ওয়ার্ডবয় দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। দুজনের গলাই চনমনে। কথা বলেও আনন্দ পাচ্ছে। কথার বিষয়বস্তু হলো, তাদের স্যারের এক ভিডিও মোবাইলে ছাড়া হয়েছে। ভিডিওটা খুব স্পষ্ট নয়, তবে তাদের স্যারকে বোঝা যায়। কিন্তু মেয়েটাকে চেনা যায় না। নার্সের পোশাক পরা মেয়ে। একবারও তার চেহারা দেখা যায়নি।
একজন বলল, ভিডিও ঠিকমতো করতে পারে নাই। প্রথমেই দুজনের চেহারা দেখানো উচিত ছিল। বাকিটা পরে দেখালে চলত।
দ্বিতীয়জন বলল, ক্যামেরাও ঠিকমতো ধরতে পারে নাই। হাত কাঁপছে।
মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কানছে। কী জন্য, এটা তো বুঝলাম না। প্রথমে তো হাসিখুশি ছিল।
হাসিখুশি বুঝলা কেমনে, মুখ তো দেখ নাই?
হাসির শব্দ শুনলাম না?
মনে হয় প্রথমেও কানছে। মুখ না দেখা গেলে হাসির শব্দ, কান্দনের শব্দ সব এক রকম।
এটা কী বললা?
হ্যাঁ। একবার আমার পুলার কান্দন শুইনা দৌড়ে গিয়া দেখি, সে হাসতেছে।
জটিল কথা বলো তো। হাসি আর কান্দনের শব্দ একই।
তারা মূল আলোচনা থেকে সরে গেছে। হাসি-কান্নার শব্দ অ্যানালাইসিস হচ্ছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি তাদের স্যারের ভিডিও দেখার জন্য আগ্রহ বোধ করছি। ভিডিও দেখে মেয়েটা হাসছে না কাঁদছে, সেটা জানার চেষ্টা। মৃত্যুর পরও কি যৌনচেতনা থেকে যায়? নিশ্চয়ই থাকে। না থাকলে নোংরা ভিডিও দেখার ইচ্ছে হতো না। কোনো যুক্তিতেই মৃত্যুর পরের যৌনচেতনার বিষয়টা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। পুরুষ যুবতী তরুণীর প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে, তার কারণ প্রকৃতি চায় মানবজাতির অস্তিত্ব টিকে থাকুক, তারা বংশবিস্তার করুক।
একজন মৃত পুরুষ কোনো মৃত তরুণীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করবে না। কারণ, তাদের বংশবিস্তারের কিছু নেই। শরীরই নেই, বংশবিস্তার অনেক পরের ব্যাপার।
ওয়ার্ডবয় দুজন চলে গেছে। আমি কেবিনঘরে আটকা পড়ে আছি। আমার শরীর কোথায় জানি না। রুবিনা কোথায় কী করছে, তা-ও জানি না।
মৃত্যুর পর অতি অচেনা এক জগতে আমি ঢুকে পড়েছি। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে। বিদেশেও বাড়িঘর আছে, মানুষ আছে; কিন্তু সবই কিছুটা আলাদা। ওদের ভাষা আলাদা, নিয়মনীতি আলাদা। রাস্তাঘাট সবই অচেনা।
বিদেশ ভ্রমণে একজন গাইড খুব প্রয়োজন। যে সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। রাস্তাঘাট চেনাবে। দর্শনীয় জায়গা দেখাবে। পরকালেও আমাদের একজন গাইড দরকার। আমি তো জানতাম, মৃত্যুর সময় মৃত আত্মীয়স্বজনেরা চারদিকে ভিড় করে। তাদের প্রধান চেষ্টা অপরিচিত ভুবনে মৃতের যাত্রা সহজ করে দেওয়া।
আমার সবচেয়ে ছোট ফুফু ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। তীব্র ব্যথায় দিনরাত পশুর মতো গোঙাতেন। ব্যথা কমানোর কোনো ওষুধপত্র তাঁর জন্য কাজ করছিল না। তার কষ্ট বর্ণনার অতীত। মৃত্যুর ঘণ্টা খানেক আগে হঠাৎ তার সব ব্যথাবেদনা চলে গেল। তাঁর মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। আমি আর বড় মামা তখন তাঁর ঘরে। ফুফু বড় মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার চিৎকারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই আমাকে ছেড়ে গিয়েছে, কেউ আমার ঘরে উঁকিও দেয় না। শুধু আপনি দিনের পর দিন আসছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছেন, আমার কষ্ট দেখে চোখের পানি ফেলেছেন। আপনার সঙ্গে এই পাগলটা আসছে। পাগলা দৌড় দিয়ে যা, আমার জন্য একটা ললি আইসক্রিম কিনে আন। লাল রঙের আনবি। (ছোট ফুফু আমাকে সব সময় পাগলা ডাকতেন।)।
লাল রঙের ললি আইসক্রিম কিনে এসে দেখি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষভর্তি ঘর। কে একজন উঁচু স্বরে কালেমা পড়ছেন। ছোট ফুফু বাম কাত হয়ে শুয়ে আছেন। তিনি চোখ বড় বড় করে এদিক-ওদিক দেখছেন। হঠাৎ বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার মতো করে বললেন, আম্মাজি আসছেন। আম্মাজি আমারে নিতে আসছেন।
কালেমা পাঠ বন্ধ হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি ফুফুর দিকে। ফুফু একদিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, আম্মাজি, একা আসছেন? আর কেউ আসে নাই?
ফুফুর মৃত আম্মাজি হয়তো জবাব দিলেন, আমরা সেই জবাব শুনতে পারলাম না। ফুফু বললেন, হ্যাঁ, এখন সবাইরে দেখতেছি। হ্যাঁ আম্মাজি, তাদের সালাম দিতে ভুলে গেছি। আসসালামু আলাইকুম।
হঠাৎ ফুফু আতঙ্কিত গলায় বললেন, আম্মাজি, এই মেয়েটা কে? আমার ভয় লাগতেছে, আমার ভয় লাগতেছে। এটা কে?
বড় মামা বললেন, জোবেদারে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে শুয়ায়ে দাও।
সবাই কালেমা পাঠ করো, বলল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
.
ছোট ফুফুকে নিতে সবাই এসেছিল। তাঁর অপরিচিত একজন মহিলাও এসেছিলেন। আমাকে নিতে কেউ আসেনি। মৃতকে পথ দেখিয়ে নেওয়ার জন্য মনে হয় কেউ আসে না। সবটাই অসুস্থ মানুষের কল্পনা। আমি কেবিনের মেঝেতে তিনটা তেলাপোকা ছাড়া কিছু দেখছি না। একটার গায়ের রং কুৎসিত সাদা। রুবিনা এই তেলাপোকাটা দেখলে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে পড়ত। তার মতে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত, সবচেয়ে নোংরা, সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীর নাম তেলাপোকা।
রুবিনার ধারণা, মৃত্যুর পর সে অবশ্যই দোজখে যাবে। তার দোজখে কোনো আগুন থাকবে না। অসংখ্য তেলাপোকা কিলবিল করবে। কিছু তেলাপোকা থাকবে সাদা রঙের। এই তেলাপোকারা তার গা বেয়ে উঠতে থাকবে।
আমি মেঝের তেলাপোকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ দেখি বারান্দায় চলে এসেছি। লম্বা বারান্দা চোখের সামনে ভাসছে। কেবিন থেকে কী করে বারান্দায় চলে এসেছি, তা জানি না।