ডাক্তার বলল, বেশি আগে না। অল্প আগে।
রুবিনা বলল, এমন কোনো সম্ভাবনা কি আছে, সে চাদর সরিয়ে উঠে বসে পানি খেতে চাইবে?
ডাক্তার-নার্স মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। রুবিনা বলল, আপনারা চলে যান, আমাকে একটু একা থাকতে দিন।
ডাক্তার বলল, ডেডবডি সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করি।
রুবিনা বলল, না।
নার্স বলল, আমরা চলে গেলে আপনি ভয় পাবেন।
রুবিনা বলল, ভয় পাব কেন? জীবিত মানুষকে ভয় পাওয়ার ব্যাপার আছে। মৃত মানুষকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে যদি জেগে উঠে বলে, এক গ্লাস পানি খাব, আমি খুব স্বাভাবিক গলায় বলব—ঠান্ডা পানি দেব, না নরমাল?
ডাক্তার বলল, আপনার আত্মীয়স্বজন কাউকে খবর দেব?
রুবিনা বলল, খবর আমিই দেব। আপনারা ডেথ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করুন।
ডাক্তার ও নার্স চলে যাওয়ার পর পর রুবিনা আমার মুখের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিল। পানির বোতল থেকে পানি খেল। বিরক্ত গলায় বলল, এখনো স্যালাইন যাচ্ছে। এইসব খুলে নাই কেন! গাধা নার্স, গাধা ডাক্তার!
রুবিনা মোবাইল নিয়ে তার বিছানায় আধা শোয়া হয়ে বসেছে। তার হাতে সিগারেটের প্যাকেট। নতুন একটা স্টিক আঙুলের পাশে ধরা। এখনো জ্বালানো হয়নি।
হ্যালো। কাদের কাদের? আমার গলা শুনে বুঝতে পারছ না, আমি কে? খামাখা কে কে করছ। তোমার মোবাইলে তো আমার নাম ওঠার কথা। নাম উঠেছে কিনা দেখো।
ম্যাডাম, উঠেছে।
আমি দুজনের কথাবার্তাই পরিষ্কার শুনছি। কাদেরের গলা শুনে মনে হচ্ছে, তার ঘুম এখনো কাটেনি।
কাদের, মন দিয়ে শুনছ?
জি, ম্যাডাম।
তোমার স্যার মারা গেছেন।
কী সর্বনাশ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। কখন মারা গেছেন?
কখন মারা গেছেন, এটা ইম্পর্টেন্ট না। মারা গেছেন, এটা ইম্পর্টেন্ট। তুমি গাড়ি পাঠাও, আমি বাসায় ফিরব। হট শাওয়ার নেব।
সবাইকে খবর দিব, ম্যাডাম?
এত রাতে কাউকে খবর দেওয়ার কিছু নেই। সবাই ঘুমাচ্ছে। সকাল সাড়ে আটটার পর খবর দেওয়া শুরু করবে।
জি, আচ্ছা, ম্যাডাম।
সবাই বাসায় আসার জন্য ব্যস্ত হবে। তাদের বলবে, ডেডবড়ি বাসায় নেই।
হাসপাতালে আছে বলব?
না। বলবে কবর হবে তোমার স্যারের বাবার কবরের পাশে। ডেডবড়ি নিয়ে গাড়ি রওনা হয়ে গেছে।
অনেকেই যেতে চাইবে।
যারা যেতে চাইবে, তারা নিজ ব্যবস্থায় যাবে। বুঝেছ?
পলিন আপুকে কি খবর দেব?
পলিন ঘুমাচ্ছে না?
