই। তুই খাবি ইরি চালের খিচুড়ি। রাগ করলি?
জ্বি না।
আমি সেকান্দরকে ডেকে বললাম, বাবা দুই পদের খিচুড়ি করলি কোন আন্দাজে? গরিব মানুষকে খাওয়াবি-ভালো কিছু খাওয়া। সে বলল, মা চিকন চালের খিচুড়িতে ওদের পেট ভরে না। এই জন্যেই মোটা চাল। আমি তখন বললাম, খুব ভালো বুদ্ধি করেছিস। শোন বাবা, তুই আজ মোটা চালের খিচুড়ি খাবি। এটা আমার আদেশ। এই শোনার পর থেকে সেকান্দর আলি মুখ শুকনা করে বসে আছে। তার কত বড় ভূঁড়ি হয়েছে দেখেছিস। চার-পাঁচ বালতি চর্বি আছে ওই ভুঁড়ির ভেতর। হিহিহি।
আম্বিয়া খাতুন শব্দ করে হাসতে লাগলেন। হাসির দমকে নাক থেকে অক্সিজেনের নলটা ছুটে গেল। নার্স এসে নল লাগিয়ে হাসানকে কঠিন গলায় বলল–রোগীকে শুধু শুধু হাসাবেন না। ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনের রোগী। আপনি এখন যান।
হাসান বের হয়ে এল। আম্বিয়া খাতুন তখনো হাসছেন। মহিলার কি মাথা আউলা হয়ে গেছে? দাঁত নেই মানুষের হাসিতে অশরীরী ভাব থাকে। গা ছমছম করে। হাসানের গা ছমছম করছে।
সেকান্দর আলি বললেন, চলে যাচ্ছে নাকি?
হাসান বলল, জ্বি না।
মা’র সঙ্গে দেখা তো হয়েছে। শুধু শুধু বসে থেকে কী করবে, চলে যাও।
দাদিমা খেয়ে যেতে বললেন। মোটা চালের খিচুড়ি খেতে বললেন।
ও আচ্ছা, তাহলে খেয়ে যাও। দেরি হবে কিন্তু। এখন ফকির মিসকিনদের খাওয়াবে। রান্না হয় নি। এখানো। রান্না হবে তার পর। ফকির ব্যাচ শেষ হলে আমাদের খাওয়া। তিনটা বেজে যাবে। থাকবে এতক্ষণ?
জ্বি।
বেশ থাক। এখন করছ কী?
কিছু করছি না।
রহমান যে বলল হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে কী কাজ করছি।
তেমন কিছু না। যা করছি তাকে চাকরি বলা যায় না।
কোনো কাজকেই ছোট করে দেখবে না হাসান। কোনো কাজই ছোট না। শিক্ষিত ছেলেপুলেদের এই এক সমস্যা হয়েছে। চাকরির জাতিভেদ করে ফেলেছে। কাজ হচ্ছে কাজ।
জ্বি।
তিনটা পৰ্যন্ত চুপচাপ বসে না থেকে তুমি বরং ঘুরে টুরে এসো। দুটা-আড়াইটা নাগাদ চলে এসো। অসুস্থ মানুষের বাড়িতে বসে থাকাও তো যন্ত্রণা।
আমার কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না।
সেকান্দর সাহেব বললেন, তাহলে থাক। লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে বোস। বইটিই পড়। লাইব্রেরি ঘরটা নতুন করেছি। কনকর্ডকে দিয়ে ডিজাইন করানো। চার লাখ টাকা নিয়েছে লাইব্রেরি করতে। অল বার্মাটিক। ‘এখন তো আর বই পড়া হয় না। শেষ বয়সে পড়ব এই জন্যে লাইব্রেরি বানানো। যাও দেখা গিয়ে–শেলফ থেকে বই যদি নামাও তাহলে যেখানকার বই সেখানে তুলে রাখবে।
জ্বি আচ্ছা।
চার লাখ টাকা দামের বামটিকের লাইব্রেরি দেখার ব্যাপারে হাসানের উৎসাহ দেখা গেল না। সে লাইব্রেরি ঘরের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইল। সামনে খবরের কাগজ আছে কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করছে না। বেকার মানুষ খবরের কাগজ পড়তে পারে না–এই তথ্যটা কি কেউ জানে? মনে হয় জানে না। নতুন বেকাররা অবশ্যি পত্রিকা হাতে নেয়, আগ্ৰহ নিয়ে কর্মখালি বিজ্ঞাপন পড়ে। পুরনো বেকাররা তাও করে না! সে পুরনো বেকার।
খবরের কাগজে মজা কিছু কি আছে? বাণী চিরন্তনী, কিংবা শব্দ জট, এস ওয়ার্ড পাজল?
চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে এই সবের ওপর চোখ বোলানো যায়। শব্দজট পাওয়া গেল। শব্দগুলো উলটাপালট করে লেখা–মূল শব্দ খুঁজে বের করতে হবে। হাসান অনাগ্ৰহ নিয়ে শব্দগুলো দেখছে–
কুলাশান্ত
ণত্রারিপ
জ্ঞভিতাঅ
শেষের দুটা পারা গেলা–পরিত্রাণ এবং অভিজ্ঞতা। প্রথমটা কী? ধাঁধা-শব্দজট এই ব্যাপারগুলো ভয়াবহ, একবার মাথায় ঢুকে গেলে আর বেরোতে চায় না। মাথায় ঘুরতে থাকে। খুবই অস্বস্তি লাগে। হাসানের মাথায় ঘুরছে কুলাশান্ত কুলাশান্ত, কুলাশান্ত, কুলাশন্ত। আসল শব্দটা কী? পারমুটেশন কম্বিনেশনে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না–
লাশন্তকু
কুশলান্ত
স্তশলাকু
কিছুই তো হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে হাসানের মাথা ধরে গেল। সে মাথা ধরা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আশ্চর্য কাণ্ড ঘুমের মধ্যে আবারো সেই উদ্ভট স্বপ্ন!! সেই হাঁসের দলের সঙ্গে সে। এবারের হাঁসগুলো মানুষের মতো কথা বলছে। সদিবসা গলায় খ্যাস খ্যাস করে কথা। হাসান তার পাশের হাঁসটিকেজিজ্ঞেস করল-তুমি শব্দজট ছাড়াতে পার?
হাঁসটা বলল, জ্বি স্যার পারি।
‘কুলাশান্ত জট ছাড়ালে কী হবে?
এটা পারব না। এটা পারব না।
তোমাদের মধ্যে কেউ পারবে না?
জ্বি না। তবে একজন পারতে পারে–তার খুব বুদ্ধি।
সে কে? তার নাম শকুন্তলা।
হাঁসের নাম শকুন্তলা।
জ্বি। আপনাদের যেমন নাম আছে–আমাদেরও আছে। ওই যে শকুন্তলা, ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন।
জিজ্ঞেস করতে হবে না। শব্দ জট দূর হয়েছে। কুশলান্ত হলো শকুন্তলা।
হাসানের ঘুম ভাঙল। আশ্চর্য! বেলা পড়ে এসেছে। ঘড়িতে বাজছে চারটা দশ। এত লম্বা ঘুম সে দিল কীভাবে? সে কি অসুস্থ? অসুস্থ মানুষরাই সময়ে-অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে উদ্ভট এবং জটিল স্বপ্ন দেখে।
বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ফকির মিসকিনরা কি খিচুড়ি খেয়ে চলে গেছে? তাকে কেউ ডাকে নি। রেডক্রস আঁকা একটা গাড়ি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আম্বিয়া খাতুনকে দেখতে কোনো ডাক্তার বোধহয় এসেছেন। হাসানের পেট চক্কর দিয়ে উঠছে। সে রাস্তার পাশে বসে হাড় হড়া করে বমি করল।
শরীরটা আসলেই খারাপ করেছে। মাথা টলমল করছে। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। কী হবে বাসায় ফিরে?
স্যার আপনের কী হইছে?
খালি একটা রিকশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। প্রশ্নটা করছে রিকশাওয়ালা। তার গলায় কৌতুহলের চেয়েও মমতা বেশি। একজন মানুষ তার সমগ্র জীবনে একশ’ বার সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে মমতা ও করুণায় আৰ্দ্ধ কথা শুনবে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত। এই রিকশাওয়ালা কি সেই একশ’ জনের এক জন?
স্যার আপনার কী হইছে?
কিছু না। হঠাৎ শরীরটা খারাপ করেছে।
বাড়িত যান। বাড়িত গিয়া ঘুমান। আহেন রিকশাত উঠেন, লইয়া যাই।
রিকশা করে যাবার ভাড়া নেই রে ভাই।
ভাড়া লাগব না, আহেন।
হাসানের কাছে রিকশা ভাড়া আছে। রিকশাওয়ালা সেই একশ জনের এক জন কি না তা পরীক্ষা করার জন্যেই কথাগুলো বলা। মনে হচ্ছে এই রিকশাওয়ালা সেই এক শ জনের এক জন।
স্যার যাইবেন কই?
হাসান কিছু বলল না। রিকশায় উঠলেই তার মানসিকতা একটু যেন বদলে যায়। নির্দিষ্ট কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। রিকশাওয়ালা তার ইচ্ছেমতো নানা জায়গায় নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে রিকশা থামিয়ে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে চা খাবে। আনন্দময় মন্থর ভ্ৰমণ। স্কুলে রচনা আসে–এ জানি বাই ট্রেন, এ জানি বাই বোট। জানি বাই রিকশা রচনাটা আসে না কেন?
স্যার যাইবেন কই?
হাসান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল–চলতে থাক। রিকশাওয়ালা হাসল। তবে কথা বাড়াল না। সে ধীরে সুস্থে প্যাডেল চাপছে। হাসান হুড ধরে চুপচাপ বসে আছে। তার মাথা খানিকটা টালমাটাল করছে। বমি করার পর মুখ ধোয়া হয় নি। সমস্ত শরীরই কেমন অশুচি অশুচি লাগছে। কোনো একটা ফোয়ারার পাশে রিকশা থামিয়ে ফোয়ারার পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। ফোয়ারাগুলো নাকি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বানানো হয়েছে। শহরের সৌন্দর্যবর্ধন করা হচ্ছে। হাসান আকাশের দিকে তাকাল। মেঘে মেঘে আকাশ কালো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন মনে আসছে–মেঘের পরে মেঘ জিমেছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কখনো রিকশায় চড়েছেন? মনে হয় চড়েন নি। রিকশায় চড়লে সুন্দর একটা বৰ্ণনা পাওয়া যেত। হাসানের পেট আবার পাক দিচ্ছে। আবারো কি বমি হবে? ঝুম বৃষ্টি নামলে খুব ভালো হতো। বৃষ্টিতে নেয়ে ফেলা যেত। কদিন ধরেই রোজ বিকেলে মেঘ করছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না।
রীনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সকালবেলার নতুন শাড়িটা তার গায়ে নেই। সে পুরনো একটা শাড়ি পরেছে। বেগুনি এবং গোলাপির মাঝামাঝি রং।। নতুন অবস্থায় শাড়িটা পরলে নিজেকে খুব চকচকে লাগত। পুরনো হয়ে শাড়িটা সুন্দর হয়েছে। এই শাড়ি পরে রীনা দাঁড়িয়ে আছে, কারণ একদিন তারেক বলেছিল–বাহ্! শাড়িটায় তো তোমাকে খুব মানিয়েছে। রানার ধারণা তারেকের এটা কথার কথা। হঠাৎ কী মনে হয়েছে—বলেছে। শাড়ির দিকে ভালোমতো না তাকিয়েই বলেছে। স্বামীরা স্ত্রীদের খুশি করার জন্যে মাঝে মাঝে এ ধরনের কথা বলে। যে শাড়িটা পরার জন্যে স্বামী খুব সুন্দর বলে সেই শাড়ি পরে ঘুরলে স্বামী ফিরেও তাকায় না।
রাত দশটার মতো বাজে। তারেকের জন্যে অপেক্ষা। অফিস থেকে বিকেলে বাসায় ফিরেছে। এক কাপ চা খেয়ে হাসিমুখে বলেছে–রীনা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, আধঘণ্টার মধ্যে ফিরব। রীনা বলেছে, যাচ্ছে কোথায়? তারেক জবাব দেয় নি। মুখ টিপে হোসেছে। রীনা ধরেই নিয়েছে–তারেকের শেষ মুহুর্তে বিয়ের দিনের কথাটা মনে পড়েছে। সে যাচ্ছে কিছু একটা কিনতে। পাঁচ-ছটা সস্তার মরা মরা গোলাপ কিনবে। বেলিফুলের মালা ভেবে যে মালাটা কিনবে সেটা আসলে রজনীগন্ধা ফুলের মালা। যা ইচ্ছা কিনুক–বিয়ের দিনের কথাটা মনে পড়েছে এই যথেষ্ট।
এখন মনে হচ্ছে তারেক উপহার। কিনতে যায় নি। কোনো কলিগের বাসায় গিয়েছে। বিয়ের দিনের কথাটা তার মনেও নেই। আসলে বিয়ের দিনটাকে মেয়েরা যত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ছেলেরা হয়তো ততটা করে না। ঘরে সে আজ পোলাও রান্না করেছে। বাচ্চা দুটার এত শখের পোলাও! ওরা না খেয়েই ঘুমিয়েছে। ব্যাপারটা ঘটেছে রীনার জন্যে। ওরা খেতে চেয়েছে–রীনা বলেছে, বাবা আসুক তারপর খাবে। বাবার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বেচারারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এদের ঘুম অসম্ভব গাঢ়। একবার ঘুমেলে। আর জাগবে না। তারেকও নিশ্চয়ই খেয়ে আসবে। বিয়ের দিনে যে পোলাও রান্না হয়েছে সেটা কেউ খাবে না।
ভাবি, অন্ধকারে দাড়িয়ে আছ কেন?
রীনা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। লায়লা চুপিচুপি কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই মেয়ে কোনো রকম শব্দ না করে হাঁটতে পারে।
লায়লা বলল, ভাইয়ার জন্যে অপেক্ষা করছ?
না। গরম লাগছিল, তাই বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। কী অসহ্য গরম পড়েছে দেখেছ?
আজ এত মেঘ করেছিল! ভাবলাম— বৃষ্টি হবে, বৃষ্টিতে ভিজব।
খবরদার ভাবি বৃষ্টিতে ভিজবে না, চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে।
চামড়া নষ্ট হবে কেন?
শহরের বৃষ্টি মানেই হলো এসিড রেইন। গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া বৃষ্টির সঙ্গে গায়ে এসে পড়ে চামড়ার বারোটা বাজিয়ে দেবে।
রীনা হাসল। তার এই ননদ শরীরের চামড়া, মাথার চুল, চোখ এইসব ব্যাপারে খুব সাবধান। শরীর ঠিক রাখার নানা কায়দা-কানুন সে করে।
ভাবি, চামড়ার সবচে’ ক্ষতি কীসে হয় তুমি জান?
না।
সবচে’ ক্ষতি করে আলট্রা ভায়োলেট রে। সূর্যের আলোয় যে মেয়ে সবচে’ কম আসবে তার চামড়া থাকবে সবচে’ সুন্দর।
তারেক আসছে। হেঁটে হেঁটে আসছে। মুখে পান। পানের পিক ফেলল-তার মানে খেয়ে এসেছে। লায়লা বলল, ভাবি ভাইয়া চলে এসছে।
তাই তো দেখছি।
তুমি ভাইয়াকে বলে আমার জন্যে দুশ টাকা নিয়ে রেখো তো ভাবি। আমাদের ক্লাসে পিকনিক হচ্ছে–দুশ টাকা করে চাদা। ছেলেরা এক শ আর মেয়েরা দু শি। মেয়েদের হাতে নাকি টাকা বেশি থাকে এই জন্যে চাঁদা বেশি। টাকাটা কাল সকালেই দিতে হবে ভাবি।
আচ্ছা আমি টাকা নিয়ে রাখব।
তারেক হাতমুখ ধুয়ে সরাসরি শোয়ার ঘরে চলে এল। রীনা বলল, ভাত খাবে না?
তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, না।
খেয়ে এসেছ?
হুঁ। আমাদের এক কলিগের মেয়ের আকিকা ছিল। খাসির রেজালা ফেজালা করে হুলস্থূল করেছে।
ও আচ্ছা।
রান্নাও হয়েছে ভালো। এমন খাওয়া খেয়েছি যে হাঁসফাস লাগছে। লবণ দিয়ে লেবুর শরবত করে দাও তো। পানিটা কুসুম কুসুম গরম করে নিও।
রীনা রাতে কিছু খেল না। একা একা খেতে ইচ্ছা করে না। বিয়ের দিন উপলক্ষে সে খুব আগ্রহ করে পোলাও রান্না করেছিল। আশ্চৰ্য, সেই পোলাও কেউ খেল না। লায়লা পোলাও খায় না। হাসানের শরীর খারাপ, সে না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। রীনার শ্বশুর। গিয়েছেন কল্যাণপুর তাঁর মেয়ের বাসায়। রীনার কান্না পাচ্ছে। এত তুচ্ছ ব্যাপারে কাদা ঠিক না। রীনার সমস্যা হচ্ছে বড় বড় দুঃখের ব্যাপারে তার কান্না পায় না। ছোট ছোট ব্যাপারে চোখে পানি চলে আসে।
রীনা ঘুমোতে যাবার আগে হাসানের ঘরে উঁকি দিল। হাসানের ঘরের দরজা খোলা-ঘর অন্ধকার। হাসানের এই অভ্যাস–মাঝে মাঝে দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
হাসান।
জ্বি ভাবি।
দরজা খোলা রেখে ঘুমোচ্ছ। দরজা লাগাও।
ঘুমোচ্ছি না ভাবি। জেগে আছি।
শরীরের অবস্থা কী?
অবস্থা ভালো। এখন একটু যেন ক্ষিধে ক্ষিধে লাগছে।
কিছু খাবে? পোলাও আছে, গরম করে দেব?
পাগল হয়েছ! দরজার বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছি কেন ভাবি, ভেতরে এস।
রীনা ঘরে ঢুকল। হাসান টেবিল ল্যাম্প জ্বালাল। রীনা খাটের পাশে বসতে বসতে বলল, তুমি ভালো একজন ডাক্তার দেখাও হাসান। দুদিন পরপর তুমি অসুখ বাঁধাচ্ছ।
হাসান দেয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসেছে। অন্ধকারে খালি গায়ে শুয়েছিলভাবিকে দেখে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে, সেই পাঞ্জাবি উল্টো হয়েছে। বুক চলে গেছে পেছনে। হাসান বিব্রত ভঙ্গিতে পাঞ্জাবি দেখতে দেখতে বলল, ভাবি আমার অসুখটা হলো মনে। মনটা ঠিক নেই, এই জন্যেই শরীর ঠিক থাকছে না।
মন ঠিক নেই কেন?
চাকরি টাকরি পাচ্ছি না–এই জন্যেই মন ঠিক নেই।
তুমি না বললে হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে একটা কাজ করছি।
ওইটা কোনো কাজ না ভাবি। সপ্তাহে একদিন যাই, ভদ্রলোকের কথা শুনি। খাতায় নোট করি। ওই প্রসঙ্গ থাক। আচ্ছা ভাবি হাঁস স্বপ্নে দেখলে কী হয়? ইদানীং খুব হাঁস স্বপ্নে দেখছি। ঘুমোলেই দেখি এক ঝাক হাঁসের সঙ্গে হাঁটছি, সাঁতার কাটছি।
রীনা তাকিয়ে আছে। তার খুব মায়া লাগছে। হাসানকে অসহায় দেখাচ্ছে। রীনার যদি চেনাজানা কোনো মন্ত্রী থাকত। তাহলে সে হাসানের চাকরির জন্যে মন্ত্রী সাহেবের পা ধরে বসে থাকত।
ভাবি যাও ঘুমোতে যাও।
রীনা উঠে দাঁড়াল। হাসান বলল, ভাবি এক সেকেন্ড। তোমার জন্যে সামান্য কিছু উপহার এনেছিলাম। টেবিলের ওপর রেখেছি, নিয়ে যাও। আমি গরিব মানুষ–এরচে’ বেশি কিছু দেবার আমার ক্ষমতা নেই।
রীনা বিস্মিত হয়ে দেখল টেবিলে গোলাপ ফুলের সুন্দর একটা তোড়া। তোড়ায় নাটা গোলাপ। তাদের বিয়ের ন’ বছর আজ পূর্ণ হয়েছে। হাসান বলল, হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভারসারি ভাবি।
রীনা বলল, থ্যাংক য়ু।
তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। গোলাপগুলো এত সুন্দরা মনে হচ্ছে, এইমাত্র বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা হয়েছে।
হাসানের ঘুম আসছে না। সে এপাশ ওপাশ করছে। কাল বুধবার। হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে কাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনাকে কি মুখ ফুটে সে বলে ফেলবে–স্যার, আমি খুব কষ্টে আছি। আমাকে পার্মানেন্ট একটা চাকরি দিন। আপনার কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না।
হিশামুদিন সাহেবের কথা ভাবতে ভালো লাগছে না। ঘুমোবার আগে সুন্দর কিছু ভাবা দরকার। তিতলীর কথা ভাবা যায়। তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কাল্পনিক কথাবার্তাও বলা যায়।
তিতলী কেমন আছ?
ভালো আছি।
আজ কী গরম পড়েছে দেখেছি?
হুঁ।
তুমি কি জান আমি যে ঘরে ঘুমোই সে ঘরে কোনো ফ্যান নেই।
জানি না, আমি তো তোমার ঘরে কখনো ঢুকি নি।
আমি করি কী জান? ঘরের দরজা-জানালা সব খুলে ঘুমোই। রীনা ভাবি খুব রাগ করে। রীনা ভাবির ধারণা, দরজা খোলা থাকলেই চোর ঢোকে। চোর ঢুকলেও কোনো অসুবিধা নেই। আমার ঘরে এমন কিছু নেই যে চোর এসে নিয়ে যাবে।
অন্য কিছু নিয়ে কথা বল তো। চোর নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
হাঁস নিয়ে কথা বলি? শোন তিতলী, হাঁস স্বপ্নে দেখলে কী হয় তুমি জান? ইদানীং আমি ঘুমোলেই শুধু হাঁস স্বপ্নে দেখছি
কী হাঁস—রাজহাঁস?
আরে না। আমি ছোট মানুষ, আমার স্বপ্নগুলোও ছোট ছোট–আমি স্বপ্নে দেখি পুড়ি একটা দুটা না-হাজার হাজার পাতিহাঁস। আমার ধারণা, আমি পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছি।
তিতলী হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। হাসান কল্পনায় একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু তার হাসি এত জীবন্ত! হাসান তিতলীর হাসি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। আশ্চর্য তো!
গরম লাগছে
গরম লাগছে?
হাসান বলতে যাচ্ছিল, জ্বি না। স্যার। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলাল। গরম লাগছে। না বললে বোকার মতো কথা বলা হবে। বোকার মতো কথা সে প্রায়ই বলে কিন্তু এই লোকের সঙ্গে বোকার মতো কথা বলা যাবে না। যা বলার ভেবেচিন্তে বলতে হবে। গরমে সে অস্থির বোধ করছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঁঠালপাকা গরম। হাসান যদি কাঁঠাল হতো এর অর্ধেক গরমে পেকে যেত। এখন ভরদুপুর। জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে মাটির তল থেকে গরম ভাপ বের হয়। সেই ভাপে পচা ঘাসের গন্ধ থাকে। হাসান গন্ধ পাচ্ছে।
সে বসেছে মাঝারি সাইজের একটা ঘরে। ঘরের প্রধান বৈশিষ্ট্য বিরাট জানালা। জানালায় ভারি পর্যাদা টানা বলে ঘর আবছা অন্ধকার। মেঝেতে কাপেট বিছানো। কার্পেটের ওপর শীতল পাটি। হাসানের ঠিক সামনেই বসেছেন হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের হিশামুদিন সাহেব। গরম তাঁকে মনে হয় তেমন কাবু করতে পারছে না। তিনি বেশ আয়েশ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছেন। খালি গা। পরনে লুঙ্গি। হাসান লক্ষ করছে লুঙ্গির গিট খুলে গেছে। হিশামুদ্দিন সাহেব ব্যাপারটা জানেন কিনা কে জানে! হয়তো জানেন না। যদি না জানেন তাহলে যে-কোনো সময় একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। কথাবার্তা শেষ করে হিশামুদিন সাহেব দাঁড়ালেন এবং লুঙ্গি পা বেয়ে নেমে এল। সর্বনাশ!
হিশামুদ্দিন সাহেব পান চিবোচ্ছেন। তার হাতের কাছে ধবধবে সাদা রুমাল। তিনি মাঝে মাঝে রুমালে ঠোঁট মুছছেন। সাদা রুমালে পানের রসের লাল দাগ ভরে যাচ্ছে। হিশামুদিন সাহেবের বয়স কত? হাসান জানে না। ঠিক অনুমানও করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু মানুষের বয়স ধরা যায় না। হাসানের ধারণা হিশামুদ্দিন সাহেবের বয়স চল্লিশও হতে পারে। আবার ষাটের কাছাকাছিও হতে পারে। তবে চল্লিশ হবার সম্ভাবনা কম। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কেউ কোটি কোটি টাকা রোজগার করতে পারে না।
হিশামুদিন ঘরের সিলিঙের দিকে তাকালেন। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। ফুল স্পিড়ে ঘুরছে না, ধীরে সুস্থে ঘুরছে। গরম বাতাস গায়ে এসে লাগছে। হিশামুদ্দিন সাহেব প্রথম প্রশ্নটি আবারো করলেন–নিচু গলায় বললেন, হাসান তোমার গরম লাগছে?
হাসান লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি স্যার।
বলতে গিয়ে কথা খানিকটা আটকেও গেল। যেন গরম লাগাটা ঠিক না। যেন সে একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
হিশামুদ্দিন বললেন, আজকের টেম্পারেচার কিন্তু গতকালের চেয়ে কম। গতকাল ছিল থাটি ফাইভ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আজ থাটি ফোর। এক ডিগ্রি কম। তারপরেও গরম বেশি লাগছে। কারণটা হিউমিডিটি। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকলে গরম বেশি। লাগে। আজ বাতাসে জলীয় বাম্পের পরিমাণ বেশি। এর মানে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। আমার ধারণা রাত নটা-দশটার দিকে বৃষ্টি শুরু হবে।
হাসান চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। তার কাজই হচ্ছে কথা শুনে যাওয়া। আলোচনায় অংশগ্ৰহণ না করা। কথা শোনার জন্যে সে টাকা পায়। ঘণ্টা হিসেবে রেট। প্রতি ঘণ্টায় ছয় শ’ টাকা। শুরুতে হাসানের মনে হয়েছিল অনেক টাকা। এখন সে জানে টাকাটা আসলে খুবই কম। হিশামুদ্দিন সাহেব কখনোই তাকে বিশ-পঁচিশ মিনিটের বেশি সময় দেন না। এত সময় তার কোথায়? বিশ-পাঁচিশ মিনিটে যা বলেন হাসানকে তা মন দিয়ে শুনতে হয়। তার দায়িত্ব শোনা কথাগুলো গুছিয়ে লেখা। যেন কোনো ভুলভ্রান্তি না হয়। হাসানের ধারণা এই কাজটা একটা টেপরেকর্ডারে খুব ভালো করা যায়। হিশামুদ্দিন সাহেব যা বলার বলবেন। টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করা থাকবে। কথাবার্তা শেষ হবার পর সে ক্যাসেট বাসায় নিয়ে যাবে। ক্যাসেট শুনে শুনে লিখে ফেলবে। কোনোরকম ভুলভ্রান্তি হবে না। হাসান ভয়ে ভয়ে হিশামুদ্দিন সাহেবকে টেপরেকর্ডারে কথাটা বলেছিল। তিনি মন দিয়ে তার কথা শুনেছেন। ভদ্রলোকের এই ব্যাপারটা আছে। কেউ যখন কথা বলে তিনি খুব মন দিয়ে শোনেন। এমনও হয় যে চোখের পলক ফেলেন না। যে কথা বলে সে পলকহীন চোখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভড়কে যায়।
হাসানের কথা শেষ হওয়ার মাত্র হিশামুদ্দিন সাহেব বললেন, যন্ত্রের সঙ্গে কি কথা বলা যায় হাসান? আমি যখন কথা বলি তোমার সঙ্গে কথা বলি, একটা মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তাই না?
জ্বি স্যার।
শোনা কথা লিখতে তোমার ভুলভ্রান্তি হচ্ছে হোক না, পরে ঠিক করা যাবে। ঠিক না করলেও অসুবিধা নেই। আমি তো আমার জীবনী লিখে বই করে ছাপাচ্ছি না। আমি আমার ইন্টারেষ্টিং জীবনীটা লিখতে চাচ্ছি। আমার নিজের জন্যে। যখন কাজকর্ম করার ক্ষমতা থাকবে না-বিছানায় শুয়ে শুয়ে, কিংবা হুইল চেয়ারে বসে বসে পড়ব।
জ্বি স্যার।
তুমি যাতে তালগোল পাকিয়ে না ফেল এই জন্যেই আমি অল্প অল্প করে বলি।
হাসান মনে মনে বলছে-স্যার, আপনি যদি একসঙ্গে অনেকখানি করে বলতেন তাহলে আমার কিছু লাভ হতো। দুটা টাকা বেশি পেতাম।
হিশামুদ্দিন সপ্তাহে একদিন হাসানের সঙ্গে বসেন। বুধবার দুপুর দুটা থেকে তিনটা। এক ঘণ্টা কখনো কথা বলেন না। পনের-বিশ মিনিট পার হবার পরই বলেন–‘আজ এই পর্যন্তই।’ হাসান ঘর থেকে বের হয়ে নিচে আসে। হিশামুদিন সাহেবের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রহমতউল্লাহ দাঁত বের করে বলে, কী, কাজ শেষ?
জ্বি।
পাঁচিশ মিনিট পার হয়েছে। যাই হোক তিরিশ করে দিচ্ছি। রাউন্ড ফিগার। পেমেন্ট নিয়ে যান।
থাক জমুক। পরে একসঙ্গে নেব।
ওরে সর্বনাশ, তা হবে না। স্যারের নির্দেশ আছে সব পেমেন্ট আপটুডেট থাকবে। আসুন ভাই খাতায় সই করে টাকা নিন।
হাসানকে শুকনো মুখে খাতায় সই করে টাকা নিতে হয়। মাঝে মাঝে ভাবে বলবেআমাকে চাকরি দেবার সময় বলা হয়েছিল বুধবারে এক ঘণ্টা করে সিটিং হবে। এক ঘণ্টা হিসেবে আমাকে টাকা দিতে হবে। পাঁচ মিনিট কথা বললেও এক ঘণ্টার পেমেন্ট বলা হয় নি। হাসানের ধারণা কথাটা বলামাত্রই তা বড় সাহেবের কানে চলে যাবে। তিনি বিরক্ত হয়ে ভাববেন–ছেলেটা তো লোভী! হাসান চাচ্ছে না হিশামুদিন সাহেব তাকে লোভী ভাবুন। কারণ প্রথমত সে লোভী না, দ্বিতীয়ত এই মানুষটাকে সে পছন্দ করে।
হাসান।
জ্বি স্যার।
আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। আজ থাক।
জ্বি আচ্ছা! হাসান মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আজ কোনো কথাই হয় নি। তার হাতে ঘড়ি নেই। ঘড়ি থাকলে বলে দিতে পারত দশ মিনিটের বেশি সময় পার হয় নি। মাত্র এক শ টাকা। হাসান উঠে দাঁড়াতে গোল-হিশামুদিন বললেন, বোস একটু। হাসান বসল। হিশামুদ্দিন রুমাল দিয়ে আবার ঠোঁট মুছলেন। মাথার ওপরের ফ্যানটার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের তাকানোর ভঙ্গি এমন যেন তিনি ফ্যানের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। তার চোখে পলক পড়ছে না।
হাসান। জ্বি স্যার। আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন দেখেছি প্ৰচণ্ড গরমের সময় বুড়ো ধরনের মানুষরা গামছা ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে বসে থাকত। তুমি কি এ রকম দৃশ্য দেখেছ?
জ্বি না স্যার।
গরমের সময় ভিজিয়ে, গায়ে রাখার জন্যে আলাদা গামছাই পাওয়া যেত। মোটা মোটা সুতা–গামছাগুলোকে বলত জলগামছা।
হাসান মনে মনে কয়েকবার বলল, জলগামছা। জলগামছা। জলগামছার ব্যাপারটা লিখে ফেলতে হবে। কোনো এক ফাঁকে এই তথ্য ঢুকিয়ে দিতে হবে। শুধু জলগামছা আওড়ালে মনে নাও থাকতে পারে। কাছাকাছি আরো কয়েকটা শব্দ বলা দরকার–
জলগামছা
পানিগামছা
ওয়াটারগামছা
হাসান।
জ্বি স্যার। সবচে’ কষ্টের গরম কোন মাসে পড়ে জান?
জ্বি না স্যার।
ভাদ্র মাসে। ভাদ্র মাসের গরমকে বলে তালপাকা গরম। তখন বাতাসে জলীয় বাষ্প খুব বেশি থাকে। গরমটা বেশি লাগে এই কারণে। একবার ভাদ্রমাসে কী হয়েছে শোন–আমি তখন ক্লাস খ্রিতে পড়ি। আমাদের বাসা নেত্রকোনার উঁকিলপাড়ায়। দু কামরার ঘর। সাধারণ নাম হলো হাফ বিল্ডিং। করোগেটেড টিনের ছাদ। টিনের ছাদের বাড়ি রাতে ঠাণ্ডা হবার কথা। আমাদের বাসা কখনোই ঠাণ্ডা হতো না। আমরা সাত ভাইবোন গরমে ছটফট করতাম।
স্যার আপনি একবার বলেছিলেন। আপনারা আট ভাইবোন।
যখনকার কথা বলছি তখন আমরা সাত জন। আমার মেজো ভাই রাগ করে বাসা থেকে চলে গিয়েছিল। অত্যন্ত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে রাগ করেছিল। তার কেডসের জুতার ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। সেই ফিতা কিনে দেয়া হচ্ছিল না। একটা জুতায় ফিতা ছিল, আরেকটায় ছিল না। সেই জুতাটা খুলে খুলে আসত। ক্লাসের বন্ধুরা তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করত। বাবা প্রতিদিন বলতেন, আজ ঠিক নিয়ে আসব। আসতেন না। একদিন স্কুল থেকে বাসায় না ফিরে সে বাড়ি চলে গেল, সেদিন বিকেলে বাবা ফিতা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ নেই।
স্যার আপনার ভাইটার নাম কী?
ভাইয়ের গল্প তো এখন করছি না। এখন তোমাকে বলছি অন্য গল্প। মেজো ভাইয়ের গল্প যখন বলব। তখন নাম বলব।
জ্বি আচ্ছা।
আমি কী বলছিলাম যেন?
আপনার সাত ভাইবোন গরমে ছটফট করতেন।
ও হ্যাঁ, আমরা গরমে ছটফট করতাম। বাবা অনেক রাত পর্যন্ত তালপাখা দিয়ে আমাদের হাওয়া করতেন। সেই পাখা পানিতে ভিজিয়ে নেয়া হতো। ভেজা পাখার হাওয়া নাকি ঠাণ্ডা।
একদিনের কথা–বাবা বাসায় ফিরলেন অনেক দেরিতে। তার হাতে বাজার করার চটের একটা ব্যাগ, মুখ হাসি হাসি। তিনি রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন–কোথায় আমার সৈন্যসামন্ত। আমরা ছুটে এলাম। বাবা চটের ব্যাগ খুললেন। ব্যাগের ভেতর খবরের কাগজে মোড়া চকচকে নতুন সিলিং ফ্যান। আমরা হতভম্ব! সেই রাতেই ফ্যান লাগানো হলো। বাবা নিজেই মিস্ত্রি। রাবারের জুতা পরে তিনি ইলেকট্রিসিটির কানেকশন দিলেন। ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। কী বাতাস, মনে হচ্ছে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তিনি গভীর গলায় বললেন, এখন থেকে এক ঘুমে রাত কাবার করে দিবি। হা করে ঘুমোবি যাতে পেটের ভেতরেও ফ্যানের হাওয়া চলে যায়।
সেই ফ্যান সর্বমোট আমরা তিনদিন ব্যবহার করি। চতুর্থ দিনে বাড়িতে পুলিশ এসে উপস্থিত। আমরা বিস্মিত হয়ে জানলাম বাবা যে দোকোনে কাজ করতেন সেই দোকানের একটা ফ্যান তিনি খুলে নিয়ে চলে এসেছেন।
আমাদের চোখের সামনেই সিলিং থেকে ফ্যান খোলা হলো। বাবা সবার দিকে তাকিয়ে সারাক্ষণই অমায়িক ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। যেন বেশ মজাদার একটা ঘটনা ঘটেছে। তিনি এই ঘটনা প্ৰত্যক্ষ করতে পেরে আনন্দিত।
দোকানের মালমাল চুরির অভিযোগে বাবার বিরুদ্ধে মামলা হয়। বাবার দু মাসের জেল হয়ে যায়। কোর্টে আমরা কেউ ছিলাম না। শুধু আমার বড় বোন ছিলেন। মামলার রায় হবার পরে বাবা তাকে বলেন, পুষ্প কোনো রকম চিন্তা করিস না। জেলখানায় বিশ দিনে মাস হয়। দুই মাস আসলে চল্লিশ দিন। চল্লিশটা দিন তুই কোনো রকমে পার করে দে। পারবি না মা?
আমার বড় বোন পুষ্পের কথা কি এর আগে তোমাকে বলেছি?
জ্বি না।
ডাকমান পুষ্প, ভালো নাম লতিফা বানু।
হিশামুদ্দিন সাহেব চুপ করলেন। সামনে রাখা পানের বাটা থেকে পান নিলেন। রুমালে ঠোঁট মুছলেন। আবার মাথা উঁচু করে ফ্যানের দিকে তাকালেন।
হাসান।
জ্বি স্যার।
মানুষের প্রধান সমস্যা হলো সে কোনো কিছুই খুঁটিয়ে দেখে না। তার সব দেখা, সব observation ভাসা ভাসা। ঠিক না?
হাসান চুপ করে রইল। মানুষের প্রধান সমস্যা কী তা নিয়ে সে কখনো ভাবে নি। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ মানুষের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন কেন তাও তার কাছে পরিষ্কার না। তবে হিশামুদ্দিন সাহেবের এই স্বভাব আছে। কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। তারপর আবার মূল বক্তব্যে ফিরে আসেন।
হিশামুদ্দিন বললেন, তুমি এক শ টাকার নোট অনেকবার দেখেছি। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে তুমি বলতে পারবে না এক শ টাকার নোটের দু পিঠে কী ছবি আছে। বলতে পারবে?
জ্বি না স্যার।
একপিঠে আছে লালবাগ দুর্গের ছবি, আরেক পিঠে তারা মসজিদের ছবি। তোমার সঙ্গে এক শ টাকার নোট আছে না? আমার কথা মিলিয়ে দেখ।
এক শ টাকার নোট নেই স্যার।
কত টাকার নোট আছে?
দশ টাকার।
দশ টাকার নোটের এক দিকে আছে কাপ্তাই বাঁধের ছবি, আরেকদিকে টাঙ্গাইলের একটা মসজিদের ছবি–আতিয়া জামে মসজিদ। মানিব্যাগ খুলে দেখ।
দেখতে হবে না। স্যার। আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই আছে।
তবুও তুমি একবার দেখে নাও।
হাসান মানিব্যাগ বের করে দেখল। হিশামুদিন সাহেব বললেন, নোটের গায়ে কী ছবি আঁকা থাকে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তারপরেও আমি মনে করি–আমাদের দৃষ্টি আরো পরিষ্কার থাকা দরকার। মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে এই কথাটা তোমাকে বললাম। কেন বললাম বল তো?
বলতে পারছি না। স্যার। আমার বুদ্ধি সাধারণ মানের।
আজ এই পৰ্যন্তই থাক।
জ্বি আচ্ছা।
হিশামুদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হাসান খুবই অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। না সে রকম কোনো ঘটনা ঘটে নি–লুঙ্গি গড়িয়ে নিচে নেমে যায় নি। হিশামুদিন সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কাঁটায় কাঁটায় চারটা বাজছে। হিশামুদিন সাহেব চারটা থেকে সাড়ে চারটা এই ত্রিশ মিনিট তাঁর শোবার ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। নিজের ইচ্ছায় না, ডাক্তারের নির্দেশে। দুটা বড় ধরনের স্ট্রোক তার হয়ে গেছে। তৃতীয়টির জন্যে অপেক্ষা। অপেক্ষার সময়টায় নানান নিয়মকানুন মেনে চলা। আজ হিশামুদিন সাহেব নিয়মের খানিকটা ব্যতিক্রম করলেন। শোবার ঘরে ঢোকার আগে মতিঝিলে হিশামুদিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের হেড অফিসে টেলিফোন করলেন। টেলিফোন ধরল জীবন। জীবনকে তিনি একটা কাজ দিয়েছিলেন। হাসান সম্পর্কে খোঁজখবর করা। ছেলেটি সম্পর্কে কৌতুহল বোধ করছেন বলেই অনুসন্ধান।
আজ হাসানের একটা ব্যাপার তাঁর চোখে পড়েছে। তিনি যখন বলছিলেন–সিলিং থেকে ফ্যান খোলা হচ্ছে আর তাঁর বাবা দূরে দাঁড়িয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে হাসছেন–তখনই তিনি লক্ষ করলেন হাসানের চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখের পানি সামলাবার জন্যে দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়েছে। হিশামুদিন সাহেবের অনেক প্রিয় গল্পের মধ্যে এই গল্পটি একটি। অনেককে এই গল্প বলেছেন। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনেছে। কারো চোখে পানি আসে নি। শুধু তাঁর মেয়ে চিত্ৰলেখার চোখে পানি এসেছিল। তাঁর মেয়েটি সেদিন স্কুল থেকে জ্বর নিয়ে ফিরছে। চোখ লাল। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি করছে। জ্বরে কাতর মেয়েটিকে দেখে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। রাত ন’টায় তিনি রওনা হবেন জাপানে। এয়ারপোর্টে সন্ধ্যা সাতটায় রিপোটিং। মেয়েটিকে একা রেখে তাকে যেতে হবে। বিশাল এই বাড়িতে চিত্ৰলেখা একা একা ঘুরবে। তিনি এয়ারপোর্টে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে মেয়ের পাশে বসলেন। না, জ্বর বেশি না। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। চিত্ৰলেখা বলল, তোমার এয়ারপোর্ট যাবার সময় হয়ে গেছে। তাই না বাবা? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
কতক্ষণ থাকতে পারবে। আমার পাশে?
আধঘণ্টা।
তাহলে একটা গল্প বল।
তিনি তাঁর বাবার ফ্যানের গল্পটা বললেন। গল্পের এক পর্যায়ে চিত্ৰলেখা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তিনি সহজ গলায় বললেন, কাঁদছ কেন মা?
তোমার বাবার কথা মনে করে কান্না পাচ্ছে।
ও আচ্ছা।
তোমার বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। তাই না? এখন তোমার কত টাকা! ইচ্ছে করলে বাংলাদেশের সব ফ্যান তুমি কিনে নিতে পার তাই না বাবা?
হুঁ।
তোমার বাবা তোমার ভাইবোনদের মধ্যে কাকে সবচে’ ভালোবাসতেন?
আমার বড় বোনকে, তাঁর নাম পুষ্প।
তাকে সবচে’ ভালবাসতেন কেন?
বড়বুবু দেখতে অবিকল আমার মা’র মতো ছিলো, এই জন্যেই বোধহয়। তাছাড়া প্ৰথম সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র একটা আলাদা মমতা থাকে।
তোমাকে কতটা ভালবাসতেন?
আমাকে খুব সামান্য। আমি সবার শেষের দিকে তো এই জন্যে বোধহয়। মাঝে মাঝে আমার নাম পর্যন্ত ভুলে যেতেন।
কী যে তুমি বল বাবা নাম ভুলবে। কী করে?
ভুলে যেতেন। আমার ঠিক আগের ভাইটার নাম ফজলু। আমার ডাকনাম বজলু। তিনি আমাকে ডাকতেন ফজলু বলে।
তুমি রাগ করতে না?
না।
আমি হলে খুব রাগ করতাম। আমাদের অঙ্ক আপা আমাকে মাঝে মাঝে ডাকেন চিত্ররেখা। আমি জবাব দিই না। চিত্ররেখা তো আমার নাম না। চিত্ররেখা ডাকলে আমি কেন জবাব দেব? ঠিক না বাবা?
হ্যাঁ ঠিক।
এখন তোমার এয়ারপোর্টে যাবার সময় হয়ে গেছে তুমি চলে যাও।
তোমার জন্যে কিছু আনতে হবে?
না।
কিছু না?
না, কিচ্ছু না।
হিশামুদ্দিন সাহেব তাঁর বাবার গল্প যখন বলছিলেন তখন ঠিক যে জায়গায় এসে চিত্ৰলেখা কেঁদে ফেলেছিল। সেই জায়গায় হাসান ছেলেটার চোখে পানি এসেছে। ব্যাপারটা তুচ্ছ, আবার ঠিক তুচ্ছও না। জীবনকে এই ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজখবর করতে বলেছিলেন। সে কতটা খোঁজখবর করেছে কে জানে!
হ্যালো জীবন?
জ্বি স্যার।
হাসান ছেলেটি সম্পর্কে তোমাকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম–খোঁজ নিয়েছ?
জ্বি স্যার। খুবই সাধারণ ছেলে স্যার।
এ ছাড়া আর কী?
ঝিকাতলায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। এড্রেস হচ্ছে এগার বাই…
হিশামুদ্দিন বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকালেন। হড়বড় করে এড্রেস বলছে–এড্রেস তো তার অফিসেই আছে। জীবন এখন পর্যন্ত কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে নি। ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। তবু এই ছেলেটিকে তাঁর বেশ পছন্দ।
হাসান সম্পর্কে আর কী জান?
কয়েকটা প্ৰাইভেট টিউশ্যানি করে?
কটা?
একজক্ট বলতে পারছি না। স্যার।
বিয়ে করেছে?
জ্বি না।
তার কোনো পছন্দের মেয়ে কি আছে?
জ্বি স্যার, একজনের বাসায় মাঝে মাঝে যায়–সেই বাসার এড্রেস হলো স্যার—কলাবাগান—ভেতরের দিকে দুই বাই…
হিশামুদ্দিন আবারো ভুরু কুঁচকালেন। জীবন মনে হয় এড্রেস ছাড়া আর কিছু বলতে পারবে না। সে এড্রেস-বিশেষজ্ঞ।
জীবন।
জ্বি স্যার?
মেয়েটির নাম কী?
কোন মেয়ের নাম স্যার?
হাসানের পছন্দের মেয়েটির নাম…
ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, নাম স্যার জানি না। তবে নাম-এড্রেস সব সংগ্ৰহ করতে পারব।
থাক সংগ্ৰহ করতে হবে না। আমি হাসানকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব।
হিশামুদ্দিন সাহেব টেলিফোন রেখে শোবার ঘরে ঢুকলেন। ঘর কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে আকাশে মেঘ করেছে। তাঁর হিসেব মতো বৃষ্টি হবার কথা রাত ন’টা-দশটার দিকে। এখুনি আকাশ এত অন্ধকার হলো কেন?
তাঁর ব্যক্তিগত বেয়ারা মোতালেব চায়ের কাপ নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। ঠিক সাড়ে চারটার সময় তিনি এক কাপ হালকা লিকারের চা খান। বিকেল পাঁচটায় অফিসে উপস্থিত হন। আজ নিয়ম ভাংতে ইচ্ছে করছে।
তিনি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, মোতালেব আকাশে কি মেঘ আছে?
মোতালেব বিস্মিত হয়ে বলল, জ্বি।
কী মনে হয় তোমার, বৃষ্টি হবে?
ঝুম বৃষ্টি হবে স্যার। আসমান অন্ধকার কইরা মেঘ করছে।
তুমি টেলিফোন করে জীবনকে জানিয়ে দাও যে আজ অফিসে যাব না।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ঝুম বৃষ্টি যদি নামে তাহলে আজ বৃষ্টিতে গোসল করব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
হিশামুদ্দিন সাহেব লক্ষ করলেন মোতালেব তাঁর কথায় অবাক হলো না। মোতালেবকে এখন পর্যন্ত তিনি বিস্মিত হতে দেখেন নি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হিশামুদ্দিন সাহেব বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
তাঁর খুব অস্থির লাগছে। অস্থির লাগছে কেন? তৃতীয় স্ট্রোকের সময় কি হয়ে গেছে? কপাল ঘামছে? পিঠের মাঝখানে ব্যথা বোধ হচ্ছে।
তিনি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। তাঁর কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কথা বলার জন্যে মোতালেবকে কি ডেকে পাঠাবেন? সে বিছানার কাছে এটেনশন হয়ে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে–তিনি কথা বলে যাবেন। তিনি ডাকলেন–মোতালেব।
মোতালেব ছুটে এল। তিনি কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তার বাবার ফ্যান চুরির গল্পটা কি বলবেন? গল্পটা সে কীভাবে নেবে? সবাইকে কি সে বলে বেড়াবে–আমাদের স্যারের বাবা ছিলেন চোর। কথাগুলো সে বলবে ফিসফিস করে। যারা শুনবে তারাও অন্যদের কাছে ফিসফিস করবে।
মোতালেব।
জ্বি স্যার।
বৃষ্টি কি নেমেছে?
জ্বি না। স্যার।
আচ্ছা তুমি যাও–এক কাজ কর, টেলিফোন হ্যান্ডসেটটা দিয়ে যাও।
মোতালেব বের হয়ে গেল। হিশামুদিন সাহেব তাঁর শোবার ঘরে টেলিফোন রাখেন না। টেলিফোন কেন–কিছুই রাখেন না। বিশাল একটা ঘর, ঘরের মাঝখানে প্ৰকাণ্ড একটা খাট-আর কিছু নেই। কাপড় বদলানোর জন্যেও তাকে পাশের ঘরে যেতে হয়। ফাঁকা একটা ঘরে রাতে যখন ঘুমোতে আসেন তখন তাঁর মনে হয় তিনি খোলা মাঠে শুয়ে আছেন।
টেলিফোন নিয়ে মোতালেব ঢুকাল না, ঢুকল রহমতউল্লাহ। শঙ্কিত গলায় বলল, স্যারের শরীর কি ভালো?
হিশামুদ্দিন বললেন, শরীর ভালো। তুমি টেলিফোন রেখে চলে যাও।
কাকে করবেন বলুন স্যার, আমি লাইন লাগিয়ে দি।
কাকে করব বুঝতে পারছি না। তুমি রেখে যাও।
ডাক্তার সাহেবকে কি খবর দেব স্যার?
না।
আজ রাত আটটায় আপনার ডিনারের দাওয়াত, চেম্বারস অব কমার্সের মিটিং। আপনি কি যাবেন?
আটটা বাজতে তো দেরি আছে–আছে না?
জ্বি স্যার।
আমি যাব। তবে বৃষ্টি নেমে গেলে যাব না। আজ বৃষ্টিতে ভিজব।
রহমতউল্লাহ অস্বস্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। হিশামুদ্দিন বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। রহমতউল্লাহ গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। হিশামুদ্দিন বললেন, তুমি কিছু বলবে?
জ্বি না স্যার।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, যাও।
হিশামুদ্দিন টেলিফোন সেট হাতে নিয়ে বসে আছেন। কাকে টেলিফোন করবেন? এমন কেউ যদি থাকত যার সঙ্গে সহজ স্বাভাবিকভাবে গল্প করা যায় তাহলে ভালো হতো। এমন কেউ নেই। ক্ষমতাবান মানুষরা ধীরে ধীরে কী পরিমাণ নিঃসঙ্গ হয় তা তিনি এখন বুঝতে পারছেন। তাঁর ক্ষমতা আরো বাড়বে–তাকে অর্থমন্ত্রী করার কথা হচ্ছে। প্রস্তাব এখনো সরাসরি আসে নি, তবে চলে আসবে। তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। পেছনের সিটে তিনি গা এলিয়ে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকবেন। ফাইল হাতে ড্রাইভারের পাশে তার চেয়েও বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকবে তার পিএস। পেছনের একটা গাড়িতে বসে থাকবে সিকিউরিটির লোকজন।
হাসানকে তাঁর বাবার গাড়িগ্ৰীতির গল্পটা বলা হয় নি। একদিন বলতে হবে। তাঁর বাবার গাড়িগ্ৰীতি ছিল অসাধারণ। কিছু টাকা-পয়সা যোগাড় হলেই তিনি একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেলতেন। ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টা শহরে ঘোরা।
মোতালেব ঘরে ঢুকল। হিশামুদ্দিন বললেন, কিছু বলবে মোতালেব?
বৃষ্টি নামছে স্যার।
বেশি নেমেছে না ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে?
ফোঁটা ফোঁটা।
যখন ঝুম বৃষ্টি নামবে তখন বলবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার। চা দিমু?
না।
হিশামুদ্দিন টেলিফোনের নাম্বার টিপছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ কিন্তু টেলিফোন নাম্বার মনে থাকে না। মনে রাখার চেষ্টাও অবশ্য করেন না। টেলিফোন নাম্বারা মনে রাখার জন্যে তার লোক আছে। একটা টেলিফোন নাম্বারই তার মনে থাকে। মেয়ের নাম্বার। মেয়েকে টেলিফোন করে কি পাওয়া যাবে? সামারে সে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।
কে? চিত্ৰলেখা?
বাবা তুমি!! কী ব্যাপার?
এত অবাক হচ্ছিস কেনা! আমি টেলিফোন করতে পারি না?
অবশ্যই পার। আমি সে জন্যে অবাক হচ্ছি না। আমার অবাক হবার কারণ ভিন্ন।
কারণটা কী?
আমি ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছি ভার্জিনিয়াতে। গাড়িতে সব জিনিসপত্র তোলা হয়েছে। গাড়ি স্টার্টও দিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো সব নেয়া হয়েছে, কাগজ-কলম নেয়া হয় নি। কাগজ-কলম নেবার জন্যে আবার ফিরে এসেছি–শুনি টেলিফোন বাজছে। তুমি কেমন আছে বাবা?
ভালো।
তোমার ডিপ্রেশন কেটেছে?
আমার আবার ডিপ্রেশন কী?
শেষবার যখন তোমার সঙ্গে কথা হলো–তখন মনে হলো–তুমি খুব ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ।
আমি ভালো আছি।
তোমার জীবনের মজার মজার ঘটনাগুলো যে কাকে দিয়ে লেখাচ্ছিলে–এখনো কি লেখাচ্ছ?
লেখা কেমন এগোচ্ছে?
খুব এগুচ্ছে না।
যা লিখেছি আমার কাছে ফ্যাক্স করে পাঠাও, আমি পড়ে দেখি।
আচ্ছা পাঠাব।
তোমাদের ওখানে ওয়েদার কেমন?
খুব গরম পড়েছে। অনেক দিন বৃষ্টি হচ্ছে না।
এদিকে ওয়েদার খুব চমৎকার। তোমাকে কি আমি একটা অনুরোধ করতে পারি বাবা?
হ্যাঁ করতে পারিস।
তুমি আমার কাছে চলে এস। আমরা দুজনে মিলে ক্যাম্পিং করব। তাবুর ভেতর থাকব। নিজেরা জঙ্গল থেকে কাঠ এনে রান্না করে খাব। হ্রদে মাছ ধরব। সেই মাছ বারবিকিউ করে খাব। বাবা আসবে?
না।
তুমি এত কঠিন করে না বলা শিখেছ কীভাবে?
না বলতে পারাটা খুব বড় গুণ মা। বেশির ভাগ মানুষ ‘না’ বলতে পারে না। এতে তারা নিজেরাও সমস্যায় পড়ে, অন্যদেরও সমস্যায় ফেলে। আমার বাবা কখনো না বলতে পারতেন না। যে যা বলত–তিনি বলতেন, আচ্ছা। শুধু এই কারণেই সারা জীবন তিনি একের পর এক সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছেন…
বাবা!
হুঁ।
তুমি যে-কোনো আলাপে তোমার বাবাকে নিয়ে আসা কেন? তাঁর ব্যাপারে তোমার কি কোনো অপরাধবোধ আছে?
হিশামুদ্দিন সাহেব জবাব দিলেন না। চিত্ৰলেখা বলল, বাবা আমি এখন রওনা হচ্ছি। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব। আর শোন–কোনো কারণে আমি যদি তোমার মন খারাপ করিয়ে দিয়ে থাকি তাহলে–সরি। এপোলজি কি গ্রান্টেড বাবা?
হ্যাঁ গ্রান্টেড।
হিশামুদিন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মোতালেব চা নিয়ে ঢুকাল। তিনি চা চান নি। কিন্তু এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, বৃষ্টি কি নেমেছে?
মোতালেব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি না স্যার।
বৃষ্টি না নামার অপরাধে সে নিজেকে অপরাধী ভাবছে।
আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব
আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। বিজলি চমকাচ্ছে। বাতাস ভরি। মাটির ভেতর থেকে অদ্ভুত গন্ধ আসছে। ছোট বাচ্চাদের গায়ের গন্ধের মতো গন্ধ। প্ৰবল বর্ষণের আগে আগে এ রকম গন্ধ পাওয়া যায়। হাসান রিকশা থেকে নেমেছে। তবে মনস্থির করতে পারছে না। রিকশাটা ছেড়ে দেবে না রিকশা করেই ফিরে যাবে। বৃষ্টি নামলে আর রিকশা পাওয়া যাবে না। রিকশাওয়ালারা এখন স্বাস্থ্যসচেতন। ভিজে জবজবা হয়ে তারা রিকশা চালায় না। বৃষ্টির সময় হুড তুলে সেটির ওপর আরাম করে বসে বিড়ি টানে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেভাড়া যাবেন? বিরক্ত হয়, জবাব দেয় না।
হাসান আকাশের দিকে তাকাল–কতক্ষণে বৃষ্টি নামবে বোঝার চেষ্টা। হাস্যকর চেষ্টা তো বটেই। আবহাওয়া বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই। আকাশে। কত রকমের মেঘ হয় ছােটবেলা পড়েছিল-ৰূপ মেঘ, পালক মেঘ…। তার আবহাওয়াবিদ্যা এই পর্যন্তই। রিকশাওয়ালা টুনি টুন করে দুবার ঘণ্টা বাজিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, খাড়াইয়া আছেন ক্যান? ভাড়া দেন। হাসান ভাড়া দিয়ে দিল। পাঁচ টাকা ভাড়া, দুটাকা বাড়তি দিল। আজ তার পকেটে টাকা আছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে তিতলীদের বাসার গেটের সামনে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না বুঝতে পারছে না। তার হাতে ঘড়ি নেই, তবে রাত মনে হয় ভালোই হয়েছে, দশটার কম না। এত রাতে তিতলীর বাসায় ঢুকলে সবাই সরু চোখে তাকাবে। না ভুল বলা হলো, সবাই তাকবে না তিতলীর বাবা মতিন সাহেব তাকাবেন। সেটা কি ভালো হবে? হাসান ক্লান্ত পায়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল, ঠিক করল গেট থেকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত যেতে যদি তার গায়ে কোনো বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে তাহলে সে ফিরে আসবে। এতদূর এসে তিতলীকে এক পলকের জন্যে না দেখে গেলে খুব খারাপ লাগবে। লাপ্তক। পৃথিবীতে বাস করতে হলে অনেক খারাপ লাগা সহ্য করে বাস করতে হয়। হাসান বাড়ির দরজা পর্যন্ত চলে এসেছে, গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে নি। এখন কলিংবেল টেপা যেতে পারে।
কলিংবেলে হাত দিয়েই হাসান ভালো একটা শক খেল। ডান হাতটা বিনবিশ্বন করে উঠল। প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। শক খেলেও বেল ঠিকই বাজল। ভেতর থেকে ধমকের সুরে তিতলীর বাবা বললেন, কে? হাসান জবাব দিল না, সে শকের ধকল সামলাচ্ছে। হাতের বিনবিন ভাব এখানো যাচ্ছে না।
তিতলীদের বাসার কলিংবেলটা অনেকদিন থেকেই নষ্ট। কিছুদিন কলিংবেলটার ঠিক ওপরে হাতে লেখা একটা কাগজ স্কচটেপ দিয়ে আটকানো ছিল। কাগজে লেখা–
কলিংবেল নষ্ট। দয়া করে হাত দেবেন না।
কাগজটা এখন নেই। আর থাকলেও লাভ হতো না। হাসান ঠিকই বেল টিপত। তিতলীদের বাসার আশপাশে এলে তার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়। সম্ভবত ব্লাডপ্রেসারঘটিত কোনো সমস্যা। হয় প্রেসার বেড়ে যায় কিংবা কমে যায়।
হাসান কড়া নাড়ল। তিতলীর বাবা মতিন সাহেব একবার ‘কে’ বলে চুপ করে আছেন। তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার, যে কলিংবেল টিপেছিল। সে চলে যায় নি। এখনো আছে। মতিন সাহেব। আবারো ধমকের গলায় বললেন, কে? হাসান জবাব দিল না। বন্ধ দরজার দুপাশ থেকে বাক্যালাপ চালানোর অর্থ হয় না। হাসান বলবে, আমি। মতিন সাহেব বলবেন, আমিটা কে? হাসান বলবে, জ্বি আমি হাসান। কোনো মানে হয় না। এরচে’ বিশ্ৰীভাবে কয়েকবার কড়া নেড়ে চুপ করে থাকা ভালো।
দরজার ছিটিকিনি খোলার শব্দ হচ্ছে। এ বাড়ির দরজার ছিটিকিনিগুলোও নষ্ট। সহজে খোলা যায় না, ধস্তাধস্তি করতে হয়। হাসান ভেবেছিল মতিন সাহেব দরজা খুলে শ্লেষজড়ানো বিরক্ত গলায় বলবেন, ও আচ্ছা তুমি? এত রাতে কী মনে করে? হাসানকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল তিতলী। এত রাতেও সে বেশ সেজেণ্ডজে আছে। চুল বাঁধা। পরনে চাঁপা রঙের শাড়ি। ঠোঁটে লিপস্টিকও আছে। গলায় চিকমিক করছে সরু চেইন। মনে হয় কোনো বিয়েবাড়ি থেকে দাওয়াত খেয়ে এসেছে। তিতলী গভীর বিস্ময় নিয়ে বলল, আরো তুমি? এত রাতে তুমি কোথেকে?
রাত খুব বেশি নাকি?
সাড়ে ন’টা বাজে।
ভেতর থেকে মতিন সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস? তিতলী লাজুক গলায় বলল, হাসান ভাইয়া এসেছেন। বাবা। মতিন সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ও।
তিতলী হাসানের দিকে তাকিয়ে হাসল। তার এত আনন্দ লাগছে। আনন্দে চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। শুধু পানি জমা না–আনন্দে শরীরও কাঁপছে। এই তো সে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়েছে। আঙুলগুলো সত্যি সত্যি কাঁপছে।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এস।
হাসান খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই ঘরের ভেতর ঢুকল। এত রাতে এসে তিতলীকে বিব্রত করার কোনো মানে হয় না। তিতলীদের বসার ঘরের অবস্থা শোচনীয়। পুরনো সোফায় কয়েক জায়গায় গদি ছিঁড়ে তুলা বের হয়ে পড়েছে। একটা সোফার স্প্রিং নষ্ট। বসলে তলিয়ে যেতে হয়। দুটা বেতের চেয়ার আছে। চেয়ারের নানা জায়গা থেকে পেরেক বের হয়ে আছে। অসাবধানে চেয়ার থেকে উঠতে গেলে প্যান্ট বা শার্ট ছিড়বেই। হাসানের কালো প্যান্টটা এভাবেই ছিঁড়েছে। ঘরের অর্ধেকটা অংশ জুড়ে খাট পাতা। খাটে তোশক বিছানো আছে। তোশকের ওপর বেশির ভাগ সময় কোনো চাদর থাকে না। আজ অবশ্যি আধ্যময়লা একটা চাদর আছে। দেয়ালে গত বছরের একটা ক্যালেন্ডার। জুন মাস বের হয়ে আছে। ক্যালেন্ডারের ছবিটা সুন্দর। হ্রদের জলে মানের পোশাক পরা এক তরুণী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তরুণীর চোখ বন্ধ। হ্রদের জল যেমন নীল, তরুণীর স্নানের পোশাক তেমনি লাল। লাল-নীলে মিলে দারুণ একটা ছবি। ক্যালেন্ডারটার পাশেই একটা দেয়ালঘড়ি। ঘড়িটা আজ বন্ধ। সাতটা একুশ বাজছে। হাসান ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, তিতলী এক গ্লাস পানি খাব।
তিতলী পানি আনতে গেল। খাবার ঘরের টেবিলে পানির জগ এবং গ্লাস রাখা আছে। তিতলী সেদিকে গেল না। বাবা খাবার টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর মুখ সন্ধ্যা থেকেই থমথমে। এখন সেই থমথমে ভাব আরো বেড়েছে। তাঁর সামনে পড়লে তিনি কঠিন চোখে তাকবেন। সব সময় কঠিন চোখ দেখতে ভালো লাগে না।
রান্নাঘরে তিতলীর মা সুরাইয়া ভাত বসিয়েছেন। মতিন সাহেবের জন্যে আলাদা করে। ভাত রাঁধতে হচ্ছে। তিনি আতপ চালের ভাত খান। সেই ভাত বািরকারে হতে হয়। ভাতের প্রতিটি দানা থাকবে আলাদা। একটার গায়ে আরেকটা লেগে থাকবে না। পাকা রাধুনির জন্যেও কঠিন ব্যাপার। সুরাইয়া পাকা রাধুনি নন। স্বামীর ভাত রান্নার সময় তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে থাকেন। তিতলী রান্নাঘরে ঢুকতেই সুরাইয়া মেয়ের দিকে তাকালেন। তিতলী লজ্জামাখা গলায় বলল, হাসান ভাইয়া এসেছে মা। বলতে গিয়ে ত্রিতলীর কথা জড়িয়ে গেল, গাল খানিকটা লালচে হয়ে গেল। ব্যাপারটা সুরাইয়ার চোখ এড়াল না। সুরাইয়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ওকে খেয়ে যেতে বল।
দরকার নেই মা।
তিতলী পানির গ্লাস নিয়ে বের হয়ে গেল। কেমন হড়বড় করে বের হচ্ছে। দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে খানিকটা পানি সে ছলকে ফেলে দিল। মেয়েটার অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখে সুরাইয়ার মন কেমন করতে লাগল। হাসানকে দেখলেই মেয়েটা এমন অস্থির হয়ে পড়ে কেন? কী আছে হাসানের মধ্যে? এ বছরও এম.এ. পরীক্ষা দেয় নি। প্রতি বছর শোনা যায় পরীক্ষা দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেয় না। হাসানের চেহারাও ভালো না। কেমন বোকা বোকা ভাব। সংসারের অবস্থা সাধারণ, ভাইয়ের সঙ্গে বাস করছে। চাকরি বাকরি কোনোদিন পাবে। এ রকম মনে হয় না। আজকাল চাকরি বাকরি হলো ধরাধরির ব্যাপার। হাসানের ধরাধরি করার কেউ নেই।
ভাতের পানি ফুটছে। সুরাইয়া ভাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে আজ ভাতে কোনো গণ্ডগোল হবে। ভাত গায়ে গায়ে লেগে যাবে। তিতলীর বাবা খেতে বসে নানান ধরনের কটু কথা বলবেন। সুরাইয়া তিনবার ‘ইয়া জালজালালু ওয়াল ইকরাম’ বলে হাঁড়ির ঢাকনা তুলে ফুঁ দিলেন।
হাসান এক চুমুকে পানিটা শেষ করে গ্লাস তিতলীর দিকে বাড়িয়ে বলল, তিতলী যাই।
তিতলী কিছু বলল না। মাথা নিচু করে হাসল। এমনভাবে হাসল যেন হাসান দেখতে না পায়। হাসানের অনেক বিচিত্র অভ্যাসের একটা হচ্ছে তিতলীদের বাড়িতে এসেই সে প্রথমে এক গ্লাস পানি খেতে চাইবে। পানি খাওয়া শেষ হলে বলবে–তিতলী যাই। মুখে বলবে কিন্তু যাবার কোনো লক্ষণ দেখাবে না।
মা তোমাকে খেয়ে যেতে বলেছে।
আরে না।
আরে না কেন? খেয়ে যাও না। মেনু অবশ্য ভালো না–চোখে দেখা যায় না। এমন সাইজের কই মাছ। বাবার ধারণা কই মাছ সাইজে যত ছোট হয় তত স্বাদ বেশি হয়।
হাসান কিছু বলল না। তিতলী বলল, তুমি যে আজ আসবে এটা কিন্তু আমি জানতাম।
আমি আসব। কীভাবে জানতে?
আজ ঘুম থেকে উঠেই তিনটা শালিক দেখেছি। মুখ ধুতে কলঘরের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি বারান্দায় কাপড় শুকোবার দড়িতে দুটা শালিক বসে আছে। তারপর কী হয়েছে শোন–মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি আরো একটা শালিক এসে বসেছে। মোট তিনটা শালিক। তখনই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম–আজ তুমি আসবে।
তিনটা শালিক দেখলে কেউ আসে?
তিতলী গানের মতো গুনগুন করে বলল–
‘One for Sorrow
Two for joy
Three for letter
Four for boy.
প্রথমে দুটা শালিক দেখলাম— তার মানে আনন্দের কোনো ব্যাপার ঘটবে, তারপর দেখলাম তিনটা, অর্থাৎ চিঠি পাব। তুমি যখনই আস একটা চিঠি নিয়ে আসা। কাজেই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত তুমি আসবে। শাড়ি পরে কেমন সেজে আছি দেখছি না। রাত সাড়ে ন’টার সময় কেউ এমন সেজেণ্ডজে থাকে? এটা নতুন শাড়ি, আগে কখনো পরি নি। রংটা সুন্দর না?
খুব সুন্দর।
না দেখেই তুমি বললে খুব সুন্দর। বল তো কী রঙের শাড়ি?
চাপা রং।
গুড। হয়েছে। আমার চিঠি এনেছ?
হুঁ।
দাও।
হাসান পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিঠি বের করল। তিতলীর হাতে দিতে দিতে বলল, আজ উঠি {
তিতলী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এসেই উঠি উঠি করছি কেন? মা তোমাকে ভাত খেয়ে যেতে বলেছে।
তিতলী চিঠি মুঠোয় লুকিয়ে তার ঘরে চলে গেল। তার ঘর হলেও সে একা ঘুমোয় না। এই ঘরে দুটা খাট পাতা। দুটা খাটে তারা তিন জন ঘুমোয়। সে আর তার ছোট দু বোন–নাদিয়া, নাতাশা। নাদিয়া-নাতাশা আজ বড় ফুফুর বাসায় বেড়াতে গেছে, রাতে থাকবে। তিতলীরও যাবার কথা ছিল। ভোরবেলায় তিনটা শালিক না দেখলে সে অবশ্যই যেত। বড় ফুফুর বাসায় যেতে তার সবসময় ভালো লাগে।
চিঠি খুলে তিতলীর মন খারাপ হয়ে গেল। এতটুকু একটা চিঠি-এক সেকেন্ডে পড়া হয়ে যাবে। তিতলী চিঠিটা গালে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে, হাত-পা কাঁপছে। আশ্চৰ্য, এ রকম হচ্ছে কেন? হাসানের চিঠি তো সে আজ নতুন পড়ছে না। অনেকদিন থেকেই পড়ছে। হাসানের এই চিঠিটা তিয়াত্তর নম্বর চিঠি। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে না। পড়লেই তো ফুরিয়ে যাবে। এখন থাক, রাতে বিছানায় শুয়ে আরাম করে পড়া যাবে। ইচ্ছে করলে চিঠিটা বুকের ওপর রেখে ঘুমিয়েও পড়তে পারে। নাদিয়ানাতাশা কেউ নেই। ঘরটা আজ তার একার। আচ্ছা মানুষটা লম্বা একটা চিঠি লিখতে পারে না? উপন্যাসের মতো লম্বা একটা চিঠি। সে পড়তেই থাকবে পড়তেই থাকবে চিঠি ফুরাবে না। এমন লম্বা চিঠি যে রাতে ঘুমোতে যাবার সময় চিঠি পড়তে শুরু করল ভোরবেলা আযানের সময় চিঠি শেষ হলো।
তিতলী।
তিতলী চমকে উঠল। এমনভাবে চমকাল যে গালে ধরে রাখা চিঠি মেঝেতে পড়ে গেল। দরজার কাছে সুরাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। তিতলীর বুক ধকধক করছে। মা কি চিঠিটা দেখে ফেলেছেন? মনে হয় না। চিঠি দেখলে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি তাকিয়ে আছেন তিতলীর দিকে। মা অবশ্যি দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন। এইসব ছোটখাটো ভান মা খুব ভালো করেন।
সুরাইয়া বললেন, ঘরে একা একা কী করছিস?
কিছু করছি না মা।
তিতলী কী করবে বুঝতে পারছে না। পা দিয়ে চিঠিটা চেপে ধরবে? না যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? মা সামনে থেকে না। সরলে সে ঘর থেকে বের হতে পারবে না। আগে চিঠিটা লুকোতে হবে।
তোর বাবাকে ভাত দিচ্ছি। তোর বাবার খাওয়া হয়ে যাক তারপর তুই হাসানকে খাইয়ে দে। এত রাতে না খেয়ে যাবে কেন?
আচ্ছা।
সুরাইয়া সরে যেতেই তিতলী ছোঁ মেরে চিঠিটা তুলে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল। তার বুকের ধুকধুকনি এখানো যায় নি। তার কেন জানি মনে হচ্ছে মা চিঠিটা দেখেছে।
মতিন সাহেব প্লেটে ভাত নিতে নিতে বললেন, এতদিনেও সামান্য ভাত ঠিকমতো রাঁধা শিখলে না। এটা এমন কী জটিল কাজ যে কুড়ি বছরেও শেখা যাবে না।
সুরাইয়া চুপ করে রইলেন। মতিন সাহেব বললেন, তোমাকে পোলাও-কোরমা, কোপ্তা-কালিয়া তো রাঁধতে বলি না। সামান্য ভাত–এটাও ঠিকমতো রাঁধবে না।
সুরাইয়া কোটা থেকে এক চামচ ঘি ভাতের ওপর ছড়িয়ে দিলেন। মতিন সাহেব আগুনগরম ভাতের প্রথম কয়েক নলা ঘি দিয়ে খান। এই ঘি দেশ থেকে আসে।
মতিন সাহেব বললেন, রাতদুপুরে হাসান এসেছে কেন? তিতলীও দেখি ওর সঙ্গে গাবের আঠার মতো লেগে আছে। দু’জনে মিলে গুটুর গুটুর গল্প। ঘরের ভেতর বাং সিনেমা আমার খুব অপছন্দ। রাতদুপুরে সে আসবেই বা কেন?
সুরাইয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, আমি আসতে বলেছি।
তুমি আসতে বলেছ? কেন?
