এর আগে সে আটটা খুনের মামলা তদন্ত করেছে। এই আটজনের মধ্যে সাতজনের ফাঁসির হুকুম হয়েছে। পাঁচজনের ফাঁসি হয়ে গেছে। দুজনের এখনো হয়নি। তারা ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে। যে একজনের ফাঁসির হুকুম হয়নি, সে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। তার নাম জিলানি।
খলিল নিশ্চিত, জিলানি জোড়া খুনের হোতা। প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে। এই ভয়ংকর অপরাধী আবারও খুন করবে। খলিল তাকে লক্ষ রাখছে। সে আবারও ধরা খাবে। ফাঁসির হাত থেকে জিলানির মুক্তি নেই।
আমার মৃত্যুর বিষয়টা নিয়ে সে যে আজই তদন্তে নেমেছে, তা নয়। চার দিন আগেই তদন্তে নেমেছে। আমি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সে লক্ষ রাখছে। খোঁজখবর শুরু করেছে। তার চোখ আনন্দে চকচক করছে, আরও একজনকে সে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবে। সেই আরেকজনের নাম রুবিনা।
খলিলের মাথার ভেতর ফাঁসির দৃশ্য। রুবিনাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। জল্লাদ রুবিনার মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। রুবিনা বলছে, ‘না, না, না।’ ফাঁসির দৃশ্য দেখার জন্য উপস্থিত জেলার সাহেব হাতের রুমাল ফেলে দিলেন। এটাই সিগন্যাল। রুবিনা ফাঁসিতে ঝুলছে। তার আলতাপরা ফর্সা পা দুলছে।
আশ্চর্য, এখন খলিলের মাথায় কবিতা ঘুরছে। ইংরেজি কবিতা নয়, বাংলা কবিতা। ‘আট বছর আগের একদিন’। প্রথম থেকে নয়, হঠাৎ একেকটা লাইন।
‘কোনোদিন জাগিবে না আর!’
সে এই কবিতাটি ইংরেজি অনুবাদের চেষ্টা করছে। অনুবাদ পছন্দমতো হচ্ছে না বলে সে নিজের ওপর রেগে যাচ্ছে। কোনোদিন জাগিবে না আর’—শি উইল নেভার ওয়েক আপ। লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার’—‘নাও শি ইজ স্লিপিং অন দ্য মর্গ টেব্ন্।’
খলিল আমার ছাত্র ছিল। কিন্তু তাকে চিনতে পারছি না। জুঁই নামের যে মেয়েটা রাত তিনটায় টেলিফোন করেছিল, তাকে চিনতে পারিনি। জীবিত অবস্থার কিছু স্মৃতি কি নষ্ট হয়ে গেছে?
লাশকাটা ঘরের পলিথিন বিছানো নোংরা টেবিলে
লাশকাটা ঘরের পলিথিন বিছানো নোংরা টেবিলে আমার শরীর চিৎ হয়ে আছে। গায়ে কোনো কাপড় নেই। টেবিল থেকে ফিনাইলের কঠিন গন্ধ আসছে। ঘরের জানালা আছে। জানালায় হলুদ রঙের পর্দা ঝুলছে। পর্দা নোংরা। সেখানে কিছু বড় বড় নীল রঙের মাছি বসে আছে। মাছিগুলো কিছুক্ষণ বসে থাকে আবার ওড়াউড়ি করে পর্দার ওপর বসে। ঘরের চারটা দেয়ালের একটায় চুনকাম করা হয়েছে। সেখানে কেউ নোংরা কথা লিখেছে। নোংরা কথাটা—এইখানে মরা লাশের পোদ… হয়। যে কথাটা লিখেছে, সে নিজেকে অন্ধকারে রাখতে চাইছে না। মহৎ বাণীর নিচেই সে লিখেছে—ইতি জসিম। তার নিচে মোবাইল ফোনের নম্বর।
ঘরে নিশ্চয়ই অসহনীয় গরম। মুখে রুমাল চেপে দাঁড়ানো ডাক্তার দরদর করে ঘামছে। ডাক্তারের চেহারা সুন্দর। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে সোনালি চশমা। ডাক্তার মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে সিলিংফ্যানের দিকে তাকাচ্ছে। সিলিংফ্যান শব্দ করে ঘুরছে, তবে কোনো বাতাস পাওয়া যাচ্ছে না।
টেবিলের কাছে কাঁচি ও ছুরি হাতে ডোম দাঁড়িয়ে আছে। ডডামের গা খালি। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের বেঁটে মানুষ। তার সারা শরীরে ঘন লোম। নির্দেশের অপেক্ষা। ডাক্তার বললেন, পেটটা কেটে শুধু স্টমাক বের করো। ভিসেরা হবে।
ডোম বলল, ফুসফুস-কলিজা নিকালব না?
