বারান্দা ফাঁকা। ওয়াকিটকি হাতে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখছি। ইনি হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, পুলিশ অফিসার কথা বলছেন আমাকে নিয়ে।
ডেডবডি রিলেটিভদের হাতে ট্রান্সফার করা হয়নি তো?
এখনো না।
ডেথ রিপোর্টে আপনারা কী লিখছেন?
ডেড রিপোর্ট এখনো তৈরি হয়নি।
আমি ডেথ রিপোর্টের কপি নিয়ে যাব। ডেডবডির সুরতহাল হবে। আমরা সাসপেক্ট করছি ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে।
বলেন কী? সাসপেক্ট কে?
এখনো জানি না। তদন্ত হচ্ছে।
পুলিশ অফিসার আমার কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ালেন। কেবিন নম্বর ৩২১। দরজায় আমার নাম লেখা, ড. ইফতেখারুল ইসলাম।
মৃত মানুষেরা নিঃশ্বাস ফেলে না। কারণ, বাতাস থেকে তাদের অক্সিজেন নেওয়ার কিছু নেই। তার পরও নিজের নামের দিকে তাকিয়ে আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলার মতো করলাম। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। আমি এই পৃথিবীতে ছিলাম, এখন নেই। হাসপাতালের কেবিনের দরজায় নামটা শুধু ঝুলছে।
পৃথিবীতে আমি ঝামেলামুক্ত ছিলাম। মৃত্যুর পর নানা ঝামেলায় জড়াচ্ছি। এখন জানছি, কেউ আমাকে খুন করেছে। সুরতহাল হবে। একজন ডাক্তার নাকে রুমাল চেপে আমার নগ্ন শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ডোম কাটাকাটি করবে। পাকস্থলীর খাদ্য কৌটায় বের করে পরীক্ষার জন্য পাঠাবে।
পত্রিকার নিশ্চয়ই নিউজ হবে। পত্রিকাওয়ালারা এই ধরনের খবরের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। প্রতিদিন খবরের ফলোআপ ছাপা হয়। পাঁচ থেকে ছয় দিনের মাথায় খবর ছাপা বন্ধ। সবাই সবকিছু ভুলে যায়।
পুলিশ অফিসার কেবিনের দরজা খুলে ঘরে উঁকি দিলেন। চোখমুখ কুঁচকে বললেন, ঘরে সিগারেটের গন্ধ। সিগারেট কে খেত?
পেশেন্টের স্ত্রী। তাকে অনেকবার নিষেধ করা হয়েছিল। মহিলা উগ্র স্বভাবের, কারও কথাই শোনেন না।
তিনি কোথায়?
বলতে পারছি না। ভোরবেলা কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছেন।
তার নম্বর কি আছে? আমি কথা বলব।
ডেস্কে নিশ্চয়ই আছে। আসুন, নম্বর বের করে দিচ্ছি।
আমি এই কেবিনে আছি। আপনি টেলিফোন নম্বরটা নিয়ে আসুন। আমাকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দেওয়া কি সম্ভব হবে?
আমি কোনো পুলিশ অফিসারকে কাছ থেকে দেখিনি। আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও পুলিশ সার্ভিসে কেউ নেই। রুবিনার এক চাচাতো ভাই আছে, পুলিশের এআইজি। একবারই তিনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আধা ঘন্টার মতো ছিলেন, সেই আধা ঘণ্টা তিনি ক্রমাগত মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। এত বিরক্ত মুখে আমি কাউকে কথা বলতে দেখিনি।
এই পুলিশ অফিসারকেও মনে হলো বিরক্ত। শুধু বিরক্ত না, অধৈর্য। প্রথমে ডিভানের ওপর বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিভান ছেড়ে বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিল। সেখান থেকে ফিরে এসে রোগীর বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ওষুধের বোতল হাতে নিয়ে শুকতে লাগল।
জিনিস শুকার বাতিক তার মধ্যে প্রবল বলে মনে হচ্ছে। সে সবকিছুই শুকছে। ক্লমেট খুলে সে রুবিনার কিছু পোশাক ঝুলন্ত পেল। পোশাকগুলো শুকল। রোগীর ওষুধের টেবিলের ড্রয়ার অনেক টানাটানি করে খুলল। সেখানে রুবিনার সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার। সে সিগারেটের প্যাকেট শুকল। প্যাকেট খুলে সিগারেট বের করে সিগারেট শুকল। লাইটারটা কয়েকবার জ্বালিয়ে-নিভিয়ে লাইটার শুকল।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমি যখন পিএইচডি করি, তখন লস্কনামের একটা টিভি সিরিয়াল দেখতাম। কলম্বো হলো সিরিয়ালের নায়ক। সে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে। পিটার ফক নামের একজন অভিনেতা কলম্বো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অসাধারণ অভিনয়। তারও শুকার বাতিক ছিল। তদন্ত করতে গিয়ে যা দেখতেন, তা-ই কতেন। বেশির ভাগ সময় জিভে লাগিয়েও দেখতেন। একটা দৃশ্যে তিনি সাসপেক্টের বাড়িতে গিয়ে সেন্টের একটা শিশি পেলেন। যথারীতি শুকে দেখলেন। জিভে খানিকটা লাগিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের জামায় খানিকটা স্প্রে করলেন। শেষ পর্যন্ত এই সেন্টের শিশি আসামিকে ধরতে ভূমিকা রাখল।
বিদেশে পড়াশোনার জটিল সময়টায় কলঙ্কেসিরিয়াল আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। দেহধারী মানুষের অনেক আনন্দের ব্যবস্থাই পৃথিবীতে আছে। নাটক-সিনেমা-বই-গান-চিত্রকলা-সংগীত-পরকালে এমন ব্যবস্থা কি আছে? বা আসলেই কি আছে? আনন্দ এবং উত্তেজনায় অধীর হয়ে কলম্বোর মতো কোনো সিরিয়াল দেখার ব্যবস্থা কি আছে? মৃতদের সিনেমা দেখার জন্য ছবিঘর আছে? লাইব্রেরি আছে?
.
কফি নিয়ে একজন ওয়ার্ডবয় ঢুকেছে। তার হাতে একটুকরা কাগজ। মনে হয় রুবিনার টেলিফোন নম্বর। পুলিশ অফিসার কফির মগ হাতে নিলেন। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। তিনি কফিতে চুমুক দিয়ে নানাভাবে গন্ধ শুকলেন। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে গন্ধ পছন্দ হয়নি। তিনি মগ নামিয়ে রেখে টেলিফোন নম্বর লেখা কাগজটি হাতে নিলেন। নাকের সামনে ধরে কাগজেরও গন্ধ নিলেন। আমি আনন্দিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই রুবিনার মিষ্টি গলা শুনতে পাব। মৃত্যুর পরও এই সুবিধাটা হয়েছে—কেউ টেলিফোন করলে দুদিকের কথাই শোনা যায়।
মিসেস রুবিনা কথা বলছেন?
ইয়েস।
কেমন আছেন, ম্যাডাম?
ভালো। হু আর ইউ?
আমার নাম খলিল। খলিলুর রহমান। আমি ইফতেখার স্যারের ডাইরেক্ট ছাত্র। স্যারকে খুব ভালোমতো চিনতাম।