শুনেছিলাম হাসানের মা’র খুব অসুখ ছিল–এখন কেমন তা জানার জন্যে আসতে বলেছিলাম।
কোনো কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো না। মা’র অসুখের খবর ছেলেকে রাতদুপুরে ঘরে এনে জিজ্ঞেস করতে হবে? মা’র অসুখের তুমি করবে। কী? তুমি সিভিল সার্জনও না, পীর ফকিরও না।
সুরাইয়া ক্ষীণ স্বরে বললেন, আরেক চামচ ঘি দেব?
দাও। আর শোন, তোমাকে বলছি, তোমার কন্যাদেরও বলছি–বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ না। বাড়াবাড়ি আমি খুব অপছন্দ করি। হাসানের মা’র খবর জেনেছ?
হুঁ।
তাহলে ওকে বসিয়ে রেখেছি কেন–চলে যাক না।
ভাত খেয়ে যেতে বলেছি।
ভাত খেয়ে যেতে বলেছ কেন?
সুরাইয়া প্ৰায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, এত রাতে না খায়ে যাবে!
মতিন সাহেব প্লেটে ডাল নিতে নিতে বললেন, তুমি সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা। বড়াবাড়ির ফল কখনো শুভ হয় না। হাসানের মা’র হয়েছে কী সেটা তো বললে না।
সুরাইয়া সমস্যায় পড়ে গেলেন। মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে তিনি সামান্য মিথ্যা বলেছেন। মিথ্যা বলাটা ঠিক হয় নি। একটা মিথ্যা বললে পরপর কয়েকটা মিথ্যা বলতে হয়। সুরাইয়া ইতস্তত করে বললেন, জ্বর।।
জ্বর শুনে একেবারে ছেলেকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছি। টাইফয়েড-টয়েড হলে তো গুষ্ঠীসুদ্ধা খবর দিয়ে নিয়ে আসতে। আমাকে বল তো–এই বাড়াবাড়ির মানে কী?
আরেকটা মাছ নাও। আগেই ডাল নিলে কেন?
মতিন সাহেব আরেকটা মাছ নিলেন। জনপ্ৰতি একটা করে কই মাছ তিনি হিসেব করে নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়ে তাদের ফুফুর বাড়িতে গেছে। দুটা মাছ বেঁচে গেল। তিনি একটা নিতে পারেন। তারপরেও হাসানের জন্যে একটা থাকবে। মতিন সাহেব খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আজ তিনি একা শোবেন। সুরাইয়া তার মেয়ের সঙ্গে ঘুমোবে। আঠার বছরের মেয়েকে কখনো একা ঘরে শুতে দিতে নেই। আঠার বছরের মেয়ে হলো সাক্ষাৎ আগুন। আগুনের সঙ্গে সব সময় পানি রাখতে হয়। মেয়ের মা হলো সেই পানি। আগুন-পানি একসঙ্গে থাকলে বিপদ থাকে না।
হাসান লজ্জিত মুখে খেতে বসেছে। সুরাইয়া তিতলীকে বললেন, তুই খেতে বসে যা।
তিতলী বলল, আমি তোমার সঙ্গে খাব মা।
তিতলীর চোখ জ্বলজ্বল করছে। মনে মনে মাকে সে অনেকবার ধন্যবাদ দিয়েছে। মা এই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পদের খাবার করে ফেলেছে। বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা, পটল ভাজা। সুরাইয়া বললেন, তুই হাসানকে দেখেশুনে খাওয়া; আমি দেখি তোর বাবার কিছু লাগে কি না।
তিতলী মনে মনে বলল, মা তুমি এত ভালো কেন? আমি কোনোদিনও তোমার মতো ভালো মেয়ে হতে পারব না। হাজার চেষ্টা করলেও পারব না।
হাসান কিছু খেতে পারছিল না। একটু ডিম ভেঙে মুখে দিল। বেগন ভাজা দিয়ে ভাত মেখে এক পাশে সরিয়ে রাখল।
তোমার প্রাইভেট টিউশ্যানি কেমন চলছে?
ভালো।
আর ওই যে জীবনী লেখার কাজ। লিখছ?
হুঁ।
ভদ্রলোকের নাম যেন কী?
হিশামুদ্দিন।
তাঁকে তুমি বল না কেন একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে। তাঁকে বল–স্যার আমি চাকরিও করব। আর ফাঁকে ফাঁকে আপনার জীবনীও লিখব।
হাসান জবাব দিল না। তিতলীর খুব ইচ্ছে করছে হাসানকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। সাহসে কুলোচ্ছে না, কখন হুট করে মা ধুকে পড়বেন। তাছাড়া হাত ছয়ে দেখতে হলে অজুহাত লাগে। তেমন কোনো অজুহাতও মাথায় আসছে না। ‘তোমার গালে এটা কী?’ এই বলে কি গালটা ছুঁয়ে দেখা যায় না?
তিতলী বলল, খাচ্ছ না কেন?
রুচি হচ্ছে না। জ্বর আসছে বোধহয়।
দেখি তো জ্বর কিনা!
তিতলী হাসানের কপালে হাত রেখে চমকে উঠল। জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। এত জ্বর নিয়ে কেউ খেতে বসে? তার উচিত গায়ে চাদর জড়িয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকা। জ্বর নিয়ে তার আসার দরকার ছিল কী। সে তো তাকে আসার জন্যে খবর দেয় নি।
তোমাকে খেতে হবে না। তুমি হাত ধুয়ে ফেল।
হাসান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বেসিনের কাছে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল। তিতলী বলল, লেবু দিয়ে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দেব?
না।
জ্বর নিয়ে আসার দরকারটা ছিল কী?
তোমার টাকাটা নিয়ে এসেছি।
টাকার জন্য কি আমি মরে যাচ্ছিলাম?
এখন দিতে না পারলে পরে হাত খালি হয়ে যাবে। দিতে পারব না।
সামান্য দুশ টাকা–আশ্চর্য! খবরদার ওই টাকা তুমি আমাকে দেবে না। তোমার কাছে থাকুক সুদে-আসলে বাড়ুক।
বমি বমি লাগছে। তিতলী ঘরে পান আছে?
আছে। তুমি বসার ঘরে গিয়ে বোস। এ কী! তুমিতো দেখি ঠিকমতো হাঁটতেও পারছি না। বাসায় যাবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না, রিকশা নিয়ে চলে যাব।
তিতলী চিন্তিত গলায় বলল, এক কাজ কর-আজ থেকে যাও। বসার ঘরের খাটে মশারি খাটিয়ে দিচ্ছি। এত জ্বর নিয়ে তুমি কোথায় যাবে?
আরে না, তুমি কী যে বল! তোমার বাবা যদি ভোরবেলা উঠে দেখেন আমি শুয়ে আছি–তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দেবেন।
আমি মাকে বলি। মাকে বললেই মা ব্যবস্থা করে দেবে।
উনাকে কিছু বলবে না।
মা এত জ্বর নিয়ে তোমাকে কিছুতেই একা যেতে দেবে না।
উনাকে কিছু বলার দরকার নেই। তিতলী আমি যাচ্ছি।
পান। পান খাবে না?
উহুঁ।
বৃষ্টি পড়ছে তো, বৃষ্টির মধ্যে যাবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না।
জ্বর নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে?
হুঁ।
পাগলের মতো হুঁ হুঁ করছ কেন? ভালোমতো কথা বল।
হাসান হেসে ফেলল। তিতলীর অস্থিরতার মধ্যে শিশুসুলভ একটা ব্যাপার আছে, যা দেখতে ভালো লাগে।
হাসছ কেন?
জ্বর হলে হাসতেও পারব না?
জ্বর নিয়ে তুমি এলে কেন? কে তোমাকে আসতে বলেছে?
হাসান আবারো হাসল। তিতলী বিরক্ত মুখে বলল, কথায় কথায় হাসবে না।
আচ্ছা যাও হাসব না।
তিতলী হাসানের হাত ধরল। ধরেই থাকল। মা এসে দেখে ফেললে দেখবে। সে কিচ্ছু কেয়ার করে না। তার চোখে এখন পানি এসে গেছে। হাসানের হাত ধরলেই তিতলীর চোখে পানি আসে।
হাসান নিজেই দরজা খুলল। ভালো বৃষ্টি নেমেছে। বাতাস নেই। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরাসরি নেমে আসছে, বাঁকাভাবে আসছে না। বাতাস থাকলে বৃষ্টি ধরে যেত— বাতাস জলভর্তি মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যেত। আজ মেঘ উড়ে যাবে না। অনেক রাত পর্যন্ত বৃষ্টি পড়তেই থাকবে। আজ রাতটা হচ্ছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর রাত। হাসান বৃষ্টির ভেতর এগোচ্ছে। দরজা ধরে তিতলী দাঁড়িয়ে আছে। হাসানের ইচ্ছা করছে। ঘাড় ফিরিয়ে একবার তিতলীকে দেখে। ইচ্ছাটা সে চাপা দিল। মেয়েটার কান্না কান্না মুখ না দেখাই ভালো। হাসানের শরীর কাঁপছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। রবফের কুঁচির মতো গায়ে এসে লাগছে। চামড়া ভেদ করে ঠাণ্ডা ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতর। এমন প্রবল বৃষ্টিতে সুপ্রিয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হেঁটে হেঁটে পুরানা পল্টন থেকে ঝিকাতলা যাওয়া কি সম্ভব?
হাসান প্যান্টের পকেটে হাত দিল–টাকার বান্ডিলটা আছে তো? ডান প্যান্টের পকেটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা তিন হাজার টাকা আছে। তিনটা পাঁচ শ টাকার নোট, বাকি সব এক শ টাকার নোট। সুমির মা তাঁকে তিন হাজার টাকা দিয়েছেন। সুমিকে তিন মাস ইংরেজি এবং অঙ্ক শেখানোর পারিশ্রমিক। টাকা দেবার সময় ভদ্রমহিলা শুকনো মুখে বললেন, টাকাটা দিতে দেরি হলো কিছু মনে করবেন না। আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম মেয়ের বাবা প্রতি মাসে টাকা পাঠান না, তিন-চার মাস পর পর একসঙ্গে পাঠান। হাসান হাসিমুখে বলল, কোনো অসুবিধা নেই। একসঙ্গে পেয়ে আমার বরং সুবিধাই হলো।
টাকাটা গুণে নিন।
গুণতে হবে না।
গুণতে হবে না কেন? অবশ্যই গুণতে হবে। গুণুন।
ভদ্রমহিলা সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাসান টাকা গুণল। সব চকচকে নতুন নোট। নতুন নোটের গন্ধ শুকে ভালো লাগে। ভদ্রমহিলার সামনে এই কাজটা করা যাবে না।
হাসান সাহেব।
জ্বি।
আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আমার মেয়েকে আমি নিজেই পড়াব। আপনার আর আসার দরকার নেই।
হাসানের মন খারাপ হয়ে গেল। তার তিনজন ছাত্রছাত্রী আছে। তিন জনের ভেতর সুমি মেয়েটা অন্যরকম। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে টুকটুক করে গল্প করে। প্রতিটি গল্পই খুব মজার। বেণি দুলিয়ে যখন গল্প করে তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
স্যার, আমার বাবার যে অসম্ভব বুদ্ধি এই গল্পটা কি আপনাকে বলেছি?
না তো!
বাবার অসম্ভব বুদ্ধি। বুদ্ধিতে বাবার নাম্বার হলো এক শ-তে এক শ দশ।
এক শ-তে এক শ দশ কীভাবে হয়?
সবার জন্যে হয় না, বাবার জন্যে হয়।
তাই বুঝি?
হাঁ তাই। বাবার বুদ্ধি যে এক শ-তে এক শ দশ এটা কে বলে জানেন স্যার?
না জানি না। কে বলে?
আমার মা বলেন। আর কী বলেন জানেন?
জানি না।
আর বলেন–মানুষের এত বুদ্ধি থাকা ভালো না।
তোমার বুদ্ধি কেমন?
এখন আমার বুদ্ধি কম, তবে আমি যখন বড় হব তখন আমার বুদ্ধিও হবে এক শতে এক শ দশ। স্যার আসুন। এখন আমরা পড়াশোনা করি। অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছি তো মা টের পেলে রাগ করবেন।
হাসান টাকা গোণা শেষ করেছে। সুমির মা বললেন, রাবার ব্যান্ড দিচ্ছি, রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নিন। আর শুনুন আমার মেয়েটা আপনাকে খুব পছন্দ করে। ওর বাবা বিদেশে–মেয়েটা একা একা থাকে, কথা বলার কেউ নেই। আপনি মাঝেমধ্যে এসে সুমিকে দেখে যাবেন।
জ্বি আচ্ছা। সুমিকে একটু ডাকুন। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাই।
ওকে ডাকার দরকার নেই। আপনি চলে যাচ্ছেন সে জানে। কান্নাকাটি করতে পারে।
এতগুলো টাকা পকেটে থাকলে মনের বিষন্ন ভাব কেটে যায়! হাসানের কাটে নি। সে সুমিদের বাসা থেকে বের হবার সময় একবার ভাবল বলে–আমাকে কোনো টাকাপয়সা দিতে হবে না। আমি সপ্তাহে তিন দিন এসে আপনার মেয়েকে পড়িয়ে যাব। বলা হয় নি। লাজুক ধরনের মানুষ বেশির ভাগ সময়ই মনের কথা বলতে পারে না। মনের কথা হড়বড় করে শুধুমাত্র পাগলরাই বলতে পারে। পাগলরা সেই কারণেই মনে হয় সুখ।
বড় রাস্তায় নেমেই হাসান রিকশা পেয়ে গেল। একটা না, তিনটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই ঝিকাতলা যাবার জন্যে প্রস্তুত। হঠাৎ এ রকম সৌভাগ্যের কারণটা কী? সৌভাগ্যের পরই দুৰ্ভাগ্য আসে। তাকে কি পথে হাইজ্যাকার ধরবে? ধরতে পারে। ধরলে মানিব্যাগ হাতে তুলে দিতে হবে। মানিব্যাগে দুটা এক শ টাকার নোট আছে। ওরা হাসিমুখে মানিব্যাগ নিয়ে চলে যাবে। প্যান্টের পকেটে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা তিন হাজার টাকার খোঁজ করবে না। তবে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে ঝড়বৃষ্টির রাতে দেখা হবার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। ঝড়বৃষ্টির রাতে তারা মজা করে নেশাটেশা করে। বৃষ্টিতে ভিজে হাইক্যাকিং করা রতাদের পোষায় না।
জ্বর সম্ভবত আরো বেড়েছে। হাসানের শরীর থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে রিকশায় পড়ে গেলে সমস্যা হবে। হাসান দু হাতে রিকশার হুড ধরে আছে। রিকশাওয়ালার হয়তো ধারণা হয়েছে সে রিকশা চালাচ্ছে না, স্পোর্টস কার চালাচ্ছে। রাস্তার পানি কেটে রিকশা শাঁ শাঁ করে এগোচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে আছে। গর্তখানা-খন্দ কিছুই চোখে পড়ছে না। হাসানের কেবলি মনে হচ্ছে কোনো একটা গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে যাবে।
রিকশাওয়ালাকে রিকশা আস্তে চালাতে বলতেও ইচ্ছা করছে না। হাসানের মনে হচ্ছে–তার কথা বলার শক্তিও নেই।
ঝিকাতলা গলির মুখে এসে রিকশা থামল। এরচে’ ভেতরে আর যাবে না। গলিতে একহাটু পানি। ছোটখাটো একটা খাল তৈরি হয়ে গেছে। স্রোতের মতো পানি বইছে–কল কল শব্দও হচ্ছে।
হাসান রিকশা ভাড়া মিটিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে রাবার ব্যান্ডে মোড়া তিন হাজার টাকার প্যাকেটটা নেই। রিকশার সিট খালি–পা রাখার জায়গাটাও খালি।
রিকশাওয়ালা বলল, ভাইজান আপনার কি শইল খারাপ?
হাসান ক্লান্ত গলায় বলল, হুঁ।
তাইলে টাইট হইয়া বহেন লইয়া যাই। জুম বৃষ্টি নামছে–সোভানাল্লাহ কী অবস্থা!
হাসান রিকশা থেকে নেমে গেল। রিকশায় টাইট হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। গলির নোংরা পানিতে পা টেনে টেনে হাসান এগোচ্ছে। বৃষ্টি নেমেছে আকাশ ভেঙ্গে। হাসানের মনটা খুব খারাপ। তিন হাজার টাকা তার কাছে অনেক টাকা। এই টাকার শোক ভুলতে তার দীর্ঘদিন লাগবে। তিতলী দুশ টাকা পেত, সেই টাকাটাও তাকে দেয়া হলো না। আবার কবে তার হাতে টাকা আসবে কে জানে!
রাত যত বাড়ছে বৃষ্টি ততই বাড়ছে। তিতলী শুয়েছে জানালার পাশে। জানালা দিয়ে ছাট এসে তাকে প্রায় ভিজিয়ে দিচ্ছে। সুরাইয়া উঠে বসলেন, তিতলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, জানালাটা বন্ধ করে দে। ভিজে যাচ্ছিস তো!
ভিজছি না।
ভিজছিস না মানে–গা তো অর্ধেক ভেজা।
সুরাইয়া জানালা বন্ধ করার জন্য এগোলেন। তিতলী করুণ গলায় বলল, পায়ে পড়ি মা। জানালা খোলা থাকুক।
শেষে একটা অসুখ-বিসুখ বাঁধাবি।
আমার কিছু হবে না।
তিতলী গুটিসুটি মেরে মায়ের কাছে ঘেঁষে এল। সুরাইয়া মেয়ের গায়ের ওপর একটা হাত তুলে দিলেন। মেয়ের জন্য আজ তাঁর মনটা খুব কাঁদছে। তিতলীর সামনে ভয়াবহ দুঃসময়। তিতলীর বড় ফুফু তিতলীর বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক করে ফেলছেন। ছেলে খুবই ভালো, জিওলজিতে মাস্টার্স করে ইউনিভার্সিটির লেকচারার হয়েছে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েছে। বউ নিয়ে পিএইচডি করতে যাবে কানাডায়। তারা এসে কয়েক দফায় তিতলীকে দেখে গেছে। মেয়ে পছন্দ কি অপছন্দ হয়েছে এমন কিছু বলছে না।
তবে পছন্দ তো হয়েছে নিশ্চয়ই–নয়তো দফায় দফায় মেয়ে দেখত না। তিতলীর ফুফু আজ এসেছিলেন, তিনি সুরাইয়াকে আড়ালে ডেকে বলেছেন–ওরা খবর পাঠিয়েছে মেয়ে ওদের পছন্দ। তারপরেও একটু খোঁজখবর করছে–ফাইনাল কথা আগামী সপ্তাহে বলবে। আল্লাহ আল্লাহ কর।
যদি শেষ পর্যন্ত ওরা পছন্দ করে ফেলে তিতলীকে সেখানেই বিয়ে দিতে হবে। বড় ফু ইচ্ছার বাইরে যাবার ক্ষমতা তিতলীর নেই। তিতলীর কেন, এ বাড়ির কারেই নেই।
জ্বি মা।
হাসানের কি একটা এনজিওর চাকরি যে হবার কথা ছিল হয় নি?
হয়েছিল। সে যায় নি–গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়, বেতনও খুব কম।
কত বেতন?
আঠার শ টাকা।
বলিস কী! মাত্র আঠার শ টাকা?
হুঁ।
সুরাইয়া বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন–তিতালরি শরীর কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি মেয়েকে আরো কাছে টেনে নিলেন।
তিতলী!
জ্বি মা।
কাঁদছিস নাকি?
তিতলী জবাব দিল না, তবে তার ফোঁপানির শব্দ শোনা গেল।
কাঁদছিস কেন?
তিতলী অস্পষ্ট স্বরে বলল, ফুফু তোমাকে আড়ালে নিয়ে কী বলেছে?
কিছু বলে নি।
আমি জানি বলেছে। মা শোন, আমি এখন বিয়ে করব না।
তোর ফুফু চাইলে না করবি কীভাবে?
তিতলী জবাব দিল না। তার শরীরের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। সে নিজেকে সামলেছে। সুরাইয়া নরম গলায় বললেন, একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে অনেক বড় ব্যাপার। বিয়ে হলো তার নিজের ঘর-সংসার। সুন্দর ঘর-সংসার সব মেয়েই চায়। চায় না?
হুঁ।
একটা বেকার ছেলেক বিয়ে করে অভাব-অনটনে সারা জীবন কাটানোর কোনো মানে হয় মা? প্রেমের চেয়েও টাকা-পয়সা অনেক বেশি জরুরি।
এখন এইসব কথা থাক মা। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাক।
তোর ফুফুরা তোর জন্যে যে বিয়েটা দেখছে সেটা যদি হয় তাহলে তোর জন্যে কিন্তু ভালো হবে। বরের সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবি। ঢাকা শহরে নিজের বাড়িতে থাকবি…
মা চুপ কর তো।
টাকা-পয়সাটা যে কত জরুরি সেটা কি তুই আমাদের এই সংসার দেখেও বুঝতে পারছিস না? তোর বাবার চাকরি নেই–সংসার চালাতে হয় ফুফুদের দেয়া টাকা থেকে। তোর ফুফুদের কথা আমরা ফেলব কীভাবে? মা, ঘুমিয়ে পড়েছিস?
তিতলী জবাব দিল না। তার আবারো কান্না পাচ্ছে। খুব সাবধানে কাঁদতে হবে। মা যেন টের না পায়। মা টের পেলে মনে কষ্ট পাবে। তিতলী কাউকে কষ্ট দিতে চায় না। কষ্ট দিতে না চাইলেও তাকে কষ্ট দিতে হবে। হাসানকে ছাড়া সে বাঁচবে না। সে যদি পথে পথে চক্ষা করেও বেড়ায় তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। দেশ-বিদেশ দেখে কী হবে? সে তার একটা জীবন হাসান ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে।
তাছাড়া কোনো একটা চাকরি তো হাসান ভাইয়ের অবশ্যই হবে। তখন তারা ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করবে। দু কামরার ঘর হলেই তাদের চলবে। একটা শোবার ঘর, একটা বসার ঘর। এক চিলতে বারান্দা থাকলে খুব ভালো হয়। বারান্দায় সে ফুলের টব রাখবে। কোনো এক সময় তাদের সংসারে একটা বাবু আসবে। বাবুর নামও সে ঠিক করে রেখেছে।
সুরাইয়া ভারি ভারি নিঃশ্বাস ফেলছেন। তিতলীর ঘুম আসছে না। তার খুব অস্থির লাগছে। হাতের আঙুল কাঁপছে। হাসানের আশপাশে থাকলে তার এ রকম হয়। নির্জনে যখন হাসানের কথা ভাবে তখনো হয়। বিয়ের পরেও কি এ রকম হবে? নাকি সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে! বাবা যেমন মায়ের সঙ্গে কঠিন গলায় কথা বলেন, হাসানও তার সঙ্গে কঠিন গলায় কথা বলবে? না, তা সে কখনো হতে দেবে না। তিতলী খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। হাসানের চিঠিটা আরেকবার পড়তে ইচ্ছে করছে। সে বারান্দায় চলে যাবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিঠিটা আরেকবার পড়বে।
হাসানের চিঠিগুলো খুব সাদামাটা ধরনের হয়। আবেগের কথা কিছুই থাকে না, তবু চিঠি চোখের সামনে ধরলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কেন এ রকম হয়?
তিতলী, কদিন ধরে আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গেলেই উদ্ভট স্বপ্ন দেখি। একটা স্বপ্ন বেশ কয়েকবার দেখে ফেললাম-স্বপ্নটা হচ্ছে। আমি একদল হাসের সঙ্গে ঘুরছি। শামুক গুগলি খাচ্ছি। কী বিশ্রণী স্বপ্ন তাই না? আচ্ছা শোন হাস বানানে কি চন্দ্ৰবিন্দু আছে? যদি থাকে তুমি দিয়ে নিও।
ইতি
হাসান।
হাসান এই হচ্ছে চিঠি। কষ্ট করে কি আরো কয়েকটা লাইন লেখা যেত না? সে কি লিখতে পারত না
‘তিতলী শোন, আমি সারাক্ষণ তোমার কথা ভাবি। সারাক্ষণ আমার ইচ্ছা করে তোমার হাত ধরে বসে থাকতে। সেই দিন কবে। যে আসবে আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। চল আমরা কোর্টে বিয়ে করে ফেলি–তারপর যা হবার হবে।
না হাসান এই জাতীয় কথাবার্তা কখনো লিখবে না। তার চিঠিগুলো হলো কাজের চিঠির মতো।
তিতলী ঘুমোতে এল। বৃষ্টি আরো প্রবল হয়েছে। তারা যখন সংসার করবে। তখন বৃষ্টির রাতগুলো ঘুমিয়ে নষ্ট করবে না। তিতলী মায়ের গায়ে হাত উঠিয়ে দিল। সুরাইয়া মেয়েকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নিয়ে বললেন, চিঠিতে কী লেখা যে একটু পর পর পড়তে হচ্ছে? তিতলীর হাত-পা শক্ত হয়ে গেল। সুরাইয়া হাসলেন। অন্ধকারে সেই হাসি তিতলী দেখতে পেল না–সে গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকের কাছে চলে এল।
মে মাসের কড়া ঝাঁঝালো রোদ
মে মাসের কড়া ঝাঁঝালো রোদ এসে পড়েছে। হাসানের মুখের ওপর। রোদ ঠেকাবার জন্যে হাসানকে উঠে জানালা বন্ধ করতে হবে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। হাসানের বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা নেই, জানালা বন্ধ করা তো অনেক পরের ব্যাপার। তার গায়ে এক শ তিন পয়েন্ট পাঁচ জ্বর। রীনা কিছুক্ষণ আগে জ্বর মেপেছে। জ্বর থার্মেমিটারে মাপা হয় নি, বাসায় থার্মেমিটার নেই। রীনা কপালে হাত রেখে গভীর গলায় বলেছে, এক শ তিন পয়েন্ট পাঁচ। জ্বরের ক্ষেত্রে রীনার অনুমান ভালো। জ্বর মনে হয় বাড়ছে। গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। মুখের ওপর রোদটা আগেও ছিল। তখন এতটা খারাপ লাগছিল না। এখন অসহ্য বোধ হচ্ছে। রোদটা মনে হচ্ছে তরল আকার নিয়েছে। মুখ থেকে গড়িয়ে চোখের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে।
হাসান কয়েকবার ডাকল, এদিকে কে আছে? এই এই! ডাক তেমন জোরালো হলো না কিংবা জোরালো হলেও কেউ শুনল না। সকালবেলার কয়েকটা ঘণ্টা বাড়ির লোকজন সীমাহীন ব্যস্ততায় থাকে। সকাল আটটা থেকে সাড়ে ন’টা এই দেড় ঘণ্টা সময়ের ভেতর তারেক অফিসের দিকে রওনা হন। অফিসে যাবার প্রস্তুতি পর্ব শেষ হতে তার পুরো এক ঘণ্টা লাগে। তিনি কোনো জিনিসই খুঁজে পান না। তার হাঁকডাক ক্ৰমাগত শোনা যেতে থাকে-আমার জুতার ভেতর মোজাজোড়া রাখলাম, একটা আছে আরেকটা গেল কোথায়? পরিষ্কার একটা রুমাল দিতে বললাম।—কথাটা কারো কানে যাচ্ছে না? এটা বলার জন্যে কি আমি মাইক ভাড়া করব? টেবিলের ওপর বড় একটা হলুদ খাম ছিল–খামের ওপর লাল কালি দিয়ে ‘Important’ লেখা। খামটা গেল কোথায়? একটু আগেও তো দেখেছি। খামের তো আর পা নেই যে হেঁটে হেঁটে মালিবাগ চলে যাবে?
তারেক সাহেবের দুই ছেলে রকেট ও বুলেটের স্কুল সাড়ে আটটায়। (আসল নাম মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এবং মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন। রকেট এবং বুলেট হাসানের ছোট ভাই রকিবের দেয়া নাম— এই নামেই তারা স্কুলে এবং বাসায় পরিচিত। তাদের সুন্দর ডাকনামও আছে টগর ও পলাশ। এই দুই নামে তাদের মা ছাড়া এখন আর কেউ ডাকে না।) তারা দু’জন এক বছরের ছোট বড় হলেও একই ক্লাসে পড়ে। যমজ ভাইদের মতো প্রতিটি কর্মকাণ্ড তারা একসঙ্গে করে। সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে দুজনেই বলে, ‘আজ স্কুলে যাব না।’ সাড়ে সাতটা থেকে আটটা এই আধঘণ্টা তাদের ওপর স্কুল যাত্রায় রাজি করানোর নানা প্রক্রিয়া চালানো হয়। কোনোটিই কাজ করে না। শেষ ওষুধ হিসেবে রীনা দু’জনের গালেই কষে চড় বসায়। দু’জন একই সঙ্গে গলা ছেড়ে কাদে। ক্ৰন্দনরত অবস্থাতেই তাদের প্রায় টেনেহেঁচড়ে রিকশায় তুলে দেয়া হয়। এদের স্কুলে পৌঁছে দেয়া এবং স্কুল থেকে আনার দায়িত্ব পালন করেন তাদের দাদুভাই আশরাফুজ্জামান সাহেব। কাজটা তিনি যে খুব আগ্রহের সঙ্গে করেন তা না। রিটায়ার্ড বাবা যদি ছেলের সংসারে বাস করতে আসেন তাহলে তাকেও কিছু কাজকর্ম করতে হয়। জগতে ফ্রি লাঞ্চ বলে কিছু নেই।
হাসানের ছোট বোন লায়লা জগন্নাথ কলেজে বি.এ. পড়ে। সে লাঞ্চবক্সে করে দুপুরের টিফিন নিয়ে যায়। তাকে এই সময় অত্যন্ত ব্যস্ত দেখা যায়। সে খুব সাজগোজ পছন্দ করে। তার ব্যস্ততা একই সঙ্গে সাজগোজের দিকে এবং টিফিন তৈরি হলো কি না। সেই দিকে। নিজের সাজগোজের ওপর লায়লার আস্থা খুবই কম। সাজের প্রতিটি পর্যায়ে সে তার ভাবির কাছে ছুটে যায়–ভাবির মতামত নিয়ে নিয়ে সাজের পরবতী ধাপের দিকে এগোয়, ভাবি টিপটা কি মাঝখানে হয়েছে? লাল টিপটাই পরব নাকি টিপ হাতে আঁকিব? ঠোঁটের লিপস্টিক কি বেশি কড়া হয়ে গেছে?
রীনা বিরক্ত হয় না। সাজসজ্জার ব্যাপারে অন্যকে পরামর্শ দেবার ব্যাপারে কোনো মেয়েরই বিরক্তি থাকে না। মেয়েরা এই কাজটা খুব আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে করে।
ঠিক ন’টার সময় ঠিকা কাজের মেয়ে ফুলির মা আসে। প্রতিদিনই তার সঙ্গে এ বাড়ির স্থায়ী কাজের মেয়ে কমলার মা’র একটা ঝগড়া শুরু হয়। কমলার মা নিচু গলায় ঝগড়া করলেও ফুলির মার গলা–কাকতাডুয়া গলা। সে চিৎকার শুরু করলেই আশপাশের কাক উড়তে থাকে। প্রতিদিনই একবার ঠিক করা হয় ফুলির মাকে আর রাখা হবে না। পাওনা গণ্ডী মিটিয়ে বিদায় করা হবে। বিদায় করা হয় না। কারণ ফুলির মার কর্মক্ষমতা অসাধারণ। ঝগড়া করতে করতেই সে অতি দ্রুত বাসনকোসন মেজে ঝকঝকে করে ফেলবে। পুরো বাড়ি ঝাঁট দেবে, কলঘরে রাখা দু বালতি কাপড় ধুয়ে চিপে দড়িতে শুকোতে দেবে। তার দায়িত্ব এই পর্যন্তই। দায়িত্ব পালনের পরেও সে যাবার আগে রীনাকে জিজ্ঞেস করবে, আর কোনো কাম আছে আফা। থাকলে তুরন্ত কন। এক বাড়িত কাম করলেই আমার শেষ না, আরো বাড়ি আছে। নিজের ঘর-সংসার আছে।
এমন একজন কাজের মানুষকে শুধুমাত্র ঝগড়া করার স্বভাবের জন্যে কেউ বিদায় করে না। মানুষ এত বোকা না!
সকালের এই ব্যস্ততা, হট্টগোল হাসান তেমন টের পায় না। কারণ তার ঘুম ভাঙে নটার পরে। ততক্ষণে হইচই থিতিয়ে আসে। চারদিকে ঝড়ের পরের শান্ত অবস্থা বিরাজ করে। আজ জ্বরের কারণে সকাল ছটা থেকে সে জেগে। বাড়ির প্রতিটি শব্দ তার কানে আসছে। প্রবল জ্বরের সময় মানুষের কান তীক্ষ্ণ হয়। নিচু শব্দও অনেক বড় হয়ে কানে বাজে। হাসান বিড় বিড় করে নিজের মনেই বলল, হইহল্লাটা একটু কমানো যায় না? গড অলমাইটি বাড়িটা একটু শান্ত করে দিন। আমার ওপর একটু দয়া করুন। প্লিজ।
হইহল্লা কমল না, বরং বাড়তে থাকল। ঝনঝনি শব্দে থালা বা কাচের জগ ভাঙল। কাচের জিনিস ভাঙার শব্দ একবার হয়েই থেমে যাবার কথা–এই শব্দ থামছে নাঝন ঝন করে বেজেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে থালাবাসনও টের পেয়েছে। এ বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ আছে। তাকে বিরক্ত করা তার পবিত্র কর্তব্য। এর মধ্যে লায়লা ঘরে ঢুকে বলল, দাদা তোর নাকি আকাশ-পাতাল জ্বর–ভাবি বলল।
হাসান জবাব দিল না। লায়লা সেন্ট মেখেছে, সেন্টের গন্ধে হাসানের গা গোলাচ্ছে। হাসান নিশ্চিত লায়লা আর কিছুক্ষণ তার ঘরে থাকলে সে বমি করে দেবে। যে কোম্পানি এই সেন্ট বানিয়েছে। সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়া দরকার।
দাদা দেখতে এই হলুদ শাড়িটা কি বেশি কটকট লাগছে?
হাসান ধমকের গলায় বলল, তুই ঘর থেকে যা তো। জাস্ট ক্লিয়ার আউট।
লায়লা হাসানের ধমকে বিস্মিত হলো না বা রাগও করল না। যেভাবে ঘরে ঢুকে ছিল, সেভাবেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তখন হাসানের মনে হলো একটা ভুল হয়েছে লায়লাকে দিয়ে জানালাটা বন্ধ করালে কাজ হতো। রোদটা আর চোখের ভেতর ঢুকে যেত না। কী বিশ্ৰী কী ভয়ংকর রোদই না। আজ উঠেছে! তরল রোদ। রোদের ভিসকেসিটি অনেক–গড়াতে গড়াতে কী সুন্দর চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে মাথাটা ভারি করে ফেলছে!
কলঘর থেকে কাপড় কাচার শব্দ এবং ফুলির মার গলাবাজি একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে–উচিত কথা আমারে শিখায়। আরো ধুমসী কাইলা মাগী–উচিত কথার ধার ফুলির মা ধারে না। তোর উচিত কথাত ফুলির মা খুক দেয়। থু থু থু।
রীনার গলা শোনা গেল— ফুলির মা চুপ কর তো।
ফুলির মার গলা আরো এক ধাপ উঠে গেল, আফা আমারে না–ধুমসী কাইলা মুঘীচুপ করতে কম। হের গলা পাও দিয়া চাইশ ধরেন। মালী আমারে উচিত কথা শিখায়।
ফুলির মা মাগী ফাগী বলবে না খবরদার!
মাগীরে মাগী বলব না তো কী বলব আফিা? ছাগী বলব? মাগীরে ছাগী বললে ছাগীরে কী বলব— বোতল বলব? আপনেই বলেন, আপনের বিচারটা কী হুনি।
চুপ কর।
আপনে চুপ করেন। অত গরম ভালো না। ফুলির মা গরমের ধার ধারে না।
হাসানের ইচ্ছা করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে–তোমরা দয়া করে চুপ করবে? দয়া করে কেউ একজন এসে আমার জানালা বন্ধ করবে? তোমরা কেউ বুঝতে পারছি না। আমার মাথার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।
হাসানের মনে হলো হঠাৎসব শব্দ কমে গেল। মাথার ভেতর জমে থাকা তরল রোগ হঠাৎ জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে গেল। হাসানের ঘুম ঘুম পেতে লাগল।
তার সত্যি ঘুম পাচ্ছে, না সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? প্ৰচণ্ড জ্বরে অজ্ঞান হয়ে যাবার কথা সে অন্যের কাছে শুনেছে। তার বেলায় এই প্রথম ঘটছে। খুব খারাপ তো লাগছে। অজ্ঞানটা আরো আগে হতে পারলে ভালো হতো। হাসান জীণ গলায় ডাকাল–ভাবি, ভাবি।
মাথায় ঠাণ্ডা পানির ধারা। কেউ একজন চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কে পানি ঢালছে? চোখ মেললেই দেখা যায়–চোখ মেলতে ইচ্ছা করছে না। বাসায় পানি ঢালার মানুষ নেই। কমলার মা কি পানি ঢালছে? মনে হচ্ছে কমলার মা। তবে কমলার মা মাথায় পানি ঢাললেও চুলে বিলি কাটবে না। তাহলে কে? চোখ মেলে কি দেখবে? না, দেখতে ইচ্ছা করছে না। যার ইচ্ছা পানি ঢালুক কিছু যায় আসে না।
হাসান!
জ্বি ভাবি।
একটু কি ভালে লাগছে?
হুঁ।
তোমার জ্বর কত উঠেছে জান?
না।
এক শ পাঁচ। আমি বাড়িওয়ালাদের বাসা থেকে থার্মেমিটার। এনে জ্বর মেপে হতভম্ব! তুমি অচেতনের মতো হয়ে ছিলে। মুখ দিয়ে ফেনা টেনা বের হয়ে বিশ্ৰী কাণ্ড। উঠে বসতে পারবে?
উঠে বসতে হবে কেন?
দুটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিতাম। জ্বরটা কমত।
শুয়ে শুয়ে খেতে পারব। দাও ট্যাবলেট দুটা দাও।
গলায় আটকাবে তো?
আটকাবে না।
হাসান শোন, পুরো এক ঘণ্টা তোমার মাথায় পানি ঢালা হয়েছে, গা স্পঞ্জ করা হয়েছে। আমার ধারণা জ্বর অনেকটা কমেছে। আমি দেয়ালে ঠেস দিয়ে তোমাকে বসিয়ে দিচ্ছি। তুমি বসে প্যারাসিটামল খাও। ঘণ্টাখানিকের মধ্যে জ্বরটা আরো কমবে তখন নাশতা নিয়ে আসব। দাঁড়াও মাথাটা আগে মুছে দি।
হাসানকে ধরে উঠাতে হলো না, সে নিজেই উঠে বসল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। রীনা তার কোলে একটা বালিশ দিয়ে দিল। জ্বর কতটা কমেছে দেখতে পারলে হতো। সম্ভব না–কারণ থার্মোমিটার কিছুক্ষণ আগে টেবিল থেকে পড়ে ভেঙেছে। বাড়িওয়ালাকে এই জাতীয় আরেকটা থার্মোমিটার কিনে দিতে হবে। আজ দিনের মধ্যেই কিনতে হবে। সন্ধ্যার মধ্যে থার্মোমিটার পাঠানো না হলে লোক চলে আসবে। তাদের বাড়িওয়ালা কঠিন বস্তু।
এখন কি একটু ভালো লাগছে?
হুঁ।
রাত দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরাজ্বরি তো হবেই।
মাঝে মাঝে অসুখ-বিসুখ হওয়া ভালো, সেবা পাওয়া যায়।
অসুখ-বিসুখ ছাড়াই সেবা পাওয়ার লোক নিয়ে এসো–চোখ বন্ধ করে বসে আছ কেন? তাকাও।
আলো চোখে লাগছে ভাবি।
লাগুক। চোখ বন্ধ করে বসে থাকবে না। বিশ্ৰী লাগে। তোমার ভাইয়েরও একই অভ্যাস। খাটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা আর পা নাচানো। মনে হয় তার একটা পা স্প্রিঙের। বাতাস পেলেই দোলে।
হাসান চোখ মেলল। আলোটা এখন আর তেমন চোখে লাগছে না। শরীর ঘামছে, জ্বর মনে হয়। সত্যি সত্যি কমছে। তবে সিগারেট খাবার ইচ্ছা এখনো হচ্ছে না। যখন হবে তখন বুঝতে হবে। জ্বর পুরোপুরি কমে গেছে। হাসান রীনার দিকে তাকিয়ে হাসল। একবার ভাবল বলে–ভাবি আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। শেষ পর্যন্ত বলল না। রীনা ভাবির মুখ খুব আলগা–ফট করে এমন এক কথা বলবে যে অস্বস্তিতে মুখটুক শুকিয়ে যাবে। ভাবি সেটা নিয়ে দিনের পর দিন ঠাট্টা করে বেড়াবে। একদিন রীনা হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরেছিল, চুলগুলো ছিল ছাড়া। হাসান তাকে দেখে মুগ্ধ গলায় বলেছিল–তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন ভাবি? রীনা গভীর গলায় বলল, তুমি কি রবীন্দ্ৰনাথ?
তার মানে?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বউদির প্রেমে পড়েছিলেন। তোমারও মনে হয় সেই অবস্থা।
হাসান দারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। রীনা সহজ ভঙ্গিতে বলল, চোখমুখ এমন করে ফেলেছ কেন? বউদিদের প্রেমে পড়া এমন কোনো ভয়াবহ অপরাধ না। এ দেশের সমাজ ব্যাপারটা সহজভাবেই দেখে। প্রেম খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছলে দেবরকে বিয়ে দিয়ে দেয়। বউয়ের সঙ্গে এক রাত কাটাবার পর সব প্ৰেম শেষ। প্রেমের সলির সমাধি হয় না–হয় বিছানা সমাধি।
রীনার রসিকতা এখানে শেষ হলেও হতো। শেষ হয় নি। সেদিনই রীনা হাসানের সামনে তার বড় ভাইকে বলল, ঘটনা শুনেছ? তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা তো আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভাইকে এক্ষুনি বিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। আর দেরি করলে সে আমাকে প্ৰেমপত্র-টত্র লিখে ফেলবে। তখন যন্ত্রণা হবে। ইট ইজ হাই টাইম।
হাসানের লজ্জায় মরে যাবার মতো অবস্থা। এ জাতীয় বিপজ্জনক মহিলার সঙ্গে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হয়। হাসান খুবই সাবধানে কথা বলে। তারপরেও মাঝে মাঝে বিশ্ৰী ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়।
রীনাকে আজ আসলেই খুব সুন্দর লাগছে। কে বলবে এই মহিলা ত্রিশ বছর পার করে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে হালকা পাতলা গড়নের এক কিশোরী–আজ মজা করে শাড়ি পরে বড় সেজেছে।
আজ কী বার ভাবি?
সোমবার।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ কেন?
সোমবার আমার জন্যে খুব খারাপ। ভয়াবহ সব সমস্যা হয় সোমবারে।
তোমার তো শুধু সোমবার খারাপ। আমার সব বারই খারাপ।
ভাবি চা খাব৷
শুধু চা?
চায়ের সঙ্গে একটা টেস্ট খেতে পারি। জ্বর মনে হয় কমে যাচ্ছে ভাবি। ঘাম দিচ্ছে।
ভেরি গুড–শোন তোমার টাকাটা ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি। তুমি এত অসাবধান কেন?
হাসান বিস্মিত হয় বলল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না ভাবি কীসের টাকা?
কাল রাতে যে ভেজা প্যান্ট কলঘরে ছেড়ে এলে তার হিপ পকেটে তিন হাজার টাকা। রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা। কাপড় ধুতে গিয়ে ফুলির মা পেয়েছে–আমাকে দিয়ে গেছে।
বল কী?
বল কী মানে? টাকার কথা জানতে না? অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর হয়, অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড বেকার হয় বলে তো জানতাম না। কোথায় পেয়েছ এত টাকা?
টিউশ্যানির টাকা ভাবি। সুমি বলে একটা বাচ্চা মেয়েকে পড়াতাম। তিন মাসের টাকা এক মাসে দিয়ে চাকরি নটি করে দিয়েছে।
কেন?
পড়াতে পারি না। এই জন্যে বোধহয়।
পড়াতে পার না?
নাহ্–পড়াতে গিয়ে শুধু গল্প করি।
বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে এত কীসের গল্প?
বাচ্চাদের সঙ্গে গল্পই সবচে’ ইন্টারেস্টিং ভাবি। যা ইচ্ছা বলতে পারেন। ওরা মন দিয়ে শুনবে। বড়দের সঙ্গে গল্প করা খুব সমস্যা। প্রতিটি কথা ভেবেচিন্তে বলতে হয়।
আমার সঙ্গে গল্প করার সময়ও কি তুমি প্রতিটি কথা ভেবে চিন্তে বল?
রীনা ঠোঁট টিপে হাসছে। হাসান সাবধান হয়ে গেল। ভাবির মতলব ভাল নাকোনো একটা প্যাচে ফেলে দেবে।
চা খাব ভাবি।
চা, টেষ্ট, সিদ্ধ ডিম?
হ্যাঁ।
মাথাটা এগিয়ে আন তো জ্বরের অবস্থা দেখি। এ কী! লজ্জায় এমন লাল হয়ে যাচ্ছে–তুমি কি সত্যি সত্যি আমার প্রেমে পড়েছ নাকি? আশ্চর্য কাণ্ড!
রীনা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারটা প্ৰায় বাজে, আজ হাফকুল, বাচ্চাদের এগারটার মধ্যে চলে আসার কথা–এখনো আসছে না কেন? অস্পষ্ট কুয়াশার মতো দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যদিও রীনা জানে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাবা সঙ্গে আছেন। ট্রাফিক জ্যামট্যামে রিকশা নিশ্চয়ই আটকা পড়েছে।
আজ দুপুরে কী রান্না হবে সেটাও দেখতে হবে। বাজার হয় নি। রোজকার বাজার হাসান করে দেয়; আগে সপ্তাহের বাজার করে ফ্রিজে রাখা হতো। ফ্রিজ কাজ করছে না। নতুন গ্যাস ভরতে হবে। দোকান থেকে ডিম আনিয়ে ডিমের তরকারি করা ছাড়া উপায় নেই। ডিম আনানোর লোক নেই। কমলার মাকে পাঠানো যাবে না। তার বাড়ি থেকে বের হওয়া মানেই অ্যাকসিডেন্ট। রিকশার নিচে পড়ে যাওয়া, ড্রেনে পড়ে যাওয়াএকবার মাইক্রোবাসের ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে দুদিন ছিল হাসপাতালে। আরেকবার পান। কিনতে গিয়ে কুকুরের কামড় খেয়ে এল। মহাখালিতে নিয়ে নাভিতে ইনজেকশন–শতেক যন্ত্রণা।
রীনা রান্নাঘরে ঢুকল। গ্যাসের চুলা দুটিই জ্বলছে। চুলায় কিছু নেই। কমলার মা নির্বিকার ভঙ্গিতে সুপারি কাটছে। কমলার মা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পান খায়। পানের খরচ তাকে আলাদা দিতে হয়।
কমলার মা?
জ্বি।
একটা ডিম সিদ্ধ করা তো।
ডিম নাই আফা।
একটাও নেই?
জ্বি না। আমার পানও ফুরাইছি। সকাল থাইক্যা সুপারি চাবাইতাছি। অখন একটা পান না খাইলে দমফুটা লাইগ্যা মিত্যু হবে।
হবার দরকার নেই–যাও পান নিয়ে আসো। দু হালি ডিম আনবে। আজ ডিমের রকারি করবে। ঘরে বেগুন আছে না? বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি। এস টাকা নিয়ে যাও। রাস্তা সাবধানে পার হবে কমলার মা। গ্যাসের চুলা নিভিয়ে দিয়ে যাও–শুধু শুধু জ্বলছে কেন?
রীনার সংসারের টাকা ষ্টিলের আলমারিতে চকলেটের খালি টিনে আলাদা করে থাকে। আজ মাসের ২৫ তারিখ, সেই টিন খালি। রীনা তা জানে তারপরেও টিন খুলল। টিন আসলেই খালি–একটা চকচকে দশ টাকার নোট পড়ে আছে। টাকার বাক্স পুরোপুরি খালি রাখতে নেই বলেই দশ টাকার নোটটা আছে।
আরেকটা চিনের কৌটা আছে তার শোবার ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে। ইমার্জেন্সি ফান্ড। সেটাও খালি। টাকা-পয়সার এই শোচনীয় অবস্থার কথা তারেককে সে দুদিন আগেই বলেছে। তারেক বলেছে ব্যবস্থা করছি। আজ তার কিছু টাকা আনার কথা। আজ না আনলে আগামীকাল বাচ্চাদের স্কুলেও পাঠানো যাবে না। এই মাসটা তাও কোনোক্রমে পার হয়ে গেলা-সামনের মাসটায় কী হবে কে জানে! এ মাসে বাড়ি ভাড়া পুরোটা দেয়া হয় নি। এক হাজার টাকা কম দেয়া হয়েছে। সামনের মাসে বাড়ি ভাড়ার সঙ্গে এক হাজার টাকা বেশি দিতে হবে। বাড়তি এক হাজার টাকাটা আসবে কোথেকে?
এই বাড়িওয়ালা এমন না যে তাকে বাচ্চাদের মতো ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা যাবে। সে ঠিকই সামনের মাসে দু তারিখে সস্তা কিছু লিজেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হবে। হাসিমুখে ডাকবে রীনা বউমা কোথায়? রকেট-বুলেট কোথায়? এই দুজনকে দিনে একবার না দেখলে ভালো লাগে না।
টাকা-পয়সার এই অশান্তি রীনার অসহ্য বোধ হচ্ছে। কোনোখান থেকে একবার হাজার পঞ্চাশেক টাকা পাওয়া গেলে খুচরা ঋণগুলো দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা যেত। সেই সম্ভাবনা নেই। হার্ডওয়ারের দোকানে আলাদীনের চেরাগ কিনতে পাওয়া যায় না। আলাদীনের চেরাগ ছাড়া এই সমস্যার কোনো দিন সমাধান নেই।
রীনার একটা ভারি নেকলেস আছে। তার দাদিজান বিয়ের সময় দিয়েছিলেন। পাঁচ ভরি সোনার পদ্মহার। দাদির স্মৃতিচিহ্ন। স্মৃতিচিহ্ন-ফিহী আবার কী? বেঁচে থাকাটাই সবচে’ বড় স্মৃতিচিহ্ন। হারটা বিক্রি করে দিতে হবে।
রীনা আবার হাসানের ঘরে ঢুকল। হাসান হাসিমুখে বলল, ভাবি জ্বরটা মনে হয় পুরোপুরি সেরে গেছে। একটু আগে একটা সিগারেট খেলাম।
ভালো। তোমার চা-টেস্ট এবং ডিম। চলে আসবে। শোন হাসান, তোমার তিন হাজার টাকা থেকে আমাকে কিছু ধার দিতে পারবে–শ পাঁচেক?
ভাবি তুমি পুরোটাই নিয়ে যাও। টাকাটার আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম পাওয়া যখন গেছে এটা তোমার।
আমি পাঁচ শ টাকাই নিচ্ছি বাকি টাকাগুলো দিয়ে তুমি দয়া করে কিছু ভালো কাপড়চোপড় বানাও। ইন্টারভু্যর সময় এলেই তোমার ভাইয়ের শার্ট-প্যান্ট নিয়ে তুমি দৌড়াদৌড়ি কর-আমার খারাপ লাগে। তোমার বয়েসী একটা ছেলের এক সেট ভালো কাপড়চোপড় থাকবে না, এটা কেমন কথা! আর শোন, ভালো একজোড়া জুতা তুমি অবশ্যই কিনবে। শার্ট ইন করে প্যান্ট পরবে, জুতা পরবে, চকচকে নতুন টাকার মতো স্মার্ট ভঙ্গিতে ইন্টারভু্য দিতে যাবে। তবেই না চাকরি হবে। লেবেন্ডিসের মতো ইন্টারভু্যু দিতে যাও বলেই তোমার কিছু হয় না। তুমি আমাকে দোকানে নিয়ে যেও। আমি দেখে শুনে তোমার জামাকাপড় কিনে দেব।
হাসান লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আচ্ছা।
রীনা টাকা হাতে বের হয়ে এল। তার লজ্জা লাগছে। টিউশ্যানি করে হাসান অল্প কিছু টাকাই পায় সেই টাকায় রীনাকে প্রায়ই ভাগ বসাতে হয়। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!! রীনা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ঠিক করে ফেলল পদ্মহারটা সে অবশ্যই বিক্রি করবে। সেই টাকায় একটা সেট পোশাক সে হাসানকে বানিয়ে দেবে। এটা হবে হাসানকে দেয়া তার উপহার। বাংলাদেশের দশটা ভালো ছেলের তালিকা তৈরি হলে হাসানের নাম সেখানে অবশ্যই থাকবে। এমন একটি ছেলেকে সামান্য উপহার দিতে না পারাটা খুব কষ্টের।
রীনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারটা একুশ বাজে। বাচ্চা দুটি এখনো ফিরছে না। কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয় নি তো! এত দেরি হবার তো কথা না। রীনার বুক ধড়ফড় করছে। কাল রাতে সে বাজে একটা স্বপ্নও দেখেছে—ঘরের ভেতর একটা হাতি ঘুরছে-ওঁড় দিয়ে আলনা থেকে টেনে কাপড় জামা নামাচ্ছে। স্বপ্নে হাতি দেখা খুব খারাপ। হাতির পিঠ কবরের মতো বলে হাতি দেখলে অতি প্রিয় কারো মৃত্যু হয়। রীনার হাতপা কাঁপছে। বারান্দার রেলিঙে একটা কাক বসে আছে। কী বিশ্ৰী ভঙ্গিতেই না সে তাকাচ্ছে! রীনা জানে এইসব কিছুই না, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যাবে বাবা রিকশা করে ওদের নিয়ে আসছেন। সেই কিছুক্ষণটাই অনন্তকালের মতো দীর্ঘ মনে হবে। কোনোরকম দুশ্চিন্তা ছাড়া মনের আনন্দে মানুষের বাঁচাটা কি এতই কঠিন?
বারান্দা থেকে সামনের রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। কমলার মারি এর মধ্যে চলে আসার কথা। দু হালি ডিম আর পাঁচ টাকার পান। কিনতে এত সময় লাগবে কেন? আবার কি কুকুরে কামড়েছে? চিঠির ব্যাগ হাতে পোস্টম্যান আসছে। রীনার বুক ধক করে উঠল। যদিও ধক করে ওঠার কারণ নেই। পোস্টম্যান নিশ্চয়ই তাদের বাসার দিকে আসছে না। আর আসলেই বা কী?
রীনা অস্বস্তি নিয়ে পোস্টম্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। না সে তাদের বাড়িতে আসছে না। ওই তো রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। রীনা প্ৰায় এক মাস আগে রেজিস্ট্রি করা একটা চিঠি পেয়েছিল। পত্র প্রেরকের কোনো নাম নেই। আধপৃষ্ঠায় একটি চিঠিতে লেখা–
ম্যাডাম,
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার স্বামীর অফিসে চাকরি করি। একটি বিশেষ কারণে আপনাকে এই পত্ৰ লিখছি। আমাদের অফিসে লাবণী নামে একজন অল্পবয়স্ক টাইপিষ্ট আছেন। আপনার স্বামী তারেক সাহেবের সঙ্গে তার গভীর প্রণয়। তাদের শারীরিক সম্পর্ক আছে ইহা নিশ্চিত। আমি ভেতরের খবর জানি। আপনি ঘর সামলান। বিলম্বে পাস্তাবেন।
ইতি
আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী জনৈক অচেনা বন্ধু
এই চিঠির কথা রীনা কাউকে বলে নি। উড়ো চিঠিকে কখনো গুরুত্ব দিতে নেই। রীনার হিতাকাঙ্ক্ষী অচেনা বন্ধু তাকে নামহীন চিঠি পাঠাবে না। সবচে’ বড় কথা তারেককে সে চেনে। অতি সরল ধরনের একজন মানুষ। একজন সরল মানুষের জীবন যাপনের পদ্ধতিও সরল হয়।
চিঠি পাবার পর রীনা একবার ভাত খেতে খেতে তারেককে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা! তোমাদের অফিসে লাবণী নামের কোনো মেয়ে আছে?
তারেক বিস্মিত হলো না, চমকাল না। রীনার দিকে তাকালও না–ভাত মাখতে মাখতে বলল, আছে। টাইপিস্ট। আমাদের দুজন মহিলা আছেন। ক্যাশ সেকশনে নতুন একটা মেয়েকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে। নাম সুস্মিতা।
মেয়েদের সঙ্গে তোমাদের কথা হয় না?
হ্যাঁ হয়। হবে না কেন? সুস্মিতা মেয়েটা পাগলা ধরনের–সারাক্ষণ কথা বলে।
লাবণী কম কথা বলে? ওর কথা বলার সুযোগ কোথায়! বড় সাহেবের চিঠি টাইপ করতে করতে হালুয়া টাইট।
লাবণীদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
জানি না তো কোথায়? আচ্ছা জিজ্ঞেস করে দেখব।
থাক তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না।
লাবণী দেখতে কেমন?
দেখতে ভালো। গোল মুখ। সুস্মিতা দেখতে ভালো না; মিকি মাউসের মতো দুটা বড় বড় দাঁত।
কথা এই পৰ্যন্তই। তারেক না হয়ে অন্য যে কেউ হলে জিজ্ঞেস করত–লাবণীর কথা জানতে চাচ্ছ কেন?
তারেক সেই প্রশ্ন করবে না। একজন সরল মানুষ পৃথিবীর সমস্ত প্রশ্নই সরলভাবে গ্ৰহণ করে।
রীনার মনে কোনো শঙ্কা নেই তারপরেও চিঠিটা কাউকে দেখাতে ইচ্ছা করে। হাসানকে দেখালে কেমন হয়? না, তা সম্ভব না। হাসান তাকে নিয়েই হাসাহসি করবে। অলীক এক গল্পের পেছনে সময় নষ্ট করার বা দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। দুশ্চিন্তার অনেক ব্যাপার। আমাদের চারপাশেই আছে।
বাচ্চাদের আসতে দেখা যাচ্ছে। রীনা দেখল টগর ঘুমোচ্ছে। রীনার শ্বশুর ছেলেকে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরে আছে। তবে জড়িয়ে ধরে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটার পা অনেকখানি বের হয়ে আছে। যে-কোনো সময় অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত। একটা ট্রাক কিংবা মাইক্রোবাস এসে ঘষা দিয়ে চলে গেল। ভাগ্যিস হয় নি! কমলার মাকেও আসতে দেখা গেল। ঘুমন্ত টগরকে রীনার শ্বশুর কমলার মার কোলে দেবার চেষ্টা করছেন। কমলার মা অতি সেয়ানা–সে ভুলেও নেবে না। বেচারা বুড়ো মানুষকেই নাতি কোলে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হবে।
রানার শ্বাশুড়ি আছেন কল্যাণপুরে তাঁর মেয়ের বাসায়। স্বামীর সঙ্গে রাগ করে চলে গেছেন। রাগ ভাঙিয়ে তাকেও কল্যাণপুর থেকে আনতে হবে। রীনার শ্বশুর রাগ ভাঙানোর প্রচুর চেষ্টা করছেন–প্রতিদিন একবার করে কল্যাণপুরে যাচ্ছেন। লাভ কিছু হচ্ছে না–রোজ রিকশা ভাড়া দিতে হচ্ছে। টগরের বাবা ফিরলে তাকে দিয়ে মাকে আনিয়ে নিতে হবে। ছেলে গেলে মা সুড়সুড়ি করে চলে আসবেন। এ রকম ছেলেভক্ত মা খুব কম আছে।
টগরের ঘুম ভেঙেছে। দাদার কোল থেকে নেমে সে এখন ছুটতে ছুটতে আসছে। মাথাটা সামনের দিকে বাকী করা। এটা তার মহিষ মহিষ খেলা। মহিষের মতো শিং দিয়ে সে মাকে গুতো দেবে। মহিষের বয়স পাঁচ বছর হলে কী হবে গায়ে জোর আছে। রীনা হাসিমুখে মহিষের ধাক্কা সামলানোর জন্যে রেলিং ধরে দাঁড়াল। তার এত ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আলাদীনের চেরাগ ছাড়াও বেঁচে থাকাটা এমন অসহনীয় নয়।
বাড়িওয়ালাদের কাজের মেয়েটি আসছে। মেয়েটার নাম হালিমা। খুব ভালো নাম। নরম স্বভাব। হাসিখুশি। এ রকম একটা কাজের মেয়ে থাকলে খুব ভালো হতো। রীনা হালিমাকে বলে দিয়েছে দেশে গেলে সে যেন তার মতো একটা মেয়ে নিয়ে আসে।
রীনা বলল, কী খবর হালিমা।
হালিমা হাসিমুখে বলল, আফনের টেলিফোন আইছে গো আফা। জরুরি ফোন।
বাড়িওয়ালার বাসার টেলিফোন নাম্বারে ভাড়াটেদের ফোন এলে তাদের ডাকা হয় না। কোনো দুঃসংবাদের ফোন কি এসেছে? মৃত্যু সংবাদ? রীনার বুক আবারো ধক করে উঠল। আজকের দিনটা তার জন্যে খারাপভাবে শুরু হয়েছে। বারবার শুধু মৃত্যু সংবাদের কথা মনে আসছে। মানুষের মনে যা আসে তাই শেষ পর্যন্ত হয়। রীনার মুখ শুকিয়ে গেল।
হ্যালো।
কে ভাবি? আমি রকিব।
ও আচ্ছা।
ভাইজান কি অফিস থেকে ফিরেছেন?
না। কেন বল তো?
আমি একটা সিরিয়াস বিপদে পড়েছি ভাবি।
কী বিপদ?
সেটা তোমাকে বলতে পারব না। তবে ভালো বিপদ। ভাবি আমি আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
কেন?
আছে, ব্যাপার আছে। স্টুডেন্ট পলিটিক্সের অনেক ঝামেলা আছে। তুমি বুঝবে না। ভাবি আমার কিছু টাকা লাগবে।
কত টাকা?
পাঁচ হাজার টাকা।
এত টাকা আমি পাব কোথায়?
যেভাবে হোক যোগাড় কর ভাবি।
রবিক শোন–তুমি খুবই অসম্ভব কথা বলছি। সংসারের অবস্থা তো তুমি জান।
আমি সবই জানি। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। ভাবি শোন আমি সন্ধ্যাবেলা একটা লোক পাঠাব, তার হাতে টাকাটা দিয়ে দিও।
রকিব কাউকে পাঠিও না। তুমি নিজে আস–তোমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা কর।
রকিব টেলিফোন রেখে দিল। রীনা বোকার মতো খানিকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল।
পাঁচ হাজার টাকা সে কিছুতেই যোগাড় করতে পারবে না। হাসানের কাছ থেকে নিয়ে হাজার দুয়েক টাকা সে দিতে পারবে–এর বেশি না। এতে কি রকিবের বিপদ কাটবে? বিপদটা কী তাও সে স্পষ্ট করে নি। এমন কী বিপদ যে বাসায় এসেও টাকা নেয়ে যাবে না!
বাড়িওয়ালার স্ত্রী জাহেদা বললেন, মা বোস শরবত খেয়ে যাও।
রীনা বলল, জ্বি না চাচি–টগর-পলাশ এরা মাত্র স্কুল থেকে এসেছে। এদের গোসল করাব-খাওয়াব।
শরবত খেতে কয় মিনিট লাগে? তিন মিনিট। গরমে তেঁতুলের শরবত খেয়ে দেখ–শরীরটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বোস খাটের ওপর বোস।
রীনা খাটে বসল। নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বসল। জাহেদা গল্প করতে ভালবাসেন। তার হাতে ধরা খেলে সহজে মুক্তি পাওয়া মুশকিল। তার সব গল্পই ভাড়াটেদের কর্মকাণ্ডের ওপর। ভদ্রমহিলা কখনো কোনো ভাড়াটের ঘরে যান না। কিন্তু তাদের সব খবর জানেন।
কেমন আছ মা তুমি?
জ্বি ভালো।
তোমার দেওর যে হাসান সে চাকরি বাকরি কিছু পায় নি?
তেমন কিছু পায় নি, তবে বেকার না। হিশামুদ্দিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ করছে।
কী কাজ?
হিশামুদ্দিন সাহেবের পার্সেনাল কিছু কাজ করে দিচ্ছে। পরে ওই ফার্মেই চাকরি দেবে।
ওর বিয়ে-টিয়ের কথা ভাবছি। ভাবলে বলবে–আমার হাতে ভালো মেয়ে আছে। খরচপাতি করে বিয়ে দেবে। দানসামগ্ৰী ছাড়া ক্যাশ টাকাও দেবে।
জ্বি আচ্ছা বলব।
ভাগ্য ফেরাবার জন্যে হলেও পুরুষমানুষের বিয়ে দিতে হয়। কথায় আছে না। স্ত্রীভাগ্যে ধন।
জ্বি।
শরবতটা কেমন লাগল। মা?
খুব ভালো লেগেছে চাচি। এখন উঠি?
দুটা মিনিট বোস মা। একটা ঘটনা বলি। এ রকম ঘটনা যে ঘটতে পারে বাপের জন্মে শুনি নাই। আমাদের চারতলায় ভাড়া থাকে যে ইয়াছিন সাহেব, উনাকে চেন?
জ্বি না।
ওই যে রোগা-চিমসা মুখ, মাথায় টাক, এজি অফিসে কাজ করে–তার ঘটনা।
চাচি আরেকদিন এসে শুনব?
এসেছ যখন শুনে যাও। ইয়াছিন সাহেবের ফ্যামিলি গিয়েছে দেশে। ভদ্রলোক ছুটি পায় নাই, যেতে পারে নাই। একদিন দেখি কী একটা মেয়ে নিয়ে ঘরে যাচ্ছে। সুন্দর মতো চেহারা। সতের-আঠার বছর বয়স। আমার হলো সন্দেহ–ব্যাপারটা কী? এই সময় তো তার অফিসে থাকার কথা। মেয়ে নিয়ে ঘরে কেন? বিষয় জানার জন্যে আমি নিজেই গেলাম।
কী জানলেন?
সে বিরাট ইতিহাস। ইয়াছিন সাহেব কেঁদে আমার পায়ে পড়ে গেল…
চাচি আরেক দিন এসে পুরো গল্প শুনব। মনে হচ্ছে খুব ইন্টারেষ্টিং।
রীনা উঠে দাঁড়াল। হাসান চলে যাবার আগেই তাকে ধরতে হবে। রকিবের জন্যে হাসানের টাকা রেখে দিতে হবে। ইয়াসিন সাহেব যা ইচ্ছা করুক। তার সংসার ঠিক থাকলেই হলো।
আশরাফুজ্জামান সাহেব দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলেন
আশরাফুজ্জামান সাহেব দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলেন। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াকিটাকি হাতে অল্প বয়েসী এক পুলিশ অফিসার। হাসি হাসি মুখ। যেন ঈদের দাওয়াত খেতে এসেছে। পুলিশের মুখের হাসিতে আশরাফুজ্জামান সাহেব বিভ্রান্ত হলেন না। শুকনো গলায় বললেন, কাকে চাই?
আপনি কি রকিবউদিনের বাবা?
জ্বি।
স্যার কেমন আছেন?
ভালো আছি।
একটু কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
বলুন।
বাইরে দাঁড়িয়ে তো কথা হয় না। ঘরে গিয়ে বসি।
আশরাফুজ্জামান দ্রুত চিন্তা করলেন। ঘরের ভেতর পুলিশ ঢোকানো ঠিক হবে না। একবার পথ চিনে ফেললে এরা বারবার আসবে। লোকজন নানান সন্দেহ করবে। আশরাফুজ্জামান সাহেব বললেন–আমি তো এখন বেরোচ্ছি। আমার একজন আত্মীয় অসুস্থ। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে।
উনি কোথায় আছেন?
হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। আমার ভাই হয়। চাচাতো ভাই।
আমি কি পরে আসব?
কখন বাসায় থাকি ঠিক নাই তো। রোগীর অবস্থা ভালো না। সারাদিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। বুকে কনজেশান হয়েছে। ক্রিটিক্যাল অবস্থা।
তাহলে বরং একটা কাজ করুন–রোগী দেখে আপনি থানায় চলে আসুন। রমনা থানা। আমার নাম বললেই হবে। আমার নাম আব্দুল খালেক সাবইন্সপেক্টর।
জ্বি আচ্ছা!
আপনার ছেলের ব্যাপারে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব। চিন্তিত হবার মতো কিছু না।
আমি চিন্তিত না।
তাহলে স্যার যাই? স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আশরাফুজ্জামান সাহেব পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বের হয়ে এলেন। মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনলেন। সিগারেট তাঁর জন্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ হলেও তিনি সমানে খেয়ে যাচ্ছেন। সিগারেট খাবার জন্যেই তাকে দীর্ঘ সময় বাসার বাইরে থাকতে হয়। সিগারেট হাতে তিনি ইস্কান্দরের চায়ের দোকানে ঢুকলেন। তার ডায়াবেটিস আছে। চিনি দিয়ে চা খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইস্কান্দরের চায়ের দোকানে তিনি এই নিষিদ্ধ কর্মটিও করেন। দু চামচের জায়গায় তিন চামচ চিনি দিয়ে চা খান।
ইস্কান্দর বলল, চাচামিয়া কেমুন আছেন?
তিনি হাসিমুখে বললেন, ভালো আছি। দেখি চা দাও। দই আছে?
আছে।
মিষ্টি না টক?
মিষ্টি।
দাও একটু দই খাই। এক কাজ কর, দইয়ের সঙ্গে একটা কালোজাম দাও।
তিনি খুব আরাম করে দই-কালোজাম খেলেন। চা সিগারেট খেলেন। পুলিশের দুশ্চিন্তা তার মাথা থেকে চলে গেল। তাঁর এখন শেষ সময়। শেষ সময়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ কী! তিনি কোনো অন্যায় করেন নি। পুলিশ তাকে নিয়ে জেলে ঢোকাতে পারবে না। যে কটা দিন আছেন–সুখে শাস্তিতে পার করে দিতে পারলেই হলো।
রকিব কী ব্যামেলা পাকিয়েছে কে জানে? কামেলা যদি পাকিয়েই থাকে তার ভাইরা বুঝবে। তিনি কে? তিনি কেউ না।
আশরাফুজ্জামান সাহেব আরেক কাপ চা দিতে বললেন। প্রথম চা-টা সিগারেট ছাড়া খেয়েছেন। দ্বিতীয় কাপ সিগারেট দিয়ে খাওয়া। ইস্কান্দরের হোটেলে দুপুরে তেহারি রান্না হয়। আজ তেহারি খেতে ইচ্ছা করছে। গরম হাঁড়ি নামলেই খেয়ে ফেলতে হবে। দেরি করলে নিচে তেল জমে যায়। তেল খাওয়াটা ঠিক না।
ইস্কান্দর।
জ্বি।
আজ তোমার এখানে তেহরি খাব।
জ্বি আচ্ছা।
মুখের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা করে। তোমার তেহারিটা ভালো হয়। বাবুর্চি ভালো। নাম কী বাবুর্চির?
ইস্কান্দর জবাব দিল না। সে জেনে গেছে বুড়োদের সব কথার জবাব দিতে হয় না। একটা পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হয়।
ইস্কান্দর।
জ্বি।
দেশে রাজনীতির হালচাল কী?
জানি না।
মিলিটারি ছাড়া আমাদের গতি নাই ইস্কান্দর। লেফট রাইট না করালে দেশটার কিছু হবে না। দেখি তোমার পিচ্চিটারে ডাক তো–একটা খবরের কাগজ আনিব।
বাসায় খবরের কাগজ আছে। তারপরেও আলাদা করে কাগজ পড়ার অন্য রকম মজা। বাসার কাগজ পড়ায় সেই মজা নেই। আশরাফুজ্জামান সাহেব মাঝে মাঝে নিজের টাকায় কাগজ কেনেন। পড়া হয়ে গেলে সেই কাগজ যত্ন করে জমা করে রাখেন। অনেকগুলো কাগজ জমেছে। বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। খবরের কাগজ কত দরে বিক্রি হয় কে জানে!
ইস্কান্দর।
জ্বি।
পুরনো খবরের কাগজের দর কত জান? কী দরে বিক্রি হয়?
জানি না।
দেখি আরেক কাপ চা দিতে বল। দুধ বেশি করে দিবে।
খবরের কাগজ শেষ করতে তাঁর এক ঘণ্টার মতো লাগল। টাকা পুরোপুরি উসুল করলেন। কোনো কিছুই বাদ দিলেন না। এরশাদ সাহেবের একটা কবিতা ছাপা হয়েছে। নদী-পাখি-আকাশ বিষয়ক। সেই কবিতা তিনি পড়ে ফেললেন। নদী-পাখি এবং আকাশ নামক বস্তুগুলোর প্রতি তার মমতা দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন কি না বোঝা গেল না।
আশরাফুজ্জামান সাহেব পত্রিক ভাজ করে বগলে নিয়ে নিলেন। তেহারি রান্না হতে এখনো দেরি আছে। আজ ছুটির দিন বাসায় লোকজন নেই। বউমা তার ভাইয়ের বাসায়। খালি বাসায় চুপচাপ বসে থাকার অর্থ হয় না। বড় মেয়ের বাসা থেকে কি একবার ঘুরে আসবেন? তাঁর স্ত্রী বর্তমানে বড় মেয়ের বাসায় আছেন। স্ত্রীর সঙ্গেও দেখা হলো। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা অবশ্য তত জরুরি না। বড় মেয়ের কাছে গেলে একটা লাভ অবশ্য হয়। বড় মেয়ে মাঝেমধ্যেই তাক্লে কিছু টাকা-পয়সা দেয়। বেশি না, সামান্যই। কখনো একশ’ টাকার দুটো নোট। কখনো পঞ্চাশ টাকার তিনটা নোট। তার স্বামী যখন আশপাশে থাকে না তখন চট করে নোট কটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে দিলে বলে—বাবা রেখে দিন।
চাচা স্নামালিকুম।
আশরাফুজ্জামান সাহেব চমকে তাকালেন। লম্বা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মুখভর্তি হাসি। এমন আনন্দিত মুখের কোনো ছেলেকে তিনি ইদানীংকালে দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।
চাচা আমাকে চিনতে পারেন নি, তাই না?