বললাম তো, শুধু স্টমাক। এত কথা বলো কেন? কাজ শেষ করো। গরমে মারা যাচ্ছি।
ডোম পেট কাটার বদলে, ফ্যানের সুইচ অফ করে দিল। ডাক্তার ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ফ্যান বন্ধ করলা কেন?
ফ্যান চললে কাম করতে পারি না।
ইয়ার্কি করো? ফ্যান চললে কাজ করতে পারো না।
ফ্যান চালায়া দিতেছি—কাটাকাটি আফনে করেন। আমি কাটব না। আর আমার সঙ্গে মিজাজ করবেন না। কালু ডোম মিজাজের ধার ধারে না।
কাজ করবে না?
না। যান, ‘রিপোর্ট’ করেন। আমার চাকরি খান। দেখি, আপনে কত বড় চাকরি খানেওয়ালা।
ডোম দরজার দিকে এগোচ্ছে। ডাক্তার ভীত গলায় বলল, ঠিক আছে। ফ্যান বন্ধ করেই কাজ করো। অল্পতে চেতে যাও কেন?
চলন্ত ফ্যান বন্ধ হয়েছে। মাছিরা পর্দা ছেড়ে আমার মুখের চারপাশে ওড়াউড়ি করছে। কখন নামবে বুঝতে পারছে না।
যতই সময় যাচ্ছে, আমার শীত বাড়ছে। শীতে শরীর কাঁপছে না, আমার শরীর বলে কিছু নেই। শীতের অনুভূতি বাড়ছে। একেকবার ঠান্ডা বাতাস আসে, সেই বাতাস কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়, তারপর বাতাস হঠাৎ থেমে যায়। শীত মনে হয় এই বাতাস নিয়ে আসছে। ঠান্ডা বাড়ার হার কি এক্সপানশিয়াল? তাহলে একটা সময় আসবে যখন আমরা এক্সপোনেনশিয়াল রেখার কাঁধে চলে আসব। সেই সময় শীত অসহনীয় পর্যায়ে বাড়তে শুরু করবে।
কালু ডোম কাটাকাটি শুরু করেছে। আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উপায় নেই, দেখতে হচ্ছে। দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর ব্যবস্থা এ জগতে নেই। মাছি যেমন চারদিক দেখতে পায়, আমিও পাচ্ছি।
ডাক্তার চোখ বন্ধ করে জানালার হলুদ পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে হঠাৎ চোখ মেলে একপলকের জন্য শবদেহের দিকে তাকিয়ে ছুটে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। ডাক্তার পেটে হাত দিয়ে লাশকাটা ঘরের বারান্দায় বসে বমি করছে। আহা, বেচারা!
কী যেন হয়েছে। মুহূর্তের জন্য আমার দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে আবার স্পষ্ট হয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখি বড় মামার ফার্মেসি। এইমাত্র ফার্মেসি খোলা হয়েছে। বাচ্চা একটা ছেলে মেঝেতে পানি ছিটিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে। বড় মামা কাউন্টারে বসে আছেন। তিনি বললেন, পত্রিকা এখনো আসে নাই?