জি।
পলিন খুব স্বাভাবিক মেয়ে না, এটা তুমি জানো।
ঘুম ভাঙিয়ে তাকে দুঃসংবাদ দেওয়ার কী আছে? এ রকম একটা খবর শুনলে সে কী করবে, সেটা তুমিও জানেন না, আমিও জানি না। সকাল নয়টার সময় তুমি রবিকে টেলিফোন করবে। সে নয়টার আগে ওঠে না। ডেডবডি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া, দাফনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার। আমি এখন আমার মোবাইল অফ করে দিচ্ছি। ড্রাইভার এখনই পাঠাও।
জি, ম্যাডাম।
কাঁদছ নাকি? কাঁদার কিছু নাই। জন্মালে মরতে হয়। তুমি মরবে, আমি মরব। তোমার পুরা গোষ্ঠী মরবে, আমার পুরা গোষ্ঠী মরবে। ঠিক না?
জি, ম্যাডাম।
আমার শোবার ঘরের এসি ছেড়ে ঘরটা ঠান্ডা করে রাখো। বাসায় ফিরে আমি কিছুক্ষণ রেস্ট নেব।
জি, ম্যাডাম।
.
রুবিনা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে কাপড় বদলাচ্ছে। আমি একজন মৃত মানুষ, তার পরেও আতঙ্কে অস্থির। দরজা লক করা না। যেকোনো সময় যে-কেউ কেবিনে ঢুকতে পারে। আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম, চোখ বন্ধ করা গেল না। সব আমার চোখের সামনেই ঘটছে। জীবিত অবস্থায় কোনো কিছু দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করতাম, এখন তা সম্ভব না? সবকিছুই আমাকে দেখতে হবে?
কেবিনের দরজা খুলে নার্স ঢুকল। বাঁচা গেছে, এর মধ্যে রুবিনার কাপড় বদলানো হয়ে গেছে। ড্রেস বদলানোর কাজটা সে অত্যন্ত দ্রুত করতে পারে।
নার্স বলল, ম্যাডাম আপনি কি চলে যাচ্ছেন?
হুঁ।
ডেডবডি নিয়ে যাবেন না?
রুবিনা বলল, না। আপনারা রেখে দিন।
নার্স হতাশ চোখে তাকাচ্ছে। তাকে হতাশ অবস্থায় রেখে রুবিনা বের হয়ে গেল। আমার বলতে ইচ্ছা করছে, সিস্টার! আমার স্ত্রীর ব্যবহারে আপনি মন খারাপ করবেন না। সে এ রকমই। ডেডবডি সে ফেলে রেখে যাবে না। যথাসময়ে নিয়ে যাবে। সে বাসায় যাচ্ছে। হট শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ এসি রুমে বিশ্রাম করবে। তারপর সব ব্যবস্থা হবে।
আমি বলতে চাচ্ছি, কিন্তু বলতে পারছি না। এটা তো ঠিক না। আমাকে কথা শোনার শক্তি দেওয়া হয়েছে, কথা বলার শক্তি কেন দেওয়া হবে না?
কেবিনে আরও দুজন ঢুকেছে। এরা ওয়ার্ডবয় বা এ রকম কিছু। হাতের ক্যানোলা থেকে নল সরিয়ে, বেড টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় নিচ্ছে, কে জানে। আমি হঠাৎ অস্থির বোধ করলাম, বেডের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কি যাব? না কি আমাকে এ ঘরেই থাকতে হবে। আমার আলাদা কোনো শরীর থাকলে, হাত-পা থাকলে আমার ডেডবড়ি যেখানে যাচ্ছে, সেখানে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম। আমার তো শরীর নেই। যা আছে তা খুব সম্ভব চেতনা। চেতনা কি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে? নাকি আমার চেতনা এই ঘরেই সীমাবদ্ধ। এখানে যা হবে, শুধু তা-ই আমি জানব। বাইরের কিছু জানব না, এটা তো ঠিক না! ভেরি আনফেয়ার।
যা ভয় করেছিলাম তা-ই, আমি কেবিন-ঘরে আটকা পড়ে আছি। ওয়ার্ডবয় দুজন ঘর পরিষ্কার করছে। মপ দিয়ে মুছছে। ঘরে স্প্রে করছে। বাথরুম ধুচ্ছে। মৃত্যু কি অশুচি বিষয়? যেখানে কেউ মারা যায়, সেই জায়গা কি অশুচি হয়ে যায়?