না চিনতে পারি নি।
আমি লিটন।
ও আচ্ছা লিটন। ভালো খুব ভালো।
আমি হাসানের বন্ধু। স্কুলে পড়েছি। ওর সঙ্গে।
ভালো ভালো। খুব ভালো।
হাসানের খোজে বাসায় গিয়েছিলাম–দেখি বাসায় কেউ নেই।
হাসান কোথায় গেছে জানি না। বউমা গেছে তার ভাইয়ের বাসায়।
হঠাৎ করে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। চাচা। আজ সন্ধ্যাবেলায় বিয়ে। অনুষ্ঠান টনুষ্ঠান কিছু না— কাজি ডেকে বিয়ে। হাসানকে খবরটা দিতে এসেছিলাম।
আমি বলে দেব।
চাচা আমার নাম মনে থাকবে তো? লিটন। লিটন বললেই হবে।
আমি বলব। আশরাফুজ্জামান হাঁটছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে লিটনও ঘটছে। ভালো যন্ত্রণা হলো দেখি।
আমি পরশুদিন সকালে মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছি। আদম বেপারিকে ধরে ব্যবস্থা হয়েছে। দেশে কিছু হচ্ছিল না। খুব কষ্টে ছিলাম চাচা–এখন মনে হয় আল্লা মুখ তুলে চেয়েছেন।
ভালো খুব ভালো।
হাসান আমার কাছে দুই হাজার টাকাও পায়। এক হাজার টাকা নিয়ে এসেছি। আপনার কাছে দিয়ে যাই।
আচ্ছা দাও।
ইচ্ছা ছিল সবার সব ঋণ শোধ করে যাব। সম্ভব হয় নাই। এখন বিদেশ থেকে পাঠাব।
ভালো খুব ভালো। ঋণ রাখতে নেই।
মালয়েশিয়ায় গুছিয়ে বসে ইনশাল্লাহ হাসানকেও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।
আশরাফুজ্জামান লিটনের টাকাটা রাখলেন। তাঁর হেঁটে হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল–এখন রিকশা নিয়ে ফেললেন। পকেটে টাকা আছে রিকশায় ঘোরাফেরা করা যায়।
চাচা।
বল বাবা।
কাল সকালে চলে যাচ্ছি তো–তাই তাড়াহুড়া কবে বিয়ে। আগেভাগে কাউকে কিছু বলতে পারি নি। হাসানকে আপনি অবশ্যই পাঠিয়ে দেবেন।
অবশ্যই পাঠাব।
আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন। চাচা।
অবশ্যই দোয়া করব।
লিটন পা ছুঁয়ে সালাম করল। আশরাফুজ্জামান সাহেব চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ বিড়বিড় করলেন।
রিকশা চলছে। তিনি হুড ধরে আনন্দিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। লিটনের টাকাটা পেয়ে ভালো লাগছে। হাত একেবাবে খালি হয়ে গিয়েছিলো। কিছু টাকা চলে এল। টাকার কথা, লিটনের বিয়ের কথা হাসানকে বলার। তিনি কোনো কারণ দেখছেন না। তিনি বুড়ো মানুষ এইসব কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক।
রিকশাওয়ালা বললেন, কই যাইবেন চাচা মিয়া?
চল রমনা থানায় চল।
রমনা থানার ঝামেলাটা চুকিয়ে আসা ভালো। তিনি রিকশার হুড ফেলে দিলেন। গায়ে রোদ লাওক। রোদে ভাইটামিন সি না ডি কী যেন আছে। বৃদ্ধ বয়সে শরীবে সব রকম ভাইটামিন দরকার–এ, বি, সি, ডি, ই, এফ, জি, এইচ, আই, জে, …। রমনা থানার যার সঙ্গে কথা বলবেন তার নাম হচ্ছে–আব্দুল খালেক। হাসানেব বন্ধুব নাম লিটন। বয়স হলেও স্মৃতিশক্তি এখনো ভালো আছে। মাথায় রোদ লাগছে। তিনি রিকশার হুড তুললেন না। বগলে রাখা খবরের কাগজটা মাথার ওপর ধরলেন। আব্দুল খালেকের সঙ্গে কথা বলে বড় মেয়ের বাসায় যাবেন। আজ দিনটা শুভ, বড় মেয়েও হয়ত নতুন পাঁচশ টাকার একটা নোট পকেট ঢুকিয়ে দেবে। যখন টাকা আসতে থাকে তখন আসতেই থাকে। এটা হলো টাকার ধর্ম।
আব্দুল খালেক হাসিমুখে বললেন, ও আপনি এসেছেন? আপনার রোগী কেমন?
আশরাফুজ্জামান চিন্তিত মুখে বললেন, ভালো না। মনে হয় সময় হয়ে গেছে।
বয়স কত?
বয়স অল্প–৪৫/৪৬ হবে।
চা খাবেন?
জ্বি না, বাসায় গিয়ে ভাত খাব। আমার নিজেব শরীরও ভালো না। আপনি কী জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলেন জিজ্ঞেস করুন।
আপনার ছোট ছেলের নাম রকিব?
জ্বি।
ও কী করে না করে তা কি আপনি জানেন?
পড়াশোনা করে–ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।
পড়াশোনা ছাড়া আর কী করে জানেন?
জানি না।
আপনার সঙ্গে যোগাযোগ কেমন?
যোগাযোগ নেই। ছেলেমেয়ে কারো সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। বাপ বুড়ো হলে যা হয়।
সিগারেট খাবেন?
দেন, একটা খাই।
আব্দুল খালেক সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিলেন। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিলেন। তারপর নিজের চেয়ার আরো কাছে টেনে এনে গলা নিচু করে বললেন–আপনার এই ছেলে ভালো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। চকবাজারের একজন রবারের ব্যবসায়ীকে সে এবং তার কয়েক বন্ধু মিলে ধরে নিয়ে গেছে। তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। এই হলো ঘটনা। তারা ওই ভদ্রলোককে প্রথম দিন রেখেছে শহীদুল্লাহ হলে— এখন অন্য কোথায় যেন ট্রান্সফার করেছে। আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
আশরাফুজ্জামান সাহেব তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। তিনি খুব যে বিক্ষিত হয়েছেন তাকে দেখে তাও মনে হলো না।
ব্যবসায়ী ভদ্রলোককে তারা যদি মেরে টেরে ফেলে তাহলে অবস্থা খারাপ হবে। এই কথাটা আপনার ছেলেকে জানানো দরকার। যদি সে বাসায় আসে, বাসার কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাকে ব্যাপারটা বলবেন।
জ্বি বলব।
আমার যা বলার বলেছি–এখন আপনি চলে যেতে পারেন।
জ্বি আচ্ছা।
আপনাকে থানায় এনে কষ্ট দিয়েছি, কিছু মনে করবেন না।
জ্বি না।
সময় খারাপ–অপরাধ করে ছেলেমেয়ে, আমরা বাবা-মাকে জেরা করি। আমাদেরও খারাপ লাগে।
আশরাফুজ্জামান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মনটা খারাপ হয়েছে। তবে এই মন খারাপ ভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে না। এই বয়সে ছেলেপুলেদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানো অর্থহীন। অল্প যে কদিন আছেন নিশ্চিন্তু মনে থাকতে চান। তিনি রাস্তায় নেমে রিকশা নিলেন। বড় মেয়ের বাসায় যাবেন। আজ দুপুরে তেহারি মনে হয় খাওয়া হবে না। বড় মেয়ের বাসায় গেলে না খেয়ে আসা যায় না। খেয়ে আসতে হয়। ইদানীং ঘরের খাওয়া তার মুখে রুচে না–তবু ভাব করতে হয় যেন অমৃত খাচ্ছেন।
তিনি বাসায় ফিরলেন রাত আটটায়। ঘরে ঢুকে একটা মজার দৃশ্য দেখলেন—তার ছোট ছেলে রকিব এসেছে। সে ঘোড়া সেজেছে। টগর এবং পলাশ দুজন তার পিঠে চেপে আছে। তারা হাঁট হাঁট করছে এবং ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে–মাঝে মাঝে চিঁহি করে বিকট চিৎকার দিচ্ছে।
বাবাকে দেখে রকিব হাসি মুখে বলল, বাবা কেমন আছ?
ভালো। তুই কখন এসেছিস?
এই তো কিছুক্ষণ আগে।
টগর, আনন্দিত গলায় বলল, দাদুভাই ছোট চাচা আজ আমাদের সবাইকে চাইনিজ খাওয়াবে। তাড়াতাড়ি কাপড় পর।
আশরাফুজ্জামান বললেন, সত্যি নাকি রে?
রবিক বলল, হ্যাঁ সত্যি। তোমার জন্যেই দেরি করছি। কাপড় পরে নাও।
চাইনিজ খাওয়াবি টাকা পেলি কোথায়?
খেলাধুলার জন্যে একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।
ভালো খুব ভালো।
আশরাফুজ্জামান খুশি মনে কাপড় বদলোত গেলেন। অনেকদিন চাইনিজ খাওয়া হয় না। থাই সুপ তাঁর খুব পছন্দের জিনিস। বৃদ্ধ বয়সে সুপ জাতীয় খাবারই ভালো। সহজপাচ্য, খেতেও সুস্বাদু।
সবাই চাইনিজ খেতে গেল। শুধু যে এ বাড়ির সবাই তাই না, রকিব তার বড় বোনকেও বলে এসেছিল। সেও চলে এল। হাসানের মা রাগ করে এতদিন মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। তিনিও এলেন। শুধু হাসান গেল না। তার শরীর ভালো না। সন্ধ্যা থেকে মাথা ঘোরাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে থাকলে মাথা ঘোরায় না। চোখ মেললেই মাথা ঘোরে। একজন ডাক্তার মনে হয় দেখানো দরকার।
বাসা খালি হয়ে যাবার পর হাসানের মন কেমন করতে লাগল। বেশি রকম একলা লাগছে। সবার সঙ্গে গেলেই হত। কিছু না খেয়ে বসে থাকলেও হতো। বাসার সবার একসঙ্গে হওয়া একটা বড় ঘটনা। অনেকদিন পর এই ঘটনা ঘটছে শুধু সে বাদ পড়ল।
হাসান বিছানা থেকে নামল। একা একা শুয়ে থাকতে অসহ্য লাগছে। রেস্টুরেন্টের ঠিকানা জানা থাকলে সেখানে চলে যেত। ঠিকানা জানা নেই। হাসান রওয়ানা হলো তিতলীদের বাসার দিকে। অসুস্থ অবস্থাতেই প্ৰিয়জনদের বেশি দেখতে ইচ্ছে করে। তিতলীকে কেন জানি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। হাসান তিতলীদের বাড়ির গেট পর্যন্ত গেল। গেটের ভেতর ঢুকাল না। এত ঘনঘন ওই বাড়িতে যাওয়া ঠিক না। তিতলীর বাবা নিশ্চয়ই রাগ করবেন। সেই রাগ তিনি হাসানের ওপর দেখাবেন না, দেখাবেন তিতলীর ওপর। তার কারণে তিতলী বকা খাবে এটা ঠিক না।
ফেরার পথে হাসান ঠিক করে ফেলল। পরের বার যখন হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে দেখা হবে তখন সে অবশ্যই একটা চাকরির কথা তাকে বলবে। তাকে বলতেই হবে। এইভাবে থাকা আর যায় না।
একটা মোটামুটি ভদ্র চাকরি হলে সে তিতলীর মাকে বলতে পারে–খালা আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
না, তার পক্ষে এটা সরাসরি বলা অসম্ভব। সে ভাবিকে দিয়ে বলবে। হিশামুদ্দিন সাহেব যেদিন তাকে চাকরি দেবেন। সেদিনই সে ভাবিকে পাঠাবে। অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই।
হাসান কেমন আছ?
জ্বি স্যার ভালো।
চোখ লাল কেন?
হাসান জবাব দিতে পারল না। তার যে চোখ লাল এই ব্যাপারটা সে জানে না। ঘর থেকে বেরোবার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়েছে। তখন চোখের দিকে তাকায় নি। আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস তার নেই।
হিশামুদিন সাহেব বললেন, রাতে ঘুম হয় নি?
জ্বি স্যার হয়েছে।
তোমার কি অনিদ্রা রোগ আছে?
জ্বি না।
তুমি তাহলে মানুষ হিসেবে খুব আধুনিক নও। অনিদ্রা হচ্ছে আধুনিক মানুষের রোগ।
হাসান চুপ করে রইল। হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে সমান তালে গল্প করার মতো অবস্থা তার না। হিশামুদিন সাহেব প্রশ্ন করলে সে জবাব দেবে। যতদূর সম্ভব কম কথায় জবাব দেবে। তবে আজ সে তার চাকরির কথাটা বলবে। যে ভাবেই হোক বলবে।
বিয়ে কর নি তো?
জ্বি না।
বিয়ের কথা ভাবছ না?
হাসান জবাব দিল না। একবার ভাবল এখনই সময়। এখনি বলা দরকার, স্যার চাকরি বাকরি নেই, বিয়ে করলে স্ত্রীকে খাওয়াব কী? এই কথায় দ্রবীভূত হয়ে হিশামুদ্দিন সাহেব তাঁর বিশাল কোম্পানিতে কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। তবে বাস্তব আশার পথ ধরে চলে না–বাস্তব চলে নিরাশার এবড়ো খেবড়ো পথে। তার কথায় হিশামুদ্দিন সাহেব দ্রবীভূত হবেন এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ জাতীয় মানুষকে অন্যরা দ্রবীভূত করতে পারে না। তবে চাকরির কথাটা আজ বলতেই হবে। এখন না হলেও কিছুক্ষণ পরে বলবে।
হাসান।
জ্বি স্যার।
তোমার কি পছন্দের কেউ আছে যাকে বিয়ে করতে চাও।
হাসান লজ্জিত গলায় বলল, আছে স্যার।
তার নাম কী?
তিতলী।
হাসান খুবই অবাক হচ্ছে। হিশামুদ্দিন সাহেব এ জাতীয় হালকা প্রশ্ন কেন করছেন সে বুঝতে পারছে না। তার পছন্দের কেউ আছে কি না তা দিয়ে হিশামুদ্দিন সাহেবের কিছু যায় আসে না।
তিতলী নামের অর্থ কী?
প্ৰজাপ্রতি।
প্ৰজাপতি তো সুন্দর নাম।
হিশামুদিন সাহেব দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন–এস শুরু করি।
হাসান অপেক্ষা করছে, হিশামুদিন সাহেব কিছুই বলছেন না। মানুষটা কি ঘুমিয়ে পড়ছে? ভাবভঙ্গি ঘুমিয়ে পড়ার মতোই। এস শুরু করি বলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে না। হিশামুদিন সাহেবের মতো মানুষ তো বটেই। হাসান বুঝতে পারছে না। খুক খুক করে কেশে সে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কি না। সেটা ঠিক হবে না। অনেক ওপরের লেভেলের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কাশি কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। হাত উঠানো যায়। হাত উঠালে। লাভ হবে না, হিশামুদিন সাহেব চোখ বন্ধ করে আছেন–কিছু দেখবেন না।
হাসান।
জ্বি স্যার।
কী বলবি গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছিলাম। তুমি যদি জীবনের গল্প শুরু কর তখন দেখবে গোছানো খুব কঠিন। সিস্টেমেটিকালি সব মনেও আসে না। তুচ্ছ ঘটনা আগে মনে পড়ে। অনেক বড় বড় ঘটনা মনেই পড়ে না। ধারাবাহিকতা থাকে না। ধারাবাহিকভাবে মানুষ তার সমস্ত ঘটনা পানিতে ডুবে মরার সময় দেখতে পায় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। তাও ঠিক না। আমি পানিতে ডুবে মরতে বসেছিলাম। আমি কিছুই দেখি নি। চোখের সামনে শুধু হলুদ আর লাল আলো দেখেছি। তুমি কি কখনো পানিতে ডুবেছ?
জ্বি না স্যার?
সাঁতার জান?
জ্বি না।
আমার পানিতে ডোবার ঘটনাটা বলব, না বাবার জেল থেকে ফিরে আসার গল্পটা আগে বলব বুঝতে পারছি না।
আপনার বাবার ফিরে আসার গল্পটা বলুন।
বাবার নাম কি তোমাকে বলেছি?
জ্বি না।
উনার নাম আজহারউদ্দিন খাঁ। আমরা খাঁ বংশ। খুবই উচ্চ বংশ। যাই হোক আমাদের উচ্চ বংশীয় বাবা দু মাসের জেল খেটে হাসিমুখে একদিন বাসায় ফিরলেন। তার হাতে চারটা কিদবেল। জেলখানার গাছের কদবেল। জেলার সাহেবকে বলেটলে কীভাবে জানি নিয়ে এসেছেন। মানুষকে মুগ্ধ এবং খুশি করার আর্ট বাবা খুব ভালো জানতেন। যে-কোনো মানুষের সঙ্গে বাবা যদি কিছুক্ষণ কথা বলেন তার ধারণা হবে বাবা অসাধারণ একজন মানুষ। বাবা বাসায় ফিরলেন। নিজের হাতে কন্দবেলের ভর্তা বানালেন। কন্দবেলের ভর্তা কখনো খেয়েছ হাসান?
জ্বি না স্যার।
ঠিকমতো বানাতে পারলে অতি উপাদেয় একটা জিনিস। চিনি দিয়ে টক কমাতে হয়। কাচামরিচ দিয়ে ঝাল ভাব আনতে হয়। লবণও দিতে হয়। চিনি ও লবণের অনুপাতের ওপর স্বাদ নির্ভর করে। বাবা ছিলেন। কদবেল ভর্তার বিশেষজ্ঞ। আমরা বিপুল আনন্দে কদবেলের ভর্তা খেলাম। বাবা হাসিমুখে জেলখানার শিল্প করতে লাগলেন। স্বাক্ষর সব গল্প। গল্প শুনলে যে কেউ বাকি জীবনটা জেলখানায় কাটিয়ে দিতে চাইবে।
বাবা তাঁর জেল জীবনের স্মৃতির উপসংহার টানলেন এই বলে যে, প্রতিটি মানুষের জীবনে জেলের অভিজ্ঞতা দরকার আছে। বাবার গল্প শুনে আমি ঠিক করে ফেললাম জীবনের একটি অংশ যে করেই হোক আমাকে জেলে কাটাতে হবে।
হিশামুদিন সাহেব চুপ করলেন। হাসান মনে মনে কয়েকবার আওড়াল আজহারউদ্দিন। নামটা যেন মনে থাকে। হিশামুদ্দিন সাহেবের স্বভাব হলো কোনো নাম তিনি বারবার বলেন না। এক-দুবার বলেন। আজহারউদ্দিন নামটা তিনি আরো বলবেন। বলে মনে হয় না।
হাসান।
জ্বি স্যার।
গল্প বলার সময় তোমার মনে যদি কোনো প্রশ্ন আসে–তুমি যদি কিছু জানতে চাও জিজ্ঞেস করো। চুপ করে থেকে না। প্রশ্ন করলে আমার মনে হবে তুমি আগ্রহ করে শুনছ।
স্যার আমি খুব আগ্রহ করেই শুনছি।
কেন?
হাসান জবাব দিতে পারল না। হিশামুদিন বললেন, আমি যে সব গল্প বলছি তা খুবই সাধারণ গল্প। কিন্তু তুমি আগ্রহ করে শুনছ কারণ যিনি গল্প বলছেন তিনি অসম্ভব বিত্তবান একজন মানুষ। তিনি যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। পরাজিত মানুষের গল্প আমাদের শুনতে ভালো লাগে না। বিজয়ী মানুষের গল্প আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনি। চেঙ্গিস খাঁর গল্প আমরা পড়ি কারণ তিনি জয়ী। যে সব রাজাদের তিনি পরাজিত করেছেন–যারা ধ্বংস হয়ে গেছে–তাদের গল্প আমরা পড়ি না। ঠিক বলছি হাসান?
জ্বি স্যার।
বাবার গল্পে চলে যাই। বাবা জেল থেকে ফেরার পর আমরা খুব কষ্টে পড়লাম। আসল কষ্ট–ভাতের কষ্ট। তিনি যে কদিন জেলে ছিলেন সেই কদিন ভাতের কষ্ট আমাদের ছিল না। দুবেলা ভাত খেতে পেরেছি। আমাদের বড় বোন পুষ্প ব্যবস্থা করেছেন। কী করে করেছেন আমরা জানি না-কিন্তু করেছেন। বাবা ফেরার পর দায়িত্ব তার হাতে চলে গেলে তিনি অকূল সমুদ্রে পড়লেন। জেলখাটা দাগি লোক কাজেই কোথাও চাকরি জোটাতে পারছেন না। সারাদিন চাকরির সন্ধানে ঘোরেন।
রাত আটটার-নাটার দিকে বাসায় ফেরেন। খাবার নিয়ে ফেরেন। আমরা রাতে একবেলা খাই–তবে পেট ভরে খাই। বাবা খাবার আনতেন হোটেল থেকে। তুমি জান কি না জানি না ভালো চালু হোটেলে উৎকৃষ্ট খাবার প্রচুর জমে যায়। হোটেল মালিকরা সেইসব খাবার ফেলে না। একত্রে জমা করে রাখে। গরিব-দুঃখীদেরকে দিয়ে দেয়। বাবা একটা হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করেছিলেন। রাত আটটার দিকে প্যাকেটিভর্তি খাবার নিয়ে আসতেন। সবকিছু একসঙ্গে মেশানো বলে অদ্ভুত স্বাদ। মাছ, গোশত, ভাজি, বিরিয়ানি, খিচুড়ি–সবকিছুর অদ্ভুত মিশ্রণ!
স্যার খেতে কেমন?
প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে যা খাওয়া যায়। তাই অমৃতের মতো লাগে– তবে ওই খাবারটা ভালো ছিল। আমরা সবাই খুব আগ্রহ করে খেতাম। শুধু আমার মেঝো বোন খেতেন না। আমার মেঝো বোন ছিলেন বিদ্রোহী টাইপের। তিনি বিদ্রোহ করে ফেলেন, কঠিন গলায় বললেন, মানুষের এঁটো খাবার আমি খাব না। মরে গেলেও না। বাবা তাকে নানা যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলেন–‘সবকিছু এঁটো হয়। কিন্তু খাবার কখনো এঁটো হয় না।’ মেঝো বোন বাবার যুক্তির ধার দিয়েও গেলেন না। তিনি চোখমুখ শক্ত করে বললেন, আমি ঐটা খাবার খাই না। তার জন্যে চিড়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সে শুকনো চিড়া চিবিয়ে পানি খেত।
আমার মেঝো বোন খুব রূপবতী ছিলেন। আমরা সবাই দেখতে মোটামুটি ভালো ছিলাম-মেঝো বোন ছিলেন সেই ভালোর মধ্যেও ভালো। খুব হাসিখুশি ছিলেন। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে আশপাশের মানুষদের চমকে দিতে ভালোবাসতেন। যেমন তাঁর একটা কথা ছিল–একটা পোকা আছে আমার খুব প্রিয়। আমি সেই পোকা কী যে পছন্দ করি! পোকাটার নাম চিংড়ি মাছ।
আপনার সেই বোনের নাম কী স্যার?
হিশামুদ্দিন ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—তার নাম আমি তোমাকে বলব না। ওই নামটা অজানাই থাকুক। হাসান আজ আর কথা বলব না। কেমন যেন মাধা ধরে গেছে। আগামী সপ্তাহে আবার দেখা হবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তোমাকে টাকা-পয়সা ঠিকমতো দিচ্ছে তো?
জ্বি সার।
আচ্ছা ঠিক আছে।
হাসান তার কথা বলতে পারল না। হিশামুদ্দিন সাহেব যেখানে তাঁর গল্প থামিয়েছেন সেখানে হুট করে চাকরি চাওয়া যায় না।
হিশামুদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। বুকে চাপ ব্যথা বোধ হচ্ছে। লক্ষণগুলো পরিচিত। আবার ঠিক পরিচিতও নয়। শরীর খারাপের একটা লক্ষণের সঙ্গে অন্যটায় তেমন মিল থাকে না।
হিশামুদ্দিন নিজের শোবার ঘরে ঢুকলেন। বিছানায় কি খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবেন? তার প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। বুকের ব্যাখােটা কমে গেছে। তবে মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ছে। মনে হয় চোখ সম্পর্কিত কোনো সমস্যা। কাল অনেক রাত জেগে কাগজপত্র দেখেছেন–চোখের ওপর চাপ পড়েছে। চশমাটা বদলানো দরকার, বদলানো হচ্ছে না। তাঁর পানির পিপাসা হচ্ছে। পানি দেবার জন্যে কাউকে বলতে হয়–এই পরিশ্রমটুকু করতে ইচ্ছা করছে না। খাটের পাশে কলিংবেলের সুইচ আছে, সুইচে হাত পড়লেই কেউ একজন ছুটে আসবে। তিনি বসেছেন সোফায়–কলিংবেলটা মনে হচ্ছে অনেক দূরে।
চিত্ৰলেখার সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? মেরিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান যেন কত? এই তথ্য তার জানা, তারপরেও চিত্ৰলেখার সঙ্গে কথা বলার সময় প্রতিবার নতুন করে জানতে হয়। দিনের শুরুতেই তিনি জানেন আজ কত তারিখ। তারপরেও প্রতিটি সিগনেচারের সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হয়–আজ কত তারিখ।
বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সময়ের ব্যবধান কত? আট ঘণ্টা? রাত দুটোর সময়ে মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার কোনো অর্থ হয় না। হিশামুদ্দিন সোফা থেকে উঠে খাটের দিকে গেলেন। খাটে হেলান দিয়ে সুইচ টিপলেন। মোতালেব উদ্বিগ্নমুখে ছুটে এলো। ঘরে ঢুকল না। দরজার পরদা সরিয়ে উঁকি দিল। হিশামুদিন সাহেব ঠিক বুঝতে পারলেন না, কী জন্যে মোতালেবকে ডেকেছেন। পানি দেবার জন্যে, নাকি কটা বাজে জানার জন্যে। তাঁর শোবার ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। ঘড়ির শব্দে তাঁর অস্বস্তি বোধ হয়। সময় জানার জন্যে তাকে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়।
কটা বাজে মোতালেব?
স্যার চারটা এখনো বাজে নাই। চা দিব?
না–আজ চা খাব না। তুমি টেলিফোন হ্যান্ডসেটটা নিয়ে এস।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
মোতালেব প্রায় দৌড়ে গেল। বাংলাদেশ-আমেরিকার সময়ের পার্থক্যটা জানা হলো না। চিত্ৰলেখা হয়তো ডরমিটরিতে নেই–ক্লাসে গেছে। টেলিফোন বেজে যাবে কেউ ধরবে না।
হ্যালো।
কেমন আছিস রে মা?
বাবা এক সেকেন্ড ধরে রাখ–আমি আসছি।
হিশামুদিন টেলিফোন ধরে আছেন। তার মাথার যন্ত্রণাটা এখন খুব বেড়েছে। এই যন্ত্রণা নিয়েই তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন। এটাও এক ধরনের খেলা!
হ্যালো বাবা।
এক সেকেন্ডের জন্যে কোথায় গিয়েছিলে?
মাইক্রো আভেন বন্ধ করতে গিয়েছিলাম।
রান্নাবান্না?
ঠিক রান্নাবান্না না–ক্ষিদে লেগেছিলে। পিজা ‘থ’ করতে দিয়েছিলাম।
থ হয়েছে?
হুঁ। হয়েছে। আমি কপ কপ করে খাচ্ছি। শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?
পাচ্ছি।
তোমার খবর কী বাবা?
খবর ভালো।
জীবনী লেখা হচ্ছে?
হুঁ।
যতটুকু লেখা হয়েছে পাঠিয়ে দিতে পারবে–এখন আমার একটা ফ্যাক্স নাম্বার আছে। নাম্বার দেব?
না।
না কেন?
সবটা লেখা হোক তারপর।
তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন বাবা?
কেমন শোনাচ্ছে।
মনে হচ্ছে তুমি অসুস্থ।
আমি সুস্থই আছি। তোর পড়াশোনার অবস্থা কী?
অবস্থা ভালো। এখন পর্যন্ত কোনো B পাই নি। স্ট্রেইট A।
ও আচ্ছা।
তুমি একটা শুকনা ও আচ্ছা দিয়ে সেরে ফেললে? ষ্ট্রেইট A যে কী ভয়াবহ জিনিস তুমি কি জান? আমি যখন করিডোর দিয়ে হাঁটি ছেলেমেয়েরা তখন অদ্ভুত চোখে তাকায়। বাবা এক সেকেন্ড ধরবে–আমি একটা কোকের ক্যান নিয়ে আসি।
হিশামুদ্দিন টেলিফোন ধরে রাখলেন। মাথার ব্যথাটা এখন আর নেই, তবে পিঠে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথার ব্যাপারটা কি সাইকোলজিক্যাল? মনস্তাত্ত্বিক ব্যথাই শুধু মিনিটে মিনিটে স্থান বদলায়।
বাবা।
কী মা?
কোকের ক্যান নিয়ে এসেছি এখন কথা বল।
কী কথা বলব?
কী কথা বলবে সেটা তুমি জান। আমি কী করে বলব।
তুই কথা বল আমি শুনি।
আমার কথা বলার হলে তো আমিই টেলিফোন করতাম। টেলিফোন তুমি করেছ। তুমি কথা বলবে। আমি শুনব।
আগের বার বলেছিলি ব্ৰাজিলের এক ছেলের সঙ্গে ভাব হয়েছে, সেই ভাব এখনো আছে?
ভাব হয়েছে এই কথা তো বাবা বলি নি–সে আমাকে ডিনার এবং মুভি দেখার জন্য ইনভাইট করেছিল আমি গিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর আবার কী?
একবারই গিয়েছিলি? আর যাস নি?
না। হাঁদা টাইপ ছেলে। চেহারা দেখে বুঝা যায় না। কিছুক্ষণ কথা বললেই টের পাওয়া যায়। ওর সঙ্গে কথা বলে আমার কী মনে হয়েছে জান?
কী মনে হয়েছে?
মনে হয়েছে–মানুষ বানর থেকে এসেছে ঠিকই। তবে সবাই পুরোপুরি মানুষ হয় নি। অনেকেই বানর রয়ে গেছে। হি হি হি।
এখন এমন কেউ নেই যার সঙ্গে ডিনার খেতে যাচ্ছিস বা মুভি দেখছিস?
উঁহুঁ। ইচ্ছে করে না। বাবা আমার কী ধারণা জান? আমার ধারণা পুরুষরা প্ৰাণী হিসেবে মেয়েদের অনেক নিচে। বুদ্ধিবৃত্তি লোয়ার লেভেলে। রাগ করেছ বাবা?
রাগ করব কেন?
তুমিও তো পুরুষ এই জন্যে হি হি হি।
কথায় কথায় হাসার অভ্যাস কি তোর এখনো আছে?
এটা তো বাবা কোনো খারাপ অভ্যাস না যে ছেড়ে দিতে হবে।
তা না।
তুমি যে বলেছ। আমার জন্যে ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের করবে যাকে আমি বিয়ে করব, খুঁজে পেয়েছ?
এখনো পাই নি।
খুঁজছি নাকি খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছ?
খুঁজছি।
বাবা আমার পয়েন্টগুলো মনে আছে তো? ছেলেটির কী কী গুণ থাকতে হবে মনে আছে?
আছে।
বল তো শুনি।
লম্বা হতে হবে, গায়ের রঙ শ্যামলা, IQ থাকবে ১৬০-এর ওপরে, কথায় কথায় হি হি করে হেসে ওঠার ক্ষমতা থাকতে হবে, পড়াশোনায় খুব ভালো হতে হবে।
একটা পয়েন্ট বাদ গেছে বাবা।
কোন পয়েন্ট?
ঠোঁট মোটা হলে চলবে না, ঠোঁট পাতলা হতে হবে।
তুই কি এর মধ্যে দেশে বেড়াতে আসবি?
পাগল হয়েছ? আমার মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগলের অবস্থা। পড়াশোনার যে কী প্ৰচণ্ড চাপ তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না। এখন সবাই ঘুরে টুরে বেড়াচ্ছে আর আমি চারদিকে বই সাজিয়ে বসে আছি। তুমি টেলিফোন রাখামাত্র আমি ফার্মাকোলজির বই খুলে বসব।
তাহলে টেলিফোন এখন রাখি মা?
আচ্ছা।
হিশামুদ্দিন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। মোতালেব চা নিয়ে এসেছে। তিনি চা দিতে নিষেধ করেছিলেন তার পরেও এনেছে।
হিশামুদিন চায়ের কাপ হাতে নিলেন।
তিতলী কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে
তিতলী কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। অপেক্ষা করছে বাবার জন্যে। মতিন সাহেব বাথরুমে ঢুকেছেন। বাথরুম থেকে বের হলে তিতলী রিকশা ভাড়া চাইবে। একবার না। তিতলীকে কয়েকবার চাইতে হবে। তিনি শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মানিব্যাগ খুলে দুটা দশ টাকার নোট বের করবেন। আসা-যাওয়ার রিকশা ভাড়া বাবদ পনের টাকা আর পাঁচ টাকা টিফিনের জন্যে। টাকাটা চাওয়া মাত্র দিয়ে দিলে কী হয়? একসঙ্গে কয়েকদিনের টাকা দিয়ে দিলে রোজ রোজ চাইতে হয় না।
মতিন সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, অস্থির হয়ে পড়েছিস কেন? টাকা টাকা করে তুই তো দেখি দরজা ভেঙে বাথরুমে ঢুকে পড়ার ব্যবস্থা করেছিস। স্বভাব থেকে অস্থিরতা দূর কর। অস্থির মানুষ কোথাও গিয়ে পৌঁছতে পারে না।
রাগে-দুঃখে তিতলীর কান্না পেয়ে যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলার মুকুলে সে অবশ্যই বলত, তুমি নিজ তো খুব সুস্থির মানুষ। তুমি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছ?
বাবার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলার সম্পর্ক তার না। তিতলী চাপা নিঃশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইল। মতিন সাহেব তাঁর শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন। টেবিলের ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগ বের করবেন। তিতলীর প্রতীক্ষার অবসান হবে। তিতলী বাবার পেছনে পেছনে গেল। মতিন সাহেব ড্রয়ারের দিকে গেলেন না। খাটের ওপর বসতে বসতে বললেন, আজকের কাগজটা দিয়ে যা। আর তোর মাকে বল এক কাপ চা দিতে। চিনি দিয়ে যেন আবার শরবত না বানায়। এক কাপে এক পোয়া চিনি না দিয়ে তো সে আবার চা বানাতে পারে না।
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা।
খবরের কাগজটা দিতে আর তোর মাকে চায়ের কথা বলতে কতক্ষণ লাগবে? কথা বলে তুই যে সময়টা নষ্ট করছিস তারচে’ কম সময়ে কাগজটা দিয়ে যেতে পারতি। মাকেও খবর দিতে পারতি।
তিতলী কাগজ এনে বাবার হাতে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। সুরাইয়া মেয়েকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন, কী রে এখনো কলেজে যাস নি?
তিতলী বলল, বাবাকে এক কাপ চা দাও। আর আমাকেও এক কাপ চা দাও। আজ কলেজে যাব না।
যাবি না কেন?
যেতে ইচ্ছা করছে না।
সুরাইয়া কলেজ প্রসঙ্গে আর কিছু বললেন না। মনে হলো মেয়ে কলেজে না যাওয়ায় তিনি খুশিই হয়েছেন। তিতলী যেদিন কলেজে না যায় সেদিন মাকে নানান কাজে সাহায্য করে। দুপুরে রান্নার সময় বলে–মা তুমি একটা মোড়া এনে মোড়ায় চুপচাপ বসে থাক আমি তোমার রান্না করে দিচ্ছি। রোজ রোজ রান্না করতে তোমার নিশ্চয়ই বিরক্তি লাগে। আজ সব রান্না আমি রাধব তুমি শুধু বাবার ভাত রাঁধবে।
তিতলীর হাতে কোনো মন্ত্রটন্ত্র আছে–যাই রাধে খেতে ভালো হয়।
কলেজে যাবি না কেন?
বললাম তো ইচ্ছা করছে না।
অসুবিধা হবে না?
কোনো অসুবিধা হবে না। কলেজে পড়াশোনা কিছু হয় না মা। টিচাররাও আসেন না। যারা আসেন হড়বড় করে দু-এক কথা বলে যান। তারা কী বলেন–আমরা কেউ শুনিও না। আমরা নিজেদের মতো ফিসফিস করে গল্প করি। কাটাকুটি খেলা খেলি।
বলিস কী!
সত্যি কথা বললাম মা। আমরা কলেজে যাই গল্পগুজব হইচই করার জন্যে। পড়াশোনা যাদের করার তারা ঘরে বসে করে।
কলেজে তাহলে খুব খারাপ অবস্থা?
খারাপ হবে কেন ভালো অবস্থা।
সুরাইয়া চায়ের কাপে চা ঢাললেন। তিতলী কাপ হাতে বাবার ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। চট করে বাবার কাপে একটা চুমুক দিয়ে দেখে নিল চিনি ঠিক আছে কি না। কাজটা ঠিক হলো না। চা এঁটো করে দেয়া হলো। তবে বাবা-মার চা এঁটো করা যায়।
মতিন সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, টেবিলের ওপর পেপারওয়েটে টাকা চাপা দেয়া আছে নিয়ে যা।
তিতলী টাকাটা নিল।
মতিন সাহেব বললেন, এদিক থেকে লালমাটিয়া কলেজে কোনো মেয়ে পড়ে না? তাহলে দুজনে শেয়ার করে যেতে পারতিস। খরচও বঁচিত। দুজন একসঙ্গে যাবার একটা সিকিউরিটিও আছে। কলেজের নোটিশ বোর্ডে একটা নোটিশ দিয়ে দিবি।
তিতলী অবাক হয়ে বলল, কী নোটিশ দেব?
সহযাত্রী চেয়ে বিজ্ঞপ্তি।
তিতলী বলল, আচ্ছা। টাকাটা যে সেভ হচ্ছে সেটা বড় কিছু না–সিকিউরিটিটা আসল। দিনকাল খুবই খারাপ। চারিদিকে সিকিউরিটি প্রবলেম।
তিতলী বাবার সামনে থেকে চলে গেল। বাবার বক্তৃতা মার্কা কথা শুনতে অসহ্য লাগছে। এরচে’ মার সঙ্গে গল্প করার অন্য আনন্দ। মা যত না গল্প করবেন তারচে’ বেশি গল্প শুনতে চাইবেন। সামান্য গল্পও মা মুগ্ধ হয়ে শোনেন। এই ধরনের মানুষকে গল্প শুনিয়ে খুব আনন্দ।
সুরাইয়া মেয়ের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বললেন, নাদিয়ার কি হয়েছে তুই জানিস?
তিতলী বিস্মিত হয়ে বলল, না তো। ওর আবার কী হবে! সুরাইয়া বললেন, আমি নাশতা খাবার জন্যে ডাকতে গেলাম দেখি বই পড়ছে ঠিকই কিন্তু চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে–কিছু বলে না।
আমি জেনে আসছি কী ব্যাপার। মা শোন আজ দুপুরে আমি রাধব। কী রাধবি? ঘরে তো বাজারই নেই। বাবা বাজারে যাবে না? বাবাকে দিয়ে এক কেজি ভালো গরুর গোশত আনিয়ে দাও তো মা। আমি কাটা পেঁয়াজ দিয়ে একটা গোশত রান্না করব। প্রমীদের বাড়িতে একদিন খেয়েছিলাম। খেতে খুব ভালো। আমি প্রমীর আম্মার কাছে সব জেনে এসেছি। ঘরে কি সিরকা আছে মা? সিরকা লাগবে। সিরকা ছাড়া হবে না।
ঘরে তো সিরকা নেই।
সিরকা আনিয়ে দাও না মা। রান্নাটা একবার রাঁধতে না পারলে ভুলে যাব। একবার রাঁধলে আর ভুলব না।
সিরকা টিরকার কথা বললে তোর বাবা আবার রেগে যায় কি না কে জানে।
এটা আবার কী ধরনের কথা মা? বাবাকে তুমি ভয় পাও কেন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। তোমাদের এ রকম কেন? তোমাদের দেখে মনে হয় একজন গুরুমশাই আরেকজন প্ৰাইমারি ক্লাসের ছাত্রী।
তিতলী উঠে দাঁড়াল। তার চা শেষ হয় নি। খেতে ভালো লাগছে না। তিতলী জানে তার মা তার চায়ের কাপের চাটুকু এক সময় চুমুক দিয়ে খাবেন। তিনি অপচয় সহ্য করতে পারেন না।
নাদিয়া নিঃশব্দে পড়ছে। তিতলী ঘরে ঢুকতেই সে বই থেকে মাথা না সরিয়ে বলল, কলেজে যাও নি। আপা?
তিতলী বলল, আজ কলেজে যাব না। আজ আমার ছুটি।
নাদিয়া বই থেকে মুখ ঘুরিয়ে বড় বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাসিই বলে দিচ্ছে বড়। আপার কলেজে না যাওয়ার সংবাদে সে খুব আনন্দিত। যদিও তার আনন্দিত হবার কিছু নেই–সে বই রেখে আপার সঙ্গে গল্প করতে বসবে না। বিকেলে একবার কিছুক্ষণের জন্যে উঠবে। ছাদে হাঁটতে যাবে, তাও একা একা। ছাদ থেকে নেমে আবারো বই নিয়ে বসবে।
খানিকক্ষণ বিরক্ত করি?
কর। কিন্তু আপা বেশিক্ষণ না।
দিনরাত যে এত পড়িস তোর ভালো লাগে?
হুঁ।
যে হারে পড়াশোনা করিসি সব বই তো তোর মুখস্থ হয়ে যাবার কথা।
নাদিয়া লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, সব বই তো আমার মুখস্থই।
মুখস্থ! তাহলে আর পড়ার দরকার কী?
না পড়লে ভুলে যাব না?’
ভুলে গেলে ভুলে যাবি। সামান্য এস.এস.সি. পরীক্ষার জন্যে জীবনটা নষ্ট করে ফেলবি। তোকে দেখে মনে হয় তুই মানুষ না–একটা যন্ত্র।
নাদিয়া বলল, আপা তুমি অনেকক্ষণ বিরক্ত করে ফেলেছ। এখন যাও। তোমাকে আর সময় দেয়া যাবে না।
আসল কথা যা বলতে এসেছিলাম সেটা বলা হয় নি।
আসল কথা কী? মা সকালে নাশতা নিয়ে এসে দেখে তুই বই পড়তে পড়তে काछिन। दो श्शरछ?
কিছু হয় নি।
আমাকে বলতে কোনো অসুবিধা আছে?
না খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। আপা। এই জন্যে বলতে ইচ্ছে করছে না।
কাউকে কিছু বলবি না–আবার ফিঁচ, ফিঁচ করে কাঁদবি এটা কেমন কথা?
আর কাঁদব না।
আমরা তিন বোনের কেউ কাঁদলে মা মনে খুব কষ্ট পায়। কী জন্যে কাঁদছিস এ জন্যেই মাকে সেটা জানানো দরকার।
মাকে কিছু জানাতে হবে না। আপা–তোমাকে বলছি তুমি শুনে রাখ। ফুফুর বাসায় যে গিয়েছিলাম সেখানে জামান ভাইয়া আমাকে একটা চিঠি দিয়েছে। কুৎসিত একটা চিঠি। কেউ যে কাউকে এমন কুৎসিত চিঠি দিতে পারে তাই আমি জানতাম না।
কী লেখা চিঠিতে?
কী লেখা তোমাকে আমি বলতে পারব না।
চিঠিটা কি ফেলে দিয়েছিস?
না ফেলি নি রেখে দিয়েছি, কিন্তু তোমাকে চিঠিটা আমি কোনোদিন দেখাব না। দেখতে চেও না। চিঠিটা পড়লে তোমার শরীর অশুচি হয়ে যাবে। আপা এখন তুমি যাও।
তিতলী উঠে দাড়তে দাঁড়াতে বলল, চিঠিতে কি ভালোবাসার কথা লেখা?
নাদিয়া চাপা গলায় বলল, ভালোবাসার কথা লেখা থাকলে আমি রাগ করব কেন? ভালোবাসা টাসা না। আপা অতি কুৎসিত কিছু কথা। আপা শোন মাকে কিছু বলার দরকার নেই।
ফুফুকে কি ঘটনাটা বলব?
না ফুফু, উল্টা আমার ওপর রাগ করবে। কোনো মার কাছেই নিজের ছেলের দোষ ধরা পড়ে না। তাছাড়া এইসব ঘটনায় সবার আগে দোষী ভাবা হয় মেয়েটাকে। ফুফু, কী বলবে জান? ফুফু বলবে বাংলাদেশে তো মেয়ের অভাব ছিল না। এত মেয়ে থাকতে জামান তোকে কেন এই চিঠি লিখলি? এই রহস্যটার মানে কী? তুই নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছিস যে তোকে এ ধরনের চিঠি লেখার সাহস পেয়েছে।
তিতলী বলল, ফুফুন এ রকম বলবে ঠিকই। তুই তো বেশ গুছিয়ে চিন্তা করা শিখে গেছিস।
আমি মোটেও গুছিয়ে চিন্তা করি না। আপা। যা মনে আসে বলে ফেলি। পড়তে পড়তেই সময় পাই না–এত চিন্তা করব কীভাবে।
নাদিয়া হাসল। এত সুন্দর করে হাসল যে তিতলীর তৎক্ষণাৎ ইচ্ছা করল বোনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকতে। সেটা করতে গেলে নাদিয়া বিরক্ত হবে। আচ্ছা! নাদিয়া কি জানে যত দিন যাচ্ছে সে তত সুন্দর হচ্ছে! না, তা সে জানে না। আয়নায় সে। মনে হয় নিজেকে দেখেও না। তার সমস্ত জগৎ পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ। তিতলীর ধারণা সে যদি প্রেমে পড়ে তাহলে কোনো মানুষের প্রেমে পড়বে না, কোনো একটা পাঠ্যবইয়ের প্রেমে পড়বে। তিতলী উঠে পড়ল।
মতিন সাহেব গোশত বা সিরকা কোনোটাই আনেন নি। গোশত প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, গোশত শরীরের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। সবচে’ খারাপ ধরনের প্রোটিন হলো এনিমেল প্রোটিন। সপ্তাহে একদিনের বেশি গোশত খাওয়া ঠিক না। এই সপ্তাহে এর মধ্যে দুদিন হয়ে গেছে–আর না। সিরকার প্রসঙ্গে বলেছেন-সিরাকাটা কোন কাজে লাগে? বাড়িটা তো কাবাব হাউস না যে সিরকা লাগবে, সয়াসস লাগবে।
সুরাইয়া স্বামীর সঙ্গে যুক্তিতর্কে যান নি। চুপ করে গেছেন। তাঁর মন একটু খারাপ হয়েছে। মেয়েটা শখ করে একটা জিনিস চেয়েছে।
মতিন সাহেব তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে রাগোরাগিও করেছেন। তিতলীর কলেজ বাদ দেয়া প্রসঙ্গে রাগারগি।
সকাল থেকে তো রিকশা ভাড়া রিকশা ভাড়া করে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল দরজা ভেঙে বাথরুমে ঢুকে পড়বে। যখন ভাড়া দিলাম তখন আর কোথাও যায় না। এর মানে কী? আব্দর দিয়ে দিয়ে সব ক’টা মেয়ের মাথা যে তুমি খেয়েছ সেটা কি তুমি জান? মেয়েরা কিছু বললে তোমার ইশ থাকে না। মেয়েদের কেউ মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করলে ওইটা নিয়েই থাক। মুখ দিয়ে সিরকা’ শব্দটা বের করেছে, তুমিও তসবি জপা শুরু করলে, সিরকা সিরকা।’ আদার এবং প্রশ্ৰয় কম দেবে। এর ফল আখেরে শুভ হবে।
মতিন সাহেব বাজার এনে দিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বসেছেন। তিতলীর কলেজের নোটিশ বোর্ডে ঝোলানোর জন্যে একটা বিজ্ঞাপন। তিনি নিজেই লিখবেন। কাল কলেজে যাবার সময় মেয়ের হাতে ধরিয়ে দেবেন। মেয়ে নিজের আগ্রহে এই কাজ করবে না। তেমন শিক্ষা তারা মার কাছ থেকে পায় নি। তাদের মা তাদের শুধু আদরই দিয়েছেশিক্ষা দেয় নি। মতিন সাহেব অনেক চিন্তা ভাবনা এবং পরিশ্রম করে জিনিসটা দাঁড় করলেন।
সহযাত্রীর জন্যে বিজ্ঞপ্তি
আমার বাসা কলাবাগানের অভ্যন্ততে। দেশের বর্তমান অশান্ত পরিবেশে রিকশাযোগে একা একা কলেজে অ্যাসবার সময় কিঞ্চিৎ ভীত থাকি। এমতাবস্থায় সহপাঠী বন্ধুদের জানাচ্ছি। তাহদের কেহ যদি কলাবাগান এলাকায় থাকেন এবং আমার সঙ্গে একত্রে রিকশায় আসা-যাওয়া করতে রাজি থাকেন তাহা হইলে আমার জন্যে অত্যন্ত শুভ হয়। রিকশা ভাড়া বাবদ যে অৰ্থ ব্যয় হয় তা সমান সমান ভাগাভাগি করা হইবে। ফলশ্রুতিতে অভিভাবকেরও অর্থনৈতিক সাশ্রয় হইবে।
যোগাযোগের ঠিকানা–
তিতলী বেগম
১২/১০ কলাবাগান। হলুদ কাঠের গেটওয়ালা বাড়ি।
দুপুরে খেতে বসে নাদিয়া উৎফুল্ল গলায় বলল, নিশ্চয় আপা রোধেছে। রঙ দেখেই টের পাচ্ছি। আপার রান্না।
তিতলী লজ্জিত গলায় বলল, আহ্লাদী করিস না, খা। তুমি যাই রাধ তাই এমন অপূর্ব কেন হয় বল তো? তুমি একটা রান্নার স্কুল দিও তো। আপা। দেখবে দলে দলে তোমার স্কুলে ছাত্র ভর্তি হবে।
যথেষ্ট হয়েছে।
মোটেই যথেষ্ট হয় নি। আপা তুমি কি জান তুমি খুব অল্প বয়সে বিধবা হবে? সুরাইয়া তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এটা কী ধরনের কথা? নাদিয়া বলল, আপা ভালো ভালো রান্না করবে। সেই রান্না খেয়ে খেয়ে দুলাভাই ফুলে ফেপে একাকার হবে। কোলেক্টরল হবে, হাই ব্লাডপ্রেসার হবে। তারপরেও খাওয়া ছাড়তে পারবে না। তারপর একদিন হার্ট অ্যাটাক।
সুরাইয়া বললেন, রসিকতা ভালো, এ ধরনের রসিকতা ভালো না। তওবা করি। বল তওবা।
নাদিয়া বলল, তওবা।
সুরাইয়া বললেন, তুই কথাবার্তা আরো সাবধানে বলবি। যা ইচ্ছা বলে ফেলিস।
তিতলী বলল, বক্তৃতা বন্ধ করা তো মা। বেচারি আরাম করে খাচ্ছে খাক।
সন্ধ্যাবেলা তিতলীর ফুফু নাফিসা খানম এলেন। পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি। কাঁধে গোলাপি চাদর। ছোটখাটো মহিলা, সরল ধরনের গোলগাল মুখ, কথা বলেন নিচু গলায়–কিন্তু তাঁর নিচু গলার প্রতিটি শব্দের গুরুত্ব অসীম।
নাফিসা খানম গাড়ি থেকে নেমেই ভুরু কোঁচকালেন। নষ্ট কলিংবেল এখনো বদলানো হয় নি। গত সপ্তাহে তিনি শক খেয়েছিলেন। মতিনকে বলে গেছেন ঠিক করতে। মতিন সেটা করে নি।
তিনি ড্রাইভারকে তৎক্ষণাৎ দোকানে পাঠালেন। ড্রাইভার ডিংডং শব্দ হয় এমন একটা কলিংবেল কিনবে, একজন ইলেকট্রিশিয়ানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। তিনি থাকতে থাকতেই কলিংবেল ঠিক হবে।
নাফিস খানম কারো বাড়িতেই খালি হাতে যান না। এখানেও এক কেজি জিলাপি নিয়ে এসেছেন। জিলাপি দোকানের কেনা না–তার নিজের বানানো। এক ময়রার কাছ থেকে তিনি মিষ্টি বানানো শিখছেন। জিলাপি ভালো হয়েছে। তবে জিলাপির প্যাঁচ ঠিকমতো হয় নি। আড়াই প্যাঁচ হবার কথা–তার কোনো কোনোটিতে তিন প্যাঁচ হয়েছে কোনোটাতে এক প্যাঁচ।
মতিন এসে বড়বোনকে কদম বুসি করলেন। এটা নতুন না, সব সময় করেন। নাফিসা খানম এত ভক্তিতেও বিচলিত হলেন না। শুকনো গলায় বললেন, কী রে তোকে না বললাম, কলিংবেল ঠিক করাতে। ঠিক করাস নি কেন?
মতিন আমতা আমতা করে বললেন–বেল কিনিয়েছি। বেল, ইলেকট্রিক তার সব কেনা, মিন্ত্রি পাচ্ছি না।
মিস্ত্ৰি পাবি না কেন? মিস্ত্রিরা সব দল বেঁধে গেল। কই?
আমার পরিচিত একজন মিস্ত্ৰি আছে–ও গেছে দেশের বাড়িতে।
পয়সা দিয়ে কাজ করাবি তার আবার পরিচিত-অপরিচিত কী?
কাল-পরশুর মধ্যে লাগিয়ে ফেলব। আপা।
তিতলীকে ওযুর পানি দিতে বল-মাগরেবের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। জিলাপি নিয়ে এসেছি— খা। গরম গরম খা। ঠাণ্ডা হলে ভালো লাগবে না।
নাফিসা খানম ওযু করে নামায পড়তে বসলেন। মতিন সাহেব হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যে কলিংবেল সমস্যা বেশিদূর গড়ায় নি।
সমস্যার এত সহজ সমাধান অবশ্যি হলো না। নামায শেষ করেই নাফিস খানম বললেন, মতিন তুই তোর কলিংবেল আর তারফার কী কিনেছিস আমাকে দেখা। আমি ড্রাইভারকে কিনতে পাঠিয়েছি যেটা ভালো সেটা লাগাব। বাকিটা তুলে রাখব।
মতিন মুখ শুকনো করে কলিংবেল খুঁজতে গেলেন। যে জিনিস কেনাই হয় নি। সে জিনিস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মতিন সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গা খুঁজছেন। আর কিছুক্ষণ পর পর বলছেন, আশ্চর্য পলিথিনের একটা কালো ব্যাগে ছিল–খাটের নিচে রেখেছি গোল কোথায়? তাঁর স্বগতোক্তি নাফিসা খানম শুনেও না শোনার ভাব করছেন। এত কিছু শোনার সময়ও তাঁর নেই। তিনি এসেছেন জরুরি কাজে-তিতলীর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে। ওই পাটি গা এলিয়ে দিয়েছিলো ফাইনাল কথা বলবে বলে ডেট দিয়ে আসে। নি। এখন আবার খানিকটা উৎসাহ দেখাচ্ছে। নতুন পরিস্থিতিতে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে তিনি আলাপ করতে এসেছেন। আলাপ তিনি করছেন সুরাইয়ার সঙ্গে তবে তিনি চাচ্ছেন মেয়েরাও ব্যাপারটা শুনুক। মতামত দেবে না, শুধু শুনে যাবে। বিয়েটিয়ে বিষয়ক গল্প শুনতে নাদিয়ার একেবারেই ভালো লাগে না–তারপরেও তাকে গভীর আগ্রহ নিয়ে জন্ম হচ্ছে। ফু যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ সবাই তাকে ঘিরে থাকবে এটাই অলিখিত নিয়ম।
নাফিস খাটে পা উঠিয়ে বসে আছেন। তার দুপাশে নদিয়া এবং তিতলী। নাতাশা ঠিক তার পেছনে হাঁটু গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাতাশার দায়িত্ব হচ্ছে ফুফুর চুল টেনে দেয়া। এই কাজটা নাকি নাতাশা খুব ভালো পারে।
ঘটনা। কী হলো শোন। রাত আটটা বাজে। তিতলীর ফুফার কাছে গেষ্ট এসেছে। আমি গেস্টদের চা আর নুডুলাস দিয়ে শোবার ঘরে এসেছি। খুবই মাথা ধরেছে। কাজের মেয়েটাকে বললাম চুল টেনে দিতে। সে চুল টানছে তখন টেলিফোন এল। খুবই নরম গলা–আপা কেমন আছেন? শরীর ভালো? এইসব ন্যাকামি টাইপ কথা। আমি গলা শুনেই বুঝেছি–কে। তারপরেও বললাম, চিনতে পারছি না তো কে বলছেন? বলল— আমি বুলা। আমি বললাম, ও আচ্ছা। বুলা হচ্ছে ছেলের মামি। পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে তো চর্বির ভাঁজে ভজে দুষ্টবুদ্ধি। আমাদের মতো সোজা সরল না। আমি বললাম কী ব্যাপার হঠাৎ টেলিফোন? সে বলে কী–আপা আপনার সঙ্গে একটু যে বসতে হয়। সোমবারে কি আপনার সময় হবে? আমি ঘললাম, না। এই সপ্তাহটা খুব ব্যস্ত থাকব। কোনোরকম আগ্ৰহ দেখলাম না। ভাবটা এ রকম করলাম যে আমার কোনো গরজ নেই। গরজ দেখালেই এরা মাথায় উঠে যায়। শুরুতে বেশি গরজ দেখানোর জন্যে। ওরা ঠাণ্ডা মেরে গিয়েছিল। যেই গরজ দেখানো বন্ধ ওমনি খোঁজ পড়েছে।
সুরাইয়া বললেন, ওদের আগ্রহ আছে?
আগ্রহ অবশ্যই আছে। তবে ভালো ছেলে একটা হাতে থাকলে যা হয়–দুনিয়ার মেয়ে বাজিয়ে দেখে। তাই করছে–দুনিয়ার মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছে। কোনো মেয়েরই ভালো কিছু চোখে পড়ছে না। শুধু খুঁতগুলো চোখে পড়ছে।
নাদিয়া বলল, ভালো ছেলে আপনি কাকে বলেন ফুফু?
নাফিসা খানম পানের বাটা থেকে পান মুখে দিতে দিতে বললেন, আমার কাছে ভালো ছেলের হিসেব খুব সোজা। ছেলের ঢাকা শহরে নিজের বাড়ি থাকতে হবে। ভালো একটা চাকরি থাকতে হবে। পরিবারের ছোট বা মেজো ছেলে হতে হবে–বড় ছেলের ওপর সংসারের দায়-দায়িত্ব থাকে। বড় ছেলে চলবে না। গায়ের রঙ ফরসা হতে হবে। রঙ ময়লা হলে তার মেয়েগুলোর রং হবে ময়লা–মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে জান বের হয়ে যাবে। লম্বা হতে হবে। বাপ বাটু হলো–ছেলেমেয়ে সব নাটবলুন্টু হয়। তোর বাবাকে ডাক তো তাকে দুটা কথা বলে বিদেয় হব।
মতিন শুকনো মুখে এসে দাঁড়ালেন। নাফিসা খাতুন চায়ের কাপে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, কলিংবেল পাওয়া গেছে?
না। পলিথিনের ব্যাগে করে খাটের নিচে এনে রেখেছিলাম।
ভালো করে ভেবে দেখ। কিনে হয়তো দোকানেই ফেলে এসেছিস।
সেটাও হতে পারে।
কিনেছিস কোথেকে?
নওয়াবপুর থেকে। কাল গিয়ে খোঁজ নিবি। পয়সা দিয়ে জিনিস কিনে দোকানে ফেলে আসা কোনো কাজের কথা না।
জ্বি বুবু।
আচ্ছা এখন যা।
মতিন হাঁপ ছাড়লেন। মনে হচ্ছে ঘাম দিয়ে তার জ্বর ছেড়েছে। নাফিসা বললেনতিতলী কাগজ আর কলম আন।। জিলাপির রেসিপি তোকে লিখে দিয়ে যাই। আমি মুখে মুখে বলি তুই লিখে নে। না নাদিয়া তুই লেখা। তোর হাতের লেখা ভালো।
নাদিয়া জিলাপির রেসিপি লিখছে। আজ তার অনেক সময় নষ্ট হলো। নষ্ট সময়টা কভার করার জন্যে অনেক রাত জগতে হবে।
সুন্দর করে লিখে রাখ উপকরণ–
ময়দা ১ কাপ
চিনি ১ কাপ
গোলাপজল ১ টেবিল চামচ
সয়াবিন তেল ১ কাপ।
ময়দা আধিকাপ পানিতে ভালো করে গুলে দুদিন ঢেকে রাখতে হবে…
রেসিপি দিয়ে নাফিস উঠলেন। সুরাইয়ার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। সামনের মাসের খরচ চার হাজার টাকা। টাকার খাম সুরাইয়া খুব লজ্জিত মুখে নিলেন। তার লজ অবশ্যি নাফিসা খানমের চোখে পড়ল না। তিনি কলিংবেল লাগানো হয়েছে কিনা দেখতে গেলেন। মিস্ত্ৰি কলিংবেল লাগিয়েছে। নাফিসা খানম দুবার বেল টিপলেন। বেলের আওয়াজে তেমন খুশি হলেন না। ক্যানক্যানে শব্দ। কানে লাগে।
নাদিয়া রাত একটা পর্যন্ত পড়ে। বড় ফুফুর জন্যে দেড় ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। সেই সময় পুষিয়ে নেবার জন্যে সে আড়াইটা পর্যন্ত পড়ে ঘুমোতে গেল। দুটা খাটের একটাতে সে একা ঘুমোয় অন্যটাতে তিতলী নাতাশাকে নিয়ে শোয়। কেউ সঙ্গে শুলে নাদিয়ার ঘুম আসে না। এটা তার ছেলেবেলার অভ্যাস। একমাত্র ব্যতিক্রম বড় আপা। বড় আপা তার সঙ্গে ঘুমেলে কোনো সমস্যা হয় না। বরং ঘুমের আগে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করতে পেরে ভালো লাগে।
রাত আড়াইটার সময় কারো জেগে থাকার কথা না। নাদিয়া ঘুমোতে এসে দেখে তিতলী জেগে আছে। নাদিয়া বিস্মিত হয়ে বলল, এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন?
তিতলী হাই তুলতে তুলতে বলল, তোর জন্যে জেগে আছি। ঘুমের আগে খানিকক্ষণ গল্প না করলে ভালো লাগে না।
আপা থ্যাংক য়্যু।
আজ কী নিয়ে গল্প করবি?
আমি তো আপা গল্প করতে পারি না। তুমি গল্প করবে। আমি শুনব।
কী গল্প শুনতে চাস?
কলেজে কী মজাটজা কর সেই সব বল।
কলেজে কোনো মজাটজা করি না। মজা মজা ভাব করি।—এই পর্যন্তই।
তোমার মজা মজা ভাবের গল্প কর আমি শুনি। আমার নিজের কোনো মজা করতে ইচ্ছে করে না-অন্যের মজা শুনতে খুব ভালো লাগে। হাসান ভাইয়া হঠাৎ হঠাৎ যখন আসে তুমি মুখটুখ লাল করে তার সঙ্গে গল্প কর। আমার কী যে ভালো লাগে! কিন্তু আপা আমি কোনোদিনও এ রকম করতে পারব না। একটা ছেলের সঙ্গে আমি গল্প করছি।—ভাবতেই পারি না।
গল্প করায় সমস্যাটা কী?
কী গল্প করব৷—আমি তোমাকে ভালোবাসি, এইসব বলব। ভাবতেই তো গা শিরশির করছে।
একটা ছেলে আর মেয়ে যখন গল্প করে তখন কেউ কিন্তু বলে না–আমি তোমাকে ভালোবাসি।
বলে না কেন?
ভালোবাসার কথা বলার দরকার হয় না।
হাসান ভাই তোমার সঙ্গে কী নিয়ে গল্প করে?
ও কী গল্প করবে? ও চুপচাপ থাকে।
তুমি এক বকবক করে যাও?
হুঁ।
কী নিয়ে বকবক কর?
ভালো যন্ত্রণা হলো দেখি! আমি কি মুখস্থ করে রেখেছি নাকি?
হাসান ভাইয়ের কোন জিনিসটা তোমার সবচে’ ভালো লাগে আপা?
জানি না। এই নিয়ে ভাবি নি।
একজন ছেলের প্রেমে তুমি হাবুডুবু খাচ্ছ, আর তাকে কী জন্যে ভালোবাস তা জান না?
তুই হঠাৎ এমন বকবক শুরু করলি কেন?
নাদিয়া বলল, আর করব না।
আয় শুয়ে পড়ি।
নাদিয়া লজ্জিত গলায় বলল, ছাদে যাবে আপা?
তিতলী বিস্মিত গলায় বলল, রাত তিনটার সময় ছাদে যাবি মানে? তোর মাথায় আসলে ছিট টিট আছে।
নাদিয়া মাথা নিচু করে হাসছে।
তিতলী চিন্তিত গলায় বলল, শোন নাদিয়া আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে তুই রাত দুপুরে এ রকম একা একা ছাদে যাস। যাস নাকি?
নাদিয়া হাসছে। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসছে।
এ রকম করে হাসছিস কেন?
আমি সহজভাবেই হাসছি তোমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। চল না। আপা ছাদে যাই। দশ মিনিটের জন্যে।
বৃষ্টিতে ছাদ পিছল হয়ে আছে।
অকারণে অজুহাত তৈরি করবে না তো আপা। তুমি যদি এখন আমার সঙ্গে ছাদে যাও তাহলে তোমাকে মন খুশি হয়ে যাবার মতো একটা কথা বলব।
তিতলী বোনের সঙ্গে ছাদে গেল। নিশিরাতের ছাদ গা কেমন জানি ছমছম করে। তিতলী বলল, তুই একা একা ছাদে এসে কী করিস?
কিছু করি না। আকাশের তারা দেখি।
আমাকে কী কথা বলবি বলেছিলি বলে ফেল। কী সে কথা যা শুনলে আমার মন ভালো হয়ে যাবে?
নাদিয়া হাসতে হাসতে বলল, কোনো কথা না আপা। তোমাকে ছাদে আনার জন্যে এটা হলো আমার একটা ট্রিকস। সরি।
ট্রিকস করার দরকার ছিল কি? আমাকে বললেই আমি আসতাম।
না। আসতে না। আচ্ছা। আপা আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তুমি যদি রাগ না কর তাহলে বলি।
রাগ করব না–বল।
আগে প্ৰতিজ্ঞা করা যে রাগ করবে না।
তোর এইসব প্রতিজ্ঞা ফ্ৰতিজ্ঞা ছেলেমানুষি আমার ভালো লাগে না— বললাম তো রাগ করব না। কথাটা কী?
নাদিয়া মুখ নিচু করে প্রায় ফিসফিস করে বলল, তুমি কি কখনো হাসান ভাইকে চুমু খেয়েছ আপা?
তিতলী স্তম্ভিত হয়ে গেল। নাদিয়ার মতো মেয়ে যে এ রকম অশালীন একটা কথা বলতে পারে তা তার কল্পনাতেও আসে নি। হতভম্ব ভাব সামলিয়ে তিতলী বলল, তুই এসব কী বলছিস! পড়াশোনা করতে করতে তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
সরি আপা।
আমি খুব রাগ করেছি। অসম্ভব রাগ করেছি।
তুমি কিন্তু বলেছিলে রাগ করবে না।
আমি তো বুঝতে পারিনি তুই এ ধরনের কথা বলতে পারিস।
আর কোনোদিন বলবো না। আপা। তুমি কি খুব বেশি রাগ করেছ?
হ্যাঁ।
তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব দাও নি।
তারপরেও তুই জবাব চাচ্ছিস?
হ্যাঁ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমি তো কল্পনাও করতে পারি না। আপা একটা মেয়ে কী করে একটা ছেলেকে চুমু খাবে।
তিতলীর ইচ্ছে করছে বোনের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে কঠিন গলায় বলল, চল নিচে যাই।
আপা তোমার মনটা তো খুব বেশি খারাপ হয়েছে–এখন তোমার মন ভালো করে দিচ্ছি। তোমাকে আমি বলছিলাম না যে তোমার মন খুশি হবার মতো একটা কথা বলব। এটা কোনো ট্রিকস না–সত্যি। কথাটা হচ্ছে কাল তুমি যখন নিউমার্কেটে গিয়েছিলে তখন হাসান ভাই এসেছিলেন।
কখন, সকালে?
হুঁ।
কাল দিন গেল, আজকের দিন গেল তুই বলিস নি কেন?
তোমাকে চমকে দেবার জন্যে জমা করে রেখেছিলাম। হাসান ভাই যখন এলেন তখন বাবা বাসায় ছিলেন না। কাজেই আমি উনাকে যত্ন করে বসালাম। অনেক গল্প করলাম।
কী গল্প করলি?
উনি তো গল্প করতে পারেন না। আমি একাই গল্প করলাম।
তুই গল্প করতে পারিস নাকি?
মাঝে মাঝে আমি খুব মজা করে গল্প করতে পারি। হাসির কথা বলতে পারি। আমি মানুষের গলার স্বরও নকল করতে পারি।
সে কী!
আমি তোমার গলার স্বর নকল করে হাসান ভাইকে শুনিয়ে দিলাম–উনি হোসেছেন।
তোর যে এমন গোপন প্ৰতিভা আছে তা তো জানতাম না।
হাসান ভাই তোমার জন্যে একটা চিঠি আমার কাছে দিয়ে গেছেন। এই নাও চিঠি। খামে বন্ধ চিঠি–এই চিঠি দিতেও তার কী সংকোচ! আমি শেষ পর্যন্ত বললাম, হাসান ভাই ভয় নেই। আমি চিঠি পড়ব না। আমার ওপর রাগ কি তোমার একটু কমেছে আপা? মনে হচ্ছে কমেছে। চল নিচে যাই। তোমার নিশ্চয়ই চিঠি পড়ার জন্যে প্ৰাণ ছটফট করছে।
তিতলী নিজের ঘরে এসে চিঠি খুলল। একটু দূর থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে নাদিয়া বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুপাতার চিঠি। পুরো পাতাজুড়ে গুণ চিহ্ন আঁকা। তিতলী লজ্জা পেয়ে হাসল। এই গুণ চিহ্নের মানে শুধু তারা দুজনই জানে।
নাদিয়া বলল, এত লম্বা চিঠি এত তাড়াতাড়ি পড়া শেষ হয়ে গেল?
হুঁ।
এখন কী করবে? বাতি নিভিয়ে দেবে? শুয়ে পড়বে?
হুঁ।
বাতি নিভিয়ে নাদিয়া বোনের সঙ্গে ঘুমোতে এল। বোনের বুকে খানিকক্ষণ মাথা ঘষে আদুরে গলায় বলল, আপা গুণ চিহ্নের মানে কী? চুমু? বলেই নাদিয়া খিলখিল করে হাসল। হাসি থামলে চাপা গলায় বলল-সরি আপা, তোমার চিঠি আমি পড়েছি। লোভ সামলাতে পারি নি। তুমি যদি এখন শাস্তি হিসেবে ধাক্কা দিয়ে আমাকে খাট থেকে ফেলে দিতে চাও ফেলে দিতে পাের। আমি কিছু মনে করব না।
তিতলী বোনকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানল।
সন্ধ্যা এখনো হয় নি
সন্ধ্যা এখনো হয় নি। কিন্তু ঘরের ভেতর অন্ধকার। দরজা-জানালা বন্ধ। ভেতরে বাতি জ্বালানো হয় নি। বাতাস ভারি হয়ে আছে। বাতাসে সিগারেটের কটু গন্ধ। সিগারেটের গন্ধের সঙ্গে মিশেছে বমির গন্ধ। খালি পেটে হুইঙ্কি খাওয়ার ফল ফলেছে–সাখাওয়াত বমি করে ঘর ভাসিয়েছে। সাখাওয়াতের মদ্যপানের অভ্যাস নেই। গত কয়েক দিন খুব খাচ্ছে–আজ বেশি খেয়ে ফেলেছে। বমি করেও তার উৎসাহ কমে নি–হানড্রেড পাইপারের বোতল উঁচু করে বলল, আর মাত্র তিন আঙ্গুল আছে। আয় সবাই এক আঙ্গুল করে খেয়ে বোতল ফেলে দিই।
রকিব জবাব দিল না। সিগারেট ধরাল। তার প্যাকেটের শেষ সিগারেট। ঘরে আর কারো কাছেই সিগারেট নেই। রাত ন’টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কয়েক প্যাকেট সিগারেট এনে রাখা দরকার ছিল। এখন ঘর থেকে বের হয়ে সিগারেট আনা ঠিক হবে না। রাত ন’টায় এক সঙ্গে বের হতে হবে।
সাখাওয়াত চারটা গ্রাসে হুইঙ্কি ঢালছে। মাপমতো ঢালার চেষ্টা করছে। তার হাত কাঁপছে। বদরুল বলল, এই সাখাওয়াত তোর মুখে বমি লেগে আছে। মুখ ধুয়ে আয় না!
সাখাওয়াত হাসিমুখে বলল, আর মুখ ধোয়াধুয়ি। আগে মাল খেয়ে নি।
রকিব বলল, তিন গ্লাসে ঢাল। আমি খাব না।
খাবি না কেন?
তোর কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে? খেতে ইচ্ছা করছে না, খাব না।
শালা তোর বাপ খাবে।
রকিব ক্রুদ্ধচোখে তাকাল। তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেছে। সাখাওয়াত ভীত গলায় বলল, এ রকম করে তাকাচ্ছিস কেন?
রকিব বলল, বাপ তুলে আর যদি কথা বলিস তোর নিজের বমি তোকে চেটে খাইয়ে দেব।
ঠাট্টা করছিলাম রে দোস্ত। থাক তোর খেতে হবে না–তোরটা আমি খাব। এই দেখ খাচ্ছি।
রকিব মুখ ফিরিয়ে সিগারেট টানছে। ঘড়িতে মাত্র ছাঁটা বাজে। ন’টা বাজতে এখনো তিন ঘণ্টা। এই দীর্ঘ সময় শুধু শুধু বসে থাকতে হবে ভাবতেই তার মাথা ধরে যাচ্ছে। তার ওপর সিগারেট শেষ হয়ে গেছে।
ঘরের এক কোণায় বিড়ি ব্যবসায়ী হাজি মুসাদেক পাটোয়ারী বসে আছেন। তার হাত পেছন দিক করে বাধা। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে আছেন। যদিও এখন তার ভয় থাকার কথা না। তার পরিবার থেকে তিন লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। রাত ন’টার সময় তাকে একটা বেবিট্যাক্সিতে তুলে দেয়া হবে। সেই বেবিট্যাক্সি নিয়ে তিনি যেখানে ইচ্ছা! সেখানে যেতে পারেন।
হাজি মুসাদেক পাটোয়ারী বিড়বিড় করে বললেন, বাবা আপনাদের দয়ার কথা কোনোদিন ভুলব না। আমি খাস দিলে আপনাদের জন্য দেয়া করি।
হাজি সাহেব কথাগুলো আন্তরিকভাবেই বললেন। তিনি বেঁচে আছেন এবং তাকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে এই আনন্দেই তিনি অভিভূত।
বাবারা একটা কথা।
মোজাম্মেল কঠিন গলায় বলল, অকারণে কথা বলবেন না। চুপচাপ থাকেন। ন’টা বাজুক ছেড়ে দিব।
বাবারা একটু পিশাব করব।
পিশাব ন’টার পরে করবেন। বাড়িতে গিয়ে আরাম করে পিশাব করবেন। কমোডে বসে করবেন।
জ্বি আচ্ছা।
সাখাওয়াত বলল, হাজি সাহেবকে একটু মাল খাইয়ে দিব? আমি আর খেতে পারছি না।
কেউ কোনো জবাব দিল না। সাখাওয়াত উৎসাহের সঙ্গে বলল, কি হাজি সাহেব, হুইঙ্কি খাবেন?
বাবারা আপনারা বললে অবশ্যই খাব।
সাখাওয়াত আনন্দিত স্বরে বলল, হাজি সাহেব হুইস্কি খেতে চায়।
রকিব বলল, সাখাওয়াত তুই বাড়াবাড়ি করছিস।
সাখাওয়াত সাথে সাথে বলল, ঠাট্টা করছি রে দোস্ত। আমি কি আর সত্যি খাওয়াতাম! তোরা আমাকে ভাবিস কী?
ছড় ছড় শব্দ হচ্ছে।
সবাই হাজি সাহেবের দিকে তাকাল। হাজি সাহেব বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, পিশাব হয়ে গেছে। বাবারা। বয়স হয়েছে, ডায়াবেটিস আছে। বাবারা কিছু মনে করবেন না। আপনাদের দয়ার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। আমি খাস দিলে আপনাদের জন্যে দোয়া করি।
ঘ্যানঘ্যান করবেন না। চুপ থাকেন।
বাবারা একটু পানি খাব।
রকিব বলল, সাখাওয়াত দেখ তো পানি আছে কি না।
সাখাওয়াত অপ্ৰসন্ন মুখে উঠে দাঁড়াল। এটা সাখাওয়াতের বোনের বাড়ি। বোন মিডল ইষ্টে তার স্বামীর কাছে গিয়েছে। বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সাখাওয়াতের কাছে দেয়া। মাঝে মধ্যে সাখাওয়াত বন্ধুদের নিয়ে আসর বসােত। নিরিবিলিতে বাড়ি। রাতভর হইচই করে আডডা দিলেও কেউ কিছু বুঝবে না। দুদিন দু রাত হাজি সাহেবকে এ বাড়িতে রাখা হয়েছে। তাকে ছেড়ে দিলেও তিনি এই বাড়ি চিনে বের করতে পারবে না। তাকে আনা হয়েছে গভীর রাতে–কম্বল দিয়ে মুড়ে। তাকে ছাড়াও হবে এই ভাবে। সাখাওয়াত পানির বোতল এনে দিল। রকিব বলল, গ্লাস দে। হাত বাধা, পানি খাবে কীভাবে? হাতের বাঁধন খুলে দে।
হাজি সাহেব অনবরত নিচু গলায় বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। সাখাওয়াত বলল, বিড়বিড় করে কী বলেন?
বাবারা দুরুদ শরিফ পড়তেছি। আপনাদের ডিসটার্ব হলে পড়ব না।
পাকসাফ হয়ে দুরুদ পড়বেন। পেশাব করে ঘর ভাসিয়ে দুরুদ শরীফ।
বাবারা আমি খুবই শরমিন্দা। আমি পায়ে ধরে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই।
হাজি সাহেব রকিবের পায়ে ধরার জন্যে এগোলেন। রকিব কঠিন গলায় বলল, যেখানে বসে আছেন বসে থাকুন। খবরদার নড়বেন না।
জ্বি আচ্ছা বাবা।
সাখাওয়াত বাঁধন খুলতে পারছে না। সাহায্য করার জন্য বদরুল এগিয়ে গেল। সে বিরক্ত গলায় বলল, হাজি সাহেবর গা তো পুড়ে যাচ্ছে। হাজি সাহেব বললেন, সামান্য জ্বর হয়েছে বাবারা। বাড়িতে গেলে ইনশাল্লাহ আরোগ্য হব।
পুলিশের কাছে বা অন্য কারো কাছে আমাদের নাম বলবেন না তো?
জ্বি না বাবারা। পাক কোরআনের দোহাই, নবীজীর দোহাই, কাউরে কিছু বলব না। কোরআন মজিদ নিয়া আসেন কোরআন মজিদে হাত রেখে প্ৰতিজ্ঞা করব।
রকিব ঘড়ি দেখল। ছটা পয়ত্রিশ। মাত্র পয়ত্ৰিশ মিনিট পার হয়েছে। আরো দুই ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট পার করতে হবে। সর্বনাশ! এত সময় পার করবে। কীভাবে। সাখাওয়াত বলল, দোস্ত সিগারেট দে।
সিগারেট নাই।
সর্বনাশ! সিাগরেট ছাড়া চলবে কীভাবে? প্যাকেট খুলে দেখ না ফাঁকেফুকে থাকতেও পারে।
সাখাওয়াত তুই কথা বেশি বলছিস। চুপ থাক।
তুই ঝিম ধরে বসে আছিস কেন? তোর কী হয়েছে?
চুপ থাক।
শালা তুই চুপ থাক।
রকিব উঠে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড চড় কষাল। সাখাওয়াত উল্টে পড়ল তার নিজের বমিতে।
হাজি সাহেব বিড়বিড় করে আবারো দুরুদ শরীফ পড়ছেন। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এরা কি তাকে সত্যি ছাড়বে?
রাত ন’টায় হাজি সাহেবকে বেবিট্যাক্সিতে তুলে দেয়া হলো। তিনি বসেছেন মাঝখানে, একপাশে বদরুল অন্য পাশে সাখাওয়াত। বদরুল হাজি সাহেবের মাথা চেপে ধরে আছে। যাতে তিনি কিছু দেখতে না পান। তারা কিছুদূর গিয়ে নেমে পড়বে। হাজি সাহেব এক এক যাবেন। হাজি সাহেব বিড়বিড় করে আবারো বললেন, বাবারা আপনাদের দয়ার কথা কোনোদিন ভুলব না। আমি আপনাদের জন্যে খাস দিলে দোয়া করি।
রকিব এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনল। চমানবাহার দেয়া মিষ্টি পান কিনল এক খিলি।
তিন লাখ টাকার ভাগাভাগিতে তার অংশে পড়েছে এক লাখ তিরিশ। সে আরো বেশি নিতে পারত, নেয় নি। এক লাখ টাকা আলাদা করে রাখতে হবে। কিছুদিনের জন্যে গা ঢাকা দেয়াও দরকার। পাসপোর্ট করে ইন্ডিয়া ঘুরে এলে হয়। তিন হাজার টাকা ফিস দিলে চব্বিশ ঘণ্টায় পাসপোর্ট হয়। ইন্ডিয়ায় দেখার অনেক কিছু আছে। কোনারকের সূর্যমন্দিরটা নাকি দেখার মতো। কোনারক কোথায় কে জানে? খোঁজ নিতে হবে। পাসপোর্ট করতে ছবি লাগে। ছবিটা আজকে তুলে ফেললে কাল পাসপোর্টের টাকা জমা দেয়া যায়। এত রাতে কি কোনো স্টুডিও খোলা আছে? আছে নিশ্চয়ই। রাত ন’টা এমন কিছু রাত না। রকিব স্টুডিওর খোজে রওনা হলো। আকাশ পরিষ্কার। চাঁদ উঠেছে। সুন্দর জোছনা। জোছনায় হাঁটতে রকিবের বেশ ভালো লাগছে। নতুন প্যাকেট খুলে সিগারেট ধরাল। নতুন প্যাকেটের প্রথম সিগারেটের স্বাদ আলাদা।
ক্ষিধে লেগেছে। প্ৰচণ্ড ক্ষিধের সময় সিগারেট ধরালে ধোয়াটা চট করে মাথায় গিয়ে লাগে। এখনো তাই হচ্ছে। ক্ষিধের দোষ নেই–দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি। শিঙাড়াবাদাম, এখন বাজে রাত সাড়ে ন’টা, ক্ষিধের দোষ কী? কোনো একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে চাইনিজ ফাইনিজ খেয়ে নিলে হয়। রেস্টুরেন্টে একা খেতে ইচ্ছে করে না। রেক্টরেন্টে একা খেতে যাবার অর্থ–এই মানুষটার সংসার নেই, বন্ধুবান্ধব নেই। বয় বেয়ারার চোখে করুণা চলে আসে। সে করুণার ধার ধারে না।
বাসায় চলে গেলে কেমন হয়। বাসায় সবাই সকাল সকাল খেয়ে ফেলে। ভাত তরকারি কিছুই হয়তো নেই। তাতে কী, রীনা ভাবি চোখের নিমিষে চাল ফুটিয়ে একটা ডিম ভেজে দেবে। ভাপ ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে ডিমভাজা–এই তো যথেষ্ট। রীনা ভাবির কাছ থেকে টাকাটা নেয়া হয়েছিল, টাকাটা ফেরত দেয়া দরকার। টগর এবং পলাশের জন্য কিছু গিফটও কেনা দরকার। খেলনার দোকান কি খোলা আছে? গরমের সময় রাত দশটা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকার কথা। টগর এবং পলাশের পছন্দের খেলনা একটাই’বল’। যখনই জিজ্ঞেস করা হয়–কী খেলনা চাই ওরা বলবে, ‘বল’। সে নিজেই ওদের চার-পাঁচটা ‘বল’ দিয়েছে। ঠিক আছে–পুরনো বলের সঙ্গে যুক্ত হোক আরো দুটা ‘বল’। বলে বলে ধুলপরিমাণ।
রকিব দুটা ‘বল’ কিনল।
দোকানদার বলল, স্যার রঙ পেন্সিল কিনবেন? চাইনিজ পেন্সিলের সেট আছে, দাম খুব সস্তা, আশি টাকা করে।
রকিব দুই সেট পেন্সিলও কিনে ফেলল। সুন্দর সুন্দর কলম বিক্রি হচ্ছে। দেখে মনে হয়। ফাউন্টেন পেন, খুললে দেখা যায় বল পয়েন্ট। কালির কলম বোধহয় পৃথিবী থেকে উঠে যাচ্ছে। একবার রীনা ভাবি বলছিল–কালির কলমে লিখতে তার সবচে’ ভালো লাগে। একটা কালির কলম কিনে ফেললে হয়। রকিব দেখে শুনে কালির কলমও একটা কিনল। দাম বেশি নিল না পাঁচ শ টাকা। নিক রীনা ভাবিকে কখনো কোনো গিফট দেয়া হয় না।
সবার জন্যে একটা করে গিফট কিনলে কেমন হয়? কত আর টাকা লাগবে? দোকানটা ছোট। সবার পছন্দসই জিনিস। এখানে পাওয়া যাবে না। গুলশানের দিকে গেলে হয়। গুলশানের দোকানগুলো জিনিসপত্রে ঠাসা থাকে। লায়লার জন্যে একটা ঘড়ি কিনতে হবে। লায়লার হাতঘড়ি চুরি হয়ে গেছে আর কেনা হয় নি।
রকিব দোকান থেকে বেরোল। তার কেমন যেন মাথা ঘুরছে। শরীর মনে হয় ভেঙে আসছে। সাততলা দালানে দ্রুত উঠে এলে যেমন লাগে তেমন লাগছে, অথচ আজ সে কোনো পরিশ্রমই করে নি। বলতে গেলে সারাদিনই সাখাওয়াতের বোনের বাসায় বসা। রকিব রিকশা নিল। বাসায় যাবার পরিকল্পনা বাদ দিল। তার মুখ দিয়ে নিশ্চয়ই ভক ভক করে গন্ধ বেরোচ্ছে। ভাড়া ঠিক করার সময় রিকশাওয়ালা অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিল। কথাও বলছিল উঁচু গলায়। মাতালদের সঙ্গে মানুষ সব সময় উঁচু গলায় কথা বলে। সবাই ধরেই নেয় নিচু গলায় কিছু বললে মাতালরা শুনতে পায় না।
সে মাতাল না। তার মাথা ঠিক আছে। খুব ঠিক আছে।
সন্ধ্যা মিলাবার পর
সন্ধ্যা মিলাবার পরপর খানিকটা সময় হাসানের খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটে। মনে হয় কিছুই করার নেই। ঘরে মন টেকে না, বাইরেও মন টেকে না। ব্যাপারটা কি শুধু তার একারই হয় না কমবেশি সবার হয়? এই প্রশ্ন মাঝে মাঝে তার মনে এলেও উত্তর জানার সে কোনো চেষ্টা করে নি। এ রকম এক সন্ধ্যায় মনের অস্থির ভােব কাটাবার জন্যে সে সুমিদের বাসায় উপস্থিত হলো। উপস্থিত হয়ে সে খানিকটা লজ্জায় পড়ে গেল। সুমি পড়ছে তার স্যারের কাছে। স্মার্ট ধরনের যুবক। চোখে চশমা। ঠোঁটের ওপর ঘন গোফ। মনে হচ্ছে সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। এরা ছাত্রীর সঙ্গে গল্প করে সময় নষ্ট করে না। পড়া শেষ করে যাবার সময় একগাদা হোমওয়ার্ক দিয়ে যায়। সুমির মা হাসানকে ছাড়িয়ে দিয়ে নতুন এই টিচার রেখেছেন। হাসানের ওপর আস্থা রাখতে পারে নি। ভদ্রমহিলা যদিও তাকে বলেছিলেন মেয়েকে তিনি নিজেই পড়াবেন। হাসান। তাই বিশ্বাস করেছিল।
সুমি হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনি কিন্তু চলে যাবেন না। এক্ষুণি আমার পড়া শেষ হবে।
সুমির এই কথাতেও তার নতুন শিক্ষক ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে। এটিও সিরিয়াস শিক্ষকের নমুনা। সিরিয়াস শিক্ষক পড়াশোনা ছাড়া যে-কোনো কথায় ভুরু কুঁচকবেন। তিন বছরের মাথায় তার কপালে পার্মানেন্ট ‘ভুরু-কুঁচকা’ দাগ পড়ে যাবে। হাতের রেখা দেখে ভবিষ্যৎ বলার মতো ভুরু-কুঁচকা দাগ দেখে বলে দেয়া যাবে ইনি একজন আদর্শ শিক্ষক।
হাসান চুপচাপ বসে আছে। ঘরের পরদা সরিয়ে সুমির মাও তাকে এক ঝলক দেখেছেন। তাকে দেখে খুশি হয়েছেন না বিরক্ত হয়েছেন হাসান তা বুঝতে পারে নি। তিনিও কি হাসানের মতো অস্বস্তিতে পড়েছেন? অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা অবশ্যি ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি। তারা যে-কোনো পরিস্থিতি অতি দ্রুত সামাল দিতে পারে। পরম শক্রকেও হাসিমুখে জিজ্ঞেস করতে পারে–তারপর ভাই কী খবর?
সুমির পড়া শেষ হয়েছে। তার টিচার এখন হোমওয়ার্ক দাগিয়ে দিচ্ছেন।
সুমি।
জ্বি স্যার।
আগামীকাল আমার আসতে আধঘণ্টা দেরি হবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
জ্বি আচ্ছা বললে হবে না, তোমার মাকে বলতে হবে, তিনি যেন আধঘণ্টা পরে গাড়ি পাঠান।
আমি বলব।
নতুন টিচার উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন হাসানের দিকে। সেই দৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ সন্দেহ— ‘এ আবার কে?’–টাইপ দৃষ্টি।
হাসান নতুন শিক্ষকের ভাগ্যে সামান্য ঈর্ষা অনুভব করল। ইনাকে গাড়ি দিয়ে আনা-নেয়া করা হয়। হাসানের বেলা কখনো তা করা হয় নি। একবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিল–সুমি বলল, ‘মা স্যারকে গাড়ি দিয়ে আসুক’। সুমির মা বলেছিলেন, ড্রাইভার আজ সারাদিন গাড়ি চালিয়েছে। এখন রেস্ট নিচ্ছে। গাড়ি বের করতে বললে রাগ করবে। হাসান ড্রাইভারকে রাগ করতে দেয় নি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রওনা হয়েছিল।
সুমি পা দোলাতে দোলাতে বলল, স্যার আজ যে আপনি আসবেন তা কিন্তু আমি জানতাম।
হাসান একটু চমকাল। জগতের অনেক বিস্ময়কর রহস্যের মতো একটি রহস্য হলো আট বছরের বালিকা এবং একুশ বছরের তরুণীর কথার ভেতরও মিল আছে। তারা একই ভঙ্গিতে কথা বলে। সুমি সামনের খালি সোফায় বসেছে। পা নাচাচ্ছে। তিতলীও সুমির মতো পা নাচায়। এবং তিতলীও প্রায়ই বলে তুমি যে আজ আসবে তা কিন্তু আমি জানতাম।
আমি যে আজ আসব তুমি জানতে?
জ্বি।
কীভাবে জানতে? শালিক দেখেছিলে?
শালিক দেখি নি। শালিক দেখলে তো কেউ আসে না। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হয়েছে আপনি আসবেন।
হাসান সিরিয়াস শিক্ষকদের মতো ভুরু কুঁচকে ফেলল। মেয়েটি কি সত্যি কথা বলছে? না তাকে খুশি করার জন্যে বাক্য তৈরি করছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। যেদিন যেদিন বাবার চিঠি আসে। আমি আগে আগে বলে দেই। এই জন্যেই না বিশ্বাস করেছে।
তুমি কেমন আছ সুমি?
ভালো আছি। তোমার নতুন স্যার কেমন?
ভালো।
আমার চেয়ে ভালো?
হুঁ।
তোমার ধারণা আমি বেশি ভালো না?
আপনি তো ভালো পড়াতে পারতেন না।
ও আচ্ছা।
আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
না রাগ করি নি। শোন সুমি আমি তোমার জন্যে একটা বই নিয়ে এসেছি।
ইংরেজি বই?
না, বাংলা। পথের পাঁচালী।
সত্যজিত রায়ের? না। সত্যজিত রায় তো ছবি বানিয়েছিলেন–এটা মূল বই বিভূতিভূষণের লেখা।
বাংলা গল্পের বই পড়তে আমার ভালো লাগে না।
হাসান বইটি বাড়িয়ে দিল। সুমি বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাল না। সে পা দোলাচ্ছে এবং হাসানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে।
হাসছ কেন সুমি?
এমনি হাসছি।
তোমার পরীক্ষা কবে?
পরীক্ষা দেরি আছে। আপনি এত রোগা হয়ে গেছেন কেন স্যার?
রোগা হয়ে গেছি নাকি?
হুঁ। আপনার খুব জ্বর হয়েছিল তাই না?
জুর অবশ্যি হয়েছিল। তুমি জানলে কীভাবে?
সুমি জবাব দিল না। আগের মতো রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল এবং পা দোলাতে লাগল। ট্রেতে করে শিঙাড়া এবং চা নিয়ে সুমির মা ঢুকলেন। এটি একটি বিশেষ ভদ্রতা। অন্য সময় কাজের মেয়ে আসে।
হাসান সাহেব কেমন আছেন?
জ্বি ভালো।
আপনার ছাত্রী আজ সকালেই বলছিল। আপনি আসবেন।
হাসান চুপ করে রইল। সুমির মা বসতে বসতে বললেন, আপনার জন্যে আপনার ছাত্রী খুব ব্যস্ত থাকে। প্রতিদিন সে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার সঙ্গে আপনার গল্প করবে।
আমাকে নিয়ে গল্প করার মতো তেমন মালমসলা তো তার কাছে নেই।
গল্প করার জন্যে। ওর কোনো মালমসলা লাগে না। বানিয়ে বানিয়ে সে অনেক কিছু বলতে পারে। আপনার ছবিও সে এঁকেছে। সেগুলো কি দেখেছেন?
জ্বি না।
সুমি স্যারকে তোমার ছবি দেখাও।
না।
না কেন? ছবিগুলো তো সুন্দর হয়েছে। এনে দেখাও।
না।
সুমি পা দোলানো বন্ধ করে উঠে চলে গেল। তার জন্যে আনা বইটিও নিয়ে গেল না। ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে রইল অনাদরে। সুমির মা বললেন, আপনার ছাত্রী যে কীসে রাগ করে কীসে রাগ করে না তা বুঝা খুব মুশকিল। এখন রাগ করে উঠে গেল।
রাগ করল কেন?
একমাত্র সেই জানে কেন। হাসান সাহেব চা খান। আপনি এসেছেন আমি খুশি হয়েছি। সামনের মাসে সুমির বাবা আসবেন—তখন আপনাকে খবর দেব। আপনি এসে আমাদের সঙ্গে একবেলা ডালভাত খাবেন।
জ্বি আচ্ছা। আজ উঠি?
একটু বসুন সুমিকে ডেকে নিয়ে আসি। ওকে হ্যালো বলে যান। জানি না সে আসবে কি না।
সুমি এল না। তবে সুমির মা প্ৰথমবারের মতো আর একটা ভদ্রতা করলেন। ড্রাইভারকে বললেন–হাসানকে গাড়িতে পৌঁছে দিতে। ড্রাইভার বিরক্ত হলো–গাড়িতে চড়ার যোগ্য নয় মানুষকে গাড়িতে চড়তে দেবার ব্যাপারে ড্রাইভারদের খুব অনগ্ৰহ থাকে।
বাজছে মাত্র আটটা। এখন বাসায় ফিরে হবে কী? ছাত্র অবস্থায় বাসায় ফেরার একটা তাড়া থাকে। বই নিয়ে বসতে হবে। এখন সেই তাড়া নেই। এম.এ. পরীক্ষাটা দিয়ে দেখলে হয়। সাহসে কুলৈাচ্ছে না। তারপরেও মনে হয় দেয়া উচিত। তখন কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে তাকে বলা যাবে এম.এ. পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। কী করেন? ‘আমি কিছু করি না’ বলা খুব কষ্টের।
ড্রাইভার বিরক্ত গলায় বলল, আপনে যাবেন কই?
হাসান বলল, কোথাও যাব না। তোমার যেখানে ইচ্ছা আমাকে নামিয়ে দিতে পার।
আপনার বাসা কোন দিকে?
বাসা অনেক দূর। এতদূর আমাকে নিয়ে যাবার মতো ধৈর্য তোমার নেই–কোনো এক জায়গায় নামিয়ে দাও।
ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল। হাসান নেমে গেল। ড্রাইভারের সঙ্গে সামান্য রসিকতা করলে কেমন হয়? পকেট থেকে ছেড়া ন্যাতন্যাতে একটা এক টাকার নোট যদি ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলা হয়–এই নাও বকশিশ। ড্রাইভারের চোখমুখের ভাব কেমন হবে? যত ইন্টারেস্টিংই হোক চোখমুখের ভাব দেখাটা ঠিক হবে না। বেকারদের অনেক কিছু নিষিদ্ধ। সেই অনেক কিছুর একটা হচ্ছে রসিকতা। বেকারদের কিছু ধর্ম আছে। তাদের সেই ধর্ম পালন করতে হয়। হাসানের স্কুল জীবনের বন্ধু জহিরের মতে বেকার ধর্মের চারটি স্তম্ভ
(১) কচ্ছপ বৃত্তি।
সব সময় কচ্ছপের মতো নিজেকে খোলসের ভেতর লুকিয়ে রাখতে হবে। মাঝে মাঝে মাথা বের করে চারপাশ দেখে আবার টুক করে মাথা ঢুকিয়ে ফেলা।
(২) গণ্ডার বৃত্তি।
চামড়াটাকে গণ্ডারের চামড়ার মতো করে ফেলা। কোনো কিছুই যেন গায়ে না লাগে। গায়ে এসিড ঢেলে দিলেও ক্ষতি হবে না।
(৩) প্যাচা বৃত্তি।
কাজকর্ম সবই রাতে। গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে হবে রাত এগারটা থেকে বারটার দিকে যখন বেশিরভাগ মানুষ শুয়ে পড়ে।
(৪) কাক বৃত্তি।
কাকের মতো যেখানে যা পাওয়া যাবে তাই সোনামুখ করে খুঁটিয়ে খেয়ে ফেলা। কোনো অভিযোগ নেই।
বেকার ধর্মের চারটি স্তম্ভ যে মেনে চলে সে আদর্শ বেকার। তার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাও হবে না। হাসানের নিজের ধারণা সে একজন আদর্শ বেকার। আদর্শ বেকার রাত এগারটার আগে বাসায় ফেরে না। রাত এগারটা পর্যন্ত হাসানের করার কিছু নেই। জহিরের কাছে যাওয়া যায়। জহির থাকে। আগামসি লেনের এক মেসে; রাত বারটার আগে তাকে পাওয়া যাবে না। বারটা পর্যন্ত তার জন্যে অপেক্ষা করা যায়। অনেকদিন জহিরের সঙ্গে দেখা হয় না। জহিরের ‘প্রোজেক্ট বাংলা হোটেলে’ কিছু টাকা দিয়ে আসা যায়। গত কয়েক মাসে কোনো টাকা-পয়সা দেয়া হয় নি।
জহির নানান সময়ে নানান ধরনের স্বপ্ন দেখে। তার বর্তমান স্বপ্ন হলো–সাধারণ ডালভাতের হোটেল দেয়া। বিভূতিভূষণের আদর্শ হিন্দু হোটেলের মতো আদর্শ বাং হোটেল। সে হোটেলে আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, করলা ভাজি, ডালের চচ্চড়ি টাইপ খাবার ছাড়া কোনো খাবার পাওয়া যাবে না। নতুন ধরনের এই হোটেল দেখতে দেখতে জমে যাবে। বন্যার স্রোতের মতো হু-হু করে টাকা আসতে থাকবে।
বুঝলি হাসান ফালতু চাইনিজ খেতে খেতে আমাদের মুখ পচে গেছে। চাইনিজদের মতো নাকিও খানিকটা ডেবে গেছে। আগে বাঙালি জাতির যে খাড়া নাক ছিল এখন নেই। আমাদের নতুন ধরনের খাবার, নতুন ব্যবস্থা–লোকজন পাগলের মতো হয়ে যাবে। ভাত খাবার জন্যে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
নতুন ব্যবস্থাটা কী?
পাটি পেতে খাবার ব্যবস্থা। আয়েশি ব্যবস্থা। পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে খাবে।
প্যান্ট পরে তো পাটিতে বসতেই পারবে না।
যারা বসতে পারবে না তারা খাবে না। আমাদের হোটেল এমন হবে যারা আসবে তারা তৈরি হয়েই আসবে।
জহির আদর্শ বাংলা হোটেল ফান্ড খুলেছে। ফান্ড চালু হয়েছে এক বছরের মতো। প্ৰতি মাসেই রোজগারের একটা অংশ হাসানের সেই ফান্ডে দেবার কথা। গত তিন মাস কিছু দেয়া হয় নি। ফান্ডে দেবার মতো রোজগারই হয় না–দেবে কী? আজ কিছু টাকা আছে জহিরকে দিয়ে এলে সে খুশি হবে। হাতে টাকা বেশিদিন থাকবে না। দিতে হলে এখনই দিয়ে আসা দরকার।
জহিরকে পাওয়া না গেলে সে যাবে লিটনের খোজে। লিটন বেচারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে। তাকে কিছু টাকা দিয়ে আসবে। সে নিতে চাইবে না। জোর করে দিতে হবে। তার চাকরি হচ্ছে না–ঠিক আছে। কিন্তু জহিরের মতো একটা ভালো ছেলের চাকরি হবে না। এটা খুব কষ্টের।
হাসান আগামসি লেনের দিকে রওনা হলো। জহিরের জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। হেঁটে হেঁটে যাওয়াই ভালো–সময় কাটবে। স্বাস্থ্যটাও ভালো থাকবে। বেকাররা ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। কারণ তাদের প্রচুর হাঁটতে হয়।
রাত বারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও জহিরের দেখা পাওয়া গেল না। ইদানীং নাকি জহিরের ফেরার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কয়েক দিন রাত তিনটায় ফিরেছে। এত রাত পর্যন্ত সে বাইরে কী করে তাও কেউ বলতে পারছে না। আর অপেক্ষা করার মানে হয়। না। এত রাতে লিটনের খোজে যাওয়াও অর্থহীন। হাসান রাত একটায় বাড়ি ফিরে এল।
রীনা দরজা খুলে কাদো কাদো গলায় বলল, তুমি কোথায় ছিলে?
রীনার পাশে লায়লা। সেও কাঁদছে। বেশ শব্দ করেই কাঁদছে।
হাসান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে ভাবি?
তোমার ভাই তো মরতে বসেছিল।
মরতে বসেছিল মানে কী?
রীনা কী হয়েছে বলার আগে বাচ্চা মেয়েদের মতো কেঁদে ফেলল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। হাসান হাত ধরে ভাবিকে চেয়ারে বসাল।
ঘটনা যা ঘটেছে তা ভয়াবহ তো বটেই।
ঘটনাটা এ রকম–তারেক অফিস থেকে ফিরে চা খেল। রীনা একবাটি মুড়ি ভেজে দিয়েছিল। সে মুড়ি খেল না। তার নাকি শরীরটা ভালো লাগছে না। রাত আটটার সময় হঠাৎ দেখা গেল তারেক শার্ট-প্যান্ট পরছে। রীনা অবাক হয়ে বলল, এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?
তারেক বিরক্ত গলায় বলল, এত রাত কোথায় দেখলে রাত মোটে আটটা বাজে।
যাচ্ছ কোথায়?
ফ্রিজ সারাইয়ের দোকানে যাব। ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। গ্যাস ভরে দেবে।
রাত আটটার সময় যাবার দরকার কী? দিনের বেলা যেও।
তারেক বিরক্ত গলায় বললেন, দিনের বেলা আমার অফিস থাকে। দিনের বেলা যাব কীভাবে?
তাহলে থাক তোমাকে যেতে হবে না। ফ্রিজের দোকানের ঠিকানাটা দিও। হাসান যাবে।
সবকিছু নিয়ে হাসানকে ডাকার আমি কোনো কারণ দেখি না। ওদের সঙ্গে কথা হয়ে আছে—সামান্য ব্যাপার।
তুমি বলছিলে শরীরটা ভালো লাগছে না।
এখন ভালো লাগছে। দেখি এক গ্ৰাস পানি দাও।
রীনা পানি এনে দিল। তারেক সেই পানিতে এক চুমুক মাত্র দিল। তারপর গভীর মুখে বের হয়ে গেল। রীনা খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগল, যদিও অস্বস্তির তেমন কোনো কারণ নেই। রীনা বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক শেষ করে তাদের খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
বাসায় তার শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই নেই। শাশুড়ির রাগ এখনো ভাঙে নি। রীনার শ্বশুর। স্ত্রীর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা হিসেবে গত তিন দিন হলো মেয়ের বাড়িতে আছেন। রীনা লায়লার সঙ্গে গল্প করতে গেল। প্ৰায় এক ঘণ্টার মতো গল্প করল। লায়লার সঙ্গে গল্প করার জন্যে কোনো বিষয়বস্তু লাগে না। যে-কোনো বিষয়ে গল্প শুরু করলে লায়লা কীভাবে কীভাবে সেই গল্প সাজগোজের দিকে নিয়ে আসে। আজ গল্প হলো ইটালিয়ান স্যান্ডেল নিয়ে। ইটালিয়ান ঘাসের স্যান্ডেল লায়লার এক বান্ধবীর বাবা মেয়ের জন্যে নিয়ে এসেছেন। লায়লা সেই স্যান্ডেল পায়ে পরে দেখেছে। তার সমস্ত হৃদয় এখন স্যান্ডেলে। তার কথা শুনে মনে হতে পারে সে তার সমগ্ৰ পৃথিবী একজোড়া ঘাসের স্যান্ডেলের জন্যে দিয়ে দিতে পারে।
বুঝলে ভাবি স্যান্ডেল পায়ে দিয়েছি–মনে হচ্ছে স্যান্ডেল না, পায়ে খানিকটা মাখন মেখেছি। এত সফট আর কেমন ওম ওম ভাব।
ঢাকায় পাওয়া যায় না?
পাগল হয়েছ ভাবি–এইসব জিনিস ঢাকায় কোথায় পাবে!
গুলশানের দোকানে নাকি অনেক বিদেশী স্যান্ডেল পাওয়া যায়।
পাওয়া গেলেও সব সেকেন্ড গ্রেড জিনিস পাওয়া যায়। গরিব দেশে ভালো ভালো জিনিস। এনে লাভ কী? কে কিনবে? স্যান্ডেল জোড়ার দাম কত জান?
ইউএস ডলারে দুশ কুড়ি ডলার। ডিউটি-ফ্রি শপ থেকে কিনেছে বলে সস্তা পড়েছে। সাধারণ শপিং মল থেকে কিনলে–আড়াই শ ডলার মিনিমাম লাগত। আড়াই শ ডলার মুম্বাদশী টাকার দশ হাজার টাকা। দশ হাজার টাকা দামের স্যান্ডেল। চিন্তা করা যায় ভাবি?
চিন্তা করা যায় না। আমি যদি এই স্যান্ডেল পরি তাহলে আমার পায়ে ফোসকা পড়ে যাবে।
আমি একদিন স্যান্ডেলগুলো তোমাকে দেখাবার জন্যে নিয়ে আসব। তুমি পায়ে পরে কিছুক্ষণ হাঁটলে তোমার কাছেই মনে হবে–দশ হাজার টাকা কোনো দামই না।
লায়লা ভাত খেতে গেল এগারটার দিকে। তারেক তখনো আসে নি। লায়লা বলল, ভাইয়া কোথায় গেছে ভাবি?
ফ্রিজ সারাইয়ের দোকানে।
রাতদুপুরে ফ্রিজ সারাইয়ের দোকানে কেন?
কী জানি কেন? চলে আসবে।
আমার তো টেনশন লাগছে ভাবি। ঢাকা শহরের যে অবস্থা। আমার এক বান্ধবীর মামাকে হাইজ্যাকাররা পেটে ছুরি মেরেছে। নাড়ির্ভুড়ি বের হয়ে পড়েছিল। আমি উনাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম।
রানার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল।
ভাবি তুমি টেনশন করছ নাকি?
না।
তোমাকে দেখে মন হচ্ছে টেনশন করছি। প্লিজ টেনশন কোরো না। তোমাকে গল্পটা বলাই ঠিক হয় নি।
রাত এগারটার পর থেকে রীনা বারান্দায় হাঁটাহাটি করতে লাগল। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়। বাসার সামনে রিকশা বা বেবিট্যাক্সি থামলে চোখে পড়ে। ফ্রিজের দোকানে তারেকের এত সময় লাগার কথা না। রাত ন’টার ভেতর দোকান বন্ধ হয়ে যাবার কথা। সে এত দেরি করছে কেন? সত্যি সত্যি হাইজ্যাকারদের হাতে পড়লে ভয়াবহ অবস্থা হবে। ছুরি মেরে ফেলে রাখলেও কেউ আগাবে না। মানুষের বিপদে এখন আর মানুষ এগিয়ে আসে না। এই যুগের নীতি হচ্ছে বিপদগ্ৰস্থ মানুষের কাছে থেকে দূরে চলে যাওয়া। যে যত দূরে যাবে সে তত ভালো থাকবে। টেনশনে রানার বুক ধকধক করা শুরু হলো। তার এই অসুখ ছোটবেলা থেকেই আছে। যত দিন যাচ্ছে অসুখ তাত বাড়ছে। আগে শুধু বুক ধকধক করত। এখন শুধু যে বুক ধকধক করে তাই না–প্ৰচণ্ড ব্যথাও হয়। নিঃশ্বাস আটকে আটকে আসে। খুব শিগগিরই ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তারের কাছে যেতেও ভয় লাগে। রীনা নিশ্চিত জানে–ডাক্তারের কাছে যাওয়ামাত্ৰই ডাক্তার ইসিজি ফিসিজি করিয়ে একগাদা খরচ করাবে। তারপর বলবে–আপনার হার্টের অসুখ আছে। একটা আর্টারি ব্লক। এনজিওগ্রাম করাতে হবে। তারচে’ বুকের ব্যথা সহ্য করা ভালো। এই ব্যথা বেশিক্ষণ থাকে না। টেনশন চলে যাওয়া মাত্র ব্যথাও চলে যায়।
ঠিক বারটার সময় বাসার সামনে এসে একটা বেবিট্যাক্সি থামল। হতভম্ব রীনা দেখল দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক বেবিট্যাক্সি থেকে ধরাধরি করে তারেককে নামাচ্ছে। তারেক ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না, মনে হচ্ছে মাথা এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। সে কি মদ টদ খেয়ে এসেছে? গল্প-উপন্যাসে এ রকম বর্ণনাই তো থাকে। মাতাল স্বামীকে বন্ধুরা পৌঁছে দিতে আসে। দুদিক থেকে দুজন তাকে ধরে রাখে। রীনা দৌড়ে এসে দরজা খুলল। তারেক এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন রীনাকে চিনতে পারছে না। মোটাসোটা ধরনের অপরিচিত ভদ্রলোক বললেন–আপা উনি কি এখানে থাকেন?
রীনা হতভম্ব গলায় বলল, ওর কী হয়েছে?
আমরাও বুঝতে পারছি না। রাস্তার মাঝখানে চুপচাপ বসে ছিলেন। বিড়বিড় করে কী বলছিলেন। তারপর ঠিক মাঝরাস্তায় বসে পড়লেন।
আপনারা এইসব কী বলছেন!
চিন্তা করবেন না। আপা। শুরুতে উনি তার নাম, বাসার ঠিকানা কিছুই বলতে পারছিলেন না। শেষে বলেছেন। উনার কথামতোই আমরা এসেছি। একজন ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বললেন–কাউন্ড অব নাৰ্ভাস ব্ৰেক ডাউন। ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়েছেন। রাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে বলেছেন।
রীনা অস্পষ্ট গলায় কী একটা বলল। কী বলল সে নিজেও বুঝতে পারল না। তারেক স্পষ্ট গলায় বলল, রীনা বাচ্চারা কি স্কুল থেকে ফিরেছে?
এই হলো ঘটনা।
হাসান পুরো ঘটনা নিঃশব্দে শুনছে। রীনা ঘটনাটা খুব গুছিয়ে বললেও মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। রানা যতবার কেঁদে উঠছে, লায়লাও তার সঙ্গে কেঁদে
ভাইজান এখন কী করছে?
ঘুমাচ্ছে।
তুমি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছ?
হুঁ।
তোমার সঙ্গে ভাইজানের কোনো কথা হয় নি? তুমি জিজ্ঞেস কর নি ব্যাপার কী?
জিজ্ঞেস করেছিলাম–কিছু বলে না।
রাতে খাওয়াদাওয়া করেছে?
রুটি বানিয়ে দিয়েছিলাম। একটা রুটি খেয়েছে।
তার মানিব্যাগ কি আছে না খোয়া গেছে?
মানিব্যাগ আছে।
যে দুজন ভদ্রলোক নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন—তাদের ঠিকানা কি রেখেছ?
না, ঠিকানা জিজ্ঞেস করার কথা মনেও হয় নি। আমি তাদের থ্যাংকস পর্যন্ত দেই নি। মাথা তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। আমার এখন এত খারাপ লাগছে।
খারাপ লাগার কিছু নেই ভাবি। এই জাতীয় কাজ যারা করে–তারা থ্যাংক-এর আশা করে না।
তোমার কি ধারণা তোমার ভাইজানের মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
ভাইজানের কিছু হয় নি। মানুষের মাথা খুব শক্ত। চট করে খারাপ হয় না। মাথার কোনো সমস্যা হলে বাসার ঠিকানা বলতে পারত না। কাল সকালে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
যদি ঠিক না হয়?
অবশ্যই ঠিক হবে। ভাবি তুমি দয়া করে কাদা বন্ধ করা। ঘুমের ওষুধা তুমিও একটা খাও, খেয়ে ঘুমাতে যাও।
তারেক সারা রাত মরার মতো ঘুমাল। তার পাশে তার গায়ে হাত দিয়ে রীনা বসে রইল। একপলকের জন্যেও চোখ বন্ধ করল না।
সকালবেলা তারেক খুব স্বাভাবিকভাবে বিছানা থেকে নামল। রীনার চোখ তখন ধরে এসেছে। সে খাটে হেলান দিয়েছে, এই অবস্থাতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল। চিন্তিত গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছে? তারেক বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় যাই মানে! বাথরুমে যাই–আবার কোথায় যাব?
তোমার শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে?
শরীর খারাপ লাগবে কেন?
রাতের প্রসঙ্গ টেনে আনা ঠিক হবে কিনা, রীনা বুঝতে পারছে না। মনে হয় ঠিক হবে না। সে খাটে বসে রইল। তারেকের বাথরুমে ঢোকার শব্দ, কল খোলার শব্দ, দাঁতে ব্ৰাশ ঘষার শব্দ সবই শুনল কান খাড়া করে। শব্দগুলোর ভেতর কি কোনো অস্বাভাবিকতা আছে? ব্রাশ কি অন্যদিনের চেয়ে দ্রুত ঘঁষছে? কলটা বন্ধ করছে না কেন? পানি ছড়ছড় করে পড়েই যাচ্ছে। ব্রাশ ঘষার সময় কলটা বন্ধ করছে না কেন? কলের পানি পড়েই যাচ্ছে। স্বাভাবিক একজন মানুষ তো এই সময় কলটা বন্ধ করবে।
তারেক বাথরুম থেকে বের হয়ে বলল, রীনা চা দিতে বল তো। চা খাব।
এটাও তো অস্বাভাবিক। তারেকের কোনো অস্বাভাবিক চা-প্ৰীতি নেই। বাসিমুখে কখনো চা খেতে চায় না। আজ চাচ্ছে কেন? রীনা চিন্তিত মুখে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। টগর এবং পলাশ দুজনেরই ঘুম ভেঙেছে। কমলার মা তাদের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে কলঘরের দিকে। টগর বলল, মা আমি কিন্তু আজ স্কুলে যাব না। পলাশও সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও যাব না।
অন্যদিন হলে রীনা কঠিন গলায় বলত, অবশ্যই স্কুলে যাবে। স্কুলে যাব না। এইকথা যেন না শুনি। আজ রানা বলল, আচ্ছা যেতে হবে না।
টগর, এবং পলাশ বিম্বিত হয়ে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা তাদের কাছে এতই অপ্রত্যাশিত যে আনন্দের বিকট চিৎকার দিতেও ভুলে গেছে।
আজ তাদের স্কুলে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে নিয়ে যাবার মানুষ নেই। হাসানকে পাঠানো যায়। রীনা তা করতে রাজি না। তারেককে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। সে একা যাবে না, হাসানকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। শ্বশুর-শাশুড়িকেও বাসায় নিয়ে আসতে হবে। মাথার ওপর মুরুকিব কেউ থাকলে ভরসা থাকে। যে-কোনো দুশ্চিন্তার ভাগ মুরুকিবরা নিয়ে দুশ্চিন্তা হালকা করে ফেলেন। কাল তাঁর শাশুড়ি বাসায় থাকলে তিনিও রীনার সঙ্গে সারা রাত জাগতেন।
তারেক চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, তোমার চোখমুখ এমন শুকনো কেনো, কী ব্যাপাৱ?
রীনা বলল, রাতে ঘুম হয় নি।
শোবার আগে আমার মতো গোসল করে শুবে তাহলে দেখবে ভালো ঘুম হবে।
রীনা ইতস্তত করে বলল, কাল রাতে তুমি ফ্রিজের দোকানে গিয়েছিলে?
তারেক বলল, ফ্রিজের দোকানে যাব কেন?
যাবে বলছিলে এই জন্যে জিজ্ঞেস করলাম। তা
রেক চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। রীনা বুঝতে পারছে না, কাল রাতের প্রসঙ্গটা নিয়ে আরো কথা বলাটা ঠিক হবে কিনা। মনে হয় ঠিক হবে না। রীনা বলল, এক কাজ কর, আজ তোমার অফিসে যাবার দরকার নেই।
তারেক বলল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। শুধু শুধু অফিস কামাই করব কেন? খবরের কাগজ এসেছে কি না একটু দেখ তো। হকারটাকে বদলাতে হবে। ঠিক অঠিসে যাবার আগে আগে কাগজ এনে দেয়। অফিসে যেতে হয় কাগজ না পড়ে।
তারেক খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নাশতা খেল, অফিসের জন্য তৈরি হতে লাগল। রীনা বলল, হাসান তোমার সঙ্গে যাবে।
আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?
মতিঝিলে ওর নাকি কী কাজ আছে। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে সে তার কাজে যাবে। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
তারেক বিস্মিত হয়ে বলল, কী উদ্ভট কথা আমার আপত্তি থাকবে কেন?
মতিঝিলে হাসানের কোনো কাজ নেই। সে ঠিক করে রেখেছে কাজ না থাকলেও সে আজ মতিঝিলেই ঘোরাফেরা করবে। দুপুরে কোনো সস্তা হোটেলে কিছু খেয়ে নিয়ে বিকেলে ভাইকে নিয়ে একসঙ্গে ফিরবে। ভাবি বেশি রকম চিন্তিত। যদিও সে চিন্তার তেমন কিছু দেখছে না।
হাসান ভাইকে নামিয়ে দিয়ে ঘুরতে বের হলো। বিশাল কর্মকাণ্ডের মতিঝিলের সঙ্গে তার যোগ নেই। আশ্চর্য ব্যাপার। অঞ্চলটা কেমন গমগম করছে। কাজ ছাড়া হাঁটতেও ভালো লাগে। অপরিচিত এক ভদ্রলোক চোখ ইশারায় হাসানকে ডাকল। হাসান এগিয়ে গেল। ভদ্রলোক গলা নিচু করে বললেন, ডলার কিনবেন?
জ্বি না।
ডলার আছে? বিক্রি করবেন?
জ্বি না।
লোকটা উদাস হয়ে গেল। হাসান ভেবে পেল না। তার চেহারায় ডলারের কেনাবেচার কোনো ছাপ কি আছে? ছাপ না থাকলে শুধু শুধু তার সঙ্গে ডলার নিয়ে ভদ্রলোক কথা বলবেন কেন? এরা অভিজ্ঞ ধরনের মানুষ। চোখ দেখে অনেক কিছু বলে ফেলে। এদের তো ভুল করার কথা না।
এক জায়গায় টেবিল-চেয়ার পেতে ফরম বিক্রি হচ্ছে। লোকজন লাইন দিয়ে ফরম কিনছে। হাসান কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে গেল। আমেরিকা যাবার ইমিগ্রেশন ফরম। দুদিন পর পর আমেরিকানরা একটা তাল বের করে, বাংলাদেশের কিছু লোকজন তাতে মোটামুটি ভালো ব্যবসা করে। ফরম বিক্রি হচ্ছে কুড়ি টাকায়। পুরোপুরি ফিলাপ করলে পঞ্চাশ টাকা।
ফরম যে বিক্রি করছে তার চোখেমুখে খুব সিরিয়াস ভাব। যেন ফরম ফিলাপ করামাত্র আমেরিকান ভিসা সে দিয়ে দেবে। সমানে বেনসন সিগারেট টেনে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্যবসা তার ভালোই হচ্ছে।
হাসান লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম কিনল। সময় কাটানো দিয়ে হচ্ছে কথা। লম্বা লাইনে দাঁড়ানোয় কিছু সময় কেটে গেল। লাইনে দাঁড়ানো নিয়েও সমস্যা। একজন আগে ঢুকে পড়েছিল তাকে বের করে দেয়া হলো। সে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে শাসাচ্ছে। ভালো যন্ত্রণা।
আরেক জায়গায় বিক্রি হচ্ছে নিউজিল্যান্ড যাবার ফরম। এই ফরমের দামও বেশি। এদের পোজপাজও বেশি। ফরমের দাম দুশ টাকা। দাম বেশি বলেই কোনো লাইন নেই। বেকারদের পকেটে দুশ টাকা থাকে না। যে ফরম বিক্রি করছে তার পেছনে নিউজিল্যান্ডের ছবি। নীল পাহাড়, পাহাড় মনে হচ্ছে লেকের পানি ফুঁড়ে বের হয়ে এসেছে। পালতোলা নৌকায় তরুণ-তরুণী। তরুণী যে পোশাক পরে আছে তাতে তাকে, নগ্নই বলা যায়। যারা নিউজিল্যান্ডের ফরম কিনবে তারা অবশ্যই মেয়েটির কথা মনে রাখবে।
ভাই আপনি কি ফরম কিনবেন?
জ্বি না।
তাহলে শুধু শুধু ভিড় করবেন না।
ভিড় তো করছি না। আপনার এখানে তো লোকই নেই।
হাসান চলে এল। বিমান অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর ঢুকে গোল অফিসে। এখানেও প্রচণ্ড ভিড়। এই ভিড়ের জাত আলাদা। যারা ভিড় করে আছে তাদের চোখ অনেক উজ্জ্বল। সেই চোখে স্বপ্নের ছায়া।
দুপুরে হাসান এক ছাপড়া হোটেলে খেতে গেল। ছাপড়া হোটেল হলেও কায়দাকানুন আছে। মিনারেল ওয়াটারের বোতল আছে। যারা খাচ্ছে তারাও শার্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক। হোটেলের মালিককে গিয়ে হাসান জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা ভাই সাহেব, বড় বড় হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার কি আছে? কাস্টমারদের না খাওয়া খাবার জমা করে পরে বিক্রি করে সেই জাতীয় কিছু?
হোটেলের মালিক চোখমুখ কুঁচকে বলল, দুই নম্বরী কোনো কিছু এইখানে পাবেন की।
কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারবেন? একটু খাওয়ার শখ ছিল।
জানি না। আমাদের সব টাটকা ব্যবস্থা। বাসির কারবার নাই। খেতে চাইলে হাত ধুয়ে আসেন।
চারটার পর হাসান তার ভাইয়ের অফিসে উপস্থিত হলো। সে ভেবেছিল তারেক তাকে দেখে খুব বিরক্ত হবে।
তারেক বিরক্ত হলো না, অবাকও হলো না। হাসানই বরং বিব্রত গলায় বলল, মতিঝিলের দিকে এসেছিলাম ভাইয়া, ভাবলাম দেখি তোমার ছুটি হয়েছে কি না। ছুটি হলে একসঙ্গে বাসায় ফিরব।
তারেক বলল, চল যাই। এখন বেবিট্যাক্সি-রিকশা কিছুই পাওয়া যাবে না। হাঁটতে হবে। আমার হাঁটতে ভালোই লাগে। এক্সারসাইজ হয়। ফোর্স সেভিংসের মতো–ফোর্স এক্সারসাইজ।
রাস্তায় নেমে তারেক নিচু গলায় বলল, তোকে একটা কথা বলি তোর ভাবি যেন না জানে। তোর ভাবি জানলে দুশ্চিন্তা করবে।
কথাটা কী?
মাঝে মাঝে আমার মেমোরি লিসের মতো হয়। খুবই অল্প সময়ের জন্যে হয়—কিন্তু হয়।
ব্যাপারটা বুঝলাম না।
এই যেমন ধর অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ মনে হয় কিছু চিনতে পারছি না। আমি কোথায় যাচ্ছি—বাসা কোথায় কিছুই মনে করতে পারি না। খুব অল্প সময়ের জন্যে হয়–কিন্তু যখন হয় তখন খুব ভয় লাগে।
ভয় লাগারই তো কথা।
একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
চল। আজই চল।
আজ না–যাব একদিন। তোর ভাবিকে কিছু বলিস না–দুশ্চিন্তা করা হলো তার ess
তোমার মেমোরি লিসের ব্যাপারটা শেষ কবে হয়েছে ভাইয়া?
তারেক জবাব দিল না। দাঁড়িয়ে পড়ল। কেমন যেন উসখুসি করছে। চারদিকে তাকাচ্ছে। হাসান শঙ্কিত গলায় বলল, কী হয়েছে?
তারেক বলল, কিছু হয় নি। চা খাবি?
চা?
চল নিরিবিলিতে কোথাও বসে চা খাই।
অফিস ছুটির সময় নিরিবিলি কোথায় পাওয়া যাবে? চায়ের দোকানগুলোতে রাজ্যের ভিড়। এর মধ্যেই আকবরিয়া রেস্টুরেন্টের একটা কেবিন হাসান যোগাড় করল। শিক কাবাব তৈরি হচ্ছে, তার ধোঁয়ার সবটাই সরাসরি কেবিনে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।
চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে ভাইয়া? শিক কাবাব?
খাওয়া যায়।
শিক কাবাব চলে এসেছে। নোংরা একটা বাটিতে খানিকটা সালাদ। অন্য একটা বাটিতে হলুদ বর্ণের কী একটা তরল পদার্থ। সম্ভবত টক জাতীয় কিছু। তারেক বলল, তুই খাবি না?না। তুমি খাও।
তারেক আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। মনে হয় সে দুপুরে কিছু খায় নি।
চা দিতে বলেছিস?
বলেছি। কাবাব কি তোমাকে আরেকটা দিতে বলব?
বল।
আরেকটা কাবাবের অর্ডার দিয়ে হাসান বসে আছে। সে তার ভাইয়ের ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছে না।
হাসান।
বল।
আমি আসলে বিরাট একটা সমস্যায় পড়েছি। কাউকে বলতেও পারছি না।
সমস্যাটা কী? চাকরি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা?
না। চাকরি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা না। পারসোনাল।
বল আমাকে শুনি।
তোর কাছে সিগারেট আছে? দে তো একটা।
সিগারেট তো তুমি খাও না।
একদম যে খাই না তা না। মাঝেমধ্যে অফিসে এসে একটা-দুটা খুচরা কিনি।
তুমি বস আমি তোমাকে সিগারেট এনে দিচ্ছি। কী সিগারেট খাও।
বাংলা ফাইভ। আর শোন, যাচ্ছিস যখন তখন জর্দা দিয়ে একটা পানও নিয়ে আসিস।
হাসান সিগারেট-পান নিয়ে ফিরল। তারেক আনন্দিত গলায় বলল, এরা চা-টা খুব ভালো বানায়। মনে হয় আফিং টাফিং মেশায়–ভেরি গুড টেষ্ট। এরপর থেকে অফিস ফেরতের সময় এদের এখানে এক কাপ করে চা খেতে হবে।
আরেক কাপ চা দিতে বলব?
বল।
নাও ভাইয়া সিগারেট ধরাও। এই নাও ম্যাচ।
হাসান লক্ষ করল তার ভাইয়া সিগারেট ধরাতে পারছে না। তার হাত কাঁপছে।
ভাইয়া।
হুঁ।
তোমার সমস্যাটা কী বল শুনি।
তেমন কোনো সমস্যা না। আবার তুচ্ছ করাও ঠিক না।
আমি তুচ্ছ করছি না, তুমি বল।
বলছি দাঁড়া সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে নেই। পান এনেছিস?
এনেছি।
জর্দা দিয়ে এনেছিস তো?
হ্যাঁ জর্দা দিয়েই এনেছি।
এই রেস্টুরেন্টটা মনে হচ্ছে খুব চালু। কাস্টমারে একেবারে গমগম করছে। ভাগ্যিাস আমরা একটা ফাঁকা কেবিন পেয়েছিলাম।
ভাইয়া তোমার সমস্যার কথা বল।
আমাদের অফিসে একজন মহিলা কলিগ আছেন–নাম হচ্ছে গিয়ে লাবণী। বয়স অল্প-কুড়ি-একুশ হবে। গত বছর বি.এ. পাস করেছে পাসকোর্সে।
দেখতে কেমন?
আছে ভালোই। এভারেজ বাঙালি মেয়েরা যেমন থাকে।
আনিমেরিড?
বিয়ে হয়েছিল হাসবেন্ড মারা গেছে। বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে-ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। হাসবেন্ড মারা যায় বিয়ের দু বছরের মধ্যে। সে আরিচা থেকে ফিরছিল। রাস্তায় একটা কুকুর দাঁড়িয়েছিল। কুকুরকে সাইড দিতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্টটা হয়।
ও আচ্ছা।
লাবণীর একটা মেয়ে আছে। খুবই সুইট চেহারা। মেয়েটার নাম কেয়া। লাবণীর হাসবেন্ডই শখ করে নাম রেখেছিল। কেয়া এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। কলাবাগানে ওমেন ফেডারেশনের একটা স্কুলে। খুব ভালো ছাত্রী। প্রতি বছর ফার্স্ট হচ্ছে। গান জানে, নাচ জানে, টেলিভিশনে ‘নতুন কুঁড়ি’-তে গিয়েছিল। টিকতে পারে নি। ওইসব জায়গায় সবই তো ধরাধরির ব্যাপার। লাবণীর ধরাধরি করার কেউ নেই।
সমস্যার ব্যাপারটা বল।
না মানে হয়েছে কী, একদিন অফিসে কাজ করছি লাবণী এসে খুব লজ্জিত গলায় বলল, সে ক্যান্টিনে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে চায়। আমি একটু অবাক হলাম, তবে এর মধ্যে দোষের কিছু দেখলাম না। চা খেতে গেলাম। সেইখানেই লাবণী বলল যে আমার চেহারা স্বভাব চরিত্র সব নাকি তার হাসবেন্ডের মতো।
তাই নাকি?
লাবণী তার হাসবেন্ডের একটা সাদাকালো ছবিও নিয়ে এসেছিল। মিল কিছুটা আছে। তবে সে যতটা বলছে ততটা না। তবে মেয়ে মানুষ তো বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু দেখে।
লাবণী কি তোমাকে প্রায়ই ক্যান্টিনে নিয়ে চা খাওয়াচ্ছে?
আরে না। ও সেই রকম মেয়েই না।
তোমার কামরায় প্রায়ই আসে?
এক অফিসে কাজ করছি। আসবে না? ধর আমি একটা চিঠি টাইপ করতে দিলাম–চিঠি নিয়ে তাকে তো আসতেই হবে।
সমস্যাটা কোথায়?
তারেক বলল, না সমস্যা আবার কী? সমস্যা কিছু না।
তুমি যে বললে তুমি একটা সমস্যায় পড়েছি।
লাবণীকে দেখে খারাপ লাগে–এই আর কী? দুঃখী মেয়ে। একে তো রূপবতী মেয়ে, তার ওপর অল্প বয়স, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিধবা টাইটেল। এই তিন সাইনবোর্ডের মেয়ে আমাদের দেশে টিকতে পারে না। লাবণী থাকে তার বড় বোনের সঙ্গে। বেশ ভালোই ছিল। ইদানীং সমস্যা হচ্ছে। বড় বোনের হাসবেন্ডের ভাবভঙ্গি সুবিধার মনে হচ্ছে না। গত সপ্তাহে ওই হারামজাদা রাত তিনটার সময় লাবণীর দরজায় টোকা দিয়েছে। লাবণী দরজা খুলে হতভম্ব। লাবণী বলল, দুলাভাই কী ব্যাপার? হারামজাদাটা বলে কী–মাথা ধরেছে, তোমার কাছে ঘুমের ট্যাবলেট আছে? লাবণী কি তার ঘরে ফার্মেসি দিয়েছে যে তার কাছে ঘুমের ট্যাবলেট খুঁজতে হবে?
এইসব গল্প কি লাবণী তোমার সঙ্গে করেছে?
হাঁ। দুঃখের কথা ঘনিষ্ঠ দু-এক জনের কাছে বললে মনটা হালকা হয়।
তুমি কি তার ঘনিষ্ঠজন?
তারেক জবাব দিল না। পান মুখে দিল। হাসান বলল, ভাইয়া তুমি কি প্রায়ই লাবণীদের বাসায় যাও?
তারেক বলল, আরে না। প্রায়ই যাব কী! মাঝেমধ্যে যাই। কেয়ার জন্মদিন হলো। জন্মদিনে গোলাম। সেও গতি সপ্তাহে। এই সপ্তাহে এখনো যাই নি।
হাসান বলল, ভাইয়া চল উঠি।
তারেক উঠে দাঁড়াল।
হাসান বলল, ভাইয়া একটা কথার জবাব দাও তো। তুমি কি লাবণী মেয়েটার প্রেমে পড়েছ?
তারেক জবাব দিল না। ভাইয়ের চোখের দিকে সরাসরি তাকালও না। তবে তার মুখে এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব দেখা গেল। যেন ভাইকে ব্যাপারটা বলতে পেরে সে শান্তি পেয়েছে।
তারেকের অফিসে যাবার পর থেকে রীনার মন উতলা হয়ে ছিল। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে সে অফিসে একবার টেলিফোনও করেছিল। তারেকের সঙ্গে কথা হয়েছে তাতেও রানার উতলা ভাব দূর হয় নি। দুপুরে সে তার শাশুড়িকে নিয়ে এল। রীনার শাশুড়ি এতদিন রাগ করে তার বড় মেয়ের বাসায় ছিলেন। কঠিন রাগ অনেক চেষ্টা করেও ভাঙানো যাচ্ছিল না। আজ তারেকের ঘটনা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছেন। তিনি বাসায় পা দেয়ামাত্র রানার মনে হয়েছে–আর ভয় নেই। দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
মনোয়ারা তসবি টিপতে টিপতে রীনার কাছে পুরো ঘটনা দু’বার শুনলেন। তারপর গাষ্ঠীর মুখে বললেন, বউমা কোনো চিন্তা করবে না। একটা মুরগি ছদকা দিয়ে দাও। আর শোেন–সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না। যা কাজকর্ম দিনে করবে। সন্ধ্যার পর সংসার দেখবে। চিরকালের নিয়ম। রীনা বলল, মা আপনি একটু বলে দেবেন।
মনোয়ারা বললেন, আমি তো বলবই। বিয়ের পর মার কথার ধার থাকে না। তার ওপর আমি হলাম পরগাছা মা। ছেলের রক্ত চুষে বেঁচে আছি। আমার কথার দাম কী। তুমি বলবে। শক্ত করে বলবে।
জ্বি আচ্ছা।
বিবাহিত ছেলে সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকবে এটা কেমন কথা!
শাশুড়ির কথা রীনার এত ভালো লাগল। তার মনের সমস্ত চিন্তাভাবনা এক কথায় উড়ে গেল। বিকেলে আরো আনন্দের ব্যাপার হলো। রকিব একগাদা উপহার নিয়ে বাসায় উপস্থিত। পলাশ এবং টগরের জন্যে দুটা ফুটবল। তার জন্যে কালির কলম। লায়লার জন্যে ঘড়ি। রানার কাছ থেকে ধার করা টকাটাও ফেরত দিল। রীনা হতভম্ব গলায় বলল, তুমি এত টাকা পেলে কোথায়?
রকিব বলল, কিছুদিন ধরে একটা ফার্মের সঙ্গে থেকে একটা পার্টটাইম চাকরি করেছি। ওরা থোক কিছু টাকা দিয়েছে।
কত টাকা?
সেটা তোমাকে বলব না। ভাবি শোন আজ রাতে ভালোমন্দ কিছু রান্না কর তো। পোলাও-কোরমা-রোষ্ট। আমি বাজার করে নিয়ে আসছি।
সন্ধ্যা হয়েছে।
বাচ্চারা ফুটবল নিয়ে খেলছে। তাদের চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। রকিব গিয়েছে বাজার করতে। তারেক ও হাসান দুজনই ফিরেছে। আশ্চর্য কাণ্ড–তারেক তার জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে। আহামরি কিছু না-সবুজ জমিন লাল পাড়। তবুও তো সে কিনল। এই প্রথম তারেক তার জন্যে শাড়ি কিনল।
তারেক গভীর গলায় বলল, শাড়িটা পর দেখি।
রীনা লজ্জিত গলায় বলল, হঠাৎ শাড়ি কেন?
আনলাম আর কী? সবুজ রঙ কি তোমার পছন্দ না?
খুব পছন্দ।
রীনার লজ্জা লাগছে। আনন্দও লাগছে। তার চোখ ভিজে উঠছে। সে বুঝতে পারছে। না। এত সুখী আল্লাহ তাকে কেন বানিয়েছেন!
বিবাহিত পুরুষ সন্ধ্যার পর ঘরে থাকবে
বিবাহিত পুরুষ সন্ধ্যার পর ঘরে থাকবে। সন্ধ্যায় সে ঘরে ফিরবে। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যাদের নিয়ে সময় কাটাবে। মনোয়ারার এই কথাগুলো রীনার খুব মনে ধরলেও সে জানে এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। পুরুষমানুষ মানেই–একটা অংশ ঘরের বাইরে। ভালো না লাগলেও এটা স্বীকার করে নিতে হবে। রীনা স্বীকার করে নিয়েছে।
তারেককে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে জামাকাপড় পরতে দেখেও চুপ করে রইল। তারেক বলল, দেখি একটা চিরুনি দাও তো চুলটা আঁচড়াই। রীনা চিরুনি এনে দিল এবং হঠাৎ লজ্জিত মুখে বলল, মাথাটা নিচু করা–চুল আঁচড়ে দেই। বিয়ের পর অনেক দিন রীনা তারেকের চুল আঁচড়ে দিয়েছে। তারপর এক সময় সংসারে টগর-পলাশ এলোরীনা ব্যস্ত হয়ে পড়ল সংসার নিয়ে। অফিসে যাবার সময় স্বামীর চুল আঁচড়ানো বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হওয়াটা ঠিক হয় নি। তার অবশ্যই উচিত ছিল স্বামীর জন্যে কিছুটা সময় আলাদা করে রাখা; রাখলে তারেকের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাসটা নিশ্চয়ই কিছু কমত।
তোমার চুল খুব লম্বা হয়েছে। চুল কাটাও না কেন?
কাটাব।
সন্ধ্যাবেলা যাচ্ছে কোথায়?
তারেক বলল, নাপিতের কাছে যাব। চুল কাটাব। চুল লম্বা হয়ে কানে লাগছে–অসহ্য।
রীনার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তারেক মিথ্যা কথা বলছে। সন্ধ্যাবেলা সে নাপিতের কাছে চুল কাটাতে যাচ্ছে না। চুল কাটার প্রসঙ্গ উঠছে বলেই সে ফিট করে বলল। চুল কাটাতে যাচ্ছি। মানুষটা গুছিয়ে মিথ্যা কথাও বলতে পারে না। বেচারা।
তারেক বলল, জুতার ব্রাশটা দাও তো জুতাজোড়া কালি করি।
রীনা নিজেই জুতা কালি করতে বসল। তারেক মোজা পায়ে অপেক্ষা করছে। রানার কেমন যেন মায়া লাগছে। এই মায়ার উৎস সে জানে না। রীনা বলল, সেজোগুজে নাপিতের কাছে চুল কাটাতে যাচ্ছে?
তারেক বলল, সাজের কী দেখলে ঐ জুতা ময়লা হয়েছিল।
ফিরতে দেরি হবে?
দেরি হবে কেন? চুল কাটাতে যতক্ষণ লাগে।
রানার মনে হলো সে শুধু শুধুই সন্দেহ করছিল। বেচারা আসলে চুল কাটাতেই যাচ্ছে। সরল ধরনের মানুষের কর্মকাণ্ডও সরলু প্রকৃতির হয়। নাপিতের দােকানে যে জুতা ব্ৰাশ করে যাবার দরকার নেই তা মনে থাকে না।
তারেক চলে যাবার পর রীনার নিজেকে খুব একলা মনে হতে লাগল। সবাই কাজকর্ম করছে শুধু তার কিছু করার নেই। টগর-পলাশ তার দাদুভাইয়ের সঙ্গে পড়তে বসেছে। তার শাশুড়ি বসেছেন জায়নামাজে। ন’টার আগে তিনি উঠবেন না।
লায়লা পড়ছে। তার পড়া বাচ্চাদের মতো। শব্দ করে সে পড়া মুখস্থ করে।
হাসান আজ বের হয় নি। ঘরে আছে। তার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করা যায়। রীনার ইচ্ছা করছে না। মাকে চিঠি লিখবো। অনেকদিন মাকে চিঠি লেখা হয় না। রকিবের দেয়া কলামটায় এখনো কিছু লেখা হয় নি। রানার মনে হলো প্রথম চিঠিটা মাকে না লিখে তারেককে লিখলে কেমন হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার সে তার স্বামীকে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি লেখে নি। চিঠি লেখার প্রয়োজন হয় নি। বিয়ের আগে তাদের পরিচয় ছিল না যে চিঠি লেখালেখি হবে। বিয়ের পর থেকে তো তারা একসঙ্গে আছে। চিঠি লেখার দরকার কী? আজ একটা চিঠি লিখে ফেললে কেমন হয়? রীনা কাগজের খোজে লায়লার ঘরে ঢুকাল। লায়লা সঙ্গে সঙ্গে বই বন্ধ করে হাসিমুখে তাকাল।
এক টুকরা কাগজ দিতে পারবে লায়লা?
হ্যাঁ পারব। ভাবি তোমাকে আজ এমন দুঃখী দুঃখী লাগছে কেন?
দুঃখী দুঃখী লাগছে?
খুব দুঃখী দুঃখী লাগছে। বোস, বল তোমার কী দুঃখ?
আমার কোনো দুঃখ নেই লায়লা।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। তোমার মনে কি কোনো দুঃখ আছে?
হুঁ।
কী দুঃখ?
বলা যাবে না, বললে তুমি হাসবে।
মানুষের দুঃখ শুনে আমি হাসব। আমি কি এতই খারাপ?
লায়লা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার দুঃখ খুবই হাস্যকর। আমার সব সময় মনে হয় আমার বিয়েটিয়ে হবে না।
বিয়ে হবে না?
চেহারা ভালো না। রঙেও ময়লা।
তোমার চেহারা ভালো না কে বলল? আর শ্যামলা মেয়েদের বুঝি বিয়ে হয় না? সবচে’ ভালো বিয়ে হয় শ্যামলা মেয়েদের এটা কি তুমি জান?
না জানি না। সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। তোমার বিয়ে নিয়ে তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না তো লায়লা। যথাসময়ে বিয়ে হবে।
আমার বিয়ে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। কোনো সম্বন্ধ আসে না। তোমরা তো কখনো কিছু বল না।
তোমার সামনে বলি না। তবে আড়ালে সব সময় বলি। অনেক ছেলে দেখাও হয়েছে।
সত্যি ভাবি?
অবশ্যই সত্যি। দেখি এখন আমাকে একটা কাগজ দাও।
লায়লা কাগজ দিতে দিতে লজ্জিত গলায় বলল, ভাবি নিজের বিয়ে নিয়ে এতগুলো কথা বললাম, আমার এখন খুব লজ্জা লাগছে।
লজ্জার কিছু নেই। তুমি পড়াশোনা কর।
লায়লা সঙ্গে সঙ্গে গুনগুন করতে শুরু করল। লায়লার জন্যে রীনার খুব মায়া লাগছে। তার বিয়ে নিয়ে আসলেই কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না। হওয়া উচিত। রীনা নিজের ঘরে ঢুকে চিঠি লিখতে বসল। সে দীর্ঘ সময় নিয়ে তার স্বামীকে ছোট্ট একটা চিঠি লিখল। সে চিঠি পড়ে নিজেই খুব লজ্জা পেল। চিঠিটা ড্রয়ারের অনেক নিচে লুকিয়ে রাখল। আজই চিঠি দিতে হবে এমন না। কোনো এক সময় দিলেই হবে। রীনা বারান্দায় এসে বসল। তার এক ভাবটা কাটছে না।
হাসানের ঘর বন্ধ। সে বিছানায় উপুড় হয়ে চিঠি লিখছে। তিতলীর কাছে চিঠি। তেমন এগোচ্ছে না। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ এ ছাড়া তিতলীকে তার লেখার কিছু নেই। সে কোনো বড় লেখক বা কবি হলে এই বাক্যটি ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে দীর্ঘচিঠি লিখতে পারত। লেখালেখির হাত তার একবারেই নেই। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ ছাড়া তিতলীকে তার আর কী লেখার আছে? ‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে’–হ্যাঁ এই বাক্যটাও লেখা যায়। তিতলীকে তার সবসময় দেখতে ইচ্ছা করে। বিয়ের পরেও কি এই ইচ্ছাটা থাকবে? নাকি প্রেমে ভাটা পড়বে? দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ শক্ত করে ঝগড়া করবে? হাসান লিখল,
তিতলী
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
হাতের লেখাটা ভালো হলো না। অক্ষরগুলো কেমন জড়িয়ে গেছে। তার হাতের লেখা ভালো না। তিতলীর হাতের লেখা অপূর্ব। গোটা গোটা অক্ষর। জড়ানো না, পেঁচানো না। প্রতিটা অক্ষর আলাদা। প্রতিটি শব্দ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে।
দরজায় টক টক শব্দ হলো। হাসান ভুরু কুঁচকে তাকাল। যতক্ষণ দরজা খোলা থাকে। কেউ আসে না। দরজা বন্ধ করা মাত্র দরজা ধাক্কাধাকি শুরু হয়। সে কাগজ-কলম নিয়ে বসার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার উঠে দরজা খুলতে হয়েছে। এবারেরটা নিয়ে হবে চতুর্থবোর। অথচ মাত্র একটা লাইন লেখা হয়েছে।
কে?
রীনা।
হাসান ধড়মড় করে বিছানা থেকে নামল। রীনা ভাবির কিছু কিছু ব্যাপার আছে বেশ মজার। সবাই ‘কে?’ প্রশ্নের জবাবে বলে আমি। একমাত্র রীনা ভাবিই ‘কে?’-র উত্তরে বলবে—রীনা।
দরজা বন্ধ করে কী করছিলে?
কিছু করছিলাম না। উপুড়পটাং হয়ে পড়েছিলাম
উপুড়পটাং আবার কী?
চিৎপটাং-এর উল্টোটা উপুড়পটাং।
চিঠি লিখছিলে?
হুঁ।
তোমার সেই তিতলী বেগমকে?
হুঁ।
মেয়েটাকে একদিন নিয়ে আসতে পার না?
পারি।
একদিন নিয়ে এসো। জমিয়ে আডডা দেব।
আচ্ছা।
তোমার এই চিঠি কি এক্ষুণি লিখতে হবে, না কিছুক্ষণ পর লিখলেও হবে?
পরে লিখলেও হবে।
আমি আসলে তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। বাচ্চারা পড়ছে। একা একা আমার দেখি কিছু ভালো লাগছে না।
গল্প কর–আমি শুনি।
রীনা খাটের এক মাথায় বসতে বসতে বলল, আমি কোনো গল্প করব না। আমার কাছে গল্প নেই। তুমি সারা শহর ঘুরে বেড়াও তুমি গল্প কর আমি শুনি।
হিশামুদিন সাহেবের গল্প বলব? তাঁর জীবন কাহিনী।
দূর দূর–তার জীবন কাহিনী শুনে কী হবে? একটা লোক একগাদা টাকা করেছে বলেই তার জীবন কাহিনী শুনতে হবে?
কমলার মা ট্রে নিয়ে ঢুকল। ট্রেতে দু কাপ চা। রীনা বলল, গল্প করার প্রস্তুতি দেখছি। কমলার মাকে বলেছি–আধঘণ্টা পর পর দু কাপ করে চা দিয়ে যেতে।
হাসান বুলল, তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আসলে গল্প শুনতে আস নি। কিছু বলতে এসেছ? সেটা কী?
তুমি কি মিসির আলি হয়ে গেছ? ভাবভঙ্গি দেখে মনের কথা বলে ফেলছি। শুনুন মিসির আলি সাহেব–আমি গল্প শুনতেই এসেছি–কিছু বলতে আসি নি।
ভূতের গল্প শুনবে ভাবি?
ভূতের গল্প শোনা যেতে পারে। তবে ঝড়বৃষ্টির রাত ছাড়া ভূতের গল্প জমে না। তুমি জমাতে পারবে তো?
পারব। আমি যে কজনকে এই গল্প বলেছি তারা সবাই সেই রাতে ঘুমোতে পারে নি। গল্পটা ঠিক ভূতেরও না। একটা ফ্যামিলিতে দুটা কিশোরী মেয়ে খুন হয় তার গল্প।
বল শুনি।
দাঁড়াও একটা সিগারেট খেয়ে নি।
হাসান সিগারেট বের করল। রীনা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, গত কয়েকদিন ধরে তোমার ভাই একটা অদ্ভুত ব্যাপার করছে–এর মানেটা কী বল তো।
অদ্ভুত ব্যাপারটা কী?
যেমন ধর–পরশুদিন রাতে ঘুমোতে গেছি। বাতি নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢুকতেই সে বলল-লাবণী আমার মনে হয় মশারির ভেতর মশা আছে। বাতি জ্বলিয়ে মশাগুলো মেরে নাও।
হাসান তাকিয়ে আছে। ভাবির গল্প করতে আসার কারণটা এখন তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
হাসান।
জ্বি ভাবি।
তোমার ভাইয়ের এই অদ্ভুত আচরণের অর্থ কী? মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে সে নিশ্চয়ই লাবণী নামের কোনো মেয়ের কথা ভাবছিল। মাথার মধ্যে সেই নামটা ঘুরছিল। ফস করে মুখ দিয়ে বের হয়ে পড়েছে।
তুমি কিছু জিজ্ঞেস কর নি?
না। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই বাতি জ্বলিয়ে মশা মারলাম। তারপর বাথরুমে হাত ধুয়ে ঘুমোতে গেলাম। সারারাত আমার এক ফোঁটা ঘুম হলো না। তোমার ভাই অবশ্যি তার স্বভাবমতো কিছুক্ষণের মধ্যে নাক ডাকিয়ে ভস ভস করে ঘুমোতে শুরু করল।
সামান্য একটা কারণে তোমার সারারাত ঘুম হলো না?
কারণটা তুমি যত সামান্য ভাবিছ তত সামান্য না। আরো একবার এ রকম হয়েছে। আমাকে রীনা ডাকার বদলে লাবণী ডেকেছে।
সেটা কবে?
সপ্তাহখানেক আগে। সকালে নাশতা খেতে বসেছে–হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, লাবণী দেখ তো খবরের কাগজ দিয়ে গেছে কিনা। আমি খবরের কাগজ এনে দিলাম। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে খবরের কাগজ পড়তে লাগল।
আর তুমি চিন্তায় অস্থির হলে? চিন্তায় অস্থির হওয়াটা কি অন্যায়? অবশ্যই অন্যায়। ভাইয়াকে তুমি চেন। চেন না? মানুষকে চেনা কি এতই সহজ? ভাইয়াকে চেনা খুবই সহজ। ভাইয়া হচ্ছে পানির মতো। হাসান তুমি একটা ভুল উপমা দিলে। পানি মোটেই সহজ বস্তু না। পানি অতি জটিল। পানি একমাত্র দ্রব্য যা কঠিন হলে আয়তনে বাড়ে।
পানি আয়তনে বাড়লেও ভাইয়া বাড়ে না। ভাইয়া খুব সাধারণ সহজ সরল একজন মানুষ। লাবণী ফাবনী নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না তো ভাবি।
রীনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ওদের অফিসে লাবণী নামে একটা মেয়ে আছে। ওদের সঙ্গে কাজ করে। নতুন এসেছে।
হাসান হাসতে হাসতে বলল, ব্যাপারটা তো তাহলে আরো সহজ হয়ে গেল। ভাইয়া মেয়েটাকে চেনে। তার নামটা মনে আছে। সে হয়তো দেখতেও অনেকটা তোমার মতো। থুতু দেখে যক্ষ্মা ভেবে বসবে না ভাবি। মেয়েদের স্বভাব হচ্ছে থুতু দেখলে যক্ষা ভাবে।
আর ছেলেদের স্বভাব।কী? যক্ষ্মা দেখলে থুতু ভাবা?
আমার ভূতের গল্পটা কি তোমাকে এখন বলব?
বল।
তাহলে পা তুলে খাটে হেলান দিয়ে আরাম করে বাস।
বসলাম।
তোমার মুখের চামড়া এখনো শক্ত আছে। রিল্যাক্স করা।
তুমি তোমার গল্প শুরু কর তো।
দাঁড়াও আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নি।
হাসান তুমি আজকাল বেশি সিগারেট খাচ্ছি। সিগারেটের গন্ধে তোমার ঘরে ঢোকা यां का!
হাসান গল্প শুরু করল। সে লক্ষ করল রীনা মন দিয়ে কিছু শুনছে না। তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু অন্য কিছু ভাবছে। অমনোযোগী শ্রোতাকে দীর্ঘ গল্প শোনানো খুবই কষ্টের ব্যাপার। হাসান বলল, গল্পটা কেমন লাগছে ভাবি?
ভালোই তো।
শেষ করব, না বাকিটা আরেকদিন শুনবে?
কেমন যেন মাথা ধরেছে। বাকিটা আরেক দিন শুনব। তুমি আজ বরং তোমার চিঠি শেষ কর।
ভাবি তোমার কি মন খারাপ?
না মন খারাপ না। কেমন যেন একা একা লাগছে।
ভাইয়া বাসায় নেই??
উহুঁ। নাপিতের কাছে চুল কাটাতে গেছে।
রাত দুপুরে চুল কাটাচ্ছে?
রীনা হালকা গলায় বলল, নাপিতের কথা বলে অন্য কোথাও যেতে পারে। আচ্ছা! হাসান ছেলেরা ঘরের চেয়ে বাইরে থাকতে বেশি পছন্দ করে, কারণটা কী?
জানি না ভাবি।
আমি মনে মনে একটা কারণ খুঁজে বের করেছি। আমার ধারণা, অতি প্রাচীনকালে মানুষ যখন পশু শিকার করে বেঁচে থাকত তখন থেকেই ব্যাপারটা শুরু। পুরুষরা শিকারে বের হতো। মেয়েরা সন্তানের দেখাশোনা করত। ওই যে পুরুষদের বাইরে থাকা অভ্যাস হয়ে গেল–সেই অভ্যাস আর যায় নি।
ভালো বলেছ তো ভাবি!
রীনা উঠে তার ঘরে চলে গেল। হাসান চিন্তিত মুখে বসে রইল। তিতলীর চিঠিটা শুরু করা দরকার। ঘোর কেটে গেছে। লিখতে ইচ্ছে করছে না।
তারেক বাসায় ফিরল রাত এগারটায়। তার হাতে দড়িবাধা মাঝারি সাইজের একটা কাতল মাছ। রীনা বলল, রাতদুপুরে মাছ আনলে কোত্থেকে?
আড়ঙের সামনে হাতে নিয়ে নিয়ে মাছ বিক্রি করে। ধানমণ্ডি লেকের মাছ। এক ব্যাটা জোর করে গছিয়ে দিয়েছে। সস্তা পড়েছে–এক শ টাকা।
তুমি খেয়ে এসেছ?
হুঁ।
কী দিয়ে খেলে?
তারেক কাপড় ছাড়তে ছাড়াতে বলল, সাধারণ খাবার–ভাজ্যভুজি। তবে নতুন একটা জিনিস খেলাম কালিয়াজিরার ভর্তা। একটু তিতা তিতা। তবে খেতে ভালো। কালিয়াজিরা ভর্তা দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে ফেলেছি।
লাবণীর কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে এসো, আমি কালিয়াজিরা ভর্তা বানাব।
তারেক অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, আচ্ছা। বলেই চমকে গেল। রীনার কাছে সে বলে গেছে নাপিতের কাছে যাচ্ছে। সেখানে রীনা। হুট করে লাবণীর প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছে এবং সেও স্বীকার করে ফেলেছে। তারেক অসহায় ভঙ্গিতে বলল, এক কাপ চা খাব রীনা।
রীনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, হাত মুখ ধোও চা নিয়ে আসছি।
চিনি দিও না। একটা বয়সের পরে চিনি ছেড়ে দেয়া দরকার।
আচ্ছা চিনি কমই দেব।
তারেক শোবার ঘরের চেয়ারে বসে আছে। বিছানায় টগর এবং পলাশ দুই ভাই জড়ােজড়ি করে শুয়ে আছে। তারা ঘুমোয় দাদাদাদির সঙ্গে, আজ এখানে চলে এসেছে। ওদেরকে দাদির ঘরে পার করতে হবে। কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে— একবার ঘুম ভেঙে গেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে।
রীনা চা এনে তারেকের সামনে রাখল। টগরকে খুব সাবধানে কোলে নিয়ে রওনা হলো। তারেক বলল, হাসানের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে এসো তো। রীনা বলল, আচ্ছা।
তারেক চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সে খুবই অসহায় বোধ করছে। রানা যদি আবারো লাবণীর প্রসঙ্গ তোলে সে কী বলবে। হুট করে রীনা লাবণীর প্রসঙ্গ তুললই বা কেন? হাসান কি তাকে কিছু বলেছে? বলার তো কথা না।
এই নাও সিগারেট।
থ্যাংক য়্যু।
তুমি দেখি পুরোপুরি সিগারেট ধরে ফেলছ।
আরে না টেনশনের সময় দু-একটা খাই।
এখন কি তোমার টেনশানের সময়?
কী যে বল টেনশনের কী আছে! তুমি কি ভাত খেয়েছ?
না, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
ব্যাপারটা কী তোমাকে বলি
কিছু বলতে হবে না।
আরে শোন না। বোস তো খাটে।
রীনা খাটে বসল। তারেক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল–আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশিয়ার শামসুল কাদের সাহেবের গলব্লাডার অপারেশন হয়েছে। সাকসেসফুল অপারেশন, হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে। বাসায় এসে আবার আগের মতো ব্যথা। ডাক্তার বলল ব্যথাটা সাইকোলজিক্যাল। ব্যথা হবার কোনো কারণ নেই। যাই হোক আমি দেখতে গেলাম, গিয়ে দেখি আমাদের অফিসের লাবণী। সেও দেখতে এসেছে। তার বাসা কদের সাহেবের বাসার সামনে। রাস্তার এমাথা ও মাথা। ফেরার সময় লাবণী বলল, স্যার আমার বাসাটা দেখে যান। এমন ধরল না যাওয়াটা অভদ্রতা মুগেলাম। লাবণীর বাবা ছিলেন বাসায় তিনি না খাইয়ে ছাড়বেন না। এই হলো
রীনা বলল, তোমার সিগারেট খাওয়া তো হয়েছে। চল শুয়ে পড়ি।
তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, চল। সে খুবই ভালো বোধ করছে। খুব গুছিয়ে সে সুন্দর একটা মিথ্যা গল্প ফেধেছে। গল্পটা বলেছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। রীনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে গল্পটা বিশ্বাস করছে। মেয়েরা সত্যির চেয়ে মিথ্যাটাকে সহজে গ্ৰহণ করে।
রীনা।
হুঁ।
একটা পান দাও না। চা খেয়ে মুখটা মিষ্টি হয়ে আছে। ঘরে পান আছে না?
আছে।
রীনা পান আনতে গেল। তারেক বেশ আয়েশ করে পা নাচাচ্ছে। সে বেশ আনন্দিত। তাৎক্ষণিকভাবে জটিল একটা মিথ্যা তৈরির আনন্দ। রীনা। এই গল্পটা বিশ্বাস করেছে জটিলতার কারণে। কারণ রীনা জানে তার ভেতরে কোনো জটিলতা নেই।
রীনা পান দিয়ে মশারির ভেতর ঢুকল। মশারি ভর্তি মশা। এত মশা ঢোকে কীভাবে কে জানে। মশারিতে কোনো ফুটা কি আছে? ফুটা তো চোখে পড়ছে না।
পান খাওয়া শেষ হলে বাতি নিভিয়ে ঘুমোতে এসো।
আচ্ছা।
বাড়িওয়ালার টাকাটা তুমি এখনো দিচ্ছ না। উনি আজো এসেছিলেন।
দিয়ে দেব।
কবে দেবে সেটা পরিষ্কার করে বল, আমি সেই ভাবে তাকে বলব। রোজ আসেন, বিশ্ৰী লাগে।
সামনের সপ্তাহে দেব। শনি-রোববারে আসতে বলো।
আচ্ছা।
নাপিতের কাছে আর যাও নি না?
গিয়েছিলাম, এত ভিড়!
রীনা জেগে আছে। বিছানায় শোয়ামাত্র তার ঘুম আসে না। গভীর রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকে। আজ তার ঘুম একেবারেই আসবে না। তারেকের মতো একটা মানুষ কী করে জটিল একটা গল্প ফাদল এটা তার মাথাতেই আসছে না। খুব সহজ যে মানুষ, তার ভেতরেও কি জটিল একটা অংশ লুকিয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ভয়াবহ জটিল মানুষের একটা অংশে কি থাকে শিশুর সারল্য? পুরোপুরি সহজ কিংবা পুরোপুরি জটিল মানুষ কি এই পৃথিবীতে হয় না?
তারেক বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম। সুখী মানুষের নিদ্রা। মানুষটা কি সত্যি সুখী ঐ একজন সুখী মানুষকে জটিল মিথ্যা গল্প বানাতে হয় না। জটিল সব গল্প অসুখী মানুষেরা তৈরি করেন।
রীনা সাবধানে খাট থেকে নামল। তার কেমন যেন গা জ্বালা করছে। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে থাকলে গা জ্বালা ভাবটা হয়তোবা কমবে।
হাসানের ঘরে বাতি জ্বলছে। সে মনে হয় চিঠি লিখছে। ভালবাসার চিঠি। রীনা তার এই জীবনে ভালোবাসার কোনো চিঠি পায় নি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ তাকে কখনো বলে নি–আমি তোমাকে ভালোবাসি। তারেকও না। সোজা সরল মানুষরা ন্যাকামি ধরনের কথা বলে না।
সোমবার তিতলীর তিনটা ক্লাস
সোমবার তিতলীর তিনটা ক্লাস। তিনটাই পার পর। ন’টার মধ্যে শুরু হয়ে বারটার মধ্যে সব ক্লাস শেষ। ঝড়-বৃষ্টি-টর্নেডো যাই হোক না সোমবার বারটায় হাসান লালমাটিয়া কলেজের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। এক জায়গায় থাকে না। একেক দিন একেক জায়গায়। তিতলীর দায়িত্ব হচ্ছে কলেজ থেকে বের হয়ে তাকে খুঁজে বের করা। একদিন সে হাসানকে পেয়েছে নাপিতের দোকানে মাথা মালিশ করাচ্ছে। কুৎসিত দৃশ্য। চোখ বন্ধ করে আয়েশ করে সে বসে আছে। নাপিত শব্দ করে মাথা বানাচ্ছে { তার জীবনে এমন ভীতু কোনো ছেলে দেখে নি। তিতলীর ধারণা, হাসানের তুলনায় তার সাহস অনেক বেশি। যেমন–হাসান কখনো তাকে নিয়ে রিকশায় উঠবে না। কোথাও যেতে হলে বেবিট্যাক্সি নেবে। বেবিট্যাক্সির সিটের দু প্রান্তে দুজন বসে থাকলে নাকি বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। বেবিট্যাক্সিতে উঠেও শান্তি নেই— হাসান বলবে, তিতলী ওড়নাটা দিয়ে নাক আর মুখ ঢেকে রােখ। নাকমুখ ঢাকা থাকলে মানুষ চেনা যায় না। তোমার পরিচিত কেউ যদি তোমাকে দেখেও ফেলে চিনতে পারবে না।
চিনতে পারলে চিনবে। তোমাকে এত ভাবতে হবে না। তুমি সহজ হয়ে বস তো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ‘উইজার্ড অব ওজের’ কাঠের পুতুল।
অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি হাসান কখনো তিতলীর হাত ধরে না। বেবিট্যাক্সিতে উঠে হাত ধরার কাজটা তিতলীকে করতে হয়। হাত ধরার পর হাসান বাইরের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন ভেতরে কী হলো সে জানে না।
ছেলেদের এত ভীতু হলে মানায় না। ছেলেরা হবে সাহসী, বেপরোয়া। তাদের দাবি থাকবে অনেক বেশি। মেয়েরা সেই সব দাবি সামলে সুমলে মোটামুটি একটা সাম্যাবস্থায় নিয়ে আসবে। এটাই নিয়ম। যে ছেলের দাবি এক শ তাকে দেবে কুড়ি কিন্তু এমন ভাব করতে হবে যেন সত্তর দেয়া হয়ে গেল। হাসানের বেলায় সব নিয়ম উল্টো। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তিতলীর অনেক সাহসী দাবি সে সামলে সুমলে চলছে।
ফার্স্ট পিরিয়ড শেষ হবার পর জানা গেল বাকি দুটা ক্লাস হবে না। ক্লাস না হওয়া সবসময়ই আনন্দজনক ব্যাপার। তিতলীর আনন্দ হচ্ছে না। কারণ, তাকে বারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বারটার পর হাসানকে খুঁজে বের করতে হবে। এই দুঘণ্টা সময় কী করা যায়? কলেজ ক্যান্টিনে চা খাওয়া যায়। দশ মিনিট গেল সেখানে—তারপর? লাইব্রেরিতে যাবে? অসম্ভব। লাইব্রেরিতে গেলেই তার মাথা ধরে যায়। সঙ্গে কোনো গল্পের বই নেই। গল্পের বই থাকলে কোনো একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে। গল্পের বই পড়া যেত।
তিতলী ক্যান্টিনের দিকে এগোচ্ছে। ক্যান্টিনে কাউকে পেলে তাকে নিয়ে আড়ঙ-এ চলে যাওয়া যায়। আড়ঙ-এ শাড়ি নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা কেটে যাবে।
এই তিতলী!
তিতলী তাকাল–নাসরিন হাত ইশারা করে ডাকছে। তার তোকানো এবং হাত ইশারার ভঙ্গি সবই রহস্যময়। নববর্ষে নাসরিন খেতাব পেয়েছে সপিণী। নাসরিন লম্বা ও ছিপছিপে। সপিণী নাম তার জন্যে মানানসই। মাছ, যেমন প্রতিবছর খোলস ছাড়ে নাসরিনও নাকি খোলস ছাড়ে। তবে তার জন্যে এক বছর অপেক্ষা করতে হয় না। পছন্দের কোনো মানুষ তাকে খোলস ছাড়তে বললেই নাকি সে ছাড়ে।
তিতলী অপ্ৰসন্নমুখে নাসরিনের দিকে এগিয়ে গেল। আশপাশে কেউ নেই। তবু নাসরিন গলা নামিয়ে বলল, তোর কাছে পঞ্চাশটা টাকা আছে? সহজ স্বাভাবিকভাবে সে কোনো কথাই বলতে পারে না। তার সবকিছুতেই খানিকটা রহস্য।
না।
তাহলে ভালো একটা জিনিস মিস করলি। আমার কাছে পাঁচটা ছবি আছে। একেকটা ছবি দেখতে দশ টাকা করে লাগবে।
কী ছবি?
কী ছবি বুঝতে পারছিস না? ওইসব ছবি—হুঁ হুঁ।
ওইসব ছবি দেখার আমার কোনো শখ নেই।
না দেখেই বলে ফেললি? ছবিগুলো সব টিভি স্টারদের। এদের কাণ্ডকারখানা দেখলে মাথায় হাত দিয়ে বসে যাবি।
আমার মাথায় হাত দিয়ে বসার দরকার নেই। তুই ছবি দেখিয়ে টাকা নিচ্ছিস আশ্চর্য তো!
টাকা না নিলে হবে? পাঁচটা ছবি আমাকে কি কেউ মাগনা দিয়েছে। নগদ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। গলাকাটা ছবি না। একজনের মুখ কেটে আকেজনের শরীরে বসানো না। জেনুইন ছবি।
বুঝলি কী করে জেনুইন ছবি?
যে দেখবে সেই বুঝবে জেনুইন ছবি। তুই দশ টাকা দিয়ে একটা ছবি দেখ। তারপর যদি তোর মনে হয় ছবি জেনুইন না, আমি টাকা ফেরত দেব।
কোনো দরকার নেই। ছবি দেখার পর তাদের নাটক দেখব। তখন শরীর ঘিনঘিন করবে।
আচ্ছা যা তোর টাকা লাগবে না। তোকে বিনা টাকায় দেখােব। আমাকে চা আর আলুর চাপ খাওয়া। দারুণ ক্ষিধে লেগেছে।
ক্যান্টিনে এখন ভিড় কম। টিফিন টাইমে বসার জায়গা থাকে না। আজ ফাঁকা ফাঁকা। সর্পিণী তিতলীকে নিয়ে কোণার দিকে একটা টেবিলে চলে গেল। কাধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে পাঁচটা ছবি বের করে তিতলীর হাতে দিল। ছবি হাতে নেবার পর তিতলীর সারা শরীর কাপতে লাগল। সে ছবিগুলোর দিকে তাকাতেও পারছে না। আবার চোখ সরিয়েও নিতে পারছে না। নাসরিন পা নাচাতে নাচাতে শিস দিচ্ছে। শিস দেয়া বন্ধ করে সে তিতলীর দিকে একটু ঝুকে এসে বলল, এই জাতীয় ছবি তুই আগে দেখিস নি?
না।
তোর দেখি শরীর কাঁপছে। ফোঁসফোঁসানি শুরু হয়ে গেছে। ছবিগুলো আমার কাছে দিয়ে নরমাল হ।
তিতলী ছবিগুলো দিয়ে দিল-নরম্যাল হওয়া বলতে যা বুঝায় তা হতে পারল না। এখনো তার হাতপা কাঁপছে। নাসরিন বলল, তোকে দেখে আমার ভয় লাগছে তুই বাথরুমে গিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি চায়ের অর্ডার দিচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে এসে চা খা।
আমি চা খাব না। বাসায় চলে যাব।
ন্যাকামি করিস না তো। তোর ন্যাকামি অসহ্য লাগছে। বাসায় চলে যাবে? তোর নায়ক বারটার সময় আসবে তখন কী হবে?
প্লিজ চুপ কর।
ছবিগুলো আরেকবার দেখবি?
না।
আচ্ছা তুই একটা কাজ কর একটা ছবি আমি তোকে দিয়ে দিচ্ছি। তুই নিয়ে যা।
কী আশ্চৰ্য কথা! আমি ছবি নিয়ে কী করব?
তোর নায়ককে দেখাবি। এইসব ছবি দুজনে মিলে দেখার মধ্যে অনেক মজা। পাঁচটার মধ্যে কোনটা নিবি?
কী অদ্ভুত কথা! আমি কোনোটা নেব না। এক কাজ করা পাঁচটাই নিয়ে যা। রাতে দরজা-টরজা বন্ধ করে আরাম করে দেখ। কাল নিয়ে আসিস। ক্যান্টিনে বসে টেনশনে এইসব ছবি দেখে কোনো মজা পাওয়া যায় না।
এই নিয়ে আর কোনো কথা বলবি না তো নাসরিন। আমি তোর কাছে হাতজোড় করছি।
তিতলী উঠে দাঁড়াল। নাসরিন বিস্মিত গলায় বলল, তুই যাচ্ছিস কোথায়? তোর না আমাকে চা আর আলুর চাপ খাওয়ানোর কথা।
বাথরুমে যাচ্ছি। হাতমুখ ধোব।
সামান্য ছবি দেখে এত গরম হয়েছিস যে শীতল জলে হাতমুখ ধুয়ে শরীর ঠাণ্ডা করতে হবে?
নাসরিন প্লিজ।
হাতমুখ ধুয়ে এসেও তিতলী ঠিক স্বাভাবিক হতে পারল না। মাথার ভেতরটা তার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নাসরিন চা আলুর চাপ খেল। তিতলীর কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে চলে গেল। তার নাকি আজ বাসায় ফেরার রিকশা ভাড়া নেই।
তিতলী ক্যান্টিনেই বসে আছে। তার সময় কাটছে না। এখন বাজছে মাত্র দশটা চল্লিশ। চিঠি লিখতে শুরু করলে হয়। তাহলে কিছুটা সময় কাটে। তিতলী খাতা বের করল। চিঠি লেখার জন্যে সে পাঁচশ পৃষ্ঠার একটা খাতা কিনেছে। না পাঁচ শ, পৃষ্ঠা না। সে গুনে দেখেছে চার শ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠা। তিতলী ঠিক করেছে সে চারশ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখবে। যদি শেষ পর্যন্ত লিখতে পারে তাহলে তার চিঠিই হবে কোনো মেয়ের তার প্রেমিকের কাছে লেখা দীর্ঘতম প্রেমপত্র। মাত্র আঠার পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। সে একসঙ্গে বেশিক্ষণ লিখতে পারে না। তার শরীর বিমঝিম করতে থাকে। ছবিগুলো দেখার পর আজ যেমন হয়েছিল, অবিকল সে রকম হয়।
তিতলী ঠিক করে রেখেছে। চিঠি শেষ হবার পর হাসানকে সে খাতাটা দেবে তার জন্মদিনের উপহার হিসেবে। কদিন ধরে অবশ্যি অন্যরকম একটা পরিকল্পনা মাথার ভেতর ঘুরছে। এই খাতাটা বাসর রাতে হাসানের হাতে দিলে কেমন হয়? হাসান বিক্ষিত হয়ে বলবে এই গাব্ববুস খাতাটা কীসের? সে বলবে–পড়ে দেখা। এটা একটা চিঠি, চার শ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার চিঠি।
চার শ ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার চিঠি! বল কী তুমি! কী লিখেছ?
পড়ে দেখ। বাসর রাতে হাসান তার স্ত্রীকে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিঠি পড়বে তা মনে হয় না। শুকনা চিঠির চেয়ে রহস্যময়ী রমণী কি অনেক প্ৰিয় হবার কথা না?
তিতলী চিঠিটা লিখেছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। শুরু করেছে তাদের প্রথম দেখা হবার দিন থেকে। শুরুটা ভালোই। তিতলী খাতা বের করল। খাতার প্রথম পাতায় লেখা–বাংলা দ্বিতীয় পত্র। লালমাটিয়া কলেজ। যেন হঠাৎ কারো হাতে খাতাটা পড়লে সে কিছু বুঝতে না পারে। চিঠির শুরুতে কোনো সম্বোধনও নেই।
তোমার সঙ্গে আমার প্রথম করে দেখা হয়েছিল তোমার কি মনে আছে? আমি এক লক্ষ টাকা বাজি রাখতে পারি তোমার মনে নেই। আমার কিন্তু সব মনে আছে। এমনিতে আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ। কিছু মনে থাকে না। এস.এস.সি. পরীক্ষার আগে ইংরেজি রচনা মুখস্ত করেছিলাম–A Journey by boat. পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখি এই রচনাটাই এসেছে। সবার আগে রচনা লিখতে বসলাম। দুটা লাইন লেখার পর সব ভুলে গেলাম। এই হলো আমার স্মৃতিশক্তির নমুনা। কিন্তু তোমার প্রতিটি ব্যাপার। আমার মনে আছে। উয়ারীতে আমরা পাশাপাশি ফ্লাটে থাকতাম সেটা অবশ্যই তোমার মনে আছে। আচ্ছা তোমার কি মনে আছে শবেবরাতের হালুয়া নিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি তুমি নামছ? হঠাৎ কী হলো তুমি হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে আমার গায়ে পড়ে গেলে। তারপর দুজন গড়াতে গড়াতে একেবারে সিঁড়ির নিচে। পিরিচ ভেঙে তোমার ঠোঁট কেটে গল গল করে রক্ত পড়তে লাগিল। সারা গা হালুয়া দিয়ে মাখামাখি। লজ্জায় তুমি মরে যাচ্ছিলে আমার দিকে চোখ তুলে তাকানো তো অনেক পরের কথা। আমি সিঁড়ির নিচে পড়েই রইলাম, তুমি রক্ত এবং হালুয়ায় মাখমাখ অবস্থাতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালে এবং দৌড়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেলে। এই ঘটনা তোমার অবশ্যই মনে আছে। যেমন–ওই দিন তোমার গায়ে ছিল হালকা সবুজ রঙের একটা ফুলশার্ট। শার্টে কালো স্টাইপ ছিল। ওইদিন যে তুমি দৌড়ে পালিয়ে গেলে বাসায় ফিরলে ঠিক রাত এগারটা পাঁচ মিনিটে। আমি তখন বারান্দায় বসে ছিলাম। বারান্দার বাতি নেভানো ছিল। যাতে তুমি আমাকে দেখতে না পাও৷ তুমি কখন ফের তা দেখার জন্যেই আমি বসেছিলাম। ওইদিন কত তারিখ ছিল তোমার মনে আছে? দুই লক্ষ টাকা বাজি তোমার মনে নেই। আমার মনে আছে-১২ তারিখ। কী বার মনে আছে? জানি মনে নেই–রোববার। এতসব খুঁটিয়ে কেন মনে রেখেছি? মেয়েদের স্বভাব হলো তুচ্ছ ব্যাপারগুলো মনে করে। রাখা / আমি তো সাধারণ একটা মেয়ে তাই না? শোনা ওইদিনটা ছিল আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। ওই দিনের কথা মনে হলেই তোমার লজ্জিত, ব্যথিত মুখের কথা আমার মনে হয়। ভয়ঙ্কর লজ্জায়। ওইদিন তোমার মাথা কাটী যাচ্ছিল। তোমার চোখ ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো পানিতে। তুমি জলভর্তি চোখে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলে আমার দিকে। তোমার ব্যথিত মুখ দেখে আমার কিশোরী হৃদয়ে এক ধরনের হাহাকার তৈরি হল। ইচ্ছে করল। তোমার হাত ধরে বলি–এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? অ্যাকসিডেন্ট হয় না? আমি অবশ্যই বলতাম। তুমি বলার সুযোগ দিলে না। দৌড়ে পালিয়ে গেলে…
তিতলী খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। মাত্র এগারোটা বাজে। এখন একবার কলেজের বাইরে গিয়ে খুঁজে দেখা যেতে পারে। হাসান যে কাঁটায় কাঁটায় বারোটার সময়ই আসবে তা তো না। বারোটার আগেই তার আসার কথা। হয়তো এগারটার সময় এসে নাপিতের দোকানে বসে মাথা বানাচ্ছে। নাপিত তার নোংরা হাতে হাসানের সুন্দর চুলগুলো ছানাছানি করছে। অসহ্য। অসহ্য।
তিতলী কলেজের গেটের বাইরে এসেই দেখে রাস্তার ওপাশে হাসান দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। হাতে চায়ের কাপ। ফুটপাতের দোকান থেকে চা কিনে বাবুর খুব আয়েশ করে চা পান করা হচ্ছে। কী অদ্ভুত মানুষ! সত্যি সত্যি এক ঘণ্টা আগে এসে বসে আছে। হাবলার মতো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তিতলী এক দৌড়ে রাস্তা পার হলো। আজ সে একটা কাণ্ড করবে চুপি চুপি হাসানের পেছনে দাঁড়িয়ে ‘হালুম করে একটা চিৎকার দেবে। এমন চিৎকার যেন হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়। বেচারাকে চায়ের কাপের দাম দিতে হবে। ভালো হবে। উচিত শিক্ষা হবে। এক ঘণ্টা আগে এসে বসে থাকার শিক্ষা।
তিতলী বলল, চিঠি এনেছ।।
হাসান হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ল। তিতলী লক্ষ করেছে কলেজের আশপাশে হাসান তার সঙ্গে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে ইশরায় জবাব দেবার চেষ্টা করে। তিতলী বলল, কই চিঠি দাও।
দেব।
দেবটেব না, এখনই দাও।
হাসান অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকাচ্ছে। তিতলীর খুব মজা লাগছে। এমন অস্বস্তি বোধ করার কী আছে? সে কি ভয়ঙ্কর কোনো পাপ করছে? এমন পাপ যে এক্ষুনি ফেরেশতারা এসে দোজখে ঢুকিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে দেবে।
কই চিঠি দিচ্ছে না কেন?
বললাম তো দেব। দাঁড়াও একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে আসি। বেবিট্যাক্সি না। বেবিট্যাক্সিতে ভটভটি শব্দ হয়, কোনো কথা শোনা যায় না। চল একটা রিকশা নিই। ওই রিকশাওয়ালাটাকে ডাক। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র। বারবার পেছনে ফিরে আমাদের দেখার চেষ্টা করবে না। আমাদের কথা শোনার চেষ্টাও করবে না।
হাসান একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে এল। তিতলী ভাব করল খুব বিরক্ত হচ্ছে, তবে সে বিরক্ত হয় নি। খুশি হয়েছে। বেবিট্যাক্সিতে চিঠি পড়তে পড়তে যাওয়া যায়। রিকশায় চিঠি পড়া যায় না। সবাই তাকিয়ে থাকে।
হাসান বলল, বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে খানিকক্ষণ ঘুরবে?
তিতলী বলল, ঘুরব। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না। নৌকা ডুবলে তুমি টেনে তুলবে।
হাসান বলল, আমিও সাঁতার জানি না।
তিতলী খুশি খুশি গলায় বলল, তাহলে চল। নৌকা ডুবলে দুজন একসঙ্গে তলিয়ে যাব। একজন পানির নিচে আরেকজন বেঁচে আছি–তাহলে খারাপ হতো।
হাসান বলল, বুড়িগঙ্গায় ওইপারে। আমার স্কুলজীবনের এক বন্ধু থাকে। ধূপনগর। সে মাছের খামার করেছে সেখানে যাবে?
তুমি যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানে যাব। তুমি যদি আমাকে সস্তা কোনো হোটেলে নিয়ে যাও হোটেলের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও তাতেও আমার আপত্তি নেই।
এসব কী ধরনের কথা?
বাজে ধরনের কথা। আচ্ছা যাও আর বলব না। চল ধূপনগরে যাই। মাছের খামার দেখে আসি।
ধূপনগরে গেলে ফিরতে কিন্তু দেরি হবে। পাঁচটার আগে ফিরতে পারবে না। দেরি হলে অসুবিধা হবে না। বাবা দেশের বাড়িতে গেছেন। রাত আটটার ট্রেনে ফিরবেন। বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে নটা। s
তোমার মা চিন্তা করবেন না?
মা তো সবসময়ই চিন্তা করছেন। একদিন না হয় একটু বেশি করলেন। কই চিঠি দাও।
হাসান চিঠি বের করল। বেবিট্যাক্সি চলছে। তিতলী হাসনের গা ঘেঁষে বসেছে। তার সমস্ত মনোযোগ চিঠিতে। চিঠির লেখক পাশে বসে আছে সেটা কোনো ব্যাপার না। হাসানের চিঠি তিতলী যেভাবে পড়ে আজ সেভাবে পড়তে পারল না। হাসানের সামনে তা সম্ভবও নয়। তিতলীর চিঠি পড়ার নিয়ম হচ্ছে–পড়ার আগে খানিকক্ষণ চিঠিটা সে গালে ছুঁইয়ে রাখবে। তারপর চিঠি পড়বে। চিঠি পড়তে পড়তে অবশ্যই তার চোখে পানি আসবে। চিঠি দিয়েই সে চোখের পানি মুছবে। চিঠি পড়তে গিয়ে চোখে যে জল এসেছে সেই জল চিঠিতেই জমা থাকুক।
তিতলী চিঠি শেষ করে নিচু গলায় বলল–তুমি লম্বা চিঠি লিখতে পার না? অনেকক্ষণ ধরে পড়া যায় এমন চিঠি? ক্লিপের মতো ছোট্ট কাগজ–কয়েকটা মাত্র লাইন–পড়ার আগেই চিঠি শেষ।
হাসান কিছু বলল না। তিতলী বলল, এ পর্যন্ত তুমি আমাকে কটা চিঠি লিখেছি বলতে পারবে?
না।
তবুও একটা অনুমান করা দেখি কাছাকাছি হয় কি না?
এক শ?
চুয়াত্তরটা। আজকেরটা নিয়ে চুয়াত্তর।
তুমি সব চিঠি জমা করে রাখ?
জমা করে রাখব না তো কী করব, পড়া শেষ হলেই কুঁচিকুঁচি করে ফেলে দেব?
ফেলে দেয়াই তো ভালো–কখন কার হাতে পড়ে!
হাতে পড়লে পড়বে। আমার এত ভয়ডর নেই।
তোমাকে দেখে কিন্তু খুব সাহসী মনে হয় না। ভীরু টাইপের। লাজুক লাজুক একটা মেয়ে মনে হয়।
আমি আসলেই ভীরু এবং লাজুক লাজুক টাইপের মেয়ে। তারপরেও প্রয়োজনের সময় আমি খুব সাহসী।
এটা ভালো।
আমিও জানি এটা ভালো। আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে। শবনম। খুব সাহসী। টিচারদের সঙ্গে টক টক করে তর্ক করে। রাজনীতি করে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের একবার একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিল তখন শবনম সমানে পুলিশের দিকে ঢিল জুড়েছে। কিন্তু যখন সত্যিকার সাহস দেখানোর প্রয়োজন পড়ল তখন সে মিইয়ে গেল। কোনো সাহস দেখাতে পারল না।
প্ৰয়োজনটা কী?
সেটা তোমাকে বলব না। মেয়েদের অনেক ব্যাপার আছে—যা ছেলেদের জানা ঠিক না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। যদিও আমরা সবসময় বলি–একটা ছেলেও মানুষ, একটা মেয়েও মানুষ। তারা আলাদা কিছু না–আসলে কিন্তু অনেকখানিই আলাদা।
হাসান হাসল। তিতলীকে নিয়ে বাইরে বের হলেই সে হড়বড় করে ক্রমাগত কথা বলতে থাকে। সেসব কথা হাসান যে খুব মন দিয়ে শোনে—তা না। তবে একটা মেয়ে মনের আনন্দে কথা বলে যাচ্ছে—ব্যাপারটাই মজার।
তিতলীর কথা বলার মধ্যে আবার হাত নাড়ােনাড়িও আছে। মনে হবে তার শ্রোতা একজন না। সে আসলে একদল ছাত্রছাত্রীকে বোঝাচ্ছে।
একটা ছেলে এবং একটা মেয়ের মধ্যে আসলে কোনো মিলই নেই। শরীরের অমিল খুব ক্ষুদ্র অমিল–আসল অমিল হলো মনে, মানসিকতায়। একটা ছেলের মানসিকতা এবং একটা মেয়ের মানসিকতা–আকাশ এবং পাতাল পার্থক্য। কোনো ছেলে যদি কোনো মেয়ের মনের ভেতরটা একবার দেখতে পারত। তাহলে সে বড় ধরনের চমক খেত।
এত কিছু বুঝলে কী করে?
বোঝা যায়। চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়। বাবাকে দেখে বুঝি, মাকে দেখে বুঝি, তোমাকে দেখে বুঝি, নিজেকে দেখে বুঝি।
আমাকে দেখে কী বোঝা?
তোমাকে দেখে বুঝি যে তোমার সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে। আমাদের বিয়ের পর কী হবে জান?
কী হবে?
তুমি তো আর সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকবে না–অফিসে যাবে। কাজকর্ম করবে। আমি ওই সময়টা সহ্য করতে পারব না। আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে যাবে। সেটা আবার তোমার খারাপ লাগবে। তুমি ভাববে। এ কী বন্ধনে জড়িয়ে পড়লাম। আর আমি তখন বন্ধন তো আলগা করবই না আরো নতুন নতুন শিকলে তোমাকে জড়োনোর চেষ্টা করব।
ইন্টারেস্টিং।
আমি আরো অনেক ইন্টারেস্টিং কথা জানি। সেসব কথা বলছি না, জমিয়ে রাখছি–বিয়ের পর বলব।
তুমি যে এত সহজে বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আস অস্বস্তি লাগে না?
না অস্বস্তি লাগে না। উল্টোটা হয়–ভালো লাগে। বাসর রাতে তোমার সঙ্গে আমি কী নিয়ে গল্প করব। সব ঠিক করে রেখেছি।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। আমি সেই রাতে খুব মজার একটা ব্যাপার করব।
মজার ব্যাপারটা কী?
এখন বলব না। আগে বললে তো মজা থাকবে না। আচ্ছা শোন আমার ক্ষিধে লেগেছে। আজ বাসা থেকে নাশতা না খেয়ে কলেজে এসেছি।
নাশতা না খেয়ে এসেছে কেন?
মা ঢেলঢেলা একটা খিচুড়ি রান্না করেছে। মুখে দিয়ে বমি আসার মতো হয়েছে। এখন ক্ষিধেয় মারা যাচ্ছি। আচ্ছা শোন এতক্ষণ হয়ে গেছে তুমি সিগারেট খাচ্ছ না। ব্যাপারটা কী? সিগারেট ধরাও। বিয়ের আগ পর্যন্ত তোমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে কিছু বলব না। বিয়ের পর–নো সিগারেট।
বিয়ের পর নো কেন?
তোমার ওপর যে আমার অধিকার আছে এটা জাহির করার জন্যেই নো।
হাসান পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তিতলী তার ব্যাগ থেকে দেয়াশলাই বের করল। হাসানের সিগারেট ধরিয়ে দেবে। হাসানের সঙ্গে বাইরে বের হবার সময় তার ব্যাগে একটা দেয়াশলাই থাকে। সে ঠিক করে রেখেছে টাকা জমিয়ে জমিয়ে সে সুন্দর একটা লাইটার কিনবে। লাইটারটা থাকবে তার কাছে। শুধু যখন হাসান সিগারেট ঠোঁটে দেবে তিতলী ধরিয়ে দেবে।
আজ কয়েকটা অদ্ভুত ছবি দেখেছি।
অদ্ভুত ছবি মানে?
না থাক ছবির ব্যাপারটা থাক।
তুমি আজ এমন ছটফট করছ, কেন?
আর ছটফট করব না। আচ্ছা শোন তুমি আমার হাতটা ধরে বসে থাক না কেন? এমন দূরে সরে আছ কেন?
সদরঘাট পৌঁছে হাসান ছইওয়ালা একটা নৌকা তিন ঘণ্টার জন্যে ভাড়া করল। ঘণ্টায় পঞ্চাশ টাকা হিসেবে দেড় শ টাকা ভাড়া, পঞ্চাশ টাকা বিকশিশ। সব মিলিয়ে দুশ টাকা। হাসান তার বন্ধুর বাড়িতে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে। হুট করে একটা মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হলে সে কী ভাববে কে জানে। হাসানের স্কুলজীবনের বন্ধুর সঙ্গে তার মাও থাকেন। তিনি প্রচীনপন্থী মহিলা। তার কাছে ব্যাপারটা নিশ্চিয়ই ভালো লাগেবে না। এরচে নৌকায় নৌকায় ঘুরে বেড়ানো ভালো। হাসান দু প্যাকেট মোরগ পোলাও একবোতল পানি এবং চারটা মিষ্টি পান। কিনেছে। বাসা থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে এলে ফ্লাস্কে করে চা নেয়া যেত। ফ্লাঙ্ক আনা হয় নি। পরের বার অবশ্যই ফ্লাস্ক আনতে হবে।
নৌকা ছোটখাটো হলেও সুন্দর। পাটাতনে শীতলপাটি বিছানো। দুটা ফুলতোলা বালিশ আছে। নৌকার বালিশ তেল চিটাচিট হয়–এই দুটা বালিশ পরিষ্কার। তিতলী বলল–মাঝিভাই শুনুন, আমরা দুজনই কিন্তু সাঁতার জানি না। নৌকা সবসময় তীরের আশপাশে রাখবেন। মাঝনদীতে যাওয়া একদম নিষিদ্ধ।
মাঝি দাঁত বের করে বলল, কিছুই হইব না আফা। এক্কেবারে লিচ্ছিন্ত থাকেন।
আচ্ছা বেশ ‘লিচ্ছিন্ত’ থাকব। তারপরেও শুনে রাখুন। নৌকা যদি ডুবে যায়আপনি কিন্তু আমাদের দুজনের একজনকেও বাঁচাতে চেষ্টা করবেন না। ভয় পেয়ে তখন হয়তো আমরা দুজনই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করব। আপনি আমাদের বাঁচাবেন। না-নিজে সাঁতরে তীরে উঠে পড়বেন।
মাঝি দাঁত বের করে হাসছে। মেয়েটার পাগলামি ধরনের কথায় সে খুব মাজা পাচ্ছে।
বেবিট্যাক্সিতে তিতলী সারাক্ষণ কথা বলছিল। নৌকা ছাড়তেই সে একেবারে চুপ হয়ে গেল। পানির দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। তার চোখও কেমন ছলছল করছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে।
হাসান বলল, তিতলী খাবার গরম আছে, হাত ধুয়ে খেয়ে ফেল। ঠাণ্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না।
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
তুমি-না বলেছিলে ক্ষিধে লেগেছে।
একসময় লেগেছিল এখন ক্ষিধে নেই।
কী হয়েছে তিতলী?
কিছু হয় নি। মন খারাপ লাগছে।
মন খারাপ লাগছে কেন?
গান জানি না। এই জন্যে খুব মন খারাপ লাগছে। গান জানলে তোমাকে গান গেয়ে শোনাতাম। তোমার কত ভালো লাগত।
আমার যথেষ্টই ভালো লাগছে।
আমার গানের গলা কিন্তু ভালো। বাবার টাকা পয়সা নেই, গান শিখতে পারলাম না। একটা হরমোনিয়াম কিনে দেবার জন্যে মার কাছে বাবার কাছে কত কান্নাকাটি যে করেছি? বিয়ের পর তুমি কিন্তু আমাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেবে। তোমার টাকা থাকুক বা না থাকুক।
অবশ্যই কিনে দেব। আমার প্রথম চাকরির বেতনের টাকায় কিনে দেব।
পানিতে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা কর। ঠাট্টা না। সত্যি।
হাসান পানিতে হাত দিয়ে রাখল। তিতলী মেয়েটাকে মাঝে মাঝে তার অদ্ভুত লাগে। ঠিক বুঝতে পারে না। একটা মেয়ের ভেতরে আসলেই অনেকগুলো মেয়ে বাস করে।
আমি গান জানলে তোমাকে কোন গানটা গেয়ে শুনাতম জান?
না—কোনটা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
তিতলীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
কী হয়েছে তিতলী?
কিছু হয় নি।
কাঁদছ কেন?
বুঝতে পারছি না কেন। হঠাৎ খুব মনটা খারাপ লাগছে।
মন খারাপ লাগছে কেন?
জানি না কেন? জানলে তোমাকে জানতাম।
বাসায় চলে যাবে?
হুঁ।
বেশ তো চল যাই।
তিতলী চারটার আগেই বাসায় পৌঁছে গেল এবং রাত আটটায় তার বিয়ে হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজির এক লেকচারের সঙ্গে। ছেলের মামারা বললেন–অনুষ্ঠান পরে হবে, আকদ হয়ে যাক। আজকের দিনটা খুব শুভ। ছেলের দাদি খুবই অসুস্থ। পিজিতে ভর্তি হয়েছেন। যে-কোনো সময় মারা যাবেন। মৃত্যুর আগে নাতবউয়ের মুখ দেখে যেতে চান।
কীভাবে কী ঘটল তিতলী নিজেও জানে না। তিতলীর শুধু মনে আছে তার বাবা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন–তুই আপত্তি করিস না মা। আমি দরিদ্র মানুষ–এমন ভালো ছেলে তোর জন্যে আমি যোগাড় করতে পারব না। তোর কী সমস্যা আমি কিছু শুনতে চাই না। মা রে তুই আমার প্রতি দয়া কর। তুই রাজি না হলে আমি বিষ খাব রে মা। সত্যি বিষ খাব। তোর মারি নামে আমি কসম কেটে বলছি বিষ খাব। তিতলী তার বাবাকে কোনোদিন কান্দতে দেখে নি–সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। সে তাকাল তার মার দিকে। ফিসফিস করে বলল, মা আমি কী করব? সুরাইয়া জবাব দিলেন না। তিনিও কাঁদছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। নাদিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। তিতলী নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, নাদিয়া আমি কী করব?
নাদিয়া বলল, আপা তুমি একজনের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ। প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ কোরো না।
কিন্তু বাবা কাঁদছেন। হাউমাউ করে কাঁদছেন। বাবাকে তিতলী কখনো কাঁদতে দেখে নি।
পিজি হাসপাতালের আঠার নম্বর কেবিনে তিতলী দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে সুন্দর চেহারার একটি যুবক। যুবকের মুখ হাসি হাসি। এই যুবকটি তার স্বামী। তার নাম যেন কী? আশ্চর্য নামটা মনে পড়ছে না।
বৃদ্ধ এক মহিলা আধবোজা চোখে তাকিয়ে আছেন। তার নাকে অক্সিজেনের নল। কাঠির মতো সরু সরু হাত। হাতের নীল রগ বের হয়ে আছে। ভদ্রমহিলার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে।
খুব গয়না-টয়না পরা এক মহিলা তিতলীকে বললেন, তোমার দাদিশাশুড়ি, সালাম কর।
তিতলী নড়ল না। বৃদ্ধা অস্পষ্ট জড়ানো স্বরে কী যেন বললেন। তিতলী সেই কথার কিছু বুঝতে না পারলেও অন্যরা বুঝল। বৃদ্ধার বালিশের নিচ থেকে গয়নার বাক্স বের করে আনল। বাক্স খুলে গয়না বের করে বৃদ্ধার হাতে দেয়া হলো। বৃদ্ধ তিতলীর দিকে চোখের ইশারা করলেন। গয়নাটা নিতে বললেন। পুরনো দিনের পাথর বসানো হার। বেদানার দানার মতো লাল লাল পাথর–।
তিতলীর মনে হচ্ছে লাল পাথরগুলো যেন চোখ। যেন বৃদ্ধার হাতের হারটা অনেকগুলো লাল চোখে তিতলীকে দেখছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটা হাসছে। এই যুবক তার স্বামী। তার নাম তিতলীর মনে পড়ছে না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না।
গানটার সুর যেন কী? আচ্ছা এই বৃদ্ধার কী হয়েছে? ক্যানসার?
লিটনকে কেমন জানি অন্যরকম লাগছে
লিটনকে কেমন জানি অন্যরকম লাগছে। কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা সূক্ষ্ম বলে ধরা যাচ্ছে না। চুল কেটেছে কি? না চুল কাটে নি। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। চুলের জন্যে কলেজে তার নাম ছিল শ্যাওড়াগাছ। লিটন বলল, তুই এ রকম করে তাকিয়ে আছিস কেন? কি দেখছিস?
হাসান বলল, তোকে দেখছি।
আমাকে দেখার কী আছে?
তোকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।
লিটন বলল, মনটা খুব খারাপ সেইজন্যেই বোধহয় অন্যরকম লাগছে।
মন খারাপ কেন?
লিটন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে দেখে বুঝতে পারছিস না কেন মন খারাপ? মালয়েশিয়া শেষ পর্যন্ত যেতে পারি নি। ঢাকা এয়াপোটে আটকে দিয়েছে। ফলস ভিসা।
হাসান বিস্মিত হয়ে বলল, তোর মালয়েশিয়া যাবার কথা ছিল নাকি?
তুই জানিস না?
না।
আমি যে বিয়ে করেছি। সেটা জানিস?
না জানালে জানব কীভাবে? আমি তো অন্তৰ্যামী না।
চাচাজান তোকে বলেন নি। আমি তাকে বলে গেছি। আমার বিয়ে তো আর কার্ড ছাপিয়ে হবে না যে কার্ড দিয়ে যাব। সস্তার বিয়ে। বন্ধুবান্ধব যে কজনকে বলেছিলাম কেউ আসে নি। কেউ না এলেও তুই আসবি সেই ব্যাপারে। আমি নিশ্চিত ছিলাম। বলতে গেলে একা একা বিয়ে করেছি। মনটা এত খারাপ হয়েছে।
মন খারাপ হবার কথাই। বুঝলি হাসান আমি ঠিক করেছিলাম আর কোনো দিন তোর সঙ্গে কথা বলব না। তোর বিয়ের কথা জেনেও আমি যাব না। তুই ভাবলি কী করে? লিটন আনন্দিত গলায় বলল, শম্পাকেও আমি এই কথা বলেছি। আমি বলেছি— শোন শম্পা, আর কেউ আসুক না। আসুক হাসান আসবেই। শম্পা বলেছে উনি কি আলাদা? আমি বললাম হাসান আলাদা কি আলাদা না তা আমি জানি না, হাসান আসবে এইটুকু জানি।
হাসান বলল, বাবা আমাকে কিছু বলেন নি, বোধহয় ভুলে গেছেন।
বুড়ো মানুষ ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। চাচাজানের কাছে এক হাজার টাকাও দিয়েছিলাম। ভেবেছি বিদেশ চলে যাচ্ছি যে যা টাকা পয়সা পেত দিয়ে যাই। সেই যাওয়া আটকে গেল। কী যে সমস্যার মধ্যে পড়েছি! আমার জন্যে কষ্ট হচ্ছে না। শম্পার জন্যে কষ্ট হচ্ছে। ও খুব কান্নাকাটি করে।
ভাবিকে কান্নাকাটি করতে নিষেধ করো। তুই না যাওয়াতে দুজন একসঙ্গে থাকতে পারছিস।
আমিও একজাক্ট এই কথাই শম্পাকে বলেছি। আমাদের দেশের ব্যাপার তো জানিস–সবাই বলাবলি করছে বিদেশ যাওয়া-টাওয়া সব ভাওতাবাজি। বিদেশে যাচ্ছে এই ভাওতা দিয়ে বিয়ে করেছে। আমার মনটা যে কী খারাপ তুই দেখে বুঝবি না।
মন খারাপের কথা বাদ দে তো। ভবির কথা বল। ভাবি দেখতে কেমন?
দেখতে মোটামুটি মানে এভারেজ আর কি। কিন্তু অসাধারণ একটা মেয়ে। অন্তরে এত মায়া তুই কল্পনাও করতে পারবি না। আমার সম্পর্কে কেউ একটা কথা বললে তার চোখ দিয়ে চেী চেী করে পানি পড়ে। একদিন হয়েছে কি শোেন–সকালবেলা ওদের বাসায় গিয়ে নাস্তা করার কথা। যেতে পারি নি। রাত ন’টার দিকে গেছি। গিয়ে শুনলাম–রাত ন’টা পর্যন্ত তোর ভাবি না খেয়ে বসে আছে। সলিড ফুড তো খায়ই নি–পানি পর্যন্ত না–এটা পাগলামি না!
পাগলামি হলেও সুন্দর পাগলামি।
তোরা যতই সুন্দর বলিস-আমি খুব রাগ করেছি। শম্পাকে কঠিন কঠিন কিছু কথা বলব বলে ভেবেছিলাম, শেষ পর্যন্ত বলি নি। হাইলি সেনসেটিভ মেয়ে তো-কঠিন কথা শুনে কী করে না করে তার ঠিক আছে। চুপচাপ থাকাই ভালো।
ভাবি কোথায় এখন? তোর সঙ্গে?
আমার সঙ্গে থাকবে কীভাবে? আমি থাকি মেসে। বউ নিয়ে তো আর মেসে উঠতে পারি না। শম্পা তার বড় মামার সঙ্গে থাকে। আমি প্রতিদিন কমপক্ষে একবার হলেও দেখে আসি। একবার রাতে ছিলামও। ওদের বাসা খুবই ছোট। দুই কামরার বাসা। এতোগুলো মানুষ। আমরাই যদি একটা ঘর দখল করে থাকি তাহলে হবে কীভাবে? আর নিউলি ম্যারিড কাপল তো আর অন্যদের সঙ্গে খাটে আড়াআড়িভাবে ঘুমোতেও পারে না। হাসান হাসছে। লিটন এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছে। কী সহজ আন্তরিক ভঙ্গিতেই না সে গল্প করছে!
হাসান শম্পার ছবি দেখবি? সঙ্গে আছে? ওদের ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছিলাম। ছত্ৰিশটা স্নাপ নিয়েছি আটটা এর মধ্য নষ্ট হয়েছে। এই দেখ।
হাসান ছবি দেখছে। লিটন গভীর আগ্রহে প্রতিটি ছবি ব্যাখ্যা করছে।
শম্পার সঙ্গে যে ছোট মেয়েটা দেখছিস সে শম্পার মামাতো বোন। ক্লাস টুতে পড়ে। এমনিতে খুব শান্ত মেয়ে, একটা বিচিত্র অভ্যাস আছে। আদর করে কামড় দেয়। ওইতো পরশুদিন হঠাৎ শম্পার নাক কামড়ে ধরল। এক্কেবারে রক্ত বের করে দিয়েছে।
এই ছবিটা দেখ শম্পার গলায় যে হারটা দেখতে পাচ্ছিস এটা রিয়েল না ইমিটেশন। হাসান বলল, ভাবি তো দেখতে খুব সুন্দর। তুই কী বলছিস মোটামুটি! সামনাসামনি আরো সুন্দর দেখা যায়। ছবিতে তেমন ভালো আসে নি। ক্যামেরাটাও তত ভালো ছিল না–দেখ না। সবাই আউট অব ফোকাস। তোকে একদিন নিয়ে যাব। শম্পা খুব খুশি হবে। তোর কত গল্প করেছি।
আমার আবার কী গল্প? তোর গল্পের কি শেষ আছে? তোর টাকা নেই পয়সা নেই–তারপরেও তুই আমাদের জন্যে যা করিস সেটা কে করে? তোর একটা গল্প শুনে শম্পার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। গল্পটা হচ্ছে…
থাক তোকে গল্প বলতে হবে না।
আহা শোন না, এই গল্প আমি যে কতজনকে করেছি–ওই যে কলেজে পড়ার সময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম, তুই খবর পেয়ে….
চুপ কর তো।
আচ্ছা চুপ করলাম, শম্পাকে কবে দেখতি যাবি? হাত একদম খালি। খালি হাতে তাকে দেখতে যাব। কীভাবে। কিছু তো নিয়ে যেতে হবে। দেখি তিন-চার দিনের মধ্যে যাব।
তোকে এসে নিয়ে যাব। শুক্রবারে আসি? কিছু নিতে হবে না, তোকে দেখলেই খুশি হবে। উপহার দিয়ে তাকে খুশি করার ক্ষমতা তো আমার নেই। মানুষ দেখিয়ে খুশি করা সেটাও তো কম না। আজ উঠি রে।
হাসান তাকে সঙ্গে করেই বেরোল। আজ বুধবার-হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। হিশামুদিন সাহেবকে এখনো তার নিজের চাকরির কথা বলা হয় নি। লজ্জার কারণে বলা হচ্ছে না-লিটনেরটা বল দেখবে নাকি? এই মুহুর্তে তারচে’লিটনের চাকরি। অনেক বেশি দরকার।
রাস্তায় বের হতেই আশরাফুজ্জামান সাহেবকে দেখা গেল। তিনি কয়েক পলক তাদের দিকে তাকিয়ে হুট করে পাশের গলিতে ঢুকে পড়লেন। আজকাল তিনি ছেলেদের দেখলে সরে পড়েন। হাসানের খুব মায়া লাগছে। মানুষের কত পরিবর্তনই না হয়! একটা সময় ছিল তার পায়ের শব্দেই বুক ধড়ফড় করত। সেই মানুষ আজ পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। পথেঘাটে হঠাৎ দেখা হলে এমন বিব্রত হন।
লিটন বলল, চাচাজান কি তোকে টাকাটা দিয়েছেন? এক হাজার টাকা?
হাসান বলল, না। তা
কে কিছু জিজ্ঞেস করিস না। বুড়ো মানুষ ভুলে গেছেন। জিজ্ঞেস করলে লজ্জা পাবেন।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করব না।
প্ৰচণ্ড রোদ উঠেছে। এই রোদে হাঁটতে কষ্ট হয়। হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। হাসানের পকেটে কুড়িটা মাত্র টাকা। কুড়ি টাকার একটা চকচকে নোট। নোটটা খরচ করা যাবে না। বেকারদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার আছে। পকেট একেবারে শূন্য করতে নেই। হাসান ঘড়ি দেখল। হেঁটে যেতে গিয়ে দেরি হয়ে যাবে না তো?
দেরি হলেই হিশামুদ্দিন সাহেবের পি.এ. মোতালেব ভুরু কুঁচকে বলবে, মাই গড় আজো দেরি? ভাবটা যেন সে সবসময় দেরি করেই যাচ্ছে।
স্যার তো মনে হয়। আজ কথা বলতে পারবেন না।
হাসান বলল, ও আচ্ছা। মোতালেব হাই তুলতে তুলতে বলল, স্যারের মেয়ে এসছে— ‘চিত্ৰলেখা’; সে স্যারের সব টাইমটেবিল ভণ্ডুল করে দিচ্ছে।
হাসান বলল, চলে যাব?
মোতালেব এই প্রশ্নের জবাব দিল না-হাই তুলল। গুরুত্বহীন মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। তাকে ঘন ঘন হাই তুলতে হয়। মোতালেব এই জন্যেই হাই তুলছে।
মোতালেব সাহেব আমি কি চলে যাব?
থাকুন কিছুক্ষণ। চা খান, দেখি স্যার কী বলেন।
হাসান বসে পড়ল। মোতালেবের এই ঘরটা ডাক্তারদের ওয়েটিং রুমের মতো। দেয়ালের সঙ্গে ঘেষে একসারি বেতের চেয়ার সাজানো। চেয়ারগুলোতে এককালে গদি ছিল–এখন নেই। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। ভারি কালো রঙের টেবিলের ওপর ময়লা কয়েকটা ম্যাগাজিন। ঘরের এক কোনায় ছোট্ট টেবিল নিয়ে ডাক্তার সাহেবের অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো বিরক্তমুখে মোতালেব বসে থাকে। মোতালেবের হাতে মুনশি। আমিরুদিনের লেখা চটি একটি বই, নাম ‘প্রেমের সমাধি’। বইটির কভারে একটা ফুটন্ত ফুলের ছবি। সেই ফুলের ওপর কুৎসিতদর্শন একটা পোকা উড়ছে। পোকাটার গায়ের রং ঘনকৃষ্ণ, চোখ টকটকে লাল। পোকাটা খুব সম্ভব ভ্রমর, তবে দৈত্যাকৃতির ভ্রমর। প্রেমের সমাধি নামের এই চটি বইটি মোতালেব গত দু মাস ধরে পড়ছে। হাসান ঠিক করে রেখেছে মোতালেব সাহেবের এই বই পড়া শেষ হলে সে বইটা তার কাছ থেকে ধার করে নিয়ে পড়ে দেখবে, ব্যাপারটা কী?
ডাক্তারের ঘরে যেমন ওষুদের গন্ধ থাকে, এই ঘরেও তেমনি ওষুধের কড়া গন্ধ। এই গন্ধ-রহস্য হাসান বের করেছে। ইনসেকটিসাইডের গন্ধ। বাগানের ফুলগাছে প্রতি সপ্তাহে একবার ক্ষেপ্ৰ করে ইনসেকটিসাইড দেয়া হয়। ইনসেকটিসাইডের বোতল এই ঘরের আলিমিরায় তালবন্ধ থাকে। আলমিরায় হাতে লেখা একটা নোটিশ আছে–
‘বিপদজণক’
জনক বানানে মূর্ধণ্য ন ব্যবহার করা হয়েছ বলেই বোধহয় নোটিশটা দেখলেই গা ছমছম করে। এই ঘরে সময় থেমে থাকে। পাঁচ মিনিট বসে থাকলেই মনে হয় পাঁচ ঘণ্টা বসে থাকা হয়েছে। হাসান নড়েচড়ে বসল। সময় থামা অবস্থাতেও অনেকক্ষণ পার হয়েছে।
মোতালেব সাহেব!
মোতালেব বই থেকে মুখ তুলল। তার দৃষ্টি অপ্রসন্ন, ভুরু কেঁচকানো। হাসান অপ্ৰস্তুত ভঙ্গিতে বলল, চলে যাব?
বাজে কটা?
সাড়ে তিনটা।
আরো পাঁচ-দশ মিনিট বসে চলে যান।
আপনি কি একটু জেনে আসবেন?
জেনে আসা যাবে না। এতদিন পর স্যারের মেয়ে এসেছে। স্যার মেয়ের সঙ্গে গল্প কৰ্ম্মশ্ৰমৰ কি কের আন উপস্থিত হব। বাংলগ ছাড়া কথা বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
চারটা পৰ্যন্ত অপেক্ষা করুন। তিনটা থেকে চারটা এই এক ঘণ্টার পেমেন্ট নিয়ে হাসিমুখে চলে যাবেন। বাকিটা আমি দেখব।
জ্বি আচ্ছা। স্যারের মেয়ে দেখতে কেমন?
দেখতে কেমন তা দিয়ে আপনার কোনো দরকার আছে?
জ্বি না।
তাহলে জানতে চান কেন? স্যারের মেয়ে কালো কুৎসিত হলেও আপনার কিছু যায় আসে না, ডানাকাটা পরী হলেও না।
তা তো বটেই।
হাসান একটা ম্যাগাজিন হাতে নিল। সময় কাটানোর জন্যে রোমহর্ষক অপরাধের কাহিনী পড়া ছাড়া কোনো গতি নেই। অপরাধের কাহিনী ছাড়া এখন কোনো মাগাজিন প্ৰকাশিত হয় না। দেশে তেমন কোনো মজাদার অপরাধের কাহিনী পাওয়া না গেলে বিদেশী অপরাধের কাহিনী ছেপে দেয়া হয়। লস এঞ্জেলসে তিন সমকামী তরুণীর গোপন কাহিনী জাতীয় মজাদার কেচ্ছা।
আপনি কি হাসান সাহেব?
হাসান ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল।
এক শ ভাগ খাঁটি বাঙালি মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ না বলে দিলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই মেয়ের নাম চিত্ৰলেখা। বাবার মতো টকটকে গায়ের রং না–শ্যামলা মেয়ে। মাথাভর্তি চুল–চুল নিয়ে সে খানিকটা বিব্রত। একটু পর পর মুটো করে চুল ধরছে। খুব সাধারণ সুতির শাড়ি পরেছে। মনে হচ্ছে এই সাধারণ শাড়িটা না পরলে তাকে মানাত না। সবচে’ মজার ব্যাপার মেয়েটির পায়ে স্যান্ডেল নেই। খালি পা। খালি পাতেও তাকে মানিয়েছে। মনে হচ্ছে কোনো স্যান্ডেলেই এই মেয়েকে মানাত না। এক ধরনের মানুষ আছে যাদের সবকিছুতেই মানায়। এও বোধহয় সে রকম কেউ।
আপনি হাসান সাহেব তো?
জ্বি।
আপনার না তিনটার সময় বাবার ঘরে যাবার কথা? আমি আপনার জন্যেই বসে ছিলাম।
আমার জন্যে?
জ্বি। আপনাকে বাবা কীসব গল্প বলেন এইসব আর আপনি কীভাবে নোট করেন তাও দেখব। ও আচ্ছা আমি তো আমার পরিচয় দিই নি। আমার নাম চিত্ৰলেখা।
জ্বি আমি বুঝতে পেরেছি।
কীভাবে বুঝলেন? ও আচ্ছা বোঝাটাই তো স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই এর মধ্যে শুনে ফেলেছেন যে আমি এসেছি তাই না?
আসুন আমার সঙ্গে।
কোথায়?
বাবা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
হাসান পেছনে পেছনে যাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করে–আপনি খালি পায়ে হাঁটছেন কেন? জিজ্ঞেস করল না। এ ধরনের প্রশ্ন করার মতো ঘনিষ্ঠতা মেয়েটির সঙ্গে হয় নি। কোনোদিন হবেও না।
হাসান সাহেব?
জ্বি।
আমেরিকার কেউ যদি আমার নাম জিজ্ঞেস করে আমি কী বলি জানেন? আমি বলি আমার নাম মিস পিকচার ড্র। আমার এই নামটিই এখন চালু। অনুবাদটা ভালো হয়েছে না?
জ্বি।
যান। আপনি বাবার সঙ্গে বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি।
হিশামুদ্দিন সাহেব আজ একটা ধবধবে পাঞ্জাবি গায়ে বসে আছেন। হাসান তাকে খালি গায়ে দেখেই অভ্যস্ত। পাঞ্জাবিতে তাকে অন্যরকম লাগছে। তার সামনে পানের বাটাও নেই। হাসানের মনে হচ্ছে চিত্ৰলেখার উপস্থিতির সঙ্গে ঘটনা দুটি সম্পর্কিত।
স্যার স্নামালিকুম।
হাসান বস। আমার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে?
জ্বি।
আমার মেয়ের মধ্যে এমন কী দেখলে চোখে পড়ার মতো?
হাসান ইতস্তত করে বলল, উনি খালি পায়ে হাঁটছেন।
হিশামুদ্দিন হাসতে হাসতে বললেন–আরে দূর। খালি পায়ে হাঁটছে কারণ স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছে না। ওর সবচে’ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ওর কাছে সব মানুষই চেনা। অতি আপন। তোমার সঙ্গেও নিশ্চয়ই খুব চেন্না ভঙ্গিতে কথা বলেছে। আমার বড় বোনের মধ্যেও এই ব্যাপারটা ছিল। আমার বড়বোনের নাম কি তোমার মনে আছে?
পুষ্প। ভালো নাম লতিফা বানু।
হ্যাঁ ঠিক আছে।
চিত্ৰলেখার খুব ইচ্ছা আমি তোমাকে কীভাবে গল্পগুলো বলি তা শুনবে। ও আসুক তখন তোমাকে আমার বড় বোনের একটা গল্প বলব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি টাকা-পয়সা ঠিকমতো পাচ্ছি। তো?
পাচ্ছি স্যার।
চিত্ৰলেখা চা নিয়ে ঢুকল। টি-পটভর্তি চা। দুধের পট, চিনির পট। হাসান অবাক হয় লক্ষ করল প্রথম চায়ের কাপটি চিত্ৰেলেখা তার বাবার জন্যে না বানিয়ে তার জন্যে বানাচ্ছে। খুব সাধারণ একটি ভদ্রতা। হাসানের মতো অভাজনের জন্যে এ ধরনের আদ্রতা চিত্ৰলেখার মতো মানুষরা করে না। তার প্রয়োজন নেই।
হাসান সাহেব আপনি কতটুকু চিনি খান?
তিন চামচ।
আজ প্রথমদিন বলে তিন চামচ দিচ্ছি–দয়া করে চিনি খাওয়া কমাবেন। আমি কিন্তু ডাক্তার। অকারণে উপদেশ দেই না। যখন প্রয়োজন তখনি উপদেশ দি।
হিশামুদ্দিন বললেন, তোর স্যান্ডেল পাওয়া গেছে?
চিত্ৰলেখা হাসিমুখে বলল, একপাটি পাওয়া গেছে–অন্য পাটি খোঁজা হচ্ছে।
হিশামুদ্দিন বললেন, তোর কি এক জোড়াই স্যান্ডেল?
হ্যাঁ। এক শ জোড়া স্যান্ডেল দিয়ে আমি কী করব? আমি কি লেডি ইমালডা? বাবা তোমার গল্প শুরু কর।
চিত্ৰলেখা ঠিক তার বাবার মতোই দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে। একটা হাত তার গালে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে–যে গল্প বলে শ্রোতারা তার দিকেই তাকিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম করে চিত্ৰলেখা তাকিয়ে আছে হাসানের দিকে। তার চোখ চাপা কৌতুকে ঝিলমিল করছে। হিশামুদ্দিন গল্প শুরু করেছেন।
আমাদের নেত্রকোনার বাসায় একটা শিউলিগাছ ছিল। শিউলিগাছ জংলি ধরনের হয়। খসখসা পাতা–কুপড়ির মতো বড় হয়। জঙ্গলে জন্মালেই এই গাছগুলোকে মানাত। শিউলিগাছের আরো সমস্যা আছে–শুয়োপোকা। বৎসরের একটা সময়ে আমাদের শিউলিগাছ ভর্তি হয়ে যেত শুয়োপোকায়। সেই সময় বাবা ঠিক করতেন গাছ কেটে ফেলা হবে। বড় আপার জন্যে কাটা হতো না। শিউলি ফুল তার খুব প্রিয় ছিল। গাছটার ফুল ফোঁটাবার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। শীতের সময় উঠোন ফুলে ফুলে ভরে থাকত। বড়। আপা বলতেন–জোছনার চাদর। যাই হোক এক বৎসর হঠাৎ কী হলো গাছটায় ফুল ফুটিল না। একটা ফুলও না। আমরা সবাই খুব অবাক হলাম–বড়। আপা হলেন অস্থির। গাছটায় একটা ফুলও ফুটবে না–এ কেমন কথা। প্রায় সময়ই দেখতাম কাজকর্ম সব ছেড়ে দিয়ে বড়। আপা গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেই শীতেই বড় আপা মারা গেলেন। অতি তুচ্ছ কারণেই তাঁর মৃত্যু হলো। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে মাথায় ব্যথা পেলেন। সামান্য ব্যথা–তেমন কিছু না। রান্নাবান্না করলেন। আমাদের খাওয়ালেন। নিজে কিছু খেলেন না–তার নাকি শরীরটা ভালো লাগছে না, মাথা ঘোরাচ্ছে। তিনি বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে রইলেন। তার আধঘণ্টা পর বাবাকে ডাকলেন। বাবা বিছানায় তার পাশে বসলেন। বড় আপা বললেন, বাবা তুমি আমার মাথার চুল বিলি করে দাও। তারপর হঠাৎ করে বললেন, বাবা আমি মরে যাচ্ছি। বাবা ভয় পেয়ে আমাদের সবাইকে ডাকলেন। তার ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই বড়। আপা মারা গেলেন। নেত্রকেনা বড় মসজিদের গোরস্থানে তার কবর হলো। হতদরিদ্র পরিবারের মৃত্যুশোক স্থায়ী হয় না। সাতদিনের মাথায বাসার সব মােটামুটি ঠিক হয়ে গেল। সেই সময় একটা আনন্দের ব্যাপারও ঘটল-বাবা একটা চাকরি পেয়ে গেলেন। চাকরি তেমন ভালো না, তবে বাবা খুব উল্লসিত-কারণ এই চাকরিতে বাড়তি আয়ের সুযোগ-সুবিধা খুবই ভালো। মাছ সাপ্লাইয়ের কাজ। ভাটি অঞ্চলের বড় বড় মাছ কাঠের পেটিতে বরফ দিয়ে ভরে ঢাকা পাঠানো। বরফের প্যাকিং হয় রাতে। এর মধ্য দু-একটা মাছ এদিকওদিক করা যায়। তাতে কেউ কিছু মনেও করে না। এই ধরনের ক্ষতি হিসেবের মধ্যে ধরা থাকে। বাবা আনন্দিত গলায় বললেন–এইবার দেখা যাবে তোরা কে কত মাছ খেতে পারিস। মাছের বড় বড় পেটি খেয়ে দেখবি এক সময় মাছের ওপর ঘেন্না ধরে যাবে। তখন মাছের ছবি দেখলেও ‘ওয়াক থু’ করে বমি করে ফেলবি।
চাকরি শুরু করার তিন দিনের মাথায় বাবা বিশাল এক চিতল মাছ নিয়ে শেষরাত্রে বাসায় চলে এলেন। মহা উৎসাহে চিতল মাছ রান্না করলেন। সকালে নাশতার বদলে বারান্দায় পাটি পেতে চিতল মাছের পেটি দিয়ে আমরা ভাত খেতে বসলাম। আর তখনি আমার মেজো বোন ময়না চেঁচিয়ে বলল, দেখ দেখ! আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম শিউলি গাছের নিচটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। শিউলিগাছ আবার ফুল ফোঁটাতে শুরু করেছে।
হাসান আজ এই পর্যন্তই।
চিত্ৰলেখা বলল, হাসান সাহেব। আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন?
জ্বি না।
আপনি কি বাবার সব গল্প লিখে ফেলেছেন?
জ্বি।
পরের বার যখন আসবেন–লেখা কপিগুলো নিয়ে আসবেন। আমি একটু পড়ে দেখব। আপনি পরের বার কবে আসবেন?
আমি প্রতি বুধবারে আসি। আপনি বললে আমি কালই দিয়ে যাব।
প্লিজ। আমার খুব পড়ার ইচ্ছা। চলুন আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
না না এগিয়ে দিতে হবে না।
অবশ্যই এগিয়ে দিতে হবে। আমি খুবই ভদ্র মেয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে চিত্রলেখা বলল, হাসান সাহেব!
জ্বি।
বাবার গল্পগুলো শুনতে আপনার কেমন লাগে?
ভালো লাগে।
বাবা খুব গুছিয়ে গল্প বলেন। লেখক হলেও তিনি খুব নাম করতেন।
জ্বি।
তবে আপনাকে একটা গোপন তথ্য দিচ্ছি—বাবার গল্পে কিছু বানানো ব্যাপার আছে। আপনি সামনে ছিলেন বলে আমি বাবাকে ধরলাম না। আপনি সামনে না থাকলে অবশ্যই ধরতাম।
হাসান বলল, কোন জিনিসটা বানানো?
ওই যে শিউলিগাছে বাবার বড় বোন পুষ্পের মৃত্যুর পর পর ফুল ফুটল।
বানানো বলছেন কেন?
কারণ এই গল্প বাবা আমাকেও বলছেন। তখন গল্পটা অন্য রকম ছিল।
কী রকম ছিল?
আমাকে বাবা বলেছিলেন–তাঁর বড় বোনের মৃত্যুর পর আমাদের দাদাজানের সব রাগ গিয়ে পড়ল গাছটার ওপর–তিনি পাগলের মতো সামান্য মাছকাটা বঁটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে গাছটা কেটে ফেললেন।
ও আচ্ছা–উনি হয়তো ভুলে গেছেন।
এ রকম একটা বড় ঘটনা ভুলে যাবার কথা তো না।
সবগুলো ডাল হয়তো কাটা হয় নি–একটা রয়ে গিয়েছিল। সেই ডালে ফুল ফুটেছে।
চিত্ৰলেখা খিলখিল করে হসছে। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, বাবাকে তো আপনি দেখি আমার চেয়েও বেশি পছন্দ করেন। এখন একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো।
হাসান ভীত গলায় বলল, কোন ব্যাপার?
বাবা আপনাকে এত পছন্দ করেন কেন সেই কারণটা ধরা গেল। আপনি বাবাকে পছন্দ করেন বলেই বাবা আপনাকে পছন্দ করেন। পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার মানুষ খুব সহজেই ধরতে পারে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করে ফেললাম। এখন আপনি চলে যান।
চিত্ৰলেখা হাসানকে গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। খালি পায়ে সে হাঁটছে–হাসানের আবারো মনে হলো এই মেয়ে খালি পায়ে না হেঁটে স্যান্ডেল পায়ে হাঁটলে তাকে মোটেও মানাত না।
দিনটা মেঘলা।
সারাদিন মেঘ ছিল না। এখন কোথেকে গাদা গাদা মেঘ আকাশ অন্ধকার করে ফেলেছে। হাসানের মনে হলো নীল রঙে আকাশকে মানায় না, কালো রঙেই মানায়।
হাসানের হাঁটতে ভালো লাগছে। মেঘলা দিনের বিকেলে হাঁটতে ভালো লাগে। শুধু সারাক্ষণ মনে হয়। একজন প্ৰিয় কেউ পাশে থাকলে আরো ভালো লাগত। তিতলীর বাসায় গিয়ে দেখা যেতে পারে। তাকে যদি কোনোভাবে শুধু বলা যায় –তিতলী আমার খুব ইচ্ছা করছে তোমাকে নিয়ে হাঁটতে। সে যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করবে। তারা হাঁটবে মেঘের দিকে তাকিয়ে। ওই যে একটা গান আছে না–মেঘ বলেছে যাব যাব। ওই গানটা দুজনই মনে মনে গুনগুন করবে।
হাসান সাত টাকা দিয়ে বড়.একটা গোলাপ কিনল। গোলাপ যে এত বড় হয় তার ধারণা ছিল না। মনে হচ্ছে বোম্বাই গোলাপী। বড় বলেই দাম বেশি। প্ৰমাণ সাইজের গোলাপ চার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে–এই গোলাপ সাত টাকা। প্রায় ডাবল দাম। গোটা দশেক। কিনতে পারলে তিতলী হতভম্ব হয়ে যেত। টাকা নেই। সাত টাকা খরচ করতেও গায়ে লাগছে।
সাত টাকায় সাত কাপ চা খাওয়া যায়। এক প্যাকেট সন্তা সিগারেট কেনা যায়। এক ডজন দেয়াশলাই কেনা যায়। সাত টাকার এই বোম্বাই গোলাপী একদিনে বাসি হয়ে যাবে। মনে হবে গোলাপটার খারাপ ধরনের ডায়রিয়া হয়েছে। তারপরেও ফেলা হবে না। রেখে দেয়া হবে। তিতলীর যা কাণ্ডকারখানা পাপড়িগুলো সে হয়তো কোনোদিনও ফেলবে না। কোনো এক গল্পের বইয়ের পাতার ভাঁজে ভঁাজে রেখে দিয়ে ভুলে যাবে। হঠাৎ একদিন বই ঝাড়তে গিয়ে পাতায় পাতায় পাওয়া যাবে গোলাপের পাপড়ির অপূর্ব শুটকি। হাসানের মনে হলো একটা গোলাপ নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। এক হচ্ছে অমঙ্গলসূচক। এক মানেই একা। সবচে’ মঙ্গলসূচক সংখ্যা হলো দুই। দুই মানেই আমি এবং তুমি। পনেরটা টাকা চলে যাবে। তার সঙ্গে আছে কুড়ি টাকার একটা নোট। ফেরার সময় ফিরতে হবে হেঁটে হেঁটে। হাঁটা মন্দ কী? তিতলীর সঙ্গে দেখা হবার পর হেঁটে হেঁটে ফিরতে খারাপ লাগবে না।
হাসান ফুলওয়ালাকে বলল, ভাই ঠিক এই সাইজের আরেকটা গোলাপ দিন। এই গোলাপগুলোর নাম কী বলুন তো? ফুলওয়ালা বিরস গলায় বলল, তাজমহল।
গোলাপের নাম তাজমহল ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না। মোতালেব সাহেবকে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি যেহেতু বাগানে বিষ প্রে করেন তিনি জানবেন। হিশামুদ্দিন সাহেবের মেয়েটিও জানতে পারে। তাকে দেখলেই মনে হয় এই মেয়ে সব জানে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে বলে দেবে।‘
দুবার কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল। দরজা খুলে দিল নাদিয়া। হাসান বলল, কেমন আছে নাদিয়া?
নাদিয়া জবাব দিল না। হাসান জানে নাদিয়া জবাব দেবে না। এই মেয়েটা অসম্ভব লাজুক। তবে একবার কথা শুরু করলে ফড়িফড় করে অনেক কথা বলে। ওই দিন খুব কথা বলেছে।
তোমার প্রিপারেশন কেমন হলো?
জ্বি ভালো।
সব বই নিশ্চয়ই ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে? নাদিয়া জবাব দিল না। চোখ বড় বড় করে হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল। হাসানের একটু অস্বস্তি লাগছে। এই মেয়েটা কখনো তো এ রকম করে তাকায় না। ব্যাপারটা কী?
তিতলী বাসায় আছে?
জ্বি না।
কোথায় গেছে? তার ফুফুর বাসায়?
জ্বি না। হাসান ভাই আপনি বসুন আপনাকে সব বলছি।
হাসান হঠাৎ বুকে একটা ধাক্কা খেল। তিতলীর কি কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে? হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে? নাকি তারচেয়েও খারাপ কিছু? না তারচে’ খারাপ কিছু না। তারচে’ খারাপ কিছু হলে নাদিয়া এমন সহজভাবে কথা বলতে পারত না কিন্তু সহজভাবে সে কি কথা বলছে?
কী হয়েছে নাদিয়া?
আপার কাল রাতে হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেছে। ফুফু একটা ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন–সেই ছেলের সঙ্গে.
তিতলীর বিয়ে হয়ে গেছে?
জ্বি।
ও এখন তার শ্বশুরবাড়িতে?
জ্বি।
ও আচ্ছা। নাদিয়া আমি তাহলে আজ যাই।
হাসান ভাই প্লিজ আপনি এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও বসে যান। আপনি এইভাবে চলে গেলে আমি সারা রাত কাঁদব।
হাসান কিছু বলল না। বসল। তার কেমন অদ্ভুত লাগছে। তার মনে হচ্ছে এই ঘরের আলো হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। ঘরের এক প্রান্তে ষাট পাওয়ারের বাতি জ্বলছে না।
জ্বলছে ফ্লাডলাইটের তীব্র আলো। সেই আলো চোখে লাগছে। চোখ জ্বালা করছে। খুব ঠাণ্ড পানি চোখেমুখে ছিটাতে পারলে ভালো লাগত।
হাসান ভাই!
হুঁ।
চা খাবেন হাসান ভাই? আপনার জন্যে এক কাপ চা নিয়ে আসি?
মেয়েটা এভাবে কথা বলছে কেন? মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে। কেঁদে ফেলার মতো কিছু হয় নি। তিতলী একটা সমস্যায় পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। এ রকম সমস্যা তো হতেই পারে।
নাদিয়া আমি চা খাব না। তবে একটু পানি খাওয়াতে পার, খুব তৃষ্ণা লেগেছে। আচ্ছা থাক পানি লাগবে না।
হাসান ভাই আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি পানি এনে দিচ্ছি।
নাদিয়া ছুটে বের হয়ে গেল। আর প্রায় তৎক্ষণাৎ হাসানের মনে হলো তিতলী এ বাড়িতেই আছে। নাদিয়া ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেছে। তার বিয়ে হয়ে গেছে এটা ঠিক সে এখনো শ্বশুরবাড়িতে যায় নি। এই মিথ্যাটার হয়তো প্রয়োজন ছিল।
হাসানকে নাদিয়া গোট পৰ্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। হাসান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল নাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে তার সঙ্গে আসছে। হাসান বলল, কাঁদছ কেন নাদিয়া?
নাদিয়া গায়ের ওড়নায় চোখ মুছল। কিছু বলল না। হাসান বলল, তিতলী ঘরেই আছে তাই না?
নাদিয়া ক্ষীণস্বরে বলল, জ্বি।
ওকে বোলো–সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে ও যেন মন খারাপ না করে।
আপনি ভালো থাকবেন হাসান ভাই।
ভালো থাকব। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা কোরো। আমি জানি তুমি খুব ভালো রেজাল্ট করবে।
কী করে জানেন?
আমার মন বলছে।
হাসান ভাই, আপনি আপার ওপর রাগ করে থাকবেন না।
না রাগ করব কেন? যাই নাদিয়া?
হাসান এগোচ্ছে। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। টিপটিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। আশ্চৰ্য কাণ্ড যখনই সে তিতলীর কাছে আসে তখনই বৃষ্টি হয়।
হাসান হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। তিতলীদের বাসাটা একবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা! করছে। সবসময় এই জায়গা থেকে সে পেছনে ফিরে তাকায়। আরেকটু এগোলে তিতলীদের বাসা আড়ালে পড়ে যাবে আর দেখা যাবে না। হাসান যতবারই এখান থেকে তাকিয়েছে ততবারই দেখেছে তিতলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিশ্চয়ই দেখা যাবে শুধুমাত্র কেন আর কোনোদিনই দেখা যাবে না। হাসানও আর আসবে না। আসা ঠিক হবে না।
তিতলীর বাবা নিশ্চয়ই মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করবেন। সেই অনুষ্ঠানে তার দাওয়াত হবে না। তিতলী এমন হৃদয়হীন কাণ্ড কখনো করবে না। ভালো কোনো উপহার তার অবশ্যি দিতে ইচ্ছে করছে। টাকা থাকলে তিতলীকে সে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিত। মেয়েটার হারমোনিয়ামের খুব শখ ছিল। তার স্বামী নিশ্চয়ই তিতলীর সেই শখ মেটাবেন। মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ইচ্ছা প্রকৃতি সবসময় পূর্ণ করে।
তিতলী কী গানটা জানি তাকে শোনাতে চেয়েছিল? হাসান কিছুতেই মনে করতে পারছে না–মেঘ বলেছে যাব যাব, মেঘের পরে মেঘ জমেছে? নাকি অন্য কোনো গান? না এটা না অন্য কী একটা গান। আশ্চর্য মনে পড়ছে না। হাসান মাথার ভেতর তীব্ৰ চাপ অনুভব করছে। গানের লাইনগুলো মনে না পড়লে কিছুতেই মনের এই চাপ কমবে না। একবার চট করে তিতলীকে জিজ্ঞেস করে এলে কেমন হয়। না না তিতলীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা ঠিক হবে না। সে জিজ্ঞেস করবে নাদিয়াকে। নাদিয়া তার আপার কাছ থেকে জেনে আসবে।
হাসান পেছন দিকে তাকাল। বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
বৃষ্টির ফোঁটা বড় বড় হয়ে পড়তে শুরু করেছে। হাসান এগোচ্ছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে।
তিতলীদের বাড়ির সামনে
তিতলীদের বাড়ির সামনে বড় একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। কালো রঙের গাড়ি–জানলার কাচ উঠানো বলে গাড়ির ভিতরে কে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
মতিন সাহেব জানালার পরদার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন। দুপুরে খাবারের পর তিনি খালি গায়ে হাতপা এলিয়ে ফুলম্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বড় একটা ঘুম দেন। আজো ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ ইলেট্রিসিটি চলে যাওয়ায় ফ্যান থেমে গেল, তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ‘চামচিকার বাচ্চারা দেশটার বারটা বাজিয়ে দিল’ বলতে বলতে জানালার পরদা সরিয়ে কালো গাড়িটা দেখলেন। তিতলীর বিয়ের পর পর বড় বড় গাড়ির আনাগোনা শুরু হয়েছে। তিতলীর শ্বশুরবাড়ির দিকের সব আত্মীয়স্বজনেরই মনে হয়। গাড়ি আছে। রোজই কেউ না কেউ আসছে। দেখতে ভালো লাগছে। খালি হাতেও কেউ আসছে না। ঘর ভর্তি হয়ে আছে মিষ্টিতে। মিষ্টি খাওয়া তার নিষেধ। সামান্য ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। সেই নিষেধ অমান্য করে তিনি নিয়মিত মিষ্টি খাচ্ছেন। খাওয়া শেষ হবার পর উদাস গলায় বলছেন–মিষ্টিটিষ্টি কী আছে দাও। খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়া রসুলে করিমের সুন্নত। সুন্নত পালন করলে স্বাস্থ্য নষ্ট হয় না।
আজ কে এসেছে? যে এসেছে সে গাড়ি থেকে নামছে না কেন? মতিন সাহেব এই বয়সেও বুকের ভেতর এক ধরনের ছেলেমানুষি উত্তেজনা অনুভব করলেন। তার সেই উত্তেজনা চরমে উঠল। যখন দেখলেন গাড়ি থেকে নামছে শওকত। তিতলীর হাসবেন্ড। কথা ছিল রুসমত না হওয়া পর্যন্ত শওকত এ বাড়িতে আসবে না। কী জন্যে এসেছে কে জানে। মতিন সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন। আলনা থেকে নিয়ে একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। সুরাইয়াকে খবর দিতে হবে। গরমের সময় তার একটা বাজে অভ্যাস আছে–ভেতরের মেঝেতে হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া। জামাই যদি এসে দেখে শাশুড়ি মাতারিদের মতো হা করে ঘুমোচ্ছে, মুখের ওপর মাছি ভিনভন করেছেসেই দৃশ্য সুখকর হবে না।
সুরাইয়া ঘুমোচ্ছিলেন না। রান্নাঘরে চায়ের পানি চাপিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। মতিন সাহেব চাপা গলায় বললেন, জামাই এসেছে। জামাই। মেয়েরা কোথায়?
তিনি সুরাইয়ার জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। মেয়েদের ঘরের দিকে ছুটে গেলেন।
তিতলী ঘরেই ছিল। নাদিয়া তার বই নিয়ে গেছে ছাদে। মুখস্থ করার কোনো ব্যাপার থাকলে সে ছাদে চলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে সে পড়া মুখস্থ করে।
তিতলী শুয়ে ছিল। হাতপা গুটিয়ে কেন্নোর মতো শুয়ে থাকা। মাথাটা পর্যন্ত বালিশে নেই। বিয়ে হওয়া মেয়ে সবসময় সুন্দর করে সেজেণ্ডজে থাকবে–কী বিশ্ৰী ভাবেই না সে আছে! মতিন সাহেব কড়া গলায় বললেন, তিতলী ওঠ তো! জামাই এসেছেশওকত। যা কথাটথা বল, দেখা কী ব্যাপার। হাত মুখ ধুয়ে চুলটুল বেঁধে তারপর যা।
কলিংবেল বাজতে শুরু করেছে। দরজা খুলে দেবার মতো কেউ নেই। মতিন সাহেব নিজেই দরজা খোলার জন্যে গেলেন।
তিতলী শুয়ে শুয়ে কলিংবেলের শব্দ শুনছে–এক দুই তিন চার। চারবার বেল বাজল। হাসান বেল বাজাত দুবার। দুবারের বেশি। কখনো না। দরজা না খুললে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার দুবার। এই বিষয়ে হাসানের বক্তব্য হচ্ছে দুই হচ্ছে পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর সংখ্যা। দুই মানেই আমি এবং তুমি। এটা নিশ্চয়ই হাসানের নিজের কথা না। কোনোখান থেকে শুনে এসে বলেছে। এ রকম গুছিয়ে কথা হাসান বলতে পারে না। সুরাইয়া দরজা ধরে দাঁড়ালেন। চাপা গলায় বললেন, মা শুয়ে আছিস? জামাই এসেছে। ওঠা মা।
তিতলী হাই তুলতে তুলতে বলল, তুমি এ রকম করে কথা বলছি কেন মা? জামাই এসেছে শুনে মনে হচ্ছে তুমি ভয় পাচ্ছি। জামাই এসেছে তো কী হয়েছে?
হাতমুখ ধুয়ে বসার ঘরে যা।
এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন মা? বিয়ে যখন করেছি। বসার ঘরে নিশ্চয়ই যাব। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তুমি আমাকে চা খাওয়াও। চা খেয়ে তারপর যাব।
কাপড় বদলাবি না?
তুমি বললে অবশ্যই বদলাব।
সুরাইয়া ক্ষীণস্বরে বললেন–তুই এ রকম করে কথা বলছিস কেন? আমি ভালোমতোই কথা বলছি–তুমি আমাকে নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে আছ বলে আমার স্বাভাবিক কথাই তোমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। ভয় কোরো না মা। আমি হাস্যকর কোনো ড্রামা করব না। গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়া আমাকে দিয়ে হবে না। কেউ একজন আমাকে দিয়ে একটা খেলা শুরু করেছে। সেই খেলোটা শেষ পর্যন্ত খেলিব।
খেলা মানে? কী খেলা?
ও তুমি বুঝবে না মা। চা এনে দাও। চা খাব। চা খেয়ে গোসল করব। তারপর সেজেণ্ডজে শওকত সাহেবের সামনে দাঁড়াব।
সুরাইয়া চিন্তিত মুখে ফিরে এলেন। তার মন বলছে এই মেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু করবে।
সেই ভয়ঙ্করটা কী তিনি ধরতে পারছেন না। মেয়ের জন্যে এক বৈঠকে এক শ রাকাত নামায তিনি মানত করেছেন। রুসমতের পর মেয়ে যে রাতে প্ৰথম শ্বশুরবাড়ি যাবে সেই রাতে তিনি মানত শেষ করবেন। মানত শেষ না করা পর্যন্ত তিনি শান্তি পাচ্ছেন না।
মতিন সাহেব অতি আনন্দের সঙ্গে তার জামাইয়ের সঙ্গে গল্প করছেন। তার হাতে রথম্যান সিগারেটের প্যাকেট। শওকতের ভদ্রতায় এই মুহূর্তে তিনি মোহিত। শওকত তার জন্যে এক কার্টুন রথম্যান সিগারেট এবং একটা লাইটার নিয়ে এসেছে। এমন সুন্দর লাইটার তিনি তার জন্মে দেখেন নি। কখনো দেখবেন এই আশাও করবেন না। লাইটারটা কালো রঙের। ছোট একটা লাল বোতাম আছে। বোতামে চাপ দিলেই নীলাভ অগ্নিশিখা দেখা দেয়। লাইটারের কর্মকাণ্ড এইখানেই শেষ হয়ে যায় না। যতক্ষণ অগ্নিশিখা জ্বলে ততক্ষণইটুনটুন শব্দ হতে থাকে। লাইটারটা তিনি এর মধ্যেই কয়েকবার জ্বলিয়েছেন নিভিয়েছেন। আবারো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। জামাইয়ের সামনে এ জাতীয় ছেলেমানুষি শোভন হবে না বলে মনের ইচ্ছা চাপা দিয়ে রেখেছেন। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তারপর বাবা বল কেমন আছ?
শওকত বিনীতভাবে বলল, জ্বি ভালো।
তুমি কি ধূমপান করা? করলে আমার সামনে সিগারেট খেতে পাের। এইসব প্রিজুডিস আমার একেবারেই নেই। বিলেতে, আমেরিকায় বাপ-ছেলে এক টেবিলে বসে মদ খাচ্ছে–আর আমাদের দেশে… শ্ৰদ্ধা ভক্তি আসলে মনের ব্যাপার। তুমি আমাকে শ্ৰদ্ধা কর কি করা না তা আমার সামনে সিগারেট খাওয়া-না খাওয়া দিয়ে বিচার করা যাবে। না। তুমি কী বল?
জ্বি তা তো ঠিকই।
নাও একটা সিগারেট খাও।
আমি সিগারেট খাই না।
ভেরি গুড। এটা এমন একটা অভ্যাস যার কোনো ভালো দিক নেই–শরীর নষ্ট, স্বাস্থ্য নষ্ট, পরিবেশ নষ্ট, অর্থ নষ্ট…কোটি কোটি টাকা ধোঁয়ায় উড়ে যাচ্ছে–ভাবাই যায় না। ঠিক বলছি না?
জ্বি।
তারপর বল তোমার খবরাখবর বল।
শওকত লজ্জিত গলায় বলল, আমি একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছিলাম।
মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বল ব্যাপারটা কী?
আমার এক বন্ধুর বিয়ে। আমার ছোটবেলার বন্ধু। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিয়ে হচ্ছে গাজীপুরে। ওর খুব ইচ্ছা আমি তিতলীকে নিয়ে সেই বিয়েতে যাই…
ইচ্ছে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তুমি তিতলীকে নিয়ে যাও। তোমার স্ত্রীকে তুমি নিয়ে যাবে এর মধ্যে আবার অনুরোধ কী?
এখনো ফরম্যালি উঠিয়ে নেয়া হয় নি…
তুমি এইসব ব্যাপার নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবে না। কাবিননামা তৈরি হওয়া মানে বিয়ে হয়ে যাওয়া।
ফিরতে হয়তো দেরি হবে। গাজীপুর অনেকখানি দূরে–।
হোক দেরি কোনো সমস্যা নেই। আমি রাত দুটার আগে ঘুমাই না।
আমার বন্ধু বলছিল রাতটা তার ওখানে থেকে যেতে। রাস্তাটা খারাপ। প্রায়ই ডাকাতি হয়।
রাতটা থেকে সকালে আস। কোনো সমস্যা নেই। আমি তিতলীকে বলে দিচ্ছি। তুমি চা-টা কিছু খাবে?
এক কাপ চা খেতে পারি।
বোস তুমি, আমি চায়ের কথা বলে আসি।
মতিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন-তার সঙ্গে শওকত উঠে দাঁড়াল। শওকতের ভদ্রতায় মতিন সাহেব। আবারো মোহিত হলেন। অসাধারণ একটা ছেলে–তিতলীর ভাগ্য ছক্কা ভাগ্য। দান ফেলেছে ছক্কা উঠে গেছে।
তিতলী লাল রঙের জামদানি শাড়ি পড়েছে। লাল শাড়িতে কালো ফুল। শাড়ির পাড়টাও কালো। যেহেতু বিয়েতে যাচ্ছে সুরাইয়া মেয়েকে কিছু গহনাও পরিয়েছেন। হাতে চারগাছ করে চুড়ি। গলায় পাথর বসানো হার। এই হার তিতলীর ফুফু। ধার দিয়েছেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ক্রমাগত আসছে। বিয়ে হওয়া মেয়ে খালি গলায় থাকবে এটা ঠিক না। তিতলীর কানে সবুজ পাথরের দুটা দুল। গায়ে শাড়ির সঙ্গে কানের এই দুলজোড়া মানাচ্ছে না। কিন্তু তারপরেও দেখতে ভালো লাগছে।
তিতলী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মা আমাকে কেমন লাগছে? সুরাইয়া সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মেয়ের বা হাতের চেটোয় হালকা করে থুথু দিলেন। এই থুথু সুন্দর দেখানোর দোষ কাটিয়ে দেয়। খুব সুন্দর কখনো ভালো না। খুব সুন্দরকে ঘিরে থাকে অসুন্দর। তিতলী বলল, মা যাচ্ছি।
বিসমিল্লাহ করে রওনা হও মা। গলার হারটা সাবধানে রাখবে। খুলে পড়ে না যায়।
পড়বে না।
শওকতের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলবি।
অবশ্যই ভদ্রভাবে কথা বলব।
চোখমুখ এমন শক্ত করে রেখেছিস কেন? মনে হচ্ছে ফাঁসি দেখতে যাচ্ছিস।। ঘর থেকে হাসিমুখে বের হ।
নতুন স্বামীর সঙ্গে হাসিমুখে বের হলে লোকজন বেহায়া ভাববে। এই জন্যে চোখমুখ শক্ত করে রেখেছি।
বিয়ে বাড়িতে মুখ এমন শক্ত করে থাকবি না।
আচ্ছা। এবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি।
মতিন সাহেব মেয়েকে গাড়ি পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন, গাড়ির ড্রাইভার কোথায়?
শওকত বলল, ড্রাইভার নেই। গাড়ি আমি চালাব।
মতিন সাহেব। আবারো মোহিত হলেন। জামাই গাড়ি চালিয়ে যাবে। পাশে বসে। থাকবে তিতলী। অসাধারণ দৃশ্য। দেখাতেও আনন্দ।
গাড়ি সাবধানে চালাবে বাবা। ঢাকার ট্রাফিকের যে অবস্থা। নিয়মকানুন বলে কিছু নেই। অদ্ভুত দেশ।
শওকত হাসিমুখে বলল, আপনারা কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি খুব সাবধানী ড্রাইভার।
মতিন সাহেব তার নতুন লাইটারে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেনসাবধান হওয়াই ভালো। সাবধানের মারা নাই।
শওকত শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে না পড়া পর্যন্ত একটা কথাও বলল না। মনে হচ্ছে সে কী বলবে বা বলবে না তা গুছিয়ে নিচ্ছে। তিতলীর বসে থাকার মধ্যেও কোনো আড়ষ্টতা নেই। বাতাসে তার চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচল উড়ছে, তার ভালোই লাগছে।
আমি একটা সিগারেট ধরালে কি তোমার খারাপ লাগবে?
জ্বি না।
আমি অবশ্যি তোমার বাবাকে বলেছি আমি সিগারেট খাই না। আসলে মাঝে মধ্যে খাই। আমি প্রফেশনাল না, এমেচারী। তারপর বল কেমন আছ?
জ্বি ভালো আছি।
বল তো আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আপনার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুর বিয়েতে। গাজীপুর।
এখানেও আমি তোমার বাবাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমরা গাজীপুর যাচ্ছি। ঠিকই কিন্তু কোনো বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছি না।
ও।
তোমাকে নিয়ে একটু ঘোরবার ইচ্ছা হলো। কাজেই একটা অজুহাত তৈরি করে তোমাকে বের করে নিয়ে এলাম। তুমি রাগ কর নি তো?
রাগ করব কেন?
শওকত হাসিমুখে বলল, আমার সবচেয়ে ছোট মামাকে আমরা ডাকি মিজু মামা। উনি ফটকাবাজি ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন। গাজীপুরে একটা জঙ্গল কিনে বাগানবাড়ি বানিয়েছেন। আজ রাতের জন্যে সেই বাগানবাড়ির চাবি আমার কাছে। জঙ্গল তোমার কাছে কেমন লাগে?
জানি না। জঙ্গলে তো কখনো থাকি নি।
সত্যিকার জঙ্গল অবশ্যি আমাদের দেশে নেই। সুন্দরবনে খানিকটা আছে তাও মূলটা পড়েছে ইন্ডিয়ায়। তুমি কখনো ইন্ডিয়া গিয়েছ?
জ্বি না।
আমি নিয়ে যাব। ইন্ডিয়ার উত্তরপ্রদেশে বড় বড় জঙ্গল আছে। কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ বইটা পড়েছ? জিম করবেটের লেখা?
জ্বি না।
ওই বইটা পড়লে জঙ্গল সম্পর্কে ধারণা পেতে। তোমার গলার এই হারটা তো খুব সুন্দর। কী পাথর এটা?
আমি জানি না। আমার ফুফুর হার। আমার না।
যতদূর মনে হয়। জিরকন। জিরকন ছাড়া এমন ব্রাইট রেড পাথর হয় না। আমার কাছে অবশ্যি লালের চেয়ে নীল পাথর বেশি পছন্দ। একটা পাথর আছে নাম একুয়ামেরিন। অপূর্ব নীলা মনে হয় আকাশ জমাট বাঁধিয়ে পাথর তৈরি করা হয়েছে। তবে খুব হালকা পাথর। ভঙ্গুর। আমি যে বকবক করে যাচ্ছি, তোমার বিরক্তি লাগছে না তো?
জ্বি না।
তুমি মনে হয় কথা কম বল।
জ্বি না। আমি প্রচুর কথা বলি, এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
গাজীপুরে যেখানে যাচ্ছি। সেখানে ছোট মামার এক বাবুর্চি থাকে–নাম মন্তাজ মিয়া। আজ রাতে সে-ই আমাদের রেঁধে খাওয়াবে। মন্তাজ মিয়ার বিশেষত্ব কী শুনবে?
বলুন শুনি।
মিজু মামার ধারণা-মস্তাজ মিয়া হচ্ছে পৃথিবীর পাঁচজন সেরা রাধুনির একজন। ও শুধু দেশী রান্না পারে। রোস্ট টেস্ট পারে না। আমি শুনেছি তুমিও খুব ভালো রাঁধতে পার।
কার কাছে শুনলেন?
তোমার বড় ফুফু, বললেন। তোমার হাতে নাকি জাদু আছে। আরেকবার তোমাকে নিয়ে এখানে আসব সেদিন তুমি রাঁধবে। সব যোগাড় যন্ত থাকবে। তুমি শুধু রান্না চড়িয়ে দেবে। তোমার কী কী লাগবে একটা লিষ্ট করে দিলে সেইভাবে ব্যবস্থা করে রাখব। ঠিক আছে?
জ্বি ঠিক আছে।
তোমার কোন রান্না ভালো হয়? মাছ না মাংস?
আমার মনে হয় মাছ।
সর্বনাশ করেছ, মাছ তো আমি খেতেই পারি না। মাছের মধ্যে চিংড়িটা খাই। তাও যে খুব আগ্রহ করে তা না।
শওকত আরেকটা সিগারেট ধরাল। তিতলী তাকিয়ে আছে বা পাশের জানালার দিকে। গাড়িতে বসে থাকতে তার ভালোই লাগছে। লোকটা অকারণে কথা বলে ভাব জমাতে চেষ্টা করছে এটাও খারাপ লাগছে না। একবার তার ইচ্ছা করল বলে–ভাব জমানোর জন্যে অকারণ কথা বলার দরকার নেই। ভাব হবার হলে আপনাতেই হবে।
একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছি। তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো?
জ্বি না।
খুব সস্তা ধরনের একটা কথা তোমাকে বলার ইচ্ছে করছে তুমি কী ভাববে ভেবে বলতে অস্বন্তি বোধ করছি। এ জাতীয় কথা ছেলেরা বাংলা সিনেমায় বলে।
আপনার যা বলতে ইচ্ছে করে বলুন।
তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। সারাক্ষণ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। তাকিয়ে থাকলে অ্যাকসিডেন্ট হবে সেই ভয়ে তাকাচ্ছি না।
গাড়ি কোথাও পার্ক করুন। পার্ক করে তাকিয়ে থাকুন।
শওকত শব্দ করে হেসে উঠল। সেই হাসি আর থামেই না।
বাগানবাড়িতে পৌঁছে শওকতের মুখের হাসি পুরোপুরি মিলিয়ে গেল। গেট তালাবন্ধ। আশপাশে কেউ নেই। ডাকাডাকি, চিৎকার, তালা ধরে ঝাঁকুনি কিছুতেই কিছু না। চারদিকে জনমানবশূন্য। তিতলী বলল, আপনি না বলেছিলেন আপনার কাছে চাবি আছে।
শওকত বিরক্তমুখে বলল, ভেতরের ঘরের চাবি। গেটের চাবি নেই। সবাইকে খবর দেয়া আছে তারপরেও এ কী অবস্থা।
গেট শেষ পর্যন্ত খুলল। দারোয়ান ভেতরে ঘুমোচ্ছিল। চোখ ডলাতে ডালতে সে এসে গেট খুলে দিল। এতে সমস্যার সমাধান হলো না। শোনা গেল মনতাজি মিয়ার জ্বর এসেছে বলে সে দুপুরে ঢাকায় চলে গেছে। রান্নার কোনো যোগাড় যন্তও নেই। সবকিছু মন্তাজের করার কথা। শওকত রাগে ফুসতে লাগল। তিতলী বলল, আপনি অস্থির হবেন না। একটা তো মোটে রাত-না খেয়ে আমি থাকতে পারব।
শওকত বিরক্ত গলায় বলল, না খেয়ে থাকবে কেন? আমি বাজারে যাচ্ছি যা পারি নিয়ে আসব–দারোয়ান রাঁধবে। তুমি একা থাকতে পারবে তো? ঠিক একাও না। দারোয়ান থাকবে। থাকতে পারবে?
পারব।
ভয়ের কিছু নেই; আর এই দারোয়ান খুব বিশ্বাসী।
আপনি বাজার করে আনুন। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
তুমি ঘুরে ঘুরে বাগান দেখ। শোবার ঘরে ছোটখাটো লাইব্রেরির মতো আছে। গল্পের বইটই পড়তে পার।
জ্বি আচ্ছা।
তিতলী একা একা অনেকক্ষণ হাঁটল। বাগানবাড়িটা আসলেই সুন্দর। শহরে পাখির ডাক শোনা যায় না–এখানে অনবরত পাখি ডাকছে। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। পাখির ক্যানক্যানে ডাক খুব শ্রুতিমধুর না। শান্ত কোনো বন কি পৃথিবীতে আছে। যেখানে একটি পাখিও ডাকে না? শুধু খুব বাতাস হলে পাতার শব্দ শোনা যায়। এরকম বন থাকলে চমৎকার হতো। ভদ্রলোকের মামা–কী নাম যেন মিজু মামা, তিনি জায়গাটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। ঝিলের মতো একটা জায়গার পাশে বসার জন্যে সিমেন্টের আসন বানিয়েছেন। দেখলেই বসতে ইচ্ছে করে। ঝিলের পানি অবশ্যি ঘোলা। পুকুর বা সিালের পানি হবে। আয়নার মতো চকচকে–যে পানি দেখামাত্ৰ হাত দিয়ে ছুতে ইচ্ছে করবে। যে পানিতে মুখ দেখতে মন চাইবে। এই পানির কাছে যেতে ইচ্ছে করে না।
মানুষেবা সঙ্গে পানির আশ্চর্য মিল আছে। কোনো কোনো মানুষকে পরিষ্কার ঝকঝকে পানির মতো মনে হয়। তাদের কাছে যেতে ইচ্ছে করে, সেই পানি ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, সেই পানিতে নিজের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে। আবার কিছু কিছু মানুষ এই ঝিলের পানির মতো হাত দিয়ে ছোয়া দূরের কথা, কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না। তারপরেও যেতে হয়। এই যেমন সে ঝিলের এই পানি পছন্দ করছে না, তারপরেও পানির পাশেই বসে আছে।
তিতলী তুমি এখানে?
জ্বি।
খাবারের ব্যবস্থা করেছি। ফ্লাঙ্কে করে চা নিয়ে এসেছি। দোকানের চা। ওভালটিন দেয়া, খেতে পারবে কিনা জানি না। খাবে?
জ্বি খাব।
শওকত ব্যস্ত ভঙ্গিতে চা আনতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাঙ্ক এবং দুটা কাপ নিয়ে এল। শার্টের বুকপকেটে এক প্যাকেট বিসকিট। মনে হচ্ছে মানুষটা খুব গোছানো স্বভাবের।
তিতলী।
জ্বি।
বাগানবাড়ি কেমন লাগছে?
সুন্দর।
আমাদের গ্রামের বাড়ি কিন্তু খুব সুন্দর। বিরাট পুকুর। শান বাধানো ঘাট। পানিও খুব পরিষ্কার–তোমাকে নিয়ে যাব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি দেখি জ্বি এবং জুি আচ্ছা ছাড়া কোনো কথা বলছি না। মাথা ধরেছে?
জ্বি।
এই নাও প্যারাসিটামল। আমি গাড়িতেই বুঝেছি তোমার মাথা ধরেছে–একপাতা প্যারাসিটামল নিয়ে এসেছি। দাঁড়াও একটা পানির বোতল নিয়ে আসি।
শওকত ব্যস্ত ভঙ্গিতে পানির বোতল আনতে গেল। তিতলী ট্যাবলেটের পাতা হাতে নিয়ে বসে আছে। সে নিজেকে তৈরি করছে। খুব কঠিন কিছু আজ তাকে বলতে হবে। বলতে হবে খুব সহজ ভঙ্গিতে। কথাগুলো সে মনে মনে অনেকবার বলেছে। মনে মনে বলা এক কথা, আর সামনাসামনি বলা আরেক কথা। তবু তাকে বলতেই হবে।
যে কথাটা সে বলবে তা হচ্ছে–আমি আপনাকে বিয়ে করে আপনার ওপর খুব অবিচার করেছি। কারণ আমি কখনো আপনাকে আমার খুব কাছে আসতে দেব না। আমি নিজেকে সাজিয়েছি অন্য একজনের জন্য। আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন–কিংবা সারাজীবন পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখতেও পারেন। সেটা আপনার ইচ্ছা; তবে আমি কখনো আপনার অবাধ্য হব না। আমার কাছে আপনি যা চাবেন তাই পাবেন।
তিতলী একদৃষ্টিতে ঝিলের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। পানিতে কিছু শুকনো পাতা পড়েছে। বাতাসে ঢেউয়ের মতো উঠেছে। পাতাগুলো ঢেউয়ে উঠছে-নামছে। দেখতে ভালো লাগছে।
তিতলী!
জ্বি।
নাও পানি নাও–তুমি কি মাথাধরার ট্যাবলেট প্রায়ই খাও?
জ্বি।
বেশি খেও না। কিডনির ক্ষতি করে।
শওকত তিতলীর পাশে বসল। তিতলী সরে গিয়ে জায়গা করে দিল। শওকত বলল, জায়গাটা খুব সুন্দর না?
জ্বি।
বাগানবাড়ি শুনতে অবশ্যি অস্বস্তি লাগে। বাগানবাড়ি শুনলেই মনে হয় নিষিদ্ধ আনন্দের জায়গা। বাগানবাড়ি না বলে খামারবাড়ি বললে মনে হয়–খুব কাজের জায়গা। A place for productive work. তিতলী তুমি কি গান পছন্দ কর?
করি।
কী ধরনের গান তোমার পছন্দ?
সব ধরনের।
নাচ? নাচ কেমন লাগে?
ভালো।
গানকে বলা হয় হৃদয়ের শব্দ, আর নাচকে কী বলা হয় জান?
জ্বি না।
নাচকে বলা হয় শরীরের সঙ্গীত। নাচ কত রকমের আছে জান?
জ্বি না।
নাচ মূলত চার রকমের–ভারত নাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী, কত্থক। ইদানীং অবশ্যি আরো দুটা ধারা ধরা হচ্ছে–ওড়িশি, কুচিপুড়ি।
ও আচ্ছা।
এ ছাড়াও আছে–যেমন ধর লোকনৃত্য, ছৌ ছৌ, রায়বেঁশে, বাউল, ঝুমুর, কাঠিনৃত্য, ব্ৰতচারী, খেমটা, কারবা, তয়ফা, ঠুমকি, বিহু, বাংরা, গরবা…।
তিতলী মনে মনে হাসল। মানুষটা তাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। গান, নাচ এই দুটি বিষয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ ব্যাপার মুখস্থ করে এসেছে। তিতলী কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, নাচের এইসব নামধাম। আপনি মুখস্থ করেছেন কেন?
শওকত হাসতে হাসতে বলল, এর একটা মজার ইতিহাস আছে। আরেক দিন বলব।
আচ্ছা।
তুমি কি গান গাইতে জান?
জ্বি না।
তোমার ফুফু, যে বললেন তুমি সুন্দর গান কর।
ভুল বলেছেন। আমার অনেক গুণ আছে এটা বোঝানোর জন্যে বানিয়ে বলেছেন।
তুমি যদি গান শিখতে চাও আমি শেখাবার ব্যবস্থা করব। শিখতে চাও?
জ্বি না।
এমনভাবে কথা বলছি কেন? তোমার কি মাথাধরা কমে নি? তিতলী জবাব দিল না। সে অনেক কথা বলে ফেলেছে আর ইচ্ছা করছে না।
রীনার জীবনে খুব আনন্দময় একটা ঘটনা
আজ রীনার জীবনে খুব আনন্দময় একটা ঘটনা ঘটেছে। তার এমনই কপাল যে আনন্দের ঘটনাগুলো যখন ঘটে তখন আশপাশে কেউ থাকে না। নিজের সুখ অন্যকে দেখিয়ে আনন্দ। এই সুখ থেকে রীনা বারবার বঞ্চিত হয়েছে।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটা গল্পের বই নিয়ে সে ঘুমোতে গেছে। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে ঠাণ্ডা মেঝেতে সে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়বে। এই ঘুমের আলাদা মজা। ঘুমে যখন চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে তখন কমলার মা বলল, আফনেরে কে জানি খুঁজে? বুড়া এক লোক।
রীনা বিরক্ত হয়ে বসার ঘরে গেল। মাথাভর্তি সাদা চুল দাড়ির এক ভদ্রলোক বসে আছেন। সেই গরমেও তার গায়ে সাদা সামার কোট। ভদ্রলোককে খুব চেনা লাগছে আবার ঠিক চেনাও যাচ্ছে না। ভদ্রলোক বললেন, কীরে রীনা রীনা টিন টিন চিনতে পারছিস না?
রীনা হতভম্ব গলায় বলল, ছোটমামা!
যাক চুলদাড়ি দিয়ে তোকে বিভ্ৰান্ত করতে পারি নি। তোকে কিন্তু আমি একবার দেখেই চিনেছি। হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় তোর চেহারা যা ছিল–শাড়ি পরা অবস্থাতেও তাই আছে, একটুকুও বদলায় নি।
রীনা তার ছোটমামার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কত প্রিয় একজন মানুষকে কত দিন পরে দেখা। মনে হচ্ছে অন্য কোনো জীবন থেকে মানুষটা হঠাৎ উঠে এসেছেন। যেন একটা স্বপ্নদৃশ্য।
মা শোন, কেঁদে সময় নষ্ট করিস না, আমি এক্ষুণি চলে যাব। আমি গত তিন দিন ধরে ঢাকায় আছি কিন্তু তোর ঠিকানা বের করতে পারছিলাম না। আজ বিকেলে ফ্লাইট।
এক্ষুণি চলে যাবে??
হ্যাঁ এক্ষুণি চলে যাব। আমি হঃকঃ-এর একটা সেমিনারে এসেছিলাম। হঠাৎ ভাবলাম বাংলাদেশ হয়ে যাই। তোর সঙ্গে দেখা হবার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, তবু যাক শেষ মুহুর্তে দেখা হলো।
তুমি এমন বুড়ো হয়ে গেলে কেন মামা?
বয়স কত হয়েছে দেখবি না?
তুমি সত্যি আজই চলে যাবে?
হ্যাঁ ইয়াং লেডি, তুই চোখের পানি মুছে ফেলে দুই-একটা কথা টথা বল আমি শুনি। তোর বরের সঙ্গে কথা বলার শখ ছিল ও তো মনে হয় অফিসে।
মামা আমি বাড়িওয়ালার বাসা থেকে টেলিফোন করে দিচ্ছি ও চলে আসবে।
কোনো দরকার নেই। আসতে আসতে এক ঘণ্টা লাগবে–ততক্ষণ আমি থাকব। না। মা শোন, আমি তোর জন্যে কোনো গিফট আনতে পারি নি–এখানে যে আসব। তেমন পরিকল্পনা ছিল না। কয়েকদিন ছুটি পাওয়া গেল, তারপর দেখি টিকিটও এভেইলেবল। ভালো কথা, তোর ছেলেমেয়ে কী?
দুই ছেলে মামা–টগর এবং পলাশ।
বাহ নাম তো খুব সুন্দর! ওরা কোথায়?
ওরা তার ফুফুর বাসায় বেড়াতে গেছে।
আমার ভাগ্য খারাপ কারো সঙ্গে দেখা হলো না। মা শোন আমি কিন্তু আর দশ মিনিট থাকব তারপর উঠব। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
রীনার মামা সত্যি সত্যি দশ মিনিট থাকলেন। যাবার সময় রীনার হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন, তোর বিয়েতে আমি কিছুদিতে পারিনি, এখানে সামান্য কিছু ডলার আছে, তুই তোর বরকে নিয়ে তোদের পছন্দমতো কোনো উপহার কিনে নিস। ছোটমামা চলে যাবার পর রীনা খাম খুলে দেখে সাতটা একশ ডলারের নোট। নিশ্চয়ই অনেক টাকা। জীবনে এই প্রথম রীনা ডলার দেখছে। সবুজ রঙের এই নোটগুলোর কী প্রচণ্ড ক্ষমতা!
সারা বিকাল রীনা ডলার।ভর্তি খাম নিয়ে ঘুরে বেড়াল। সাত শ ডলারে ঠিক কত টাকা হবে তাও জানে না। জানতে খুব ইচ্ছে করছে। যত টাকাই হোক সে একটা পয়সা খরচ করবে না। জমা করে রাখবে। শুধু শীতের আগে আগে টগর এবং পলাশের সুন্দর দুটা সুয়েটার কিনবে। গত বৎসর এদের জন্যে দুটা সুয়েটার তার খুব পছন্দ হয়েছিল। একেকটার সাড়ে চার শ’ টাকা করে দাম। তার বাজেট ছিল পাঁচ শ টাকা। তারেককে ভালো একজোড়া পামিসু কিনে দিতে হবে। প্রতিবছর ঈদের বাজারের সময়ে সে পামসু দেখে বেড়ায়। জুতা পরে মচমচ করে খানিকক্ষণ হাঁটে। রীনার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে–ভালো ফিট করেছে। দাম শুনে আর কেনে না।
এই দুটা জিনিসের জন্যে সে যা টাকা লাগে খরচ করবে। তার বেশি না। একটা টাকাও না।
সন্ধ্যার আগে আগে তারেক ফেরে, আজ ফিরল না। তবে হাসান ফিরল। রীনা প্রায় ছুটে গেল হাসানেব। ঘরে। উৎফুল্প গলায় বলল, কেমন আছ হাসান?
হাসান প্ৰাণহীন গলায় বলল, ভাবি ভালো আছি।
হাসানের নিম্প্রাণ গলা বীনার কানে বাজল না। সে আনন্দ ও উত্তেজনায় ঝলমল করছে।
আজ এত সকাল সকাল ফিরলে যে?
একদিন সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ফিরে দেখলাম কেমন লাগে।
কফি খাবে হাসান?
কফি?
আজ তোমার ভাইকে চমকে দেবার জন্যে একটিন কফি কিনিয়ে এনেছি। এতটুকু একটা টিন দাম নিয়েছে আশি টাকা।
ভাবি কফি খাব না।
আহা খাও। আমিও তোমার সঙ্গে খাব।
বেশ তো খাব।
রীনা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, হাসান তুমি কি জান বাংলাদেশে ডলার কত করে?
তোমার কথা বুঝতে পারছি না ভাবি।
এক ডলারের বদলে বাংলাদেশী কত টাকা পাওয়া যাবে?
তুমি ডলারের খোঁজ করছ, কেন?
রীনা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আদার ব্যাপারি তো এইজন্যে ডলারের খোঁজ করছি। কত করে ডলার তুমি জান না?
একশ ডলারে তিন হাজার পাঁচশ টাকা করে পাওয়া যায়।
রীনা দ্রুত হিসাব করে বলল–চব্বিশ হাজার পাঁচ শ, কী সৰ্বনাশ!
ভাবি বিড়বিড় করে কী বলছ?
আমি কী বলব তুমি বুঝতে পারবে না। দেখি তুমি হাত পাত তো। চোখবন্ধ করে হাত পাত। আহা হাত পাত
হাসান হাত পাতল।
রীনা তার হাতে একটা একশ ডলারের নোট দিয়ে বলল, এটা তোমার। ভাবি ব্যাপার কী?
আমি কিছু ডলার পেয়েছি, সেখান থেকে এক শ ডলার তোমাকে দিলাম। তোমার টাকায় আমি কত অসংখ্যবার ভাগ বসিয়েছি আজ সামান্য কিছু তোমাকে ফেরত দিতে পেরে আমার কী যে ভালো লাগছে তা তুমি কোনোদিনও বুঝতে পারবে না।
ডলার তোমাকে কে দিয়েছে?
আমার ছোটমামা। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। আর ফিরে আসেন নি। তিনি আজ দুপুরে হঠাৎ বাসায় এসে উপস্থিত। যাবার সময় আমাকে সাত শ ডলার দিয়ে গেছেন।
তুমি তো বিরাট বড়লোক ভাবি।
বড়লোকের চেয়ে বড় কথা হল–আমি কী যে খুশি হয়েছি তা তোমাকে বোঝাতে পারব না।
তোমার খিলখিল হাসি শুনে বুঝতে পারছি।
ডলারটা পকেটে রাখা হাসান।
হাসান ডলারটা পকেটে রাখল। রীনা বলল, তোমার মুখ এমন শুকনো কেন তোমার কি শরীর খারাপ?
না।
মন খারাপ?
হাসান কিছু বলল না। রীনার গলার স্বর তীক্ষ্ণ হলো, সে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। হাসানের যে মন এতটা খারাপ তা সে বুঝতে পারে না। কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে হাসানকে।
সত্যি কিছু হয় নি?
না।
আমাকে বলতে পার। আমি শ্ৰোতা হিসেবে ভালো। তোমার সমস্যা আমাকে লাভ হবে না। আমি কিছু করতে পারব না। তারপরও শুনতে চাই।
শোনাবার মতো কোনো সমস্যা হয় নি।
বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে? তিতলী বেগম।
হাসান সামান্য হাসল। শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, না। ঝগড়া হয় নি।
আমার মনে হচ্ছে তোমরা ঝগড়া করেছ। ভালোবাসাবাসির সময়ে অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হয়। কঠিন প্ৰেম ভেঙে যায় যায় অবস্থাও হয়।
এসব কিছু না ভাবি। আমাদের কখনো ঝাগড়া হয় নি। মনোমালিন্য হয় নি।
তাহলে কী?
হাসান সহজ গলায় বলল, তিতলীর বিয়ে হয়ে গেছে।
রীনা বিস্মিত হয়ে বলল, কী বললে?
কাল বিকেলে ওদের বাসায় গিয়ে শুনলাম হঠাৎ করে ওর বিয়ে হয়ে গেছে।
কবে বিয়ে হলো?
কবে বিয়ে হলো বলতে পারব না। এত কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না। ও বাসাতেই ছিল–দেখা হয় নি।
রীনা কোমল গলায় বলল, হাসান মনটা কি খুব বেশি খারাপ হয়েছে?
হ্যাঁ।
তোমার মন ভালো করার মতো কিছু কি আমি করতে পারি?
কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে খাওয়াতে পার।
তিতলীর ওপর তোমার কি খুব রাগ হচ্ছে?
না। রাগ হচ্ছে না। এক সময় আমরা দুজন একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। যে যত অন্যায়ই করুক আমরা কেউ কারো ওপর রাগ করব না। আমি প্ৰতিজ্ঞা রক্ষা করছি।
রীনা উঠে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল, আমি তোমার জন্যে কফি নিয়ে আসছি। হাসান বলল, এখন কপি খাব না ভাবি। পরে এক সময় বানিয়ে দিও। কারো হাতে বরং খুব ঠাণ্ড এক গ্লাস পানি পাঠাও–পানির পিপাসা হচ্ছে।
ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র রীনার চোখে পানি এসে গেল। এমন একটা কষ্টের ব্যাপার ঘটেছে অথচ সান্ত্বনার কোনো কথা সে বলতে পারছে না। সান্ত্বনা হাসান চাচ্ছেও না। চাইলে নিজেই এসে বলত-। সে বলতে চায় নি। রীনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করেছে। কোনো দরকার ছিল না। কেন সে জিজ্ঞেস করতে গেল? রীনা বারান্দার রেলিং ধরে দাড়িয়ে রইল। রাত ন’টার মতো বাজে। টেবিলে রাতের খাবার দেবার সময় হয়েছে। কমলার মা আজ টেবিলে খাবার দেবে না। তার শরীর ভালো না। সন্ধ্যা থেকে কথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। রীনা শঙ্কিত বোধ করছে। কমলার মার লক্ষণগুলো ভালো মনে হচ্ছে না। তার শরীর খারাপটা দেশে যাওয়ার ছুতো না তো? প্রতিবারই দেশে যাবার আগে কমলার মার শরীর খারাপ করে। কয়েকদিন কোনো কাজকর্ম করে না। শুয়ে বসে থাকে। তারপর হঠাৎ বলে মন টিকছে না, দেশে যাব। টিনের ট্রাংক গুছিয়ে সে তৈরি। কার সাধ্য তাকে আটকায়। আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে সপ্তাহখানিক থেকে সে ফিরে আসে। ঘরে ছেলের বউয়ের যন্ত্রণায় টিকতে পারে না। এবার যদি ছেলের বউ যন্ত্রণা করে, যদি আদর-যত্ন না করে তাহলে কী হবে? আচ্ছা রীনার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। একটু আগে সে হাসানের এতবড় একটা দুঃসংবাদ শুনেছে। শোনার পরে সে কিনা ভাবছে কমলার মার কথা? রীনা রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। মনোয়ারার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি ডাকলেন।
বউমা শুনে যাও তো।
রীনা শাশুড়ির ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ভীত গলায় বলল, মা কিছু বলবেন?
শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার সময় তার সব সময় একটু ভয় ভয় লাগে।
তোমাকে দুপুরে একবার বললাম না ডেটল পানি দিয়ে আমার ঘরটা মুছে দেবার ব্যবস্থা করতে? এখন বাজে রাত নাটা। ঘরটা মোছা হবে কখন? আর শুকাবে কখন?
কমলার মার শরীরটা খারাপ। শুয়ে আছে।
দুদিন পরে পরেই তো শুনি শরীর খারাপ। মাখনের শরীর নিয়ে ঝি-গিরি করতে আসে কেন? পটের বিবি সেজে পালঙ্কে ঘুমায়ে থাকলেই পারে। তুমি বালতিতে করে এক বালতি পানি, ডেটলের শিশি আর একটা ন্যাকড়া দিয়ে যাবে। তোমার শ্বশুরকে দিয়ে মোছাব। উপায় কী?
টগরদের খাইয়ে আমি নিজেই এসে মুছে দেব।
তোমার মুছতে হবে না। তারপর চারদিকে বলে বেড়াবে শাশুড়ি এই করেছে সেই করেছে। ছেলের বউয়ের কথা শোনার আমার দরকার নেই। এই বয়সে কথা শুনতে ভালো লাগে না।
আপনি কি মা এখন ভাত খাবেন?
এখন ভাত খাব না তো কি শেষরাতে খাব? এটা তো মা রোজার মাস না যে সেহেরি খাওয়াবে।
টেবিলে ভাত বেড়ে আপনাকে খবর দেব।
তারেক এসেছে?
জ্বি না।
এত রাত পর্যন্ত সে কোথায় থাকে?
জানি না মা।
জানি না মা বললে তো হবে না। জানতে হবে। পুরুষমানুষ আর ছাগল এই দুই জিনিসকে চোখে চোখে রাখতে হয়। কখন কীসে মুখ দেয় কিছু বলা যায় না। রাতে যেদিনই দেরি করে ফিরবে মুখের কাছে নাক নিয়ে গন্ধ শুকবে। মদ ফাঁদ খেয়েছে কি না। বোঝার এটাই বুদ্ধি। একদিন তোমার শ্বশুর কী করেছে শোন— বাসায় ফিরেছে রাত বারটায়। দেখি মুখভর্তি পান। পানের রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। দেখেই সন্দেহ হলো কোনোদিন পান খায় না। আজ হুজুর খাচ্ছেন কেন? মুখের কাছে মুখ নিতেই গন্ধ পেলাম। বললাম, গন্ধ কীসের? তোমার শ্বশুর বলল, জর্দা দিয়ে পান খেয়েছি তো জর্দার গন্ধ। আমি বললাম তুমি পান খাও না-আজ একেবারে জর্দা দিয়ে পান। ব্যাপারটা কী? তখন দেখি হুজুর গাইগুই করে। একটু চাপ দিতেই আসল জিনিস বের হয়ে পড়ল। সে নাকি বন্ধুদের চাপে পড়ে অতি সামান্য হুইঙ্কি খেয়েছে। আমি বললাম অতি সামান্যটা কত?
হুজুর বললেন, এক চামচ।
আমি বললাম, কত বড় চামচ? ডালের চামচ না চায়ের চামচ?
তরকারির চামচের এক চামচ।
আমি বললাম, এক চামচ হুইঙ্কি যখন খেয়েছ তখন এক চামচ গু খেতে হবে। গু খেলে বমি হবে। পেটের জিনিস বের হয়ে আসবে। আমি যদি সতী মায়ের সতী কন্যা হই, তোমাকে আজ আমি এক চামচ গু খাওয়াব বলেই চায়ের চামচে এক চামচ গু নিয়ে এলাম।
রীনা শঙ্কিত গলায় বলল, খাওয়ালেন? গু দেখেই হুজুরের খবর হয়ে গেল। বুঝে গেল আমি খাইয়ে ছাড়ব। বমিটমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেলল। সত্যি সত্যি তো আর খাওয়াতাম না। ভাব ধরেছিলাম। ওই ভাবেই কাজ হয়েছে। শাশুড়ির কাছ থেকে একটা জিনিস শিখে রাখ মা। সব সময় ভাব ধরবে। ভাবেই কাজ হবে। পুরুষ মানুষ যদি রাত এগারটা-বারটার সময় ঘরে ফেরে তখন বুঝবে খবর আছে। অনেক কথা বলা হয়েছে এখন যাও ভাত দাও। হুজুর কোথায়?
টগর, আর পলাশকে পড়াচ্ছেন।
তাহলেই কাজ হয়েছে। ওদের আর ইহজনমে পাস করা লাগবে না। হুজুরকে আগে ভাত দাও। হুজুরের খাওয়া শেষ হলে আমাকে দেবে।
তারেক ফিরল রাত বারটার একটু আগে। রীনা দরজা খুলে দিল। তারেক বিব্ৰতমুখে বলল, দেরি করে ফেললাম। তুমি ভাত খেয়েছ; রীনা না সূচক মাথা নাড়ল।
তুমি খেয়ে নাও। আমি খাব না। খেয়ে এসেছি।
কোথেকে খেয়ে এলে?
বলছি দাঁড়াও। হাতমুখটা ধুয়ে নি। শরীরটা ঘামে চটচট করছে। রিকশা পাচ্ছিলাম না! হাঁটতে হাঁটতে অবস্থা কাহিল। গোসল করে ফেলব কিনা ভাবছি।
ভাবাভাবির কী আছে, কর।
তুমি এক কাপ চা দাও। গোসল করে গরম গরম এক কাপ চা খাব। আচ্ছা থাক তুমি খাওয়াদাওয়া সেরে চা দিও।
গিয়েছিলে কোথায়?
লাবণীদের বাসায় মিলাদের দাওয়াত ছিল। ওর স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকী। না গেলে ভালো দেখায় না। দুঃখী মেয়ে সেই জন্যেই যাওয়া।
মিলাদ কখন ছিল?
বাদ আছর ছিল। অফিস থেকে সরাসরি সেই জন্যেই চলে গিয়েছিলাম। মিলাদে লোকজন কিছুই হয় নি। বলতে গেলে আমি আর মওলানা সাহেব! মিলাদে তো আর আজকাল লোক হয় না, গানবাজার জলসা হলে লোক হয়।
মিলাদ রাত বারটা পর্যন্ত চললি?
আরে না। আছর ওয়াক্তের মিলাদ খুব ছােট হয়। আমি চলে আসতাম লাবণী এমন কান্নাকাটি শুরু করল। ওকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে রাত হয়ে গেল।
তারেক বাথরুমে ঢুকে পড়ল। রীনার খিদে মরে গেছে। কিছু মুখে দিতে ইচ্ছা করছে। না। তারপরেও তাকে খেতে বসতে হবে কারণ লায়লা তার সঙ্গে খাবে বলে এখনো খায় নি। ভাবি খায় নি বলে সে না খেয়ে বসে থাকবে লায়লা তেমন মেয়ে নয়। তার পেটে বিশেষ কোনো গল্প আছে বলেই সে ভাবির সঙ্গে নিরিবিলিতে খাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।
খেতে বসে রীনা বলল, কিছু বলবে লায়লা?
লায়লা বলল, না তো।
তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাও।
কিছু বলতে চাই না। বলব। আবার কী? ভাবি তুমি কি কখনো মাড ট্রিটমেন্ট করেছি?
মাড ট্রিটমেন্টটা কী?
মাড ট্রিটমেন্ট হচ্ছে ভাবি অদ্ভুত একটা জিনিস। মুখের চামড়া ঠিক করার জন্যে এরচে’ ভালো কিছু হতে পারে না। কী করতে হয় শোন-কিছু এঁটেল মাটি নিতে হয়। কাগজি লেবুর রস, জামপাতার রস আর সামান্য ফিটকিরি মিশিয়ে এঁটেল মাটিটাকে কাদা বানাতে হয়। খুব মিহি কাদা প্রয়োজনে শিলপাটায় বেটে নেয়া যায়। তারপর সেই মিহি কাদাটা মুখে মেখে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। সকালবেলা মুখ ধুয়ে ফেলা। সপ্তাহে একদিনও যদি করা যায় তাহলে মুখে কোনোদিনও রিংকেলস পড়ে না। চামড়া হয় উজ্জ্বল এবং সফট…
লায়লা আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে রীনা মনে মনে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললমেয়েটা কী সুখে আছে। পৃথিবীর কোনো সমস্যাই তাকে স্পর্শ করে না। সে আছে নিজের মতো। সাজগোজের সামান্য উপকরণ পেলেই সে তৃপ্ত। সংসার চলছে না, একটা ভাইয়ের চাকরি নেই, তার নিজের বিয়ের কিছু হচ্ছে না–তাতে কী?
ভাবি।
হুঁ।
তুমি আমাকে খানিকটা এঁটেল মাটি যোগাড় করে দেবে?
তুমি মাড ট্রিটমেন্ট করে কী করবে। তোমার মুখের চামড়া এমনিতেই উজ্জ্বল। আয়নায় নিজেকে দেখ না?
দেখি তো। সারাক্ষণই তো আয়নায় দেখি। আমার নিচের ঠোঁটটা ভাবি একটু বেশি মোটা, আরেকটু কম মোটা হলে ভালো লাগত।
মোটা ঠোঁটের আলাদা সৌন্দৰ্য আছে।
এটাও ভাবি ঠিক বলেছ। পুরুষরা মোটা ঠোঁট পছন্দ করে। মোটা ঠোঁটের মেয়েদের খুব সেক্সি লাগে তো এই জন্যে।
হাসান ভাত খাবে না।
তার জ্বর এসেছে। রীনা গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে আসলেই জ্বর। বেশ ভালো জ্বর।
রীনা খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়ল। রুচি হচ্ছে না। প্লেটভর্তি ভাত রেখে উঠতেও কষ্ট হচ্ছে। ছোটবেলায় মা বলতেন না খেয়ে ফেলে রাখা প্রতিটা ভাত সত্তরটা করে সাপ হয়ে দংশন করবে। সেই স্মৃতি বোধহয় মনে রয়ে গেছে।
ভাবি তোমার কি কোনো কারণে মন খারাপ?
না।
ভাবি মন সব সময় ভালো রাখতে হবে। মন খারাপ হলে শরীরের ওপর তার এফেক্ট হয়। চোখের নিচে কালি পড়ে, মুখের চামড়া টামড়া চিমসে মেরে যায়। মাথার চুলও পাতলা হয়ে যায়।
এই জন্যেই কি তুমি কখনো মন খারাপ কর না?
অনেকটা তাই। আমি দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করি ভাবি।
দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপনের পদ্ধতি এক সময় তোমার কাছ থেকে আমার শিখতে হবে। আমি সব সময় ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় থাকি।
তোমাকে দেখে অবশ্যি তা বুঝা যায় না। তবে এক সময় বোঝা যাবে। হঠাৎ একদিন দেখা যাবে তুমি বুড়ি হয়ে গেছ। তোমার চামড়ায় রিংকেলস পড়েছে।
তখন মাড ট্রিটমেন্ট করব। এ ছাড়া আর উপায় কী?
ভাবি কমলার মা তো দেশে যাচ্ছে ওকে বলেছি কিছু এটেল মাটি নিয়ে আসতে।
রীনা শঙ্কিত গলায় বলল, ও দেশে যাচ্ছে নাকি? হ্যাঁ আমাকে তো বলল, তার নাকি শরীর টিকছে না।
কী সর্বনাশের কথা!
একবস্তা এঁটেল মাটি নিয়ে এলে আমাদের অনেক দিন চলে যাবে।
রীনা চা বানাতে বসেছে। লায়লা তার পাশে বসে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। রীনার মনে হলো লায়লা তার মার স্বভাব পেয়েছে। দুজনই কথা বলতে পছন্দ করে। যাকে কথাগুলো বলা হচ্ছে সে শুনছে কি শুনছে না। তা নিয়ে মাথা ঘামায় না।
তারেক গোসল শেষ করে তার ভাইয়ের ঘরে উঁকি দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা আসবে। চায়ের সঙ্গে একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। সিগারেটের অভ্যাসটা বোধহয় হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝেই সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে। একটা প্যাকেট কিনে আলমারিতে রেখে দিতে হবে।
হাসানের ঘরে বাতি জ্বলছে। সে আধশোয়া হয়ে আছে। সন্ধ্যা থেকেই তার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, এখন যন্ত্রণাটা বেড়েছে। জ্বর এসেছে। জ্বরটা কত কে জানে। মনে হচ্ছে আজ রাতে ঘুম হবে না। আর ঘুম হলেও হাঁসের স্বপ্নটা দেখবে।
তোর শরীর খারাপ নাকি রে?
না।
মুখটুখ শুকিয়ে কেমন হয়ে আছে। তোর কাছে কি সিগারেট আছে? থাকলে একটা দে।
হাসান প্যাকেট বের করল। একটা সিগারেট বের করে ভাইয়ের দিকে দিল। তারেক বলল, আরেকটা দে–বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাব।
তোমার দেখি সিগারেটের নেশা হয়ে যাচ্ছে।
তারেক হাসল। হাসানের মনে হলো তার ভাইকে আজ খুশি খুশি লাগছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার জীবনে আনন্দময় কোনো ঘটনা ঘটেছে।
ভাইয়া বাস।
তোর ভাবিকে বলেছিলাম চা দিতে। ভুলে গেছে কিনা কে জানে।
ভাবি ভুলবে না।
তুই খাবি? তুই খেলে রানাকে বলে আসি।
আমি খাব না। তুমি খাও।
তাৱেক বসল। আরাম করে সিগারেট ধরাল। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর চাকরির ব্যাপারে আজ কথা বললাম।
কার সঙ্গে কথা বললে?
লাবণীর সঙ্গে কথা বললাম। লাবণীর আপন মামা কমার্স মিনিস্টার। তাদের হাতে অনেক চাকরি। লাবণীর চাকরির ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছেন।
আজ কি তুমি ওই মহিলার বাসায় গিয়েছিলে?
হুঁ।
প্রায়ই কি যাও?
প্রায়ই যাব কী? মাঝে মধ্যে যাই। দুঃখী মেয়ে তো আমার সঙ্গে কথা বললে মনে শান্তি পায়। আজ ওর হাসবেন্ডের মৃত্যুদিবস ছিল। সেই উপলক্ষে মিলাদ।
ও।
লাবণীকে চিটাগাং বদলি করে দিয়েছে। সামনের সপ্তাহে চলে যাবে। অফিসের কাণ্ডকারখানা দেখ–একটা মহিলা হুট করে তাকে বদলি করে দিল চিটাগাং।
উনার মামাকে দিয়ে বললেই বদলি রদ হয়ে যাবে। লাবণীও চিটাগাং যেতে চাচ্ছে–সেখানে কোয়ার্টার পাবে। নিজের মতো করে থাকতে পারবে। অবশ্যি আজকালকার সোসাইটি যা হয়েছে। একজন মহিলার পক্ষে বাচ্চা একটা মেয়ে নিয়ে থাকা মুশকিল। তার উপর আবার বিধবা।
হুঁ।
একা একা চিটাগাং যেতেও ভয় পাচ্ছে। আমি বলেছি পৌঁছে দেব।
তোমার যাওয়াটা ঠিক হবে না ভাইয়া।
এত জিনিসপত্র নিয়ে একা একা যাবে কীভাবে?
দরকার হলে আমি পৌঁছে দেব।
তোর সঙ্গে যাবে কেন? তোকে সে চেনে নাকি? আমাকেই যেতে হবে। তোর ভাবিকে বলব দুদিনের একটা ট্যুর পড়ে গেছে।
হাসান গভীর বিস্ময়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কী রকম সহজ সরল ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে–যেন জীবনে জটিলতা বলতে কিছু নেই। জীবনটা শান্ত দিঘির জলের মতো।
রীনা চায়ের কাপ নিয়ে উপস্থিত হলো।
তুমি এখানে আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি।
তারেক আনন্দিত গলায় বলল, হাসানের সঙ্গে গল্প করছিলাম–ওর চাকরির একটা লাইন পাওয়া গেছে। লাবণীর এক মামা হচ্ছেন কমার্স মিনিস্টার। ফুল মিনিস্টার না–প্রতিমন্ত্রী। তবে প্রতিমন্ত্রীদেরও অনেক ক্ষমতা। মোটামুটি ধরনের একটা চাকরি ওদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। লাবণী বলেছে একটা বায়োডাটা তৈরি করে ওর হাতে দিতে।
রীনা গভীর গলায় বলল, ভালো কথা দিও।
তারেক উৎসাহী গলায় বলল, হাসান তুই সুন্দর করে একটা বায়োডাটা তৈরি করে দু-একদিনের মধ্যে আমাকে দে, সার্টিফিকেট মার্কশিটের ফটোকপি দিবি, দুটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি, লেটার অব রেফারেন্স কিছু থাকলে তাও দিবি।
আচ্ছা দেব। আমি যাই তুই আরাম করে ঘুমো। এত চিন্তা করে কী হবে। রুটিরুজি নিয়ে এত চিন্তা করতে নাই।
তারেক চলে যাবার পর হাসান ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। গত রাতে সে এক মুহূর্তের জন্যেও ঘুমোতে পারে নি–মনে হয় আজো ঘুমোতে পারবে না। কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ নিয়ে আসা দরকার ছিল।
তিতলী অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে সুখে আছে–গল্প করছে এই চিন্তাটাই তাকে কষ্ট দিচ্ছে। তিতলী কী নিয়ে গল্প করে? তার গল্প করার বিষয়বস্তুর অভাব হবার কথা না। অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও সে সুন্দর কথা বলে। বড়লোক স্বামীর ঘর করছে–গানও নিশ্চয়ই এখন শিখবে। সে কি তার স্বামীকে ওই গানটা শোনাবে? যে গানটা তাকে শোনাবার কথা ছিল। গানটার লাইনগুলো কী? আশ্চর্য এখনো মনে আসছে না। এক কপি গীতবিতান কিনে প্রতি গানের প্রথম লাইনের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে গেলেই গানটা পাওয়া যাবে। হাসান সেটা চাচ্ছে না। তার ইচ্ছা আপনাতেই গানটা তার মনে আসুক। ‘বিধি ডাগর আঁখি?’ উঁহুঁ। চরণ ধরিতে দিও গো… উঁহুঁ। না তাও না। তাহলে গানটা কী?
হাসানের মাথা দপদপ করেছে। সে উঠে এসে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়াল। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার। চাঁদ আছে–চাঁদটা দেখা যাচ্ছে না। ডান দিকের সাততলা বাড়ির আড়ালে ঢাকা পড়েছে। তিতলী এবং তার স্বামী কি চাদটা দেখতে পাচ্ছে? আচ্ছা তারা কি জেগে আছে? জেগে থাকারই কথা। নতুন বিয়ে হওয়া স্বামীস্ত্রীরা চট করে ঘুমোতে যায় না। এক ধরনের মধুর ইনসমনিয়ায় তারা আক্রান্ত হয়। হাসানের মাথাধরাটা আরো বাড়ছে। সে বাথরুমের দিকে রওনা হলো। কলের নিচে মাথা দিয়ে সে কলটা অনেকক্ষণ ছেড়ে রাখবে। কলে পানি আছে তো? কদিন ধরে পানির খুব টানাটানি যাচ্ছে। সন্ধ্যারাতেই পানির ট্যাংক খালি হয়ে থাকে। আজ কি কৃষ্ণপক্ষ না শুক্লপক্ষ?
এক শ ডলারের নোটটা
এক শ ডলারের নোটটা হাসান ভাঙিয়েছে। তার ভাগ্য ভালো ডলারের দাম হঠাৎ চড়ে যাওয়ায় তিন হাজার সাত শ টাকা পেয়েছে। এক শ টাকার নোটে পাঞ্জাবির পকেট ভর্তি। একটা হাত সব সময় পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে হচ্ছে। সব সময় টাকা ছুঁয়ে থাকা।
হাসান আজ কিছু উপহার কিনবে। লিটনের স্ত্রীর জন্যে ভালো একটা শাড়ি। লিটনের জন্যে একটা পাঞ্জাবি, পায়জামা এবং একজোড়া স্যান্ডেল। লিটনের স্যান্ডেল দেখে সেদিন খুব মায়া লেগেছিল। উপহারের চেয়ে টাকাটা পেলে তাদের কাজে লাগত। সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় বিয়ে করার যন্ত্রণায় হাসানকে যেতে হয় নি। এটা কম কি?
তার জীবনে যা ঘটেছে মনে হয় ঠিকই ঘটেছে। তিতলীর ভালো বিয়ে হয়েছে। প্রথম কিছুদিন সে কষ্ট করবে। তারপর সেই কষ্ট গা সহা হয়ে যাবে। সব কষ্টই মানুষের একসময় শেষ হয়ে যায়। মানুষের কষ্ট গ্যাস বেলুনের মতো–উঁচুতে উঠতে থাকেএক সময় না এক সময় সেই বেলুন নেমে আসতে থাকে। বেলুন ভর্তি প্যাস থাকে ঠিকই তবে গ্যাসের বেলুনকে উড়িয়ে রাখার ক্ষমতা থাকে না।
হাসান সুন্দর একটা সিন্ধের শাড়ি কিনল। শাড়ি কেনার সময় তিতলীর কথা মনে পড়ল। কোন রঙটা তিতলীকে মানাবে ভেবে কেনা। শাড়ি পছন্দ করার একটা বুদ্ধিও তিতলী তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। সেই বুদ্ধিটাও খুব সুন্দর। দোকানদার অনেকগুলো শাড়ি মেলে ধরবে। তখন তুমি দেখবে কিছু কিছু শাড়ি তোমার হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে। ওই শাড়িগুলোই শুধু কিনবে। তিতলী সব সময় মজার মজার কথা বলত। এখনো কি বলে?
লিটনকে তার মেসে পাওয়া গেল। কেরোসিনের চুলায় সে ভাত বসিয়েছে। একটা বাটিতে ডিম ফেটে রেখেছে। ভাত নেমে যাবার পর ডিম ভাজবে। লিটন হাসানকে দেখে লাফিয়ে উঠল–আরে তুই।
ভাবিকে দেখতে এসেছি, আমাকে নিয়ে চল।
লিটন হাসিমুখে বলল, আশ্চর্য কাণ্ড, আমি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছি তুই এসেছিস। খুবই অদ্ভুত একটা স্বপ্ন। দেখি কী, আমি আর শম্পা কক্সবাজারে বেড়াতে গেছি। সন্ধ্যাবেলা সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছি। হঠাৎ শম্পা চেচিয়ে বলল, ওই দেখ তোমার বন্ধু বসে আছে। আমি বললাম, তুমি তো তাকে কোনোদিন দেখ নি। চিনলে কী করে। শম্পা তখন এমন হাসতে শুরু করল যে হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে দেখি রাত তিনটা বাজে। তারপর আর ঘুম হয় নি। রাতে চা বানিয়ে খেলাম। সকালে দোকান থেকে পরোটা এনে খেয়েছি। এখন এগারটা বাজে, এর মধ্যে ক্ষিধে লেগে গেছে। ভাত বসিয়েছি।
নিজেই রান্না করে খাস?
হুঁ। খরচ বাঁচে। অবস্থা কাহিল রে দোস্ত।
তুই ভাত খেয়ে নে। আমি বসি।
তোকে একটা ডিম ভেজে দি খা।
না—আমি খাব না।
খা নারে দোস্ত। আমি গরিব মানুষ এর বেশি কী দেব। দাঁড়া আমি চট করে একটা ডিম নিয়ে আসি।
আমার জন্যে কিছু আনতে হবে না। তুই খেয়ে শেষ কর। তোর জন্য একটা পাঞ্জাবি এনেছি–গায়ে দিয়ে দেখ লাগে কি না।
আমার জন্যে পাঞ্জাবি কেন? আমি কী করলাম?
তুই বিয়ে করেছিস। ফকির অবস্থায় বিয়ে করে যে সাহস দেখিয়েছিস সেই সাহসের পুরস্কার।
মাই গড! স্যান্ডেলও কিনেছিস নাকি?
হ্যাঁ। তোর এখনকার স্যান্ডেল জোড়া দয়া করে আমার হাতে দে। আমি নিজে ডাক্টবিনে ফেলব।
এত দামি পাঞ্জাবি কিনেছিস? টাকা পেলি কোথায়? তোর কি চাকরি বাকরি কিছু হয়েছে?
না। শোন লিটন, তোদের উপহার দেয়ার জন্যে আমি কিছু টাকা বাজেট করেছিলাম। উপহার কেনার পর কিছু টাকা বেঁচে গেছে। এই টাকাটাও আমি দিতে চাই। কার কাছে দেব? তোর কাছে না তোর স্ত্রীর কাছে?
লিটন কথা বলছে না। তার ডিম ভাজা হয়ে গেছে–আগুনগরম ভাত সে কাপ কপ করে খাচ্ছে। অভাবের সময় মানুষের ক্ষিধে বেশি লাগে এটা বোধহয় ঠিক।
হাসান।
হুঁ।
তুই যে খুব অদ্ভুত একটা প্ৰাণী তা কি তুই জানিস?
না।
তোর বন্ধুবান্ধবরা সবাই কিন্তু এটা জানে।
জানলে তো ভালোই।
কত মানুষের দোয়া যে তোর ওপর আছে!
দোয়ায় তো কাজ হয় না।
তা হয় না। কাজ হলে আমার দোয়াতেই তোর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ভালো চাকরি বাকরি করে সুখে ঘর-সংসার করতি।
আমি সুখেই আছি।
সুখে থাকলে তো ভালোই।
লিটন নতুন পয়জামা-পাঞ্জাবি পরল। স্যান্ডেল পরল। হাসিমুখে বলল, হাসান আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
খুবই ভালো দেখাচ্ছে শুধু মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িটায় সমস্যা করছে। ভালমতো শেভ কর।
নাপিতের দোকানে শেভ করব। শম্পা। আজ কী যে খুশি হবে–ওর খুশি খুশি মুখ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। গত চারদিন তার সঙ্গে দেখা হয় নি।
কেন?
খুবই লজ্জার ব্যাপার–তোকে বলতেও লজ্জা লাগছে।
লজ্জা লাগলে বলার দরকার নেই।
শোন। তোকে না বললে আর কাকে বলব, হয়েছে কী, শেষবার যখন শম্পার সঙ্গে দেখা হলো সে হঠাৎ খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, তুমি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে? আমি বললাম, কত? সে বলল, পাঁচ শ টাকা দিলেই হবে। আমি বললাম আজ তো সঙ্গে নেই। পরের বার যখন আসব নিয়ে আসব। টাকার যোগাড় হয় নি যাওয়াও হয় নি। আজ তুই যখন বললি, উপহার কেনার পর কিছু টাকা বেঁচেছে তুই টাকাটা দিয়ে দিতে চাস তখন আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তুই বোধহয় লক্ষ করিস নি। আমি সেই সময় ডিম ভাজা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পুরুষ মানুষের চোখের পানি কাউকে দেখাতে নেই।
শম্পা শাড়ি দেখে ছেলে মানুষের মতো খুশি হলো। কয়েকবার বলল, আশ্চর্য এত সুন্দর শাড়ি! এত সুন্দর রঙ!
লিটন বলল, যাও তো তুমি শাড়ি পরে আসা। আর এই খামটা রাখ।
খামে কী?
এক হাজার টাকা আছে। রেখে দাও–টুকটাক খরচ আছে না?
শম্পা খুবই লজ্জিতভাবে হাসানের দিকে তাকাচ্ছে। লিটন বলল, হাসান মিষ্টি এনেছে–মিষ্টি ভেতরে দিয়ে আস। বাচ্চারা খাক। আর শোন তুমি হাসানের সঙ্গে দুএকটা কথা বল। এমন মূর্তির মতো বসে আছ কেন?
শম্পা আরো লজ্জিত হয়ে বলল, আমি শাড়িটা পরে আসি। আর শোন তুমি এই চার দিন আস নি কেন?
মানুষের কাজকর্ম থাকে না?
শম্পা হাসানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে লিটনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি গতকাল তোমার মেসে গিয়েছিলাম। তুমি ছিলে না। কেউ তোমাকে বলে নি?
কী আশ্চর্য! তুমি মেসে উপস্থিত হলে কোন আন্দাজে? তোমাকে না বলেছি আজেবাজে জায়গায় থাকি কখনো যাবে না।
কেন তুমি চারদিন আসলে না?
শম্পার চোখে পানি এসে গেছে। একটু আগে যে মেয়ে শাড়ি হাতে আনন্দে ঝলমল করছিল এখন সে প্রায় বাচ্চাদের মতোই শব্দ করে কাঁদছে। হাসান খুব অস্বস্তিতে পড়েছে। আবার তার খুব ভালোও লাগছে। তার মন বলছে লিটনের সব সমস্যার সামধান হবে। তাদের দুজনের সুন্দর সংসার হবে। সেই সংসারে চাঁদের মতো খোকাখুকু আসবে। ভালবাসার পবিত্র অশ্রু প্রকৃতি কখনো অবহেলা করে না।
লিটন বলল, শম্পা তুমি যাও তো শাড়িটা পরে আসা। আর শোন প্লেটে করে হাসানকে একটু মিষ্টি দাও। ওর মিষ্টিই ওকে খাইয়ে দি। বেলপাতায় বেলপূজা। হা হা হা।
শম্পা শাড়ি হাতে ভেতরে চলে গেল। লিটন বলল, হাসান আমার বউকে কেমন দেখলি?
সুন্দর খুব সুন্দর।
ছেলেমানুষ–বয়সও অবশ্য কম। জুন মাসে আঠার হবে। এই কদিন আসি নি কেঁদে কেটে কী সিন ক্রিয়েট করল দেখলি! তুই থাকায় রক্ষা নয়তো আরো হইচই করত।
লিটন তুই এক কাজ কর বউকে নিয়ে আজ সারাদিন ঘুরে বেড়া। কিছু টাকা তো আছে?
কোথায় ঘুরব?
জাদুঘর, চিড়িয়াখানা কিংবা এক কাজ করা–সদরঘাটে গিয়ে একটা নৌকা ভাড়া কর। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘুরবি। কিছু খাবারদাবার সঙ্গে নিবি, একটা ফ্লাস্কে করে চা।
নৌকা ভাড়া কত জনিস?
এটা হিসেবে ভাড়া। পঞ্চাশ টাকা করে ঘণ্টা। নৌকায় বসে দুজনে গল্পগুজব করবি।
মাঝি ব্যাটা তো সব শুনবে।
শুনুক, অসুবিধা কী?
তুইও চল আমাদের সাথে।
আরে না। আমি না। পুরো ব্যাপারটাই দুজনের।
শম্পার চুল কত লম্বা দেখেছিস?
হ্যাঁ, খুব লম্বা চুল।
সেদিন কী বলল শোন, ফট করে বলল, আমি যদি তার সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া করি। তাহলে সে চুল কেটে ফেলবে। যা সেনসেটিভ স্বভাব–কেটে ফেলবে তো বটেই। আমি খুব ভয়ে ভয়ে থাকি।
লিটন তৃপ্তির হাসি হাসছে। হাসান মুগ্ধ হয়ে লিটনের হাসি দেখছে। না। শম্পা মেয়েটা ভাগ্যবতী। সে তার এক জীবনে অসংখ্যবার স্বামীর সুন্দর হাসি দেখবে।
হিশামুদ্দিন সাহেব বাথরুমে ঢুকে কল ছাড়লেন
হিশামুদ্দিন সাহেব বাথরুমে ঢুকে কল ছাড়লেন তখন হঠাৎ তার মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। পৃথিবী দুলছে। অস্পষ্ট কাঁপুনি। আশ্চর্য কাণ্ড! সেই কঁপুনি তার শরীরের প্রতিটি কোষে ঢুকে যাচ্ছে। শরীরও কপিছে। ব্যাপারটা কী? তিনি এক হাতে বেসিনে ধরে ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলালেন। ভূমিকম্পের সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে ফাঁকা জায়গায় ছুটে যেতে হয়। তার পা থেমে গেছে–তিনি বাথরুম থেকে বেরোবার আশা ছেড়ে দিলেন। বের হওয়া এখন অসম্ভব। তাকে যেতে হবে দরজা পর্যন্ত। দরজার লক। খুলতে হবে। অথচ পা জমে আছে। ভূমিকম্পের দুলুনি আরো বাড়ছে। তার শরীরের দুলুনিও বাড়ছে। তিনি ভাঙা গলায় ডাকলেন–চিত্ৰলেখা! চিত্ৰলেখা! নিজের গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে কি না তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। চারদিক থেকে ঝমােঝম শব্দ হচ্ছে। সবাই যেন টিনের থালাবাসন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। তিনি আবারো ডাকলেন চিত্ৰলেখা! চিত্ৰলেখা! কেউ কি আযান দিচ্ছে। তিনি আযানের শব্দও শুনছেন।
মহাপ্রাকৃতিক বিপদে মানুষ। আযান দেয়। আযান কে দিচ্ছে? মোতালেব?
বাথরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ছে। কে যেন মিষ্টি গলায় ডাকছে—বাবা দরজা খোল। দরজা খোল। কে ডাকছে? চিত্ৰলেখা? তার গলা তো এমন না। মনে হচ্ছে দশ বছরের কোনো বালিকা।
বাবা তোমার কী হয়েছে?
ভূমিকম্প হচ্ছে রে মা।
দরজা খোল ত বাবা।
আমি নড়তে পারছি না রে মা।
খোলা কল দিয়ে ছড়াছড় শব্দে পানি পড়ছে। বাথরুমের আলো উজ্জ্বল হচ্ছে। আবার কমে যাচ্ছে। হিশামুদ্দিন বুঝতে পারছেন তার বাথরুমের দরজার পাশে অনেকেই ভিড় করেছে। দরজায় শব্দ হচ্ছে। তারা বোধহয় দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টা বাদ দিয়ে তাদের উচিত–নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেয়া। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুৰ্যোগের সময় কারো দিকে তাকাতে হয় না। পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কারো দিকেই না। শুধু নিজেকে বীচানো। তার মধ্যে দােষের কিছু নেই। প্রকৃতি মানুষের ডিএনএ কোষে এই ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির মমতা তার সৃষ্টির জন্যে। প্রকৃতি জানে মহাবিপদের সময় যদি একে অন্যকে বাচানোর চেষ্টা করতে থাকে তাহলে কেউ বাঁচবে না। কাজেই প্রকৃতি এই বিধান ডিএনএ-তে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে বিধানে ভয়ঙ্কর বিপদে মানুষের সব চিন্তা নিজের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। কিন্তু এরা এমন করছে কেন? এরা কেন ছুটে গিয়ে মাঠে কিংবা ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে না। টিনের থালা বাসন পেটানোরও বা অর্থ কী। আনন্দের কোনো ব্যাপার তো না যে ঘণ্টা বাজাতে হবে?
বাথরুমের দরজা ভাঙা হয়েছে। দরজার ওপাশে উদ্বিগ্নমুখে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। মোতালেব, রহমতউল্লাহ, চিত্ৰলেখা। চিত্ৰলেখা বাথরুমে ঢুকে বাবার হাত ধরল। পানির ট্যাপ বন্ধ করল। হিশামুদিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় বললেন, ভূমিকম্প হচ্ছে। চিত্ৰলেখা বলুল, ভূমিকম্প হচ্ছে না। তোমার শরীর খারাপ করছে। মনে হয় প্রেসার সাডেন শুট করেছে। তুমি কি আমার হাত ধরে ধরে হাঁটতে পারবে? নাকি তোমাকে কোলে করে নিতে হবে?
হাঁটতে পারব।
তাহলে এস।
পা আটকে গেছে। পা নাড়াতে পারছি না।
কোনো অসুবিধা নেই। আপাতত পা না নাড়ালেও চলবে। তোমাকে কোলে করে নেবার ব্যবস্থা করছি।
হিশামুদিন সাহেব খুবই বিস্মিত হচ্ছেন। কল বন্ধ করা হয়েছে অথচ এখনো পানি পড়ার ছড়াছড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে শব্দটা মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছে। অনন্তকাল এই শব্দ মাথার ভেতর হতেই থাকবে। একঘেয়ে শব্দের জন্যে হিশামুদ্দিন সাহেবের কেমন ঘুমাও পেয়ে গেছে। যন্ত্রণাময় ঘুম। প্রবল জ্বরের সময় এ ধরনের ঘুম পায়; ঘুম হচ্ছে অথচ শারীরিক সব যন্ত্রণা টের পাওয়া যাচ্ছে। সবার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে–এ রকম।
হিশামুদ্দিন সাহেব শুয়ে আছেন তার নিজের খাটে। ঘর অন্ধকার। জানালার সব পরদা টেনে দেয়া। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। দিনের শুরুটা ঠাণ্ডা। ফ্যানের বাতাসে তার শীত শীত লাগছে। গায়ে একটা পাতলা চাদর দিয়ে দিতে কি চিত্ৰলেখাকে বলবেন? শীত শীত ভাবটা খুব যে খারাপ লাগছে তা না। মাঝে মাঝে একটু শুধু কাঁপন লাগছে–এই যা।
শরীরটা এখন কেমন লাগছে বাবা?
ভালো।
তোমার ব্লাডপ্রেসার এখন অনেকখানি কমেছে। তবে পালস রেট এখনো হাই–মিনিটে ৯৮, তবে রেগুলার হয়েছে–আগে খানিকটা ইরেগুলারিটি ছিল। তোমাকে আমি টাংকুলাইজার দিয়েছি। এতে ঘুম হবে কিংবা তন্দ্রার মতো হবে। তোমার থরো চেকাপের একটা ব্যবস্থা আমি করছি। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা তুমি নাড়াতে পার কি না। একটু দেখ তো।
হিশামুদিন পায়ের বুড়ো আঙুল নাড়লেন। চিত্ৰলেখা বলল, গুড। এখন ব্রেকফার্স্ট কর। হালকা কিছু খাও। দুধ সিরিয়েল, আধা কাপ ফলের রস। এক কাপ আগুনগরম চা।
তুই তো সত্যিকার ডাক্তারদের মতো কথা বলছিস।
আমি সত্যিকারেই ডাক্তার। আমি এখন একটু বের হব। এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরব। তোমার কানে যে যন্ত্রণা হচ্ছিল সেটা কি এখনো হচ্ছে?
না।
একসেলেন্ট! কাঁপছ কেন? তোমার কি শীত লাগছে?
একটু মনে হয় লাগছে।
গায়ে চাদর দিয়ে দেব?
না।
আমি রহমতউল্লাহকে তোমার নাশতা দিয়ে যেতে বলেছি।
কটা বাজে?
এখন বাজছে আটটা পঁয়ত্ৰিশ।
আজ এগারটার সময় একটা জরুরি অ্যাপায়েন্টমেন্ট আছে।
শুধু আজ না, আগামী এক সপ্তাহ তোমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। তুমি বিছানায় শুয়ে রিলাক্স করবে। গল্প করবে। বইটই পড়বে।
আজ এগারটায় যে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট সেটা ক্যানসেল করা যাবে না।
সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করা যায় না। মৃত্যুর সঙ্গে যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেটাকেও পেছনের ডেটে সরানোর জন্য আছি আমরা— ডাক্তাররা।
সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট কিন্তু ক্যানসোল হয় না।
আজ হয় না একদিন হবে। মানুষ অমরত্বের কৌশল জেনে যাবে। এজিং প্রসেস—বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াটা জানার চেষ্টা হচ্ছে–যেদিন মানুষ পুরোপুরি জেনে যাবে ব্যাপারটা সেদিনই দেখবে মৃত্যু জয় করার চেষ্টা শুরু হবে।
ভালো।
তিন হাজার সনের মানুষের অমর হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
হিশামুদ্দিন সহজ গলায় বললেন, তিন হাজার সনের মানুষ তাহলে খুব দুঃখী মানুষ। মৃত্যুর আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত।
চিত্ৰলেখা অবাক হয়ে বলল, মৃত্যুর আবার আনন্দ কী?
হিশামুদিন হাসিমুখে বললেন, আনন্দ তো মা আছেই। আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব এই জন্যেই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে। যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা কখনো এত সুন্দর লাগত না।
তুমি ফিলোসফারদের মতো কথা বলছি বাবা।
আর বলব না। ক্ষিধে লেগেছে নাশতা দিতে বল। আর শোন দুধ সিরিয়েল খাব না। দুধ-চিড়া খাব। দুধ-চিড়াও না–দই-চিড়া। পানিতে ভিজিয়ে চিড়াটাকে নরম করে টক দই, সামান্য লবণ, কুচিকুচি করে আধটা কাচামরিচ. এটা হচ্ছে আমার বাবার খুবই প্রিয় খাবার।
তুমি যেভাবে বলছ আমারও খেয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। এক কাজ করলে কেমন হয়। আগামীকাল আমরা এই নাশতাটা খাব–আজ আমার মতো খাও।
আচ্ছা।
আমি চলে যাচ্ছি, রহমতউল্লাহ ঠিক দশটার সময় দুটা ট্যাবলেট দেবে তুমি হাসিমুখে খেয়ে নেবে।
আচ্ছা হাসিমুখেই খাব।
হিশামুদ্দিন সাহেব নাশতা খেলেন। রহমতউল্লাহ তাকে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। সাধারণত তিনি তার নাশতা বা খাবার একা একা খান। কেউ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে অস্বস্তি লাগে। আজো লাগছে। কিন্তু তিনি কিছু বলেন না।
রহমতউল্লাহ।
জ্বি স্যার।
কাল দই-চিড়া খাব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
দই-চিড়া আমার বাবার খুবই প্রিয় খাবার।
জ্বি আচ্ছা।
হিশামুদিনের ভুরু কঁচকে গেল। তিনি ঠিক কথা বলছেন না। দই-চিড়া তার বাবার প্রিয় খাবার না। গরিব মানুষদের কোনো প্রিয় খাবার থাকে না। খাদ্যদ্রব্য মাত্রই তাদের প্রিয়। তার বাবা যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন কিছু খেতে পারতেন না। তখন বলেছিলেন, দই-চিড়া দে। দই-চিড়া বলকারক, খেতেও ভালো। সেই দই-চিড়ার ব্যবস্থা হয় নি। তার বাবার বিচিত্র ধরনের অসুখ হয়েছিল। অসহ্য গরম লাগত। কাপড় ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে হাওয়া করেও সেই গরম কমানো যেত না। রাতে ঘরে ঘুমোতে পারতেন না। বারান্দায় হাওয়া বেশি খেলে বলে বারান্দায় শুইয়ে রাখা হতো। এক রাতে অবস্থা খুব খারাপ হলো। কবিরাজের কাছ থেকে মকরধ্বজ এনে খাওয়ানো হলো। সেই ওষুধের নাকি এমনই তেজ যে খাওয়ামাত্র মরা রোগী লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। মকরধ্বজ খাওয়ার পর তার অবস্থা আরো খারাপ হলো, তিনি ছটফট করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে ছটফটানি কমত–তিনি তখন বলতেন— আমার শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। আরো জোরে হাওয়া কর। আরো জোরে। রাত দুটার দিকে তার জুলুনি বোধহয় একটু কমল। তিনি ক্লান্তভঙ্গিতে বললেন-আজ মৃত্যু হবে কি না বুঝতে পারছি না। চাঁদনী রাত ছিল। মরণ হলে খারাপ ছিল না। শরীরের জ্বলুনিটা কমত। জ্বলুনি আর সহ্য হয় না।
দুৰ্ভগাদের কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হয় না। তার শেষ ইচ্ছাও পূর্ণ হয় নি। তিনি মারা যান। পরের রাতে। সে রাতে আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। চাদ বা তারা কোনোটাই ছিল না।
আচ্ছা তিনি কি তার বাবাকে গ্লামারাইজড করছেন না? একটা দুষ্ট প্রকৃতির লোককে দুঃখী, মহৎ এবং সুন্দর মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা আসলে সে রকম না। তার বাবা ছিলেন চোর, অসৎ প্রকৃতির মানুষ, সৰ্বরকম দায়িত্ব জ্ঞানহীন একজন দুর্বল মানুষ। দুর্বল মানুষদের চরিত্রও দুর্বল থাকে। তার চরিত্রও দুর্বল ছিল। তার খারাপ পাড়ায় যাতায়াত ছিল। খারাপ পাড়ার একটি মেয়েকে তিনি বিয়েও করেছিলেন। সেই মেয়েকে তিনি অবশ্যি ঘরে আনেন নি। তবে সেই নষ্ট মেয়ের গর্ভের একটি সন্তানকে ঘরে স্থান দিয়েছিলেন। এই ঘটনা চিত্ৰলেখাকে বলা হয় নি, হাসানকেও বলা হয় নি। তিনি পাশ কাটিয়ে গল্প বলছেন। এটা ঠিক হয় নি।
রহমতউল্লাহ!
জ্বি স্যার।
তুমি হাসানকে একটু খবর দাও। জ্বি আচ্ছা স্যার।
পান দিতে বল। চা খেয়ে মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে। জর্দা ছাড়া পান।
জ্বি দিচ্ছি।
একটা পাতলা চাদর আমার গায়ে দিয়ে দাও। শীত লাগছে।
ফ্যান বন্ধ করে দিব স্যার?
ফ্যান বন্ধ করতে হবে না।
হিশামুদ্দিন চোখ বন্ধ করলেন। বেশ ভালো ঠাণ্ডা লাগছে। তার বাবা মৃত্যুর সময় অসহ্য গরমে ছটফট করেছেন। আর তিনি নিজে হয়তো শীতে কাপতে কাঁপতে মারা যাবেন। তার বাবার কোনো সাধই পূর্ণ হয় নি। তার নিজের প্রতিটি সাধ পূর্ণ হয়েছে। তিনি যদি চান তার মৃত্যু হবে জোছনা দেখতে দেখতে তাহলে হয়তো-বা কৃষ্ণপক্ষের রাতেও পূৰ্ণচন্দ্ৰ দেখা যাবে।
স্যার!
হুঁ।
পান এনেছি স্যার।
পান খাব না নিয়ে যাও। আরেকটা পাতলা চাদর গায়ে দাও। শীত বেশি লাগছে।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তোমার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। তুমি চলে যাও।
রহমতউল্লাহ চলে গেল না। ঘরে থেকে বের হয়ে গেল ঠিকই। তবে দাড়িয়ে রইল দরজার ওপাশে। মনে হয় তার প্রতি চিত্ৰলেখার এ ধরনের নির্দেশ আছে।
হিশামুদ্দিন চোখ বন্ধ করে আছেন। পানিতে ডুবে যারা মারা যায় সমগ্র জীবনের ছবি তাদের চোখের ওপর দিয়ে ভেসে যায়। খাটে শুয়ে যাদের মৃত্যু তাদের চোখের ওপর দিয়ে কিছু কি ভাসে? যাপিত জীবনের খণ্ডচিত্ৰ?
রহমতউল্লাহ আবার ঘরে ঢুকেছে৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জিত এবং কিঞ্চিত ভীত।
কিছু বলবে?
হাসান সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে স্যার।
ভালো। ভেরি গুড। সে এলে তাকে সরাসরি এখানে নিয়ে আসবে।
জ্বি আচ্ছা।
আপা এই ওষুধ দুটা দিয়ে গেছেন। দশটার সময় আপনাকে খাওয়াতে বলেছেন।
আচ্ছা দাও।
হিশামুদিন ট্যাবলেট দুটা গিলে ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঝিমুনির মতো এসে গেল। তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
হাসান অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে। তাকে চা-স্যান্ডউইচ দেয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে খানিকটা আদর-যত্ন করা হচ্ছে। অন্য সময় এরচে’ দীর্ঘ সময় বসে থাকলেও চাটা কিছুই দেয়া হয় না। হিশামুদ্দিন সাহেব খুব অসুস্থ এই খবরটা তাকে দেয়া হয়েছে। অসুস্থতার ফলে তাকে এখানে ডেকে আনার কারণটা সে ধরতে পারছে না। গুরুতর অসুস্থ মানুষ লইয়ারদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। বিষয়-সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করে। কেউ কেউ মওলানা ডেকে এনে তওবা করেন। পরকালে নিৰ্ভয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। তবে তওবার ব্যাপারটা নিম্নবিত্তের মানুষদের ক্ষেত্রেই বেশি ঘটে। হিশামুদিন সাহেবদের মতো অকল্পনীয় বিত্তের মানুষরা তওবা করেন না।
হাসান সাহেব!
হাসান প্ৰায় লাফিয়ে উঠল। হিশামুদ্দিন সাহেবের মেয়ে চিত্ৰলেখা দরজা ধরে দুয়েছে। মেয়েটিকে আজ খুব বিষন্ন লাগছে। বাবার অসুখের ব্যাপারে সে হয়তো চিন্তিত।
ম্যাডাম স্নামালিকুম। আমাকে ম্যাডাম ডাকবেন না তো— শুনতে কুৎসিত লাগে। আমাকে নাম ধরে ডাকবেনা–চিত্ৰলেখা। কোনো সমস্যা নেই। চা খাওয়া হয়েছে?
জ্বি।
বাবা অসুস্থ শুনেছেন বোধহয়?
জ্বি।
অসুখ যতটা সহজ ভেবেছিলাম তত সহজ না। বেশ জটিল। আমি বেশ চিন্তিত বোধ করছি। ভালো কোনো ক্লিনিকে তাকে ট্রান্সফার করলে ভালো হত। আমি ক্লিনিক খুঁজে বেড়ালাম। কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না। ক্লিনিকে সুযোগ-সুবিধা কী আছে জানতে চাইলে ওরা বলে–এসি আছে, কালার টিভি আছে, ফ্রিজ আছে, ইন্টারকমের ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা কী তা বলে না।
স্যারের কী হয়েছে?
ব্লাডপ্রেসার খুব ফ্লাকচুয়েট করছে। পালস ইরেগুলার। তার এখন দরকার কনসটেন্ট মনিটরিং।
কোনো হাসপাতালে কি ভর্তি করাবেন? ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা পিজি?
এখনো বুঝতে পারছি না। আজ দিনটা দেখে আগামীকাল ডিসিশান নেব। আপনি আসুন। বাবার ঘুম ভেঙেছে তার সঙ্গে কথা বলুন।
উনি আমাকে কেন ডেকেছেন বলতে পারেন?
লাইফ ক্টোরি সম্ভবত বলবেন।
এখন কি উনার কথা বলা ঠিক হবে?
আমি তাতে কোনো অসুবিধা দেখছি না। কথা বলে তিনি যদি আনন্দ পান তাহলে কথা বলাই উচিত। উনি যে গুরুতর অসুস্থ তা আমি তাকে বুঝতে দিতে চাচ্ছি না। আমার কথা বুঝতে পারছেন তো?
জ্বি।
বাবা যে আপনাকে গল্প বলেন তার পেছনের কারণটা কি আপনি ধরতে পেরেছেন?
জ্বি না।
বাবা যা করছেন তা হচ্ছে এক ধরনের কনফেসন। খ্রিষ্টানরা যখন কোনো অপরাধ করে তখন তারা পাদ্রীদের কাছে কনফেসন করে। বাবা যা করছেন তা হচ্ছে এক ধরনের কনফেসন।
উনি তো কোনো অপরাধ করেন নি।
অপরাধ না করেও কেউ কেউ নিজেকে অপরাধী ভাবে। বাবার মা-বাবা, ভাইবোন হতদরিদ্র ছিলেন। অনেকেই মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। যারা বেঁচে আছেন তাদের অবস্থা শোচনীয়। অথচ মাঝখান থেকে বাবা হয়ে গেলেন বিলিওনিয়ার। এই কারণেই তিনি হয়তো নিজেকে অপরাধী ভাবেন। মানুষ অতি বিচিত্ৰ প্ৰাণী হাসান সাহেব। কী, ঠিক বলছি না?
জ্বি।
আপনার কথাবার্তা দেখছি–জ্বি এবং জ্বি নাতে সীমাবদ্ধ। হড়বড় করে কথা বলা অভ্যাস করুন তো। হড়বড় করে যারা কথা বলে তাদের মন সব সময় প্রফুল্প থাকে। এটা হচ্ছে রিসেন্ট ফাইন্ডিং নিউজউইকে উঠেছে।
হাসান চুপ করে রইল। চিত্ৰলেখা বলল, বাবার অপরাধবোধের আরেকটা বড় কারণও আছে। তিনি তার আত্মীয়স্বজনদের কোনো সাহায্য করেন নি। কেউ কেউ সাহায্যের জন্যে এসেছিল তাদের দূর দূর করে তাড়িয়েছেন।
ও
বাবার অনেক কিছু আমি বুঝতে পারি না। এই ব্যাপারটিও পারি না।
বুঝতে বোধহয় চেষ্টাও করেন নি।
ঠিক বলেছেন, চেষ্টাও করি নি। আমার উচিত ছিল বাবার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, আমি সেটাও করি নি। বাবা যেমন পৃথিবীতে একা আমিও একা। আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে–কিন্তু আমার কথা বলার মানুষ নেই। এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি–আমার ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে বলুন তো?
বলতে পারছি না।
কারণ আপনি বাবার খুব পছন্দের মানুষ। কী করে বললাম বলুন তো?
বুঝতে পারছি না।
কাল রাতে খেতে বসে বাবা হঠাৎ বললেন, হাসানকে একদিন আমাদের সঙ্গে খেতে বলি। আমি বললাম, বেশ তো বল। উনি তৎক্ষণাৎ বললেন— না থাক। বাবার সমস্যা কী জানেন? তার সমস্যা হচ্ছে–তিনি যাদের পছন্দ করেন তাদের কখনো তা জানান না। তার পছন্দ এবং অপছন্দ দুটা ব্যাপারই খুব গোপন। আমি বোধহয় বকবক করে আপনার মাথা ধরিয়ে দিয়েছি। চলুন বাবার ঘরে যাই।
হাসানকে দেখেই হিশামুদ্দিন বললেন, তোমার কী হয়েছে হাসান?
হাসান হকচাকিয়ে গেল। সে রোগীর ঘরে ঢুকেছে। রোগী তাকে দেখে বলছেন তোমার কী হয়েছে।
কিছু হয় নি স্যার।
তোমাকে মৃত মানুষদের মতো দেখাচ্ছে।
আমি ভালোই আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন?
আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি ভালোই আছি-কিন্তু আমার মেয়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো নেই। ডাক্তাররা যখন রোগীর সামনে অতিরিক্ত রকমের হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে তখন বুঝতে হয়-সামথিং ইজ রং। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।
হাসান বসল। হিশামুদ্দিন সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন–আমার বাবা প্রসঙ্গে নানান সময় তোমাকে নানান কথা বলেছি। আমার কথা শুনে শুনে তার একটা ছবি নিশ্চয়ই তোমার মনে তৈরি হয়েছে। ছবিটা কেমন?
স্যার ছবিটা খুবই সুন্দর। আপনার বাবাকে আমার অসাধারণ মানুষ বলে মনে হয়।
হিশামুদ্দিন শান্ত গলায় বললেন, তিনি খুবই সাধারণ মানুষ। ভণ্ড টাইপের মানুষ। মিথ্যাবাদী, চোর, স্বার্থপর, অলস… যে কটি খারাপ গুণ মানুষের থাকা সম্ভব সবকটি তার মধ্যে ছিল। খারাপ পাড়ার একটি মেয়েকে তিনি বিবাহ করেছিলেন–সেই ঘরে তার একটি ছেলে হয়েছিল। ওই মহিলা বাবাকে এক পর্যায়ে ছেড়ে চলে যান। আমি কী বলছি তুমি মন দিয়ে শুনছ তো?
জ্বি স্যার শুনছি।
বাবা ওই মহিলার গর্ভজাত সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু তাকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। তার অন্য সন্তানরাও তাকে দেখতে পারত না। কেউ তার সাথে রাতে ঘুমোত না। সে ঘুমোত একা একা। সে জ্বরে ছটফট করলে কেউ এসে মাথায় হাত দিয়ে জ্বর দেখত না। বাবার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত সেই ছেলেটা সারাজীবন করেছে। তোমার বুদ্ধি কেমন হাসান?
আমার বুদ্ধি স্যার মোটামুটি পর্যায়ের।
মোটামুটি পর্যায়ের বুদ্ধি দিয়েও তুমি আশা করি বুঝতে পারছি সেই ছেলেটি কে। পারছি না?
জ্বি স্যার পারছি।
এখন বল তোমাকে এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? তোমার সমস্যা কী?
তেমন কোনো সমস্যা নেই স্যার।
সমস্যা থাকলে বলতে পার। বিত্তবান মানুষরা নিজের সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও অন্যের সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
হাসান কিছু বলল না, চুপ করে রইল। একবার তার ইচ্ছা করছিল বলে ফেলে–স্যার আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিন। বলতে লজ্জা লাগল। একজন অসুস্থ মানুষকে চাকরির কথা বলা যায় না। লিটনের কথা কি সে স্যারকে বলবে? নিজের কথা বলা না গেলেও অন্যের কথা নিশ্চয়ই বলা যায়।
আমার এক বন্ধুর জন্যে কি স্যার আপনি একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন?
তোমার বন্ধু?
জ্বি স্যার। খুব ভালো ছেলে।
কী করে বুঝলে খুব ভালো ছেলে?
আমি তাকে স্কুলজীবন থেকে দেখছি। ও খুব কষ্টে আছে। বিয়ে করে খুব ঝামেলায় পড়েছে।
চাকুর বাকরি নেই বিয়ে করে ফেলল? ও তো বোকা। বোকাদের সমস্যার সমাধান করতে নেই। বোকাদের সমস্যা নিজের ঘাড়ে নিলে কী হয় জান হাসান?
জ্বি না।
তখন নিজের সমস্যার সঙ্গে বোকার সমস্যাও যুক্ত হয়।
হাসান চুপ করে গেল। হিশামুদ্দিন বললেন, তোমার বন্ধুর নাম কী?
লিটন।
ভালো নাম কী?
হামিদুর রহমান।
পড়াশোনা কী?
এম. এ. পাস করেছে।
কত টাকা বেতনে চাকরি হলে তোমার বোকা বন্ধুর সমস্যার সমাধান হয়?
মাসে হাজার পাঁচেক টাকা পেলেই ওরা মহাখুশি হবে। একটা কিছু পেলেই হয় স্যার।
তুমি একটা কাগজে তার নাম-ঠিকানা লিখে মোতালেবের কাছে দিয়ে যাও।
স্যার। থ্যাংক য়্যু।
হাসান লক্ষ করল হিশামুদিন সাহেব হাসছেন। এই মানুষটাকে সে খুব কম হাসতে দেখেছে। উনি হাসছেন কেন?
হাসান!
জ্বি স্যার।
তুমি বরং আজ যাও। এখন আবার কেন জানি মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
স্যার আমি কাল এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
কাল এসে খোঁজ নিতে হবে না। তোমার সঙ্গে যেমন কথা আছে তেমনি আসবে বুধবার বিকেল তিনটায়।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
পরের বুধবার বিকাল তিনটায় এসে হাসান জানতে পারল, হিশামুদিন সাহেব আজ দুপুরের আগে মারা গেছেন।
বাড়িভর্তি মানুষ। কম্পাউন্ডের ভেতরে এবং বাইরে প্রচুর মানুষ। হাসান গেট থেকেই বিদেয় হলো। একবার মুহুর্তের জন্যে তার ইচ্ছা হলো সে চিত্ৰলেখার সঙ্গে দেখা করে–সাত্ত্বনার দুটা কথা বলে। পর মুহূর্তেই মনে হলো সান্ত্ৰনার কথা সে জানে না। এবং চিত্ৰলেখার মতো মেয়েদের সান্ত্বনার দরকার নেই।
রেজিস্ট্রি করা চিঠি
রেজিস্ট্রি করা চিঠি।
লিটন সই করে চিঠি নিল। রেজিষ্ট্র চিঠি তাকে কে পাঠাবে? সাধারণ চিঠিই আসে। না। আর রেজিস্ট্রি চিঠি। ইংরেজিতে টাইপ করে তার নাম লেখা।
হামিদুর রহমান। নিজের নাম অথচ অপরিচিত লাগছে। ভালো নামটা সে ভুলতে বসেছে। চিঠি এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে। এটিও অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জেনারেল ম্যানেজার মাহিটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। কে আছে সেখানে? বন্ধুবান্ধবদের কেউ। ভাগ্যবানদের একজন। বিদেশে চাকুরি করছে। তার সুখ ও আনন্দ পুরনো বন্ধুকে জানাতে চাচ্ছে। সে এই মেসের ঠিকানা জানল। কী করে?
পিয়ন দাঁড়িয়ে আছে। লিটন বলল, কী ব্যাপার?
স্যার বকশিশ।
লিটন বিস্মিত হয়ে বলল, বিকশিশ কেন? সে কি এতই হতভাগ্য যে বিদেশ থেকে একটা চিঠি আসার জন্যে বকশিশ দিতে হবে?
যান ভাই বিকশিশ-টকশিশ নেই।
পিয়ন বিমর্ষমুখে চলে যাচ্ছে। টাকা থাকলে পাঁচটা টাকা দিয়ে দেয়া যেত। টাকা নেই।
লিটন খিচুড়ি বসিয়ে দিল। চালডালের খিচুড়ি। আনাজপাতি থাকলে দিয়ে দেয়া যেত। কিছু নেই। চিঠিটা বিছানায় পড়ে আছে। থাকুক পড়ে। বন্ধুর চিঠি পড়ার কোনো আগ্রহ এই মুহুর্তে সে অনুভব করছে না। তার মনটা খুব খারাপ। শম্পার শরীর ভালো না। গা দিয়ে গুটির মতো বের হয়েছে। সম্ভবত হাম। বড়দের হাম হওয়া খুব কষ্টের। বেচারি কষ্টের মধ্যে পড়েছে–অথচ সে কিছু করতে পারছে না। সে রোজই সন্ধ্যার পর যাচ্ছে। দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত থেকে চলে আসছে। তাকে ভদ্রতা করেও কেউ বলছে না–জামাই আজ থেকে যাও। শম্পাকে এখনো ডাক্তার পর্যন্ত দেখানো হয় নি। এমন কষ্টে মানুষ পড়ে?
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর লিটন চিঠি খুলে পড়ল। জন স্মিথ জুনিয়ার নামের এক ভদ্রলোক তাকে জানাচ্ছেন যে, মাহিটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সিঙ্গাপুর শাখার একজিকিউটিভ অফিসার প্রোডাকশান শাখায় তাকে নিয়োগপত্র দেয়া হচ্ছে। তিন বৎসর মেয়াদি এই নিয়োগ। পরবতী এক্সটেনশন কোম্পানি শর্তে আলোচনাসাপেক্ষ। মাসিক বেতন সাত হাজার সিঙ্গপুরি ডলার। ফ্রি ফার্নিশড কোয়ার্টার। ফ্রি মেডিকেল। তাকে অতি দ্রুত সিঙ্গাপুর অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। ঢাকায় মতিঝিলে কোম্পানির একটা অস্থায়ী অফিসের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। এই ঠিকানায় যোগাযোগ করলে তারা তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে।
এর মানে কী? কেউ কি রসিকতা করছে? এপ্ৰিল ফুল জাতীয় কিছু? কিংবা কোনো দুষ্ট লোক টাকা কামানোর ফন্দি করছে। সব অভাবি যুবকদের এই জাতীয় চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হবে। মতিঝিল অফিসে ছুটে যাবে। সেই অফিসের একজন বলবে–আমরা সব খবরাখবর আনিয়ে দিচ্ছি। তার খরচ বাবদ এক শ ডলার লাগবে। আমাদের অফিসে একটা ফরম ফিলাপ করতে হবে। ফরমের দাম তিন ডলার। সাত দিনে রমরমা ব্যবসার পর কোম্পানি ডুব মারবে।
আরেকটা ব্যাপার হতে পারে। হয়তো তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কোনো চিঠিই তার নামে আসে নি। পুরোটাই সে কল্পনায় দেখছে।
মতিঝিলের যে অফিসের ঠিকানা আছে সেখানে গিয়ে খোঁজ নেয়া যায়। কয়টা বাজে। অফিস কি বন্ধ হয়ে গেছে না খোলা? চারটা পর্যন্ত খোলা থাকলে অফিসে পৌঁছানো যাবে। কারণ তাকে যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। লিটন কাপড় পরল।
অফিস খোলাই ছিল। বয়স্ক একজন ভদ্রলোক তার ঘর বন্ধ করে চলে যাচ্ছিলেনলিটন তার চিঠিটা ভদ্রলোকের হাতে দিল। তিনি চিঠি খুলেই বললেন–ও আপনি। আপনার নামে ফ্যাক্স এসেছে আমাদের কাছে। আমাদের কাছ থেকে কী ধরনের অ্যাসিসট্যান্স চাচ্ছেন?
লিটন কী বলবে বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোক বললেন, আপনার হাতে তো এখনো দিন পনের সময় আছে। এর মধ্যে গোছগাছ করে নিন।
লিটন অস্পষ্ট গলায় বলল, ও আচ্ছা।
আপনার টিকিট সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে–পি.টি.এ। আমরা আনিয়ে রাখব। লিটন আবার বলল, জি আচ্ছা। কেন সে জ্বি আচ্ছা বলছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না।
কাল তো অফিস ছুটি আপনি পরশু সকালের দিকে চলে আসুন। লিটন আবার বলল, জ্বি আচ্ছা।
আপনার ভাগ্য খুব ভালো। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। পৃথিবী জুড়ে এদের শাখা। লিটন ক্ষীণ গলায় বলল, চাকরিটা কি সত্যি পেয়েছি?
ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকালেন। লিটন কুষ্ঠিত মুখে বলল, ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
ভদ্ৰলোক হেসে ফেললেন।
পরশু আসুন। বিশ্বাস না হবার কী আছে। আপনার হাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। এইসব কোম্পানি যে শুধু শুধু চাকরি দিচ্ছে তা তো না। বাংলাদেশে তারা কোটি কোটি টাকার কাজ করছে। এইসব কাজের একটা শর্ত আছে–এ দেশের কিছু ছেলেমেয়েকে চাকরি দিতে হবে। এইসব শর্ত তারা মানে না। কালেভদ্রে মানে। আপনার স্ট্রং রিকমন্ডেশন–আপনি পেয়ে গেছেন।
পরশু অ্যাসব?
জ্বি পরশু আসুন। আপনার পাসপোর্ট আছে তো?
লিটনের পাসপোর্ট আছে। সেই পাসপোর্টে কি কাজ হবে? সেখানে মালয়েশিয়ার একটা মিথ্যা মিথ্যা ভিসা আছে।
পাসপোর্ট না থাকলে অসুবিধা নেই। চব্বিশ ঘণ্টায় পাসপোর্ট পাওয়া যায়। সিঙ্গাপুরে আপনি একা যাবেন না। ফ্যামিলি নিয়ে যাবেন?
ফ্যামিলি নিয়ে যাব।
সব পার্টিকুলারস নিয়ে আসবেন। ফ্যাক্স করে দেব। কোনো সমস্যা হবে না।
জ্বি আচ্ছা। লিটন রাত ন’টা পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় হাঁটল। সব কেমন অদ্ভুত লাগছে। শম্পাকে কি ব্যাপারটা জানানো উচিত না? উঁহুঁ–উচিত হবে না। পরে দেখা যাবে মালয়েশিয়ার ভিসার মতো ফলস অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। পরশুর আগে কিছু জানা যাবে না। বেছে বেছে কালই কিনা ছুটি পড়ে গেল?
আচ্ছা পুরো ব্যাপারটা তো সত্যি হতেও পারে! সে কত অসংখ্য মানুষকে চাকরির কথা বলেছে তাদের কেউ একজন দয়াপরবশ হয়ে সুপারিশ করেছে। পুরোটাই ভাগ্য। কথায় আছে না–পাথরচাপা ভাগ্য। তারটাও তাই ছিল। হঠাৎ পাথর সরে গেছে। হাসানের সঙ্গে কথা বললে হয়। ওকে চিঠিটা দেখানো যেতে পারে। না তাও ঠিক হবে না। হাসান মন খারাপ করবে। বেচারার মন খারাপ করিয়ে কোনো দরকার নেই।
আজ সারারাত রাস্তায় হাঁটলে কেমন হয়?
পকেটের চিঠিটার একটা ফটোকপি করিয়ে রাখা দরকার। যদি হারিয়ে যায়। একটা না কয়েকটা ফটোকপি করানো দরকার।
পুরো ব্যাপারটা সত্যি হলে সামনে বিরাট ঝামেলা। শম্পার পাসপোর্ট কাপড়চোপড় বানানো।
সিঙ্গাপুর দেশটা কেমন? শীতকালে বরফ পড়ে? বরফ পড়া দেখার তার খুব শখ ছিল এই শখটা বোধহয় এবার মিটবে।
লিটন চায়ের স্টলে ঢুকল। তার পকেটে একটি টাকাও নেই। না থাকুক-এক কাপ চা খেয়ে সে যদি বলে, ভাই ভুলে মানিব্যাগ ফেলে এসেছি আপনাকে কাল টাকাটা দিয়ে যাব তাহলে দোকানদার নিশ্চয়ই তাকে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেবে না। মানুষ এখনো এতটা নিচে নামে নি। মানুষের মনে মমতা, করুণা, দয়া এখনো আছে।
চা খেয়ে সে যাবে আজমপুর গোরস্থানে। বাবার কবর জিয়ারত করবে। কতদিন হয়েছে যাওয়া হয় না। কবরের চিহ্ন এখন আর নিশ্চয়ই নেই। না থাকুক।
লিটন চায়ে চুমুক দিচ্ছে। এরা তো চা খুব ভালো বানায়। অপূর্ব লাগছে। আরেক কাপ চা কি খাবে? এক কাপ চায়ের দাম বাকি রাখা আর দু কাপের দাম বাকি রাখা তো একই ব্যাপার।
কর্মহীন লোক
কর্মহীন লোক নানান কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। মতিনউদিনের বেলায় এই কথাটি সর্বাংশে সত্য। তিনি নানা কাজে প্রায়ই ব্যতিব্যস্ত থাকেন। তাকে দেখে মনে হতে পারে–এমন কাজের একজন মানুষ নিজের সংসার কোন চালাতে পারছেন না। তার অনেক কর্মকাণ্ডের একটি হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়ে নিয়ে প্ৰবন্ধ রচনা। তিনি তার প্ৰবন্ধগুলো দেশের সবকটি দৈনিকে নিয়মিত পাঠান। এখন পর্যন্ত তার কোনো প্ৰবন্ধ প্রকাশিত হয় নি। তবে সম্পাদকের কাছে লেখা দুটি চিঠি ছাপা হয়েছে। একটি দৈনিক বাংলায় এবং একটি সংবাদে। তিনি পত্রিকার কাটিং ফাইল বের করে রেখেছেন।
আজো তিনি খুব ব্যস্ত। একটি দীর্ঘ প্ৰবন্ধ শুরু করেছেন। এটি রাজনৈতিক প্ৰবন্ধ নয়। তবে শিক্ষামূলক প্রবন্ধ, প্রবন্ধের নাম–‘নারী জাগরণের প্রয়োজনীয়তা ও অপ্ৰয়োজনীয়তা’।
শিরোনামটি তার খাতার ওপর লেখা। প্ৰবন্ধ শেষ হবার পর ঠিক করবেন কোন শিরোনামটা শেষ পর্যন্ত যাবে। বাকি তিনটি শিরোনাম হলো–
১. আমার চক্ষে নারী।
২. বেগম রোকেয়া থেকে মাদার তেরেসা।
৩. হে নারী।
এখন রাত বাজছে সাড় আটটা। টিভিতে বাংলা খবর শেষ হয়ে গেছে। নৃত্যের তালে তালে’ নামের নাচের একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। মতিনউদ্দিন টিভির সামনেই বসে আছেন। তবে টিভি দেখছেন না বা শুনছেনও না। টিভির সাউন্ড অফ করে দেয়া আছে।
টিভির বাংলা সংবাদ মতিনউদ্দিন সাহেব সব সময় শোনেন। কর্মহীন লোকরা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকতে ভালোবাসে এবং এটাকে তার প্ৰধান দায়িত্বের একটি বলে মনে করে। মতিনউদ্দিন সাহেব শুধু যে টিভির সংবাদ শোনেন তা না, বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাও শোনেন। আগে রেডিও পিকিঙের এক্সটারনাল সার্ভিস শুনতেন। ইদানীং শোনেন না, কারণ তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে খবর দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
বেছে বেছে আজকের দিনটাতেই মতিনউদ্দিন টিভির খবর শুনলেন না। নারী বিষয়ক প্ৰবন্ধে অতিরিক্ত মনোযোগ দেবার কারণে এই ঘটনাটা ঘটল। আজ টিভি শুনলে তিনি বড় রকমের বিস্ময়ে অভিভূত হতেন। কারণ আজ এস.এস.সি.র রেজাল্ট হয়েছে। টিভিতে তার মেজো কন্যা নাদিয়া মেহজাবিন-এর নাম বলা হয়েছে। আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় থেকে নাদিয়া মেহজাবিন আটটি লেটার নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ছেলে ও মেয়ে সবার মধ্যে প্রথম হয়েছে।
রাত দশটায় সুরাইয়া স্বামীর ঘরে ঢুকলেন। মতিনউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, এখন ভাত খাব না। তোমরা খেয়ে নাও। আমি যখন লেখালেখির কোনো কাজে ব্যস্ত থাকি তখন আমাকে খাওয়াদাওয়ার মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত করবে না। এই কথাটা কতবার বলতে হবে?
সুরাইয়া বললেন, আজ এস.এস.সি’র রেজাল্ট হয়েছে। আটটার বাংলা সংবাদে বলেছে।
মতিনউদ্দিন স্ত্রীর কথার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁপানির শব্দ শুনলেন। তাকিয়ে দেখলেন দরজা ধরে নাদিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সে ফোঁপাচ্ছে এবং তার চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে। মেয়েদের চরিত্রের এই দুর্বলতায় তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। মাত্র টিভিতে রেজাল্ট ডিক্লেয়ার করেছে। পাস-ফেল জানতে জানতে আরো দুদিন–এর মধ্যেই নাকের জলে চোখের জলে একাকার। তার রাগ উঠে গেল। তিনি প্রবন্ধের স্বার্থে রাগ সামলাবার চেষ্টা করলেন। মাথায় রাগ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী জটিল প্ৰবন্ধ লেখা যায় না। মতিনউদ্দিন গাখীর গলায় বললেন–গাধা মেয়ে কাঁদছ কেন?
সুরাইয়া নিজেও কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–তোমার মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে। আটটা লেটার পেয়েছে।
কী বললে?
ওদের ক্লাসের হেডমিস্ট্রেস এসেছেন। মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। স্কুল থেকে দুজন টিচারও এসেছেন।
নাদিয়া ফার্স্ট হয়েছে? কী বলছি। এইসব! সে ফার্স্ট হবে কী জন্যে?
সুরাইয়া এইবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে বললেন–আমার বিশ্বাস হয় না। তুমি নিজে একটু নাদিয়ার হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে কথা বল। আমার মাথা যেন কেমন করছে।
উনাদের চা-টা দাও। আমি যাচ্ছি। ফলস নিউজ হতে পারে। হয়তো নাদিয়ার নামে নাম একটা মেয়ে ফার্স্ট হয়েছে বেকুব হেডমিসট্রেস মনে করেছে তোমার মেয়ে।
টিভিতে ওদের স্কুলেরও নাম বলেছে।
বাংলাদেশ টিভির নিউজের কোনো মূল্য আছে? মূল্য থাকলে আমরা ব্যাটারি পুড়িয়ে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা শুনি? পাঞ্জাবিটাতে ইন্ত্রি দিয়ে দুটা ডলা দিয়ে দাও-আমি দেখছি ব্যাপার কী? অল্পতে অস্থির হয়ে না। অস্থির হবার মতো কিছু নাই। বোঝাই যাচ্ছে ফলিস নিউজ।
রাত এগারটার ভেতর মতিনউদ্দিন জেনে গেলেন ঘটনা সত্যি। মিষ্টি নিয়ে নাদিয়ার বড়ফুফু চলে এসেছেন। নাদিয়ার স্কুলের কিছু বান্ধবী এসেছে। আশপাশের বাসার কিছু মহিলা এসেছেন। সবকটা পত্রিকা অফিস থেকে লোক এসেছে। বাবা-মা দুপাশে মেয়ে মাঝখানে এইভাবে ছবি তোলা হবে। মতিনউদ্দিন রাজি হলেন না। তিনি বিনীত গলায় বললেন, ভাই আমি আমার মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কিছুই জানি না। ওদের দিকে কোনোদিন লক্ষ করি নি। আজ যদি মেয়েকে সাথে নিয়ে ছবি তুলে পত্রিকায় ছাপাতে দেই সেটা খুবই অন্যায় হবে। মেয়ে তার মাকে নিয়ে ছবি তুলুক। সেটাই হবে ঠিক এবং শোভন। মতিন সাহেব কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হলেন। মেয়ের জন্যে কোনো একটা উপহার। কিনতে ইচ্ছে করছে। এত রাতে দোকানপাট সব বন্ধ থাকার কথা। তারপরেও চেষ্টা করে দেখা। কিছু কিছু দোকান অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। একটা ভালো হাতঘড়ি কি পাওয়া যাবে? মেয়েটা ঘড়ি ছাড়া পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ পর্যায়ে তিনি ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন। পরীক্ষার জন্যে ঘড়িটা প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু এই মেয়ে মুখফুটে তা বলে নি। ভালো একটা ঘড়ির কত দােম পড়বে কে জানে। তার কাছে এত টাকা নেই। টাকা। যা ছিল সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ছ সাত শ’র বেশি হবে না। এই টাকায় ভালো ঘড়ি হবে না। একটা কলম কিনে দেয়া যায়। কলামটা নিশ্চয়ই সে খুব যত্ন করে রাখবে। তার ছেলেমেয়েরা যখন বড় হবে তখন তাদের সে কলমটাি দেখিয়ে বলবে–আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন। যেদিন আমার এস.এস.সি’র রেজাল্ট হলো সেই রাতে বাবা কিনে নিয়ে এসেছেন।
শাড়ি কাপড়ের একটা দোকান খোলা পাওয়া গেল। মতিনউদ্দিন মেয়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনে ফেললেন। সাড়ে ছয় শ টাকা দাম। হাফসিল্ক। শাড়ির রঙ গাঢ় কমলা। রঙটা মতিনউদ্দিনের খুব পছন্দ হলো। তিনি ইতস্তত করে দোকানিকে বললেন, আমার মেয়ে শ্যামলা এই শাড়িটাতে তাকে মানাবে তো?
দোকানি শাড়ি প্যাক করতে করতে বলল, একটা পেত্নীকে যদি এই শাড়ি পড়িয়ে দেন তাকে লাগবে রাজকুমারীর মতো।
আরো দশটা দোকান দেখেশুনে কিনতে পারতাম। কিন্তু জিনিসটা আজই দরকার। আমার মেয়ের জন্য উপহার। ওর এস.এস.সি’র রেজাল্ট হয়েছে। ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। বিজ্ঞান গ্রুপ। লেটার পেয়েছে আটটা। কাল সব পত্রিকায় তার ছবি দেখবেন। নাম হলো নাদিয়া মেহজাবিন। মেহজাবিন শব্দের অর্থ হলো চাঁদকপালী। আরবিতে মে হচ্ছে চন্দ্র। জাবিন হলো কপাল। আসলেই আমার মেয়েটা চাঁদকপালী।
দোকানদার সত্যিকার অর্থেই বিস্মিত হলো।
আপনার মেয়ে?
জ্বি ভাইসাহেব, আমার মেজো কন্যা। নাদিয়া মেহজাবিন।
দোকানদার ড্রয়ার খুলে এক শ টাকা ফেরত দিল। শাড়ির দাম পড়ল সাড়ে পাঁচ শ।
মতিনউদ্দিন দোকানদারের ভদ্রতায় মোহিত হলেন। তার চোখে পানি এসে গেল।
ঘরে অনেকরকম খাবার ছিল। নাদিয়ার ফুফু, হোটেল থেকে রোস্ট, পোলাও আনিয়েছেন। মতিনউদ্দিন কিছুই খেতে পারলেন না।–যাই খান ঘাসের মতো লাগে। তার খুবই ইচ্ছা ছিল মেয়ের সঙ্গে খানিক গল্পগুজব করেন। তাও করতে পারলেন না। মেয়ে তার সামনেই আসে না। নিজ থেকে মেয়েকে ডেকে গল্প করা তার স্বভাববিরুদ্ধ।
রাতে যথাসময়ে শুতে গেলেন। সুরমা বললেন, তিনি আজ নাদিয়ার সঙ্গে ঘুমোবেন। এটা তার মনঃকষ্টের কারণ হলো। তিনি ভেবেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে শুয়ে শুয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবেন—তা হলো না। না হলে কী আর করা।
মেয়ের শাড়ি কি পছন্দ হয়েছে?
হয়েছে বোধহয় কিছু তো বলল না।
নতুন শাড়ি পরে সালাম করল না। শুধু পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে হবে না। আদব কায়দা তো শিখতে হবে। ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া কঠিন কিছু না–আদব কায়দায় দূরস্ত হওয়া কঠিন।
শাড়ি পরতে বলেছিলাম, তার নাকি লজ্জা লাগবে। পরে আসতে বলব?
না থাক। যন্ত্রণা ভালো লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে।
মতিনউদ্দিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তিনি নিশ্চিত আজ রাতে তার এক ফোঁটা ঘুম হবে না। বুকও কেমন যেন ধড়ফড় করছে। হাট অ্যাটার্ক ট্যাটাক হবে না। তো। হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরে থাকলেও কেউ কিছু টের পাবে না। এটা হচ্ছে কপাল। সংসার থেকেও সন্ন্যাসী। মতিনউদ্দিন তার প্রবন্ধ নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন। মাথায় কিছু আসছে না। চিন্তা ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে গেছে। নজরুলের সেই কবিতাটা যেন কী? বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। কবিতাটা ঠিক না। বেশিরভাগই নারী করে–পুরুষ করে সামান্যই। তাকে দিয়েই এর প্রমাণ। তিনি কিছুই করতে পারেন নি। মতিনউদিনের পানির পিপাসা পেয়ে গেল। তিনি বাতি জ্বালালেন-ঘরে আজ পানি রাখা হয় নি। ভুলে গেছে। পানির জন্যে যেতে হবে রান্নাঘরে। তিনি দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলেন। নাদিয়ার ঘরে বাতি জ্বলছে। মা-মেয়ের হাসি শোনা যাচ্ছে। এই হাসিতে তিনি যুক্ত হতে পারছেন না। আশ্চর্য। আচ্ছা তিতলীকে কি খবরটা দেয়া হয়েছে? তার শ্বশুরবাড়িতে কেউ কি একটা টেলিফোন করে নি। করে নি নিশ্চয়ই–করলে ওরা চলে আসত। খবর না দেয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। তিতলীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভোরবেলা খবরের কাগজ পড়ে সংবাদ জানবে। এর আনন্দও তো কম না। মতিনউদ্দিন পরপর দু গ্লাস পানি খেলেন তার পিপাসা মিটাল না। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যতই পানি খাচ্ছেন–পিপাসা ততই বাড়ছে। তিনি আরেক গ্লাস পানি হাতে বারান্দায় এসে বসলেন। ঘুম যখন হবেই নাবারান্দায় বসে থাকা যাক। আবারো নাদিয়ার হাসি শোনা যাচ্ছে। মা-মেয়ে কী নিয়ে এত হাসােহাসি করছে? দরজায় টোকা দিয়ে তাদের কি বলবেন–এই তোমরা বাইরে চলে আস। সবাই মিলে একসঙ্গে গল্প করি। না থাক। তারা আসবে, মুখ গন্তীর করে বসে থাকবে এরচে’ মা-মেয়ে গল্প করুক। সুরাইয়ার জন্যে একটা শাড়ি কিনে আনলে হতো। কাগজে লিখে দিতেন–মাতা শ্রেষ্ঠাকে সামান্য উপহার। ইতি মতিনউদ্দিন। না সেটাও ঠিক হতো না। বাড়াবাড়ি হতো। তারচে’ বরং মনে মনে নারী জাগরণ বিষয়ক প্ৰবন্ধটার খসড়া করে ফেলা যাক। শুরুটা ইন্টারেস্টিং হওয়া দরকার। পড়তে গিয়ে পাঠক ভাববে গল্প পড়ছে। গল্পের লোভ দেখিয়ে তাকে জটিল প্ৰবন্ধে ঢুকিয়ে দেয়া হবে–শুরুটা এ রকম করলে কেমন হয়–
ঘুঘু ডাকা ছায়া ঢাকা ছোট্ট সুন্দর সবুজ গ্রাম। গ্রামের নাম পায়রাবন্দ। সেই গ্রামের একটি শিশু তার নাম রোকেয়া…
নাদিয়ার ঘর থেকে আবার হাসির শব্দ আসছে। মতিনউদ্দিন উঁচু গলায় বললেন, তোমরা একটু আস্তে হাসাহাসি কর, মানুষকে ঘুমোতে দেবে না।
হাসির শব্দ থেমে গেল। মতিন সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। হাসাহসির করছিল করত। তিনি কেন ধমক দিলেন। সারাজীবন তিনি কি শুধু ভুলই করে যাবেন! তার চোখে পানি এসে গেল। কেউ সেই পানি দেখল না।
শওকতের অভ্যাস হচ্ছে ভোরবেলা দুটা খবরের কাগজ নিয়ে চা খেতে বাসা। নাশতাটা জরুরি না, খবরের কাগজ পড়াটা জরুরি। তিতলী সেই সময় তার সামনেই থাকে। তবে সে নাশতা খায় না। সঙ্গ দেবার জন্যে যে বসে তাও না। নিজ থেকে একটি কথাও বলে না। শওকত কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়। সেই জবাবও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মানুষের অভ্যস্ত ক্ষমতা অসাধারণ। শওকত মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
আজ শওকত খবরের কাগজ তিতলীর দিকে বাড়িয়ে দিল–বিস্মিত গলায় বলল, নাদিয়ার ছবি ছাপা হয়েছে।
তিতলী কিছু বলল না, সে তার চায়ের কাপে চা ঢালছে। তাকে কোনো প্রশ্ন করা হয় নি, কাজেই জবাব দেবার কিছু নেই।
শওকত বলল, কী ব্যাপার, তুমি এই খবর পেয়েছ?
পয়েছি।
কখন পেয়েছ?
কাল রাতে।
রাতে মানে ক’টার সময়?
এগারটার সময়। নাদিয়া টেলিফোন করেছিল।
আমি তো তখন বাড়িতেই ছিলাম। আমাকে কিছু বল নি কেন?
বলার কী আছে?
এত বড় একটা খবর তুমি আমাকে জানাবে না?
এখন তো জানলেই।
তার মানে কি এই দাঁড়াচ্ছে–তুমি নিজ থেকে আমাকে কিছু বলবে না?
তিতলী জবাব দিল না, চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। শওকত বিরক্ত মুখে বলল, তুমি যা করছি তা যে ছেলেমানুষ তা কি বুঝতে পারছি?
তিতলী এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। শওকত ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যা করছ তা হচ্ছে হাস্যকর ছেলেমানুষ। যখন ছেলেমানুষিটা শুরু করেছিলে আমি তোমাকে বাধা দেই নি। আমার ধারণা ছিল বাধা দিলে এটা আরো বাড়বে। আমি ভেবেছি সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দেখছি হচ্ছে না।
এখন কী করবে?
শোন তিতলী! আমার ধৈর্য অপরিসীম। আমি তোমাকে আরো সময় দেব। দু’বছর, তিন বছর, চার বছর…কোনো অসুবিধা নেই। আমি দেখতে চাই এক সময় তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ।
যদি কোনোদিনই ভুল বুঝতে না পারি?
তুমি তো বোকা মেয়ে না। বুদ্ধিমতী মেয়ে–আমি নিশ্চিত তুমি ভুল বুঝতে পারবে। তখন আমরা জীবন শুরু করব। সে জীবন অবশ্যই আনন্দময় হবে।
আনন্দময় হলেই তো ভালো।
ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার কি এর মধ্যে দেখা হয়েছে?
না।
টেলিফোনে কথা হয়েছে?
না।
শোন তিতলী আমি চাচ্ছি ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার দেখা হোক, কথা হোক।
কেন চাচ্ছ?
আমার ধারণা ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার যদি দু-একবার দেখা হয়–তুমি তোমার ভুল দ্রুত বুঝতে পারবে। এক কাজ করা যাক-আমি ভদ্রলোককে বাসায় একদিন খেতে বলি।
কোনো প্ৰয়োজন নেই।
তোমার অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। আমি তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করবো।
তিতলী চুপ করে আছে। তার দৃষ্টি চায়ের কাপের দিকে।
শওকত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তিতলী ঠিক তার সামনে বসা। নতুন বউরা শ্বশুরবাড়িতে এসে শুরুর কিছু দিন ঘোমটা দিয়ে থাকে। তার মাথায়ও ঘোমটা। লালপাড়ের কালো শাড়িতে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দেবী প্রতিমার মতো মেয়েটি চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। শওকত নিশ্চিত জানে এই শক্তমুখ একদিন কোমল হবে। সেই একদিনটা কবে এটাই সে জানে না।
তিতলী!
জ্বি।
আমি আশপাশে থাকলে তোমার কি অসহ্য লাগে?
না।
আমি আশপাশে থাকলে তোমার মুখ শক্ত হয়ে থাকে। এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি। নাদিয়াকে কনগ্রাচুলেট করতে যাবে না?
যাব।
আমি সঙ্গে গেলে কোনো অসুবিধা আছে?
অসুবিধা নেই–তবে আমি একাই যেতে চাই।
ব্যাপারটা খুব অশোভন হবে না? তুমি আমার সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করছ, সেটা ལ་ལས་ཀ་༢ বাড়ির কেউ জানে না। সবাই জানে আমরা খুব সুখে আছি। আনন্দে
সেটা জানাই তো ভালো।
তাদের জন্যে ভালো তো বটেই। তাদের সেই ভালোতে যেন খুঁত না থাকে সেই চেষ্টা তো আমাদের করা উচিত। তোমার পক্ষ থেকে কিছু অভিনয় দরকার। কাজেই হাসিমুখে আমার সঙ্গে চল।
আচ্ছা।
আরেকটা কথা। তুমি তো জানই আমি পি.এইচডি করতে বাইরে যাচ্ছি। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?
সেটা তোমার ইচ্ছা।
অর্থাৎ তোমার নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই।
না।
সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তোমার না যাওয়াই ভালো। এখানে থাকতে পার বা ইচ্ছে করলে তোমার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পার।
আমি এখানেই থাকব।
বেশ তো থাকবে। যদি এর মধ্যে তোমার ইচ্ছা করে আমার কাছে যেতে-চিঠি দিলেই আমি টিকিট পাঠাব। তুমি চলে আসবে।
আচ্ছা।
তোমার সব কথাই তো এ পর্যন্ত শুনে আসছি–এখন তুমি কি আমার একটা কথা শুনবে? কথাটা হচ্ছে–চল আমার সঙ্গে দুজন মিলে কোনো সুন্দর জায়গা থেকে ঘুরে আসি। যেমন ধর নেপাল। সুন্দর দৃশ্যের পাশে থাকলে মন সুন্দর হয়। পুরনো অসুন্দর ধুয়ে মুছে যায়। যাবে?
তুমি বললে যাব।
ভেরি গুড।
তোমার নাশতা খাওয়া তো হয়েছে। আমি কি এখন উঠতে পারি?
শওকত ক্লান্ত গলায় বলল, পার। তার মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে। সে অনেক চেষ্টা করেও মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে সমস্যাটা সামলাতে পারছে। না। ভবিষ্যতেও পারবে কি না বুঝতে পারছে না।
হাসান নামের ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তার কি দেখা করা উচিত? তার সমস্যা মেটানোর জন্য ভদ্রলোকের সাহায্য প্রার্থনা করাটা কি ঠিক হবে? ভদ্রলোক কি সাহায্য করবেন? মনে হয় করবেন। যে-কোনো বিবেকবান মানুষেরই সাহায্য করা উচিত।
তিতলীকে না জানিয়ে ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলে হয়। সহজ স্বাভাবিকভাবে সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করা হবে। ক্ষতি কী?
তিতলী! তিতলী!
তিতলী এসে দাঁড়াল। কিছু বলল না। শওকত বলল, আচ্ছা যাও। এমনি ডেকেছিলাম। ও আচ্ছা শোন, নাদিয়ার ইন্টারভ্যুটা পড়েছ?
না।
পড় নি কেন? নাকি প্ৰতিজ্ঞা করেছ। আমার কেনা খবরের কাগজও পড়বে না?
আমি কোনো প্ৰতিজ্ঞা করি নি।
পড়ে দেখ। ভালো লাগবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তোমার প্রিয় মানুষ কে?
সে তোমার নাম বলেছে।
ও আচ্ছা।
তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তিতলী!
থ্যাংক য়্যু।
তুমি কি আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ রাখবে? খুব ছোট্ট অনুরোধ?
কী অনুরোধ?
হাসলে তোমাকে কেমন দেখায় আমি জানি না। একটু হাস আমি দেখি। এত বড় খুশির একটা খবর পেয়েছ। এমনিতেই তো হাসা উচিত।
উচিত কাজ কি মানুষ সব সময় করতে পার?
না, উচিত কাজ মানুষ সব সময় করতে পারে না। মানুষ বরং অনুচিত কাজটাই সব সময় করে। আমাকে বিয়ে করাটা ছিল খুবই অনুচিত কাজ সেই কাজটা তুমি করেছি। বিয়ের পর পুরনো সমস্যা ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হওয়াটা ছিল উচিত কাজতুমি করছি উল্টোটা। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাস কথা বলি।
তিতলী বসল।
শওকত ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো। তুমি কি আমার কাছ থেকে মুক্তি চাও? চুপ করে থেকে না, বল হ্যাঁ বা না।
মুক্তি চাইলে পাব?
তিতলী তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পড়ছে না। শওকত চুপ করে রইল। তিতলীর প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। সম্ভবত জবাব তার জানা নেই।
ইংরেজিতে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি
ইংরেজিতে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি। যার বঙ্গানুবাদ মোটামুটি এ রকম–
প্রিয় হাসান সাহেব,
আশা করি ভালো আছেন। আমার বাবা গত মাসের ৯ তারিখে মাইয়োকাড্রিয়েল ইনফেকশনে মারা গেছেন। তাঁর জীবনের অংশবিশেষ যা আপনি লিখেছেন তা আমাকে দিয়ে গেলে বাধিত হব। আপনি আপনার জনৈক বন্ধুর জন্যে বাবার কাছে চাকুরি চেয়েছিলেন। তিনি সে ব্যবস্থা করে গেছেন। আশা করি ইতিমধ্যে আপনার বন্ধু সে খবর জানেন। আপনি ভালো আছেন তো?
বিনীতা
চিত্রলেখা
অফিস অফিস গন্ধওয়ালা চিঠি। অফিস বস ডিকটেট করেছেন–পি.এ. ডিকটেশন নিয়ে চিঠি টাইপ করেছে। ফাইনাল কপি বাস পড়েছেন, দু-একটা বানান ঠিক করে নাম সই করেছেন। চিঠি চলে গেছে ডিসপ্যাঁচ সেকশনে। চিঠিতে নাম্বার বসিয়ে ডিসপাঁচ ক্লার্ক চিঠি পোষ্ট করে দিয়েছে। চিঠিতে আন্তরিক অংশ হচ্ছে গোটা গোটা অক্ষরে বাং লেখা আপনি ভালো আছেন তো? এটাকেও আন্তরিক ধরার কোনো কারণ নেই। অফিসিয়েল চিঠিকে ব্যক্তিগত ‘ফ্লেভার’ দেয়ার এটা একটা টেকনিক।
হাসান চিঠি পেয়েছে বিকেলে। সন্ধ্যা মিলাবার পরপরই ফাইল হাতে হিশামুদ্দিন সাহেবের বাড়ির গেটের সামনে উপস্থিত হলো। গেটের দুজন দারোয়ানই তাকে খুব ভালো করে চেনে–তারপূরেও তারা এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন তাকে তারা এই প্রথম দেখেছে। হাসান বলল, ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করব। উনি আছেন না?
দারোয়ানের একজন গম্ভীর গলায় বলল, ম্যাডাম বাড়িতে কারো সঙ্গে দেখা করেন না। আপনি অফিসে যাবেন।
দারোয়ানরা দর্শনপ্রাথীদের আটকে দিতে পারলে খুশি হয়। হাসান লক্ষ করল দারোয়ান দুজনেই মুখের তৃপ্তির ভাব।
উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ভেতরে খবর দিয়ে দেখুন। ইন্টারকম তো আছে।
আমাদের ওপর অর্ডার আছে কাউকে ঢুকতে না দেয়ার।
ও আচ্ছা। আমার কাছে ম্যাডামের কিছু জরুরি কাগজপত্র ছিল।
দারোয়ানদের একজন নিতান্ত অনিচ্ছায় ইন্টারকমের দিকে এগোচ্ছে। তার যেতে আসতে প্রচুর সময় লাগবে–হাসান সিগারেট ধরাল। সে অবাক হয়ে লক্ষ করল হিশামুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলার আগে বুকের ওপর সে যেমন চাপ অনুভব করত এখনো তাই করছে।
আপনি যান। সিগারেট ফেলে দিয়ে যান।
হাসান সিগারেট ফেলল। সিগারেট হাতে কাউকে ঢুকতে দেয়া যাবে না–এমন নির্দেশ কি আছে? দারোয়ানরা ক্ষমতাবানদের যেমন সম্মান দেখাতে ভালোবাসে তেমনি ক্ষমতাহীনদের অপমান করতেও ভালবাসে। গেটের সামনে চিত্ৰলেখা দাঁড়িয়ে থাকলে সে নিশ্চয়ই বলত না–সিগারেট ফেলে দিয়ে আসুন।
হাসান বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছে। কতক্ষণ হয়েছে? তার হাতে ঘড়ি নেই। বসার ঘরেও ঘড়ি নেই। সময় কতটা পার হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না, মনে হয়। অনেকক্ষণ হয়েছে। একা একা বসে থাকতে অদ্ভুত লাগছে। নীরব একটা বাড়ি। শব্দ নেই, হইচই নেই। টিভি চলছে না, কেউ হাঁটাহাঁটি করছে না। এ রকম শব্দহীন ঘরে মানুষ বাস করে কী করে। বাড়িতে নানান রকম শব্দ হবে–শিশুরা চিৎকার করবে–দাপাদাপি করবে। তাদের হাসি এবং কান্নার শব্দ ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাবে…
সরি হাসান সাহেব দেরি করে ফেলেছি। দেরিটা ইচ্ছাকৃত না। নিন চা নিন।
চিত্ৰলেখা নিজেই হাতে করে চায়ের কাপ এনেছে। তার এই ভদ্রতা দীর্ঘ অপেক্ষা এবং গেটের সামনের অপমান ভুলে যাওয়া যায়।
আপনি এসেছেন শোনার পর হট শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢুকেছিলাম। সারা দিন নানান জায়গায় ছোটাছুটি করেছি। গা ঘেমে ছিল। একা একা নিশ্চয়ই খুব বোর হচ্ছিলেন?
বোর হচ্ছিলাম না।
বাবার মৃত্যুর খবর জানতেন?
উনি যেদিন মারা গিয়েছিলেন আমি সেদিনই এসেছিলাম। উনার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আসিনি–এমনিতেই এসেছিলাম। বাড়ির সামনে প্রচুর গাড়ি দেখলাম। খবর শুনলাম–তারপর ভাবলাম আমার কিছু করার নেই। চলে গিয়েছি।
আপনি মানুষকে সান্ত্বনা দিতে পারেন না। তাই না?
জ্বি না।
বাবা আপনাকে খুব পছন্দ করতেন, উনাকে একবার শেষ দেখার ইচ্ছাও আপনার হয় নি?
জ্বি না। জীবিত অবস্থায় তাকে দেখেছি সেই স্মৃতিই আমি রাখতে চাই। মৃত মুখের স্মৃতি রাখতে চাই না।
এটা অবশ্য ভালোই বলেছেন। বাবার জীবনী লেখার কাগজগুলো কি এনেছেন?
জ্বি। ফাইলে সব গোছানো আছে। কিছু বানান ভুল থাকতে পারে। বাংলা বানানে আমি খুব কাঁচা।
এখানে ক’পৃষ্ঠা আছে?
পঞ্চাশ পৃষ্ঠার মতো। স্যার যখন যা বলেছেন আমি লিখেছি। সাজাই নি। আপনি যদি বলেন–সাজিয়ে দেব।
চিত্ৰলেখা হাসছে। হাসান বুঝতে পারছে না মেয়েটার হাসির কারণ কী। বাবার এই মেয়ে সামলে উঠেছে। সামলে না। উঠলেও তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার জীবনের ওপর এত বড় একটা ঝড় গেছে।
হাসান সাহেব।
জ্বি।
এই লেখাগুলো আপনি আমার সামনে বসে কুটি কুটি করে ছিঁড়ুন।
কী বলছেন বুঝতে পারছি না।
চিত্ৰলেখা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা নিজেই আমাকে বলে গেছেন কাগজগুলো যেন ছিঁড়ে ফেলা হয়। আপনাকে যা বলা হয়েছে–তা ঠিক না। ভুল বলা হযেছে। উইসফুল থিংকিঙের মতো উইসফুল পাস্ট বলে এটা ব্যাপার আছে। বাবা তাই করেছেন।
ও আচ্ছা।
তার বড় বোন পুষ্পের কথা আছে না? যিনি হঠাৎ মারা গেলেন। তিনি হঠাৎ মারা যান নি। বিষ খেয়েছিলেন। বিষ খাওয়া ছাড়া তার উপায়ও ছিল না। এই তরুণী মেয়েটিকে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যে কুৎসিত নোংরামির ভেতরে দিয়ে যেতে হয়েছিল। বাবার উচিত ছিল তার নিজের সংগ্রামের গল্প বলা। কী করে তিনি ধাপে ধাপে এতদূর উঠেছেন। এত শক্তি পেয়েছেন কোথায়? বাবা যে স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলের একজন শিক্ষক নজিবুর রহমান তাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। নিজে দরিদ্র মানুষ হয়েও বাবাকে কলেজে পড়ার খরচ দিয়েছেন। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি করিয়েছেন। এই অসাধারণ মানুষটির জন্যে বাবা কিছুই করেন নি। তিনি শেষ জীবনে খুব কষ্টে পড়েছিলেন, বাবা তাকে দেখতে পর্যন্ত যান নি।
চিত্ৰলেখা একটু থামতেই হাসান বলল, এইসব কথা বলতে আপনার বোধহয় খারাপ লাগছে। প্ৰসঙ্গটা থাক।
আমার বলতে খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। আমি মনে হয় বাবাকে একটু একটু বুঝতে পারছি। তার চরিত্রের একটা অদ্ভুত দিক কি জানেন? জীবনে বড় হবার জন্যে তিনি যাদের সাহায্য নিয়েছেন পরবর্তী সময়ে তাদের পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছেন। আবার কারো কারো প্ৰতি অকারণ মমতা পোষণ করেছেন। যেমন ধরুন আপনি। কারোর কথায় বা কারোর সুপারিশে বাবা কাউকে চাকরি দিয়েছেন বা চাকরির যোগাড় করেছেন এমন নজির নেই। কিন্তু আপনার ব্যাপারে ভিন্ন ব্যবস্থা হলো। তাৎক্ষণিকভাবে বাবা সব ঠিকঠাক করলেন। আপনার বন্ধু নিশ্চয়ই খুব খুশি?
জ্বি খুবই খুশি।
উনি কি সিঙ্গাপুর চলে গিয়েছেন?
জ্বি।
আপনার প্রতি নিশ্চয়ই তিনি খুব কৃতজ্ঞ। তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গিটা কী একটু বলুন তো শুনি। তিনি কী করলেন? আপনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন?
ও আমার ভূমিকাটা জানে না। ওকে কিছু বলি নি।
কিছুই বলেন নি?
জ্বি না।
বলেন নি কেন?
বলতে ইচ্ছা করে নি।
চিত্ৰলেখা তাকিয়ে আছে। তার চোখে কৌতুক ঝিলমিল করছে। মনে হচ্ছে হাসানের এই ব্যাপারটায় সে খুব মজা পাচ্ছে।
হাসান সাহেব।
জ্বি।
লোকচরিত্র বোঝার ব্যাপারে বাবার ক্ষমতা ছিল অসীম। আমার ধারণা আপনাকে উনি ঠিকই বুঝেছিলেন। আপনি কি জানেন বাবা আপনার পেছনে স্পাই লাগিয়ে রেখেছিলেন?
কী বললেন?
চমকে উঠবেন না। এটাও বাবার পুরনো স্বভাব। কারো সম্পর্কে কিছু জানতে হলে তিনি লোক লাগিয়ে দিতেন। আপনার ওপর বিরাট একটা ফাইল আছে। আপনি কোথায় যান, কী করেন মোটামুটি সবই সেই ফাইলে আছে।
হাসান হতভম্ব গলায় বলল, ও।
তিতলী নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আপনার খুব ভাব ছিল তাই না?
জ্বি।
উনাকে নিয়ে আপনি মাঝে মধ্যে বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘুরতেন।
এইসব কি ফাইলে আছে?
জ্বি।
আপনার এক ভাই রকিব সম্পর্কে অনেক কিছু আছে।
কী আছে?
থাক আপনার না জানলেও চলবে। আপনি বরং তিতলীর কথা বলুন। উনার সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়।
জ্বি না।
দেখা করতে ইচ্ছে করে না?
জ্বি না।
ভুল কথা বলছেন কেন? আপনি তো মাঝে মাঝেই তিতলীদের বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন।
ফাইলে লেখা?
জ্বি। ভুল লেখা?
জ্বি না, ভুল লেখা না।
আপনি তো এখনো বুড়িগঙ্গায় নৌকায় চড়ে একা একা ঘোরেন। তাই না?
জ্বি।
আপনার কি মনে হয় না–আপনার কর্মকাণ্ড অস্বাভাবিক।
হতে পারে।
আপনার সঙ্গে অনেকক্ষণ বকবক করলাম। কিছু মনে করবেন না। আসলে কথা বলার কেউ নেই। বাবার সব দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার হাতে। সামাল দিতে পাচ্ছি। না। আপনার মতো একটা জীবন আমার হলে মন্দ হতো না। কাজকর্ম নেই। ঘুরে বেড়ানো–হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি। বিষন্ন মনে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভ্ৰমণ।
চিত্ৰলেখা কিশোরীদের মতো হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, সরি। ঠাট্টা করলাম, কিছু মনে করবেন না।
হাসান বলল, আজ উঠি?
আচ্ছা। ভালো কথা, হাসান সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে বাবা আপনাকে ঘণ্টা হিসেবে টাকা দিতেন না?
জ্বি।
আমিও আপনাকে ঘণ্টা হিসেবে টাকা দেব। মাঝে মাঝে এসে আমার বকবকানি শুনে যাবেন।
হাসান কিছু বলল না। চিত্ৰলেখা বলল, এখান থেকে আপনি কোথায় যাবেন?
বুঝতে পারছি না। সুমিদের বাসায় যেতে পারি।
আপনার ছাত্রী?
জ্বি।
চিত্ৰলেখা হাসতে হাসতে বলল–এখন তো সে আপনার ছাত্রী না। এক সময় ছিল। আচ্ছা যান শুধু শুধু আপনাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছি…। আসুন আপনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দি।
চিত্ৰলেখা হাসানের সঙ্গে নিঃশব্দে হাঁটছে। দারোয়ান দুজন চট করে দাঁড়িয়ে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট দিল।
হাসান বলল, যাই।
চিত্ৰলেখা জবাব দিল না। তার বাবা হিশামুদ্দিন সাহেব এই ছেলেটিকে এত পছন্দ কেন করতেন তা সে বোঝার চেষ্টা করছে। হিশামুদ্দিন সাহেব হাসানের ফাইল এত যত্ন করে কেন তৈরি করেছেন। তার মাথায় অন্য কোনো পরিকল্পনা কি ছিল?
বেল টিপতেই সুমি দরজা খুলে দিল। সহজ গলায় বলল, স্যার কেমন আছেন? যেন সে স্যারের বেল টেপার জন্যেই বসার ঘরে চুপচাপ বসেছিল।
হাসান বলল, কেমন আছ সুমি?
সুমি বলল, ভালো। স্ট্রং ডায়রিয়া হয়েছিল— এখন ভালো।
স্ট্রং ডায়রিয়ার জন্যে কি তোমাকে এমন রোগা রোগ লাগছে?
না। বাবা চলে গেছেন তো খুব মন খারাপ। এই জন্যেই রোগা রোগ লাগছে। মন খারাপ হলে মানুষকে রোগা রোগী লাগে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। আপনারও নিশ্চয়ই মন খারাপ। আপনাকেও খুব রোগা রোগা লাগছে।
আমার মন অবশ্যি একটু খারাপ। তুমি ঠিকই ধরেছ।
স্যার বসুন। কী খাবেন বলুন, চা না কোক?
বাসায় আর কেউ নেই?
কাজের মেয়েটা আছে–রহমত চাচা আছে। মা গিয়েছে মেজোখালার বাসায়। আমারও যাবার কথা ছিল।
যাও নি কেন?
আপনি আসবেন তো–এই জন্যে যাই নি।
হাসান হেসে ফেলল। সুমির এই ব্যাপারটা খুব মজার। এমনভাবে কথা বলে যেন সে ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখছে। দু’মাস পর আজ হাসান এসেছে। তাও আসার কথা ছিল না। বেবিট্যাক্সি দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ বেবিট্যাক্সির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। বেবিট্যাক্সিওয়ালা স্ট্রার্টার হাতল ধরে অনেক টানাটানি করে হাল ছেড়ে দিল। হাসান বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে দেখে সুমিদের বাসা দুটো বাড়ির পরেই। বাসার আশপাশেই যখন আসা তখন সুমিকে দেখে যাওয়া যাক। এই ভেবে সুমিদের বাসায় আসা। অথচ মেয়েট ভবিষ্যদ্বক্তা জেন ডিক্সনের মতো কথা বলছে।
স্যার।
হুঁ।
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। তাই না?
কে বললা করছি না। করছি তো।
উঁহুঁ। আপনি বিশ্বাস করছেন না। আপনার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনি মনে মনে হাসছেন। কেউ যখন মনে মনে হাসে তখন তার চোখ হাসতে থাকে। মুখ থাকে খুব গম্ভীর।
হ্যাঁ। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন।
সেটা কীভাবে?
ফুলিকে আমি বলব–আমার পড়ার টেবিলে ওপর থেকে নীল ভেলভেটের ডায়রিটা আনতে। ওই ডায়েরিতে আজকের তারিখে আমি লিখে রেখেছি–আজ হাসান স্যার আমাদের বাসায় আসবেন।
বল কী?
ডায়েরিটা আমি নিজেই আনতে পারতাম। আমি আনলে আপনি ভাবতেন আমি আপনার সামনে থেকে চলে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ডায়েরিতে এটা লিখে নিয়ে এসেছি। এই জন্যেই ফুলিকে দিয়ে আনাব।
সুমি গম্ভীরমুখে বসে আছে। পা দোলাচ্ছে। হাসান মনে মনে বলল, মেয়েটা খুব অন্যরকম। বিরাট একটা বাড়িতে এক এক বড় হয়ে মেয়েটা অন্যরকম হয়ে গেছে। যতটুকু ভালবাসা তার প্রয়োজন তার মা একা তাকে ততটুকু ভালবাসা দিতে পারছে না। মেয়েটা নিঃসঙ্গ। সঙ্গপ্রিয় মানুষের জন্যে নিঃসঙ্গতার শাস্তি কঠিন শাস্তি। এই শাস্তি মানুষকে বদলে দেয়।
স্যার।
বল।
আমার বাবার ধারণা আমার ই.এস.পি. ক্ষমতা আছে। ই.এস.পি, হচ্ছে এক্সট্রা সেনাসরি পারসেপশন।
তুমি এই কঠিন বাক্যটা জান!
হ্যাঁ জানি। বাবা আমার সম্পর্কে কী বলে জানেন?
না।
জানতে চান?
হ্যাঁ জানতে চাই।
বাবা বলেন–আমি ইচ্ছা করলে মানুষের ভবিষ্যৎ বলে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাতে পারি। বাবার কথা কিন্তু ঠিক না। আমি সবার ভবিষ্যৎ বলতে পারি না। যাদের খুব পছন্দ করি। শুধু তাদেরটা বলতে পারি।
আমাকে কি তুমি খুব পছন্দ করা?
হ্যাঁ।
কেন?
সেটা আমি আপনাকে বলব না।
ফুলিকে ডেকে বল ডায়েরিটা আনতে। দেখি ডায়েরিতে তুমি কী লিখেছি?
হাসান ডায়েরি দেখে সত্যিকার অর্থে একটা ধাক্কার মতো খেল। ডায়েরিতে গোটা গোটা হরফে লেখা–আজ হাসান স্যার আমাকে দেখতে আসবেন। তবে আমার জন্যে কিছু আনবেন না। খালি হাতে আসবেন।
হাসান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার তো দেখি আসলেই ই.এস.পি, আছে। তুমি আমার সম্পর্কে আর কী বলতে পার?
অনেক কিছু বলতে পারি। আপনি কাকে বিয়ে করবেন—তাও বলতে পারি।
বলতে পারলে বল।
উঁহুঁ আমি বলব না।
বলবে না কেন?
শুধু শুধু কেন বলব? স্যার আপনি চা খাবেন, না কোক খাবেন?
চা খাব।
আগে একটু কোক খেয়ে নিন না। তারপর চা খাবেন। আমি কোক দিয়ে খুব একটা মজার ড্রিংকস বানাতে পারি। বাবা শিখিয়েছেন। কী করতে হয় জানেন-কোকের গ্লাসে দুটা কালো কাঁচা মরিচ মাঝামাঝি চিরে দিয়ে দিতে হয়। তার সঙ্গে এক চামচ লেবুর রস এবং সামান্য বিট লবণ দিতে হয়। তারপর কোকের গ্লাসটা ডিপ ফ্রিজে দিয়ে খুব ঠাণ্ডা করতে হয়। সার্ভ করার আগে সামান্য গোলমরিচের গুড়া গ্লাসে দিয়ে দিতে হয়। না দিলেও চলে। আমি দেই নি। বাসায় গোলমরিচের গুড়া ছিল না, এই জন্যে দেইনি।
তুমি কি ড্রিংকস বানিয়ে রেখেছ?
বেশ তো তাহলে নিয়ে এস খাই।
বাবার ধারণা ড্রিংসটা খুব ভালো। আমার ভালো লাগে না। ঝাল তো এই জন্যে ভালো লাগে না। আপনার কি ঝাল পছন্দ?
পছন্দ।
কাল কম খাবেন। কাল বেশি খেলে পেটে আলসার হবে।
আচ্ছা কমই খাব। তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে কেন?
সুমি পা দোলাতে দোলাতে বলল, চশমা নিয়েছি তো এই জন্যে অন্যরকম লাগছে। চশমা পরলে সবাইকে অন্যরকম লাগে। কাউকে বেশি অন্যরকম লাগে, আবার কাউকে কম অন্যরকম লাগে। আমাকে বেশি লাগছে।
হাসান কাঁচা মরিচের কোক খেল। চা খেল। সে ভেবেছিল মিনিট দশেক থেকে চলে যাবে। সে থাকল প্ৰায় দুই ঘণ্টা। নানা রকম সমস্যায় সে পর্যুদস্ত। বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সময় কোনো সমস্যা মাথায় থাকে না। বরং মনে হয়–পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন নয়। বেঁচে থাকার আনন্দ আলাদা। শুধুমাত্র সেই আনন্দের জনেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায়।
হাসান বলল, সুমি আজ উঠি?
সুমি বলল, আচ্ছা।
আবার আসবেন বাক্যটা বলল না। এই মেয়ে কখনো তা বলে না। কারণ কী? সে জানে আবার কবে স্যার আসবেন সেই জন্যেই কি? এই হাস্যকর যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ ভবিষ্যৎ জানে না। জানে না বলেই তারা মনের আনন্দে বর্তমান পার করতে পারে।
হাসানের বড় মামা–মুকুল মামা ভবিষ্যৎ জেনে ফেলেছিলেন। ডাক্তারেরা তার পেট পরীক্ষা করে বললেন–ক্টোমাক কান্সার মেটাসথিসিস হয়ে গেছে। শরীরে ক্যানসারের শাখা-প্ৰশাখা ছড়িয়ে গেছে। আয়ু আছে তিন মাস। ভবিষ্যৎ জানার পর মুকুল মামার জীবন বিষময় হয়ে গেল। মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে লাগলেন তিন মাস আগে থেকেই। যার সঙ্গে দেখা হয় তাকে জড়িয়ে ধরেই কাদেন-আমার জীবনটা রক্ষা কর। আমার জীবনটা রক্ষা কর। মুকুল মামার জন্যে ভবিষ্যৎ জেনে ফেলাটা সুখকর হয় নি। আনন্দময় কোনো ভবিষ্যৎ আগে ভাগে জেনে ফেললে কী হবে? সেই আনন্দ অনেকখানি কমে যাবে। মানুষকে সুখী থাকা উচিত বৰ্তমান নিয়ে। মানুষ তা পারে না। বর্তমানে সে দাঁড়িয়েই থাকতে পারে না। তার এক পা থাকে অতীতে আরেক পা ভবিষ্যতে। দু নৌকায় পা, সেই দু নৌকা আবার যাচ্ছে দুদিকে।
রাস্তায় নেমে হাসান রিকশা নিল। রাত বেশি হয় নি–নটা বাজে। এখনি বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। বেকারদের রাত দশটার আগে বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। হঠাৎ করে তিতলীদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে। মাঝে মাঝে এই ইচ্ছা হয়। যখন হয় তখন আর কিছু ভালো লাগে না। ইচ্ছাটা হু-হু করে বাড়তে থাকে। তিতলীদের বাড়িতে যাবার জন্যে অজুহাত একটা আছে। ভালো অজুহাত। নাদিয়া এমন চমৎকার রেজাল্ট করেছে তাকে কনগ্রাচুলেট করা তার অবশ্যই কর্তব্য। যেদিন নাদিয়ার রেজাল্টের কথা জেনেছে সেদিনই সে নাদিয়ার জন্যে ভালো একটা কলম কিনেছে। কলমের বাক্সটা গিফট র্যাপে মুড়েছে। ছোট্ট একটা চিরকুট গিফট র্যাপে ঢোকাল।
সেখানে লেখা–
নাদিয়া,
ফার্স্ট হওয়া ছেলেমেয়ে এতদিন শুধু পত্রিকায় দেখেছি। বাস্তবে এদের সত্যি সত্যি কোনো অস্তিত্ব আছে তা মনে হতো না। রেজাল্ট হবার পর তোমাকে বাস্তবের কেউ মনে হয় না। মনে হয়। তুমি অন্য কোনো গ্রহের। তুমি আমার অভিনন্দন নাও।
ইতি
হাসান ভাইয়া
উপহারটা নাদিয়াকে এখনো দেয়া হয় নি। অনেকবারই সে তিতলীদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে। শেষ পর্যন্ত গেট খুলে ভেতরে ঢোকে নি। হয়তো বাড়িতে গল্প করছে। হাসান সেই আনন্দময় মুহুর্তে প্ৰবেশ করামাত্র ছন্দপতন হবে। আজ বোধহয় যাওয়া যায়। তিতলী মার বাড়িতে এলেও এত রাত পর্যন্ত নিশ্চয়ই থাকবে না। নববিবাহিতা তরুণীরা মার বাড়িতে এত সময় নষ্ট করে না। এরা দ্রুত অতীত ভুলতে চেষ্টা করে। মেয়েরা তাদের শরীরে সন্তান ধারণ করে। সন্তান ধারণ করে বলেই হয়তো প্রকৃতি তাদের ভবিষ্যৎমুখী করে রাখে। অতীত তাদের কাছে পুরনো গল্পের বইয়ের মতো। যে গল্প একবার পাঠ করা হয়েছে বলে কৌতুহল মরে গেছে। দ্বিতীয়বার পড়তে ইচ্ছা করে না। বইটি হারিয়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই।
হাসান তিতলীদের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে যতটুকু মনের জোর দরকার এই মুহুর্তে ততটুকু মনের জোর তার নেই। কেন জানি মনে হচ্ছে তিতলী তার মার বাড়িতে। কারণ ঘরে অনেকগুলো বাতি জ্বলছে। বারান্দায়ও বাতি জ্বলছে। এতগুলো বাতি জ্বলার কথা না। বাইরে বারান্দার বাতি তো কখনোই জ্বালানো থাকে না। ঘটনা কী ঘটেছে হাসান তো অনুমান করার চেষ্টা করছে। তিতলী এসে কলিংবেল টিপৌঁছে। নাদিয়া বাইরে বারান্দায় বাতি জ্বলিয়ে দরজা খুলল। তারপর আপাকে দেখে এতই আনন্দিত হলো যে বাতি নেবাতে ভুলে গেল। তিতলী এ বাড়িতে এলে গেটের ভেতরে একটা গাড়ি থাকার কথা। গাড়ি অবশ্যি নেই। তিতলীর স্বামী এসে হয়তো তিতলীকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। রাত এগারটার দিকে আবার এসে নিয়ে যাবেন।
হাসান হাঁটা শুরু করল। আজ থাক আরেকদিন সে আসবে। নাদিয়ার উপহারটা মনে হয় দীর্ঘদিন পকেটে পকেটে ঘুরবে। গিফট র্যাপ কচুকে যাবে, ময়লা হয়ে যাবে উপহার আর দেয়া হবে না। সবচে’ ভালো হত হঠাৎ যদি রাস্তায় নাদিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। উপহারটা তার হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলা যেত। রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা শূন্য। নাদিয়া এমন মেয়ে যে কখনো ঘর থেকে বের হয় না। ঘর থেকে বের হলেই তার নাকি কেমন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। চান দেয়ালের ভেতরে সে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই নাকি তার শান্তি শান্তি লাগে। কী অদ্ভুত কথা!
বাসায় ফিরতে হাসানের ইচ্ছা করছে না। আজ বাসার পরিস্থিতি খুব খারাপ থাকার কথা। তারেক একদিনের অফিস টুরের কথা বলে চিটাগাং গিয়েছিল। এক দিনের জায়গায় সাতদিন কাটিয়ে আজ দুপুরে ফিরেছে। টুরের ব্যাপারটা যে মিথ্যা রীনার কাছে তা প্ৰকাশ হয়ে পড়েছে। চারদিনের দিন অফিস থেকে তারেকের এক কলিগ এসেছিল খোঁজ নিতে–তারেকের অসুখ-বিসুখ কিছু করেছে। কিনা, তার কাছেই রীনা জেনেছে। তারেক দুদিনের ক্যাজুয়েল লিভ নিয়েছে। রীনা খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে–দুইয়ে দুইয়ে চার করা তার জন্যে কোনো সমস্যাই না। হাসান এখনো জানে না ভাবি হিসাব মিলাতে বসেছে কি না। সব ঘটনা জানার পর রীনার প্রতিক্রিয়া কী হবে হাসান তাও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে ধৈৰ্য হারালে সমস্যা হবে। তবে ভাবি সম্ভবত ধৈৰ্য হারাবে না।
তারেক দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। সন্ধ্যায় গোসল করে পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে। দুবার চা চেয়ে নিয়ে খেয়েছে। তার চেহারা এবং কথাবার্তায় কোনোরকম উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা নেই। বরং মুখটা হাসি হাসি। টগরের কথা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর টগর ঠিকই শব্দে কাশছে তারেক সেটা নিয়ে উদ্বেগও প্ৰকাশ করল। রীনাকে ডেকে বলল, টগরের বুকে কফ বসে গেছে। এক কাজ কর সরিষার তোলে রসুন দিয়ে তেলটা গরম করে বুকে মালিশ করে দাও। আর এক কাপ কুসুমগরম পানিতে এক চামচ মধু দিয়ে ওই পানিটা খাইয়ে দাও। কফ আরাম হবে। ঘরে মধু আছে?
রীনা স্বাভাবিক গলায় বলল, না মধু নেই।
তারেক বলল, এক শিশি মধু ঘরে সব সময় রাখবে। মেডিসিন বক্সে যেমন নানান ধরনের ওষুধপত্র থাকে তেমনি এক শিশি মধু থাকা উচিত। কোরান শরীফে কয়েকবার মধুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাসানকে বল মধু নিয়ে আসুক।
হাসান বাসায় নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে-কাগজটা পড়ে দি। আমি এনে দেব।
তারেক মধু এনে দিয়ে রাতের খাবার খেতে গেল। সে সাধারণত চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। আজ রানার সঙ্গে গল্প শুরু করল। রাজনৈতিক গল্প। তারেক বিএনপি সমর্থক ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর সে কিছুটা আওয়ামী লীগ ঘেসা হয়ে পড়েছে।
শেখ হাসিনা দেশ তো মনে হয় ভালোই চালাচ্ছে, কী বল?
হুঁ।
সাহস আছে। রাজনীতিতে সাহসটা অনেক বড় জিনিস। কর্নেল ফারুক গং-কে কেমন জেলে ঢুকিয়ে দিল দেখলে?
হুঁ।
ভালো কাজ করলে সাপোর্ট পাবে। তবে মূল সমস্যাটা কোথায় জান?
না।
মূল সমস্যা মানুষের ভেতর না। মূল সমস্যা সিংহাসনে। সিংহাসনে কিছুদিন বসলেই মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধীকে দেখ–লোকে যে তাকে এখনো ভালো বলে কেন বলে? সিংহাসনে বসেন নি বলেই বলে। দু মাস সিংহাসনে বসতেন দেখতে মানুষ গান্ধীজীর নাম শুনে থুতু দিত। ছাগল নিয়ে ঘুরেও লাভ হতো না। ঠিক বলছি না?
হুঁ।
ঘরে কি পান আছে?
আছে।
কাঁচা সুপারি আছে?
না।
কাল অফিস থেকে ফেরার সময় কাঁচা সুপারি নিয়ে আসব। কাঁচা সুপারি হার্টের জন্যে ভালো। কাঁচা সুপারিতে এলাকলিয়েড বলে একটা জিনিস থাকে। নাইট্রোজেনঘটিত কম্পাউন্ড। এটা হার্টের জন্যে উপকারী। পেপারে পড়েছি।
ও আচ্ছা।
আমাদের গ্রামের মানুষদের মধ্যে হার্টের অসুখ নেই তার মূল কারণ ওরা কাঁচা সুপারি খায়।
ও।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তারেক নিজেই বিপুল উৎসাহে ছেলের বুকে তেল মালিশ করে দিল। কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। নিজে ঘুমোতে এল রাত এগারটার দিকে। পান খেয়ে তার মুখ লাল। হাতে সিগারেট। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শেষ সিগারেটটা খাবে। সুখী সুখী চেহারা। রীনা মশারি খাটাল। পানির গ্লাস, জগ এনে রাখল। ঘুমোতে যাবার আগে আয়নার সামনে চুল বাঁধতে বাঁধতে সহজ গলায় বলল, চিটাগাঙের ওয়েদার কেমন?
তারেক বলল, ভালো।
বৃষ্টি হচ্ছে না?
একদিন হয়েছিল।
এই কদিন লাবণীর বাসাতেই ছিলে?
হ্যাঁ। আর বল কেন যন্ত্রণা–ওরা এপার্টমেন্ট দিয়েছে। কমপ্লিট হবার আগেই দিয়ে বসে আছে। ইলেকট্রিসিটির কানেকশন নেই। গ্যাসের কানেকশন নেই। দুটা বাথরুমের একটায় কোনো ফিটিংসই নেই। এই অবস্থার ফেলে রেখে আসতে পারি না।
আমাকে তুমি মিথ্যা কথা বলে গিয়েছ। বলেছ ট্যুরে যাচ্ছ।
তাই বলেছিলাম?
হ্যাঁ।
মিথ্যা না–টুরেই গিয়েছিলাম। চিটাগাং অফিসের হিসাবপত্র অডিট হচ্ছে। ঢাকা থেকে অডিট টিম যাচ্ছে, আমি সেই অডিট টিমে আছি।
চুল বাঁধা শেষ করে রীনা স্বামীর দিকে ফিরল। সহজ গলায় বলল, আমি এর মধ্যে তোমার অফিসে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে জানলাম তুমি দুদিনের ক্যাজুয়েল লিভ নিয়েছ।
ও এই ব্যাপার। আসলে হয়েছে কি–অডিটের ডেট হঠাৎ করে পিছিয়ে দিল। এদিকে মানসিকভাবে আমি তৈরি চিটাগাং যাব। তখন ভাবলাম যাই ঘুরেই আসি।
তুমি তো মিথ্যা কখনো বল না। আজ এমন সহজ ভঙ্গিতে মিথ্যা বলছি কেন? আমি তো কোনো রাগারগিও করছি না হইচই করছি না। মিথ্যা বলার দরকার কী? তুমি কি লাবণী মেয়েটির প্রেমে পড়েছ?
আরে কী যে বল, প্রেমে পড়া পড়ির মধ্যে কী আছে। একটা অসহায় মেয়ে বিপদে পড়েছে তাকে সাহায্য করেছি। এর বেশি কিছু না।
এর বেশি কিছু না?
না।
দয়া করে তুমি আমাকে সত্যি কথা বল–এর বেশি তোমার কাছে কিছু চাচ্ছি না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। আমি কোনো সমস্যা তৈরি করব না। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি, আমি কী সমস্যা করব? আচ্ছা তুমি ছদিন ওই মেয়েটির বাড়িতেই ছিলে?
হ্যাঁ। ওর হলো টু বেডরুম এপার্টমেন্ট। আমি একটাতে ছিলাম, ওরা মা-মেয়ে একটাতে ছিল।
রাতে সে তোমার সঙ্গে গল্প করতে আসে নি?
এসেছে।
কী নিয়ে গল্প করলে? পলিটিক্স?
না–লাবণী তার জীবনের নানান গল্প করত, শুনতাম। খুবই দুঃখী মেয়ে।
মেয়েটির সঙ্গে তোমার শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়েছে?
আরো ছিঃ ছিঃ এইসব কী বলছি?
হয়েছে কি না সেটা বল? গল্প করতে করতে হয়তো অনেক রাত হয়ে গেল। মেয়েটা ঠিক করল রাতটা তোমার সঙ্গেই থাকবে।
কী যে তুমি বল রানা, আমি ফেরেশতার মতো মানুষ!
ইবলিশ শয়তানও এক সময় ফেরেশতা ছিল–তারপর সে শযতান হয়েছে।
এইখানে তুমি একটা ভুল করলে। অধিকাংশ মানুষ এই ভুলটা করে। ইবলিশ কিন্তু ফেরেশতা ছিল না। ইবলিশ আসলে ছিল জ্বিন।
জ্বিন ছিল না ফেরেশতা ছিল সেটা পরে দেখা যাবে–এখন বল, মেয়েটার সঙ্গে কি তোমার কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে?
রীনা পানি এনে দিল। তারেক কয়েক চুমুক পানি খেয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিল। রীনা বলল, তুমি আমার প্রশ্নের জবাব কি দেবে, না দেবে না? হ্যাঁ বলবে কিংবা না বলবে। তুমি যা বলবে তাই আমি বিশ্বাস করব। সত্যি কথা বলার অনেক উপকারিতা আছে। তুমি তো বিরাট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছ–এখন তোমার উচিত। সত্যি কথা বলা। এখন মিথ্যা কথা বললে ঝামেলা আরো বাড়বে। সবকিছু জট পাকিয়ে যাবে। এখন তোমার উচিত জট কমানো। তুমি কি মেয়েটার সঙ্গে ঘুমিয়েছ? আমি খুব ভদ্রভাবে তোমাকে প্রশ্নটি করলাম। আসলে কী বলতে চাচ্ছি তা নিশ্চয়ই বুঝছ? মেয়েটার সঙ্গে রাতে ঘুমিয়েছ?
হ্যাঁ।
মেয়েটি কি তোমাকে বিয়ে করতে চায়?
চাইলেই বা উপায় কী?
উপায় থাকবে না কেন? বিয়ে তো আর কিছুই না এক ধরনের কন্ট্রাক্ট। আরবিতে নিকাহনাকার অর্থ হচ্ছে sex contact। তুমি পুরনো কন্ট্রাক্ট বাতিল করে নতুন কন্ট্রাক্ট করবে।
তুমি রেগে যাচ্ছে রীনা।
আমি মোটেই রাগি নি। তবে আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে বাস করব না। আগামী পরশু আমি চলে যাব। কালকের দিনটা আমার যাবে গোছগাছ করতে। তোমার সংসার তোমাকে আমি বুঝিয়ে দিয়ে যাব। তারপর তুমি আমাকে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবে। ডিভোর্স হয়ে যাবার পর এই মেয়েটিকে বিয়ে কোরো। চাকরিজীবী মেয়ে আছে তোমার জন্যে সুবিধাও হবে। তোমার একার রোজগারে সংসার চলছে না। দুজনের রোজগারে চলবে।
রীনা তুমি খুবই রেগে গেছ বুঝতে পারছি। রাগারই কথা।
আমি মোটেও রাগি নি। ব্যাপারটা জানার পর থেকেই আমি এটা নিয়ে ভাবছি। তোমাকে যে কথাগুলো বললাম। তার প্রতিটি শব্দ নিয়ে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেবেছি। যাই হোক এখন ঘুমোতে চল।
রীনা বাতি নিভিয়ে বিছানায় উঠে এল। গত চার রাতে তার এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। আজ বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। শান্তিময় ঘুম।
রীনা খুব শান্ত ভঙ্গিতেই তার সুটকেসে কাপড় ভরল
রীনা খুব শান্ত ভঙ্গিতেই তার সুটকেসে কাপড় ভরল। কয়েকটা ব্যবহারি শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকেট। ব্যাস এই তো। নয় বছরের বিবাহিত জীবনে নেই নেই করেও অনেক কিছু জমে গেছে। সবকিছু সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। থাকুক তার স্মৃতি হিসেবে কিছু জিনিসপত্র। সঙ্গে করে সামান্য হলেও কিছু টাকা-পয়সা নেয়া দরকার। সেটা নিতে ইচ্ছে করছে না। ছোট মামার দেয়া সাত শ ডলারের কিছুই নেই। রীনা ভেবেছিল একটা টাকাও সে খরচ করবে না। সব জমা করে রাখবে। অথচ কত দ্রুতই না সেই টাকাটা খরচ হলো। তারেকের অফিসের কিছু দেনা শোধ করা ছাড়া টাকাটা আর কোনো কাজে লাগে নি। তার হাত আজ পুরোপুরি খালি।
বউ হিসেবে যখন সে বাবার বাড়ি থেকে আসে তখনো খালি হাতে এসেছিল। বাবা কয়েকবার বলেছিলেন, মেয়েটার হাতে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দাও। টুকটাক খরচ আছে। ফন্ট করে স্বামীর কাছে চাইতেও পারবে না লজ্জা লাগবে। বিয়েবাড়ির উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত তার হাতে টাকা দেয়ার ব্যাপারটা মনে রইল না। সে গাড়িতে উঠল। এক্কেবারে খালি হাতে। আজ বাড়ি থেকে বিদায় নেবার সময়ও খালি হাতে বিদায় নেয়া ভালো। যেভাবে এসেছি–সেভাবে যাচ্ছি। না তাও ঠিক না। সে স্বামীর কাছে এভাবে আসে নি। তার দরিদ্র বাবা ধারদেনা করে অনেক গয়নাপাতি দিয়েছিলেন। এই নিয়ে বাড়িতে অনেক অশান্তিও হয়েছে। রীনার মা ঝাঁঝালো গলায় বলেছিলেন–এত যে ঋণ করলে শোধ দিবে কীভাবে? টাকার গাছ পুঁতেছ? রীনার বাবা হাসিমুখে বলেছিলেন, মেয়েটা ঝলমলে গয়না পরে স্বামীর কাছে যাচ্ছে এই দৃশ্য দেখতেও অনেক আনন্দ। তোমার এই মেয়ে সুখের সাগরে ডুবে থাকবে।
সুখের সাগরে ডুবে থাকার এই হলো নমুনা। নয় বছর স্বামীর সঙ্গে থেকে আজ সব ফেলে দিয়ে চলে যেতে হচ্ছে।
রীনা তার গলার হারটা সঙ্গে নিল। বাবার দেয়া গয়না একে একে বিক্রি করে সংসারের ক্ষুধা মেটাতে হয়েছে। হারটা রয়ে গেছে। হার বিক্রি করে নগদ কিছু টাকা হাতে নিতে হবে। মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু অর্থ! স্বার্থহীন বন্ধু। যে মানুষের চারদিকে শক্ত দেয়াল হয়ে মানুষকে রক্ষা করে। রানার সে রকম বন্ধু নেই। আশ্রয় দেবার মতো আত্মীয়স্বজনও নেই। সে যার কাছেই উঠবে সে-ই ব্যস্ত হয় উঠবে তাকে তাড়িয়ে দিতে। তাকে উঠতে হবে স্কুল জীবনের বান্ধবীর বাসায়। তারা তাকে তাড়িয়ে দেবে না। স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব অন্যরকম ব্যাপার। এই বন্ধুত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। কখনো কমে না। রীনার সঙ্গে তার স্কুলজীবনের বন্ধুদের কোনো যোগ নেই। কে কোথায় আছে সে জানেও না। একজন থাকে বারিধারায়। সুস্মিতা। তার সঙ্গে নিউমার্কেটে হঠাৎ দেখা হয়েছিল। সুস্মিতা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সুস্মিতা বাড়ির নম্বর, টেলিফোন নম্বর সব একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল। কাগজটা অনেকদিন ছিল টেবিলের ড্রয়ারে। তারপর উড়ে চলে গেল। সুস্মিতার ঠিকানা জানা থাকলে কাজ হতো।
বিকালের মধ্যে রীনা সব গুছিয়ে ফেলল। বিকেলে বাচ্চারা খাবে তার জন্যে নুডলস। রাতের জন্য পোলাও। দুজনই খুব পোলাও পছন্দ করে। রোজ খেতে বসে বলবে, মা পিলাউ’। টগর সব শব্দ উচ্চারণ করতে পারে শুধু পোলাও বলতে গিয়ে বলে পিলাউ। পোলাও থাকলে তার আর কিছু লাগবে না। তরকারি না হলে চলবে। কপি কাপ করে ‘‘পিলাউ খাবে। সেই খাওয়া দেখার ভেতরও আনন্দ আছে। আজ রীনা এই আনন্দ পাবে না। টগর ‘‘পিলাউ খাবে একা একা। না, একা একা নিশ্চয়ই খাবে না–লায়লা থাকবে।
রীনা এক শ টাকার একটা নোট এবং কিছু ভাংটি টাকা সঙ্গে নিল। যেখানেই যাক রিকশা ভাড়া, বেবিট্যাক্সি ভাড়া তো দিতে হবে।
আলমিরা খুলে টগর এবং পলাশের জুতাজোড়া নিল। জন্মের এক মাস পর এলিফ্যান্ট রোডের এক দোকান থেকে রীনা নিজে এই দু জোড়া জুতা কিনেছিল। লাল ভেলেভেটের জুতা। এখনো ঝলমল করছে। জুতা জোড়া কেনার সময় সে বিস্মিত হয়ে ভাবছিল–জন্মের সময় মানুষের পা এতো ছোট থাকে? রীনার অনেক দিনের শখ টগর এবং পলাশের যেদিন বিয়ে হবে সেদিন কাচের বাক্সে জুতাজোড়া রেখে সেই বাক্সটা মায়ের বিয়ের উপহার হিসেবে সে দেবে। প্ৰতীকী উপহার। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া–দেখ একদিন তুমি এ রকম ছোট ছিলে-আজ বড় হয়েছ। তোমার সংসারে এ রকম ছোট একটা শিশু আসবে। চক্ৰ কোনোদিন ভাঙবে না। চলতেই থাকবে।
এই জীবনে রানার কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হয় নি। কে জানে এই ইচ্ছাটাও হয়তো পূর্ণ হবে না। টগর-পলাশের বিয়ে হয়ে যাবে সে খবরও পাবে না। রীনার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যেন চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে যায়। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় চোখের পানি ফেলতে নেই। চোখের পানি বাড়ির জন্যে ভয়াবহ অমঙ্গল নিয়ে আসে। রীনা চায় না, এই বাড়ির অমঙ্গল হোক। এ বাড়িতে টগর ও পলাশ থাকে। হাসান থাকে, লায়লা থাকে। তার শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন। এদের সবাইকে রীনা অসম্ভব পছন্দ করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সবচে’ বেশি পছন্দ করে তার শাশুড়ি মনোয়ারাকে। কেন করে সে নিজেও জানে না।
সব গোছানোর পর রীনা মনোয়ারার ঘরে উঁকি দিল। যাবার আগে একটু দেখা করা। তাকে কিছু বলে যাওয়া যাবে না। সেটা সম্ভব না।
রীনা শাশুড়ির ঘরের দরজা ফাঁক করল। মনোয়ারা বললেন, বউমা তোমার শ্বশুর। কোথায় জান?
জানি না মা।
বারান্দায় গিয়ে উঁকি দাও–তোমার শ্বশুরকে দেখবে রাস্তার ওপাশে যে চায়ের স্টল আছে, বিসমিল্লাহ টি-স্টল, ওইখানে বসে আছে।
খবর দিয়ে আনব মা?
না খবর দিয়ে আনতে হবে না। কয়েকদিন ধরেই আমি ব্যাপারটা লক্ষ করছি। বুড়োর ভীমরতি হয়েছে। ঠিক এই সময় বুড়ো চায়ের স্টলে বসে থাকে কেন জানতে চাও?
কেন?
মেয়েস্কুল ছুটি হয়। মেয়েগুলো শরীর দোলাতে দোলাতে রাস্তা দিয়ে যায়। আর আমাদের বুড়ো এই দৃশ্য চোখ দিয়ে চাটে। বুঝলে কিছু?
রীনা চুপ করে রইল।
একটা বয়সের পর পুরুষ মানুষের এই রোগ হয়। চোখ দিয়ে চাটার রোগ। খুবই ভয়ঙ্কর রোগ। আল্লাহপাক এই বিষয়টা জানেন বলেই এই বয়সে চোখে ছানি ফেলে দেন। আমাদের বুড়োর চোেখ পরিষ্কার, ছানি পড়ে নি। তার খুব সুবিধা হয়েছে। রোজ বিকেলে চা খেতে যাচ্ছে। জীবনে তাকে চা খেতে দেখলাম না, এখন চা খাওয়ার ধুম পড়েছে। ভেবেছে আমি কিছু টের পাই নি। কোনো ভরা বয়সের মেয়ে ঘরে এলে বুড়ো কী করে লক্ষ করেছ? তার মা ডাকার ধুম পড়ে যায়। মা মা বলে আদরের ঘটা। মা ডাকলে মাথায় পিঠে, পাছায় হাত বোলানোর সুযোগ হয়ে যায়-। সুযোগ আমি বার করছি। আজ বাসায় ফিরুক। সাপের পা তো কেউ দেখে নাই। তোমার শ্বশুর আজ সাপের পা দেখবে, শিয়ালের শিং দেখবে।
মা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
একা যাচ্ছ?
জ্বি।
একা যাবার দরকার নেই, বুড়ো শয়তানকে সাথে নিয়ে যাও। বুড়ো একদিনে অনেক মেয়ে দেখে ফেলেছে আর না দেখলেও চলবে। যাচ্ছে কোথায়?
আমার এক বান্ধবীর বাসায়।
শয়তানটাকে সাথে নিয়ে যাও। তুমি বন্ধুর বাসায় যেও। শয়তানটাকে রিকশায় বসিয়ে রাখবে। সে রিকশাওয়ালার সঙ্গে গল্প করবে। এটাই তার শান্তি। আর শোন মা তুমি দেরি করবে না। সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরবে। বাড়ির বউ সন্ধ্যার পর বাইরে থাকলে সংসারে অমঙ্গল হয়। বাড়ির বউকে দুটা সময়ে অবশ্যই ঘরে থাকতে হয়। সূৰ্য ওঠার সময় এবং সূর্য ডোবার সময়। এই কথাগুলো মনে রাখঘা মা। তোমার ছেলে দুটাকে যখন বিয়ে দিবে তখন তাদের বউদেরও বলবে।
জ্বি আচ্ছা।
রীনা শাশুড়ির ঘর থেকে বেরোল। টগর-পলাশ বারান্দার দেয়ালে মহানন্দে রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকছে। দেয়ালে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ কর্ম। এই নিষিদ্ধ কর্মের জন্যে দু ভাই অতীতে অনেক শাস্তি পেয়েছে। আজ পেল না। রীনা তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। দু। ভাই মাথা নিচু করে বসে আছে। ভয়ে কেউ মাথা তুলছে না। রীনার খুব শখ ছিল যাবার আগে ছেলে দুটির মুখ ভালোমতো দেখে যায়। সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না। মাকে দেখে এরা দুজন মাথা আরো নিচু করে ফেলল। দেয়ালে দু মাথাওয়ালা একটা ভূত আঁকা রয়েছে। রীনা ভূতের দিকে তাকিয়ে আছে। রীনা নরম গলায় ডাকল, টগর। টগর মার গলায় বিপদের আভাস পেয়েছে। সে ছুটে দাদিমার ঘরে ডুকে গেল, মুহূর্তের মধ্যেই তাকে অনুসরণ করল পলাশ। মার হাত থেকে মুক্তির এই একটিই উপায়।
ভাবি শোন।
বারান্দায় লায়লা দাঁড়িয়ে আছে। তার গলার স্বর ভারি। মনে হয়। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। চোখে কাজল লেপ্টে আছে।
কী ব্যাপার লায়লা?
তুমি একটু আমার ঘরে আস তো ভাবি।
রীনা লায়লার ঘরে ঢুকতেই লায়লা দরজা বন্ধ করে দিল। রীনা বলল, ব্যাপার কী বল তো?
লায়লা কান্না চাপতে চাপতে বলল, ভাবি তুমি বল আমি কি এতই ফেলনা? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?
ব্যাপারটা কী?
আমি জানি আমার চেহারা ভালো না। রং ময়লা–তাই বলে আমার জন্যে ডিভোর্সড ছেলে খুঁজতে হবে?
কে খুঁজছে ডিভোর্সড ছেলে?
বড়বুবু একটা ছেলের সন্ধান এনেছেন। ডিভোর্সড। আগের ঘরের একটা ছেলে আছে তিন বছর বয়স। আমার চেহারা খারাপ বলে আমার ভাগ্যে বুঝি সেকেন্ডহ্যান্ড হাসব্যান্ড।
বিয়ে তো এখনো হয়ে যায় নি লায়লা।
না হোক বড়বুবু কেন সেকেন্ডহ্যান্ড হাসবেন্ডের খোঁজ আনবে। ভাবি তুমি তো জান সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিসই আমি দু চোখে দেখতে পারি না। নিউমার্কেটে কত সুন্দর সুন্দর সেকেন্ডহ্যান্ড সুয়েটার পাওয়া যায়। আমার বন্ধুরা সবাই কিনেছে। আমি কখনো কিনেছি?
লায়লা চুপ কর তো!
কেন আমি চুপ করব? ভাবি আমি কি মানুষ! আমাকে আগেভাগে কিছু না বলে মেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমিও হাসিমুখে সেকেন্ডহ্যান্ডটার সাথে কথা বলেছি। গাধাটা আবার যাবার সময় বড়বুবুকে বলেছে মেয়ে পছন্দ হয়েছে। আরো গাধা তোর তো যেকোনো মেয়েই পছন্দ হবে।
লায়লা শোন এখানে তোমার পছন্দটাই জরুরি। তুমি তোমার পছন্দ-অপছন্দটা কড়া করে বলবে। তুমি যে জীবন যাপন করবে সেটা তো তোমার জীবন। অন্যের জীবন তো না।
লায়লাকে শান্ত করে রীনা বের হয়ে এল। ভাগ্য ভালো সুটকেস হাতে বেরোতে তাকে কেউ দেখল না।
রীনা রিকশায় উঠেছে। ঢাকায় তার থাকতে ইচ্ছে করছে না। ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যেতে হবে। ময়মনসিংহ চলে গেলে কেমন হয়। রানার বড়মামা ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার। কেউটখালিতে বাসা। বাসে ময়মনসিংহ যেতে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগে। সে পৌছবে সন্ধ্যার পর পর। তখন কেউটখালিতে গিয়ে বড়ামামাকে খুঁজে বের করতে হবে। বাসার ঠিকানা রীনার জানা নেই। যদি খুঁজে না পাওয়া যায়। যদি মামা এর মধ্যে বাসা বদল করে থাকেন? দুশ্চিন্তা হচ্ছে। রীনা দুশ্চিন্তাকে আমল দিল না। তার সমস্ত শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে। মুখ শুকিয়ে পানির পিপাসা হচ্ছে। কোনো একটা দোকানের সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে সে কি এক বোতল পানি কিনে নেবে? কত দাম এক বোতল পানির?
রিকশাওয়ালা বলল, কই যাবেন?
রীনা বলল, কমলাপুর রেলস্টেশন।
বলেই মনে হলো সে ভুল করেছে। সে যাবে মহাখালি বাসস্টেশন। মহাখালি বাসস্টেশন থেকেই ময়মনসিংহের বাস ছাড়ে। শুধু শুধু কমলাপুর রেলস্টেশন বললে কেন? ভুলটাকে ঠিক করতে ইচ্ছা করছে না। যাক কমলাপুরেই যাক। ময়মনসিংহ যাবার কোনো একটা ট্রেন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর পাওয়া না গেলে একটা রাত রেলস্টশনে কাটিয়ে দেয়া তেমন কঠিন হবে না। স্টেশনে সারা রাত গাড়ি আসা-যাওয়া করবে। অসুবিধা কী? জনতার মধ্যে আছে নির্জনতা।
যে চেয়ারটায় হিশামুদিন বসতেন
যে চেয়ারটায় হিশামুদিন বসতেন সেই চেয়ারে চিত্ৰলেখা বসে আছে। প্রথম দিন অস্বস্তি লেগেছিল–এরপর আর লাগে নি। এমন ব্যস্ততায় তার দিন কাটছে যে অস্বস্তি লাগার সময়ও ছিল না। ব্যস্ত মানুষদের অস্বস্তি বোধ করার সময় থাকে না। চিত্ৰলেখার দিন কাটছে বাবার কর্মপদ্ধতির মূল সূত্রগুলো ধরতে। তাকে কেউ সাহায্য করছে না। যাদের সাহায্য করার কথা তারা এক ধরনের নীরব অসহযোগিতা করছেন। অফিসের প্রধান প্রধান কর্তব্যক্তিরা এগিয়ে আসছেন না। তাদের প্রশ্ন করেও তেমন কিছু জানা যাচ্ছে না। এ রকম কেন হচ্ছে চিত্ৰলেখা বুঝতে পারছে না। তারা কি চান না। সব আগের মতো চলুক?
চিত্ৰলেখার সামনে তিন কর্মকর্তা বসে আছেন, জিএম আবেদ আলি, এজিএম ফতেহ খান এবং প্রোডাকশান ম্যানেজার নুরুল আবসার। তাদের চা দেয়া হয়েছে। তারা বিমর্ষমুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আবেদ আলি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। চিত্ৰলেখা বলল, আপনি সিগারেট ধরাবেন না। সিগারেটের ধোঁয়া আমার পছন্দ না। বন্ধঘরে ধোঁয়া যেতে চায় না। অসহ্য লাগে।
আবেদ আলি সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে রাখলেন। তার মুখ আরো গভীর হয়ে গেল।
চিত্ৰলেখা বলল, আমি যদি কারো চাকরি টাৰ্মিনেট করতে চাই আমাকে কী করতে হবে বলুন তো?
আবেদ আলি কিছু বললেন না, ফতেহ খান বললেন, আপনি যা করবেন কোম্পানি আইন মোতাবেক করবেন। কোম্পানি আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার ক্ষমতা মালিকদের দেয়া হয় নি। মালিক চেয়েছেন বলে চাকরি নেই এই ব্যবস্থা এখন নেই।
প্রাইভেট কোম্পানিতে কোনো একটা ব্যবস্থা তো থাকতেই হবে। সেই ব্যবস্থাটা জানতে চাচ্ছি।
ফতেহ খান বললেন, আপনাকে ল’ইয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। কোম্পানির নিজস্ব ল’ইয়ার আছে তার কাছে জেনে নিন।
আপনারা কিছু জানাবেন না?
আমরা তেমন জানি না।
আপনি জানেন না সেটা বলুন। আমরা বলছেন কেন? আবেদ আলি সাহেব হয়তো জানেন, নূরুল আবসার সাহেবও হয়তো জানেন। অন্যদের দায়িত্ব নেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
নুরুল আবসার বললেন, মিস চিত্ৰলেখা আপনাকে একটা কথা বলি। দয়া করে কিছু মনে করবেন না, আপনি একসঙ্গে সবকিছু বুঝে ফেলতে চেষ্টা করছেন। আমাদের এই কোম্পানি অনেক বড় কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা দীর্ঘদিন থেকে জড়িত। বছরের পর বছর কাজ করে আমরা যা শিখেছি আপনি এক সপ্তাহে তা শিখে ফেলতে চান, তা কী করে হবে! ধীরে চলার একটা নীতি আছে সেই নীতি মেনে চলাই ভালো।
আমাকে ধীরে চলতে বলছেন?
অবশ্যই ধীরে চলতে বলছি।
আপনাদের ধারণা আমি ধীরে চলছি না?
আমাদের ধারণা। আপনি একসঙ্গে সব জেনে ফেলার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। ছটফট করছেন।
আপনিও বললেন–আমাদের ধারণা। আপনি বলুন আমার ধারণা। নাকি আপনাদের তিন জনের ধ্যান-ধারণা সব এক রকম।
আমরা সব একজিকিউটিভ ডিসিশান মেকিঙে থাকি। আমাদের ধ্যান-ধারণা এক রকম হওয়ারই তো কথা।
গত মাসে কোম্পানি প্ৰায় এক কোটি টাকা লোকসান করেছে। কেন করেছে আবেদ আলি সাহেব। আপনি বলুন?
এক কোটি টাকা না–সত্তর হাজার পাউন্ড। একটা বিশেষ খাতে লোকসান হয়েছে। সেই লোকসান আমরা সামলে উঠব। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকে। বিজনেস হচ্ছে এক ধরনের গ্যামলিং।
লাভ-লোকসান ব্যবসায় থাকবে তাই বলে ব্যবসা গ্যামলিং হবে কেন? আমরা তো জুয়া খেলতে বসি নি।
আবেদ আলি ভুরু কুঁচকালেন। মনে মনে বললেন–ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল।
চিত্ৰলেখা বলল, আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাই নি–এত বড় একটা লোকসান হলো কেন?
যথাসময়ে এলসি খোলা হয় নি। তারপর আমাদের কিছু ক্রটি ছিল যার জন্যে পেনাল্টি দিতে হয়েছে।
কী ক্রটি?
ম্যাডাম বিষয়টা তো জটিল–চট করে বোঝাতে পারব না। সময় লাগবে।
সময় আপনাকে দিচ্ছি–আপনি বোঝাতে শুরু করুন। কাগজ-কলম লাগবে?
আবেদ আলি বললেন, মিস চিত্ৰলেখা, বসের কন্যাকে প্রাইভেট পড়ানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে না। তারপরও আমি আপনাকে বোঝাব। তবে এখন না। এখন আমাকে যেতে হবে। আমার জন্যে লোকজন অপেক্ষা করছে। আপনাকে আরো একটা কথা বলি মিস চিত্ৰলেখা, যখন-তখন আপনি মিটিং ডাকবেন না। এতে সবারই কাজের ক্ষতি হয়। মিটিং যখন ডাকবেন–এজেন্ডা ঠিক করে ডাকবেন। এজেন্ডা জানা থাকলে আমাদের তৈরি হয়ে আসতে সুবিধা হয়।
আবেদ আলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। শুধু ফতেহ খান বললেন, ম্যাডাম তাহলে যাই? চিত্ৰলেখা বলল, আচ্ছা যান। তাকে সূক্ষ্মভাবে অপমান করা হলো তবে সে অপমান গায়ে মাখল না। সে বাবার চেয়ারে কিশোরী মেয়েদের মতো খানিকক্ষণ দোল খেল। তারপরই চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলল।
কিছু মজার মজার ফাইল এই ড্রয়ারে আছে। ফাইলগুলো বাড়িতে ছিল সে নিয়ে এসেছে। প্রতিদিনই সে খুব মন দিয়ে পড়ে। হিশামুদ্দিন সাহেব তার অফিসের প্রতিটা কর্মচারী সম্পর্কে আলাদা আলাদা নোট রেখে গেছেন। পড়তে পড়তে চিত্ৰলেখার প্রায় মনে হয়-বাবা যেন জানতেন একদিন চিত্ৰলেখা এই ফাইল পড়বে। পড়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
ফাইল তৈরি করা ছাড়াও হিশামুদ্দিন সাহেব আরো একটা কাজ করে গেছেন। কোম্পানি পরিচালনা সম্পর্কে দীর্ঘ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। চিঠির মতো করে লেখা এই নির্দেশনামা চিত্ৰলেখা বলতে গেলে প্ৰতিদিনই একবার করে পড়ছে।
মা চিত্ৰলেখা,
তোমার মাথায় বিরাট দায়িত্ব এসে পড়েছে। তোমার কি মনে হচ্ছে তোমার মাথায় তিন মণ ওজনের পাথর চেপে বসেছে? তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছ না?
যদি এ রকম মনে হয় তুমি পাথর ছুড়ে ফেলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আমি একটি কর্মকাণ্ড শুরু করেছি। আমার মৃত্যুর পরেও তা চলতে থাকবে এ জাতীয় চিন্তাভাবনা আমার কোনো কালেই ছিল না। এই পৃথিবীতে সবকিছুই সাময়িক।
অবশ্য পুরো ব্যাপারটা তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দেখতে পার। আমার ধারণা তোমার সেই যোগ্যতা আছে। যদি তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও তাহলে তোমাকে আমার কিছু উপদেশ দেবার ইচ্ছা।
পুরনো কালে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধবিগ্ৰহ চলত। দু দল যুদ্ধ করছে। সেনাপতিরা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এই সময় হঠাৎ যদি কোনো কারণে কোনো একদলে সেনাপতি নিহত হয় তখন সেই দল সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়। সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অস্ত্র ফেলে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। এই ব্যাপারটা এখনো আছে৷ এখনো সেনাপতির মৃত্যু মানে যুদ্ধে পরাজয়। সৈন্যরা এখনো যুদ্ধ করে তাদের নিজেদের জন্যে না–যুদ্ধ করে তাদের সেনাপতির জন্যে।
সেনাপতিকে সৈন্যদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই কাজটা সবচে’ কঠিন। তুমি তা পারবে। ভালোভাবেই পারবে।
কোম্পানি পরিচালনা শুরুতে তোমার কাছে জটিল মনে হবে–কাজটা কিন্তু জটিল নয়। ঘোড়ার পিঠে চড়া এবং ঘোড়াটাকে দৌড়ানো শুরু করাটা জটিল, কিন্তু একবার যখন ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করে তখন জটিলতা কিছু থাকে না। শুধু দেখতে হয়–পথ ঠিক আছে কি না। পথে কোনো খান্দা-খন্দ পড়ল কি না। অবশ্য আরেকটা জিনিস দেখতে হয় তোমার শেষ সীমাটা কোথায়? গোলটী কী?
তুমি অবশ্যই কোমল হবে। সেই কোমলতার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নির্মমতাও তোমার মধ্যে থাকতে হবে। যেখানে নির্মম হওয়া দরকার সেখানে কখনো কোমল হবার চেষ্টা করবে না। দয়া, করুণা এইসব মানবিক গুণাবলি কোম্পানি পরিচালনার কাজে আসে না বরং কাজ শ্লথ করে দেয়। মনে কর কেউ একটা অন্যায়। করল, কিংবা কারো কোনো কাজে কোম্পানি ক্ষতিগ্ৰস্ত হলো। তুমি যদি তার শাস্তি না দাও। তাহলে এই অন্যায়টি সে আবারো করবে। সে ধরে নেবে যে সে ক্ষমা পেয়ে যাবে। শুধু সে না। অন্যরাও তাই ভাববে। You have to be cruel, only to be kind. কাজের পুরষ্কার যেমন থাকবে তেমনি অন্যায়ের শাস্তিও থাকবে।
ক্ষমা অত্যন্ত মহৎ গুণ। কোম্পানি পরিচালনায় ক্ষমা একটা বড় ত্রুটি।
কোম্পানির কার্যপ্ৰণালীর প্রতিটি খুঁটিনাটি তোমাকে জানতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি:–কোম্পানির অতি তুচ্ছ কাজ যে কজন করে তাদের একজন হলো রশীদ। রশীদ হলো সাইকেল পিয়ন। তার একটা সাইকেল আছে। হাতে হাতে চিঠি পাঠাতে হলে চিঠি এবং ঠিকানা দিয়ে রশীদকে বললেই সে চলে যাবে। তুমি কি জান রশীদ তার এই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করে। তাকে তুমি ঠিকানা লিখে চিঠি দেবে এবং তা সে পৌঁছাবে না। এটা কখনো হবে না।
একবার কী হয়েছে শোনা –সে একটী চিঠি নিয়ে গেল। যার চিঠি সে বাসায় ছিল না। রশীদ বাসার সামনে রাত তিনটা পর্যন্ত বসে রইল। কোম্পানি ঠিকমতো তখনই চলবে যখন যার যা কাজ তা ঠিকমতো করা হবে।
তোমাকে দায়িত্ব গ্ৰহণ করার পর একটি অপ্রিয় কাজ করতে হবে–কাজটা হচ্ছে জেনারেল ম্যানেজার পদে নতুন কাউকে আনা। অবশ্যই তোমাকে আবেদ আলিকে অপসারণ করতে হবে। কাজটা আমিই করে যেতাম। তোমার জন্যে রেখে গোলাম। আবেদ আলি অত্যন্ত কর্মঠ। সে নিজের কাজ খুব ভালো জানে। তার সমস্যা হলো সে নিজেকে এখন অপরিহার্য বিবেচনা করছে। যখন এই কাজটা কেউ করে তখন নানান সমস্যা হতে থাকে। সে নিজের স্বার্থটিকে প্ৰাধান্য দেয়। কাজকর্মেও হেলাফেলা ভাব চলে আসে। সে তার প্রতি অনুগত একটা শ্রেণীও তৈরি করে নেয়। আবেদ আলি তাই করেছে।
আবেদ আলির চাকরির টার্মিনেশন লেটার আমি তৈরি করে রেখেছি। আইনগত কিছু জটিলতা আছে বলেই তৈরি করে যাওয়া। তুমি যদি কোম্পানির দায়িত্ব নাও তাহলে এই টার্মিনেশন লেটার সই করে তুমি তাকে দেবে। আর তুমি যদি দায়িত্ব না নাও তাহলে যেমন আছে তেমনি থাকবে। তোমার অনুপস্থিতিতে তার প্রয়োজন আছে…
চিত্ৰলেখা আবেদ আলির চাকরির টাৰ্মিনেশন লেটারে নিজের নাম সই করল। তারিখ বসাল। ইন্টারকমে বলে দিল–সাইকেল পিয়ন রশীদকে যেন পাঠানো হয়।
রশীদ এসে দাঁড়াল মাথা নিচু করে। বেঁটেখাটো মানুষ। মালিক শ্রেণীর কারো দিকে চোখ তুলে তাকানো বোধহয় তার অভ্যাস নেই। সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।
কেমন আছ রশীদ?
ভালো।
এই ঠিকানায় একটা চিঠি দিয়ে এসো।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার সাইকেলটি ঠিক আছে?
বেল নষ্ট।
বেল ঠিক করার ব্যবস্থা কর।
কোযারটেকার স্যারকে বলেছিলাম।
উনি ব্যবস্থা করেন নি?
রশীদ চুপ করে রইল। সে কখনো তার ওপরওয়ালাদের বিষয়ে কোনো নালিশ করে না।
আচ্ছা আমি বলে দেব।
আমি চলে যাব? চিঠি দিয়ে এসে আপনাকে রিপোর্ট করব?
দরকার নেই। তুমি যাও। চিত্ৰলেখা কেয়ারটেকারকে ডেকে পাঠাল। কেয়ারটেকারের নাম সালাম। সে
ভীতমুখে সামনে এসে দাঁড়াল।
কেমন আছেন সালাম সাহেব?
জ্বি, আপা ভালো। কাজকর্মে মন বসছে না আপা।
মন বসছে না কেন?
স্যার নাই। কী কাজ করব কার জন্য করব?
আমার জন্যে করবেন।
তা তো অবশ্যই। . আমাদের যে সাইকেল পিয়ন রশীদ তার সাইকেলের বেল নষ্ট। বেল ঠিক হচ্ছে না কেন?
আমাকে তো আপা সে কিছু বলে নাই।
সে বলেছে। যেহেতু আপনার কাজকর্মে মন নাই আপনি শুনতে পান নি। বাবার মৃত্যুতে আপনি এতই ব্যথিত যে, কোনো কিছুই আপনি এখন মন দিয়ে শুনছেন না। আচ্ছা। আপনি যান–আমাদের জিএম সাহেবকে একটু আসতে বলে দিন।
জ্বি আচ্ছা। চিত্ৰলেখা ঘড়ি দেখল। তিনটা বাজে। অফিস আরো এক ঘণ্টা চলবে। সে অফিস থেকে ঠিক চারটায় বের হবে। আজ তার পরিকল্পনা হলো রাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটা।
আবেদ আলি বিরক্তমুখে ঢুকলেন।
আমাকে ডেকেছেন?
চিত্ৰলেখা বলল, আবেদ আলি সাহেব বসুন।
মিটিঙের মাঝখান থেকে উঠে এসেছি।
কীসের মিটিং?
এলসি খোলার দেরি এবং ইরেগুলারিটি বিষয়ে একটা তদন্তের ব্যবস্থা করছি।
ও আচ্ছা।
কী জন্যে ডেকেছিলেন?
একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গের জন্যে ডেকেছি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন, তারপর বলছি।
আবেদ আলি বসলেন। তার ভুরু কুঞ্চিত। চিত্ৰলেখা খুব সহজ এবং স্বাভাবিক গলায় বলল, কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে একটি অপ্রিয় কাজ করতে হচ্ছে। আপনার সার্ভিস আমাদের আর প্রয়োজন নেই। আমাদের কাছে মনে হচ্ছেকোম্পানির স্বাৰ্থ আপনি এখন আর আগের মতো দেখছেন না। সত্তর হাজার পাউন্ডের যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে—তার দায়-দায়িত্বও সম্পূর্ণ আপনার।
কী বলছেন?
যা সত্যি তা বলছি।
আমাকে ছাড়া আপনি তো সাত দিনও চলতে পারবেন না। আপনি তো সামান্য মানুষ আপনার বাবারও আমি ডানহাত ছিলাম।
আমার বাবা যেহেতু নেই; আমার বাবার ডানহাতেরও প্রয়োজন নেই তাই না? নিন এটা হচ্ছে আপনার জব টামিনেশন লেটার। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন, এই চিঠি বাবাই লিখে টাইপ করে রেখে গেছেন। আমি শুধু নাম সই করেছি। কিছু কিছু মানুষ মৃত্যুর পরেও তাদের উপস্থিতির ব্যবস্থা রেখে যায়।
আবেদ আলি চিঠি পড়ছেন। তার হাত কাঁপছে। ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অপ্ৰত্যাশিত।
আবেদ আলি সাহেব!
জ্বি।
আপনার দায়িত্ব আপনি এজিএম সাহেবকে বুঝিয়ে দেবেন।
ম্যাডাম ব্যাপারটা কি আরেকবার কনসিন্ডার করা যায় না?
জ্বি না, যায় না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে। আপনি এখন আসুন।
আপনি বিরাট সমস্যায় পড়বেন। হাতেপায়ে ধরে আবার আমাকেই আপনার আনতে হবে।
আনতে হলে আনব। এই মুহুর্তে আপনাকে আমাদের দরকার নেই।
চিত্ৰলেখা আরেক কাপ চায়ের কথা বলল। অফিসে বসার পর থেকে তার খুব ঘনঘন চা খাওয়া হচ্ছে। অভ্যাসটা কমাতে হবে। মাথা ধরেছে। মাথাধরা কমানোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ওষুধ খেতে ইচ্ছা করছে না। খোলা বাতাসে বসা দরকার। এসি দেয়া বদ্ধঘরে এক সময় দম আটকে আসে। চিত্ৰলেখা এসি বন্ধ করল। জানালার পরদা সরাল। জানালা খুলল। দিনের আলো নিভে আসছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেঘ বলেছে যাব যাব? মেঘেরা কোথায় যেতে চায়? হিমালয়ের দিকে না। অন্য কোথাও? মানুষের পাখা থাকলে ভালো হতো। মেঘদের সঙ্গে উড়ে বেড়াত। মেঘদের সঙ্গে বাস করলেই জানা যাবে মেঘেরা কোথায় যেতে চায়।
আসব?
চিত্ৰলেখা জানালা থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, আসুন। রশীদ তাহলে আপনাকে খুঁজে পেয়েছে। বসুন।
হাসান বসল। সে হিশামুদ্দিন সাহেবের এই বিশাল অফিসে এই প্রথম এসেছে। তার চোখে বিস্ময়।
চা খাবেন?
জ্বি না।
খেয়ে দেখতে পারেন। এরা চা খুব ভালো বানায়। দার্জিলিঙের চা পাতা এবং বাংলাদেশের চা পাতা সমান সমান নিয়ে একটা মিকচার তৈরি হয়। সেই মিকচার দিয়ে চা বানানো হয়।
তাহলে দিতে বলুন।
আপনাকে ডেকেছি। কী জন্যে জানেন?
জ্বি না।
আপনাকে ডেকেছি। কারণ আজ বিকেলে আপনাকে নিয়ে ঘুরব। গাড়িতে করে না।—হণ্টন।
বৃষ্টি আসছে তো!
আসুক। আমার একটা রেইনকোট আছে–আপনার জন্যে ছাতা আনিয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টির সময় রেইনকোট পরে হাঁ