বড় মামা যেকোনো মানুষের সঙ্গে অতিদ্রুত ঘনিষ্ঠতা করতে পারেন। রুবিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে তাঁর মোটেই সময় লাগল না। মাঝেমধ্যেই
সে মামার ফার্মেসিতে সানগ্লাসে চোখ ঢেকে বসে থাকত।
আমার সঙ্গে রুবিনার মামার ফার্মেসিতেই প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতে বুকে ধাক্কার মতো লাগল। কাউন্টারের পেছনে হলুদ পরি বসে আছে। আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রুবিনা বলল, কী লাগবে, বলুন? তার প্রশ্নে আমার থতোমতো ভাব কাটল না, বরং আরও বাড়ল। আমি গেছি মামার খোঁজে। মামা ফার্মেসিতে নেই। এই হলুদ পরিকে কী বলব? বড় মামার খোঁজে এসেছি? বড় মামা বললে কি এই মেয়েটি চিনবে? নাকি বড় মামার নাম বলব? আমার মাথার ভেতর এতই জট পাকিয়ে গেছে যে কিছুতেই বড় মামার নাম মনে করতে পারলাম না।
রুবিনা বলল, কোনো কাজ ছাড়া ফার্মেসির সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। এই বলে রুবিনা হাই তুলল। হাই তুললে পৃথিবীর সব মানুষকেই কুৎসিত দেখায়। এই মেয়েটির বেলায় মনে হলো, তার হাই তোলাও একটি নান্দনিক দৃশ্য।
এই হলুদ পরির সঙ্গে বড় মামা আমার বিয়ের ব্যবস্থা কীভাবে করলেন, সেটা ভালোমতো জানি না। বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগোনোর পর রুবিনার সঙ্গে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। রুবিনা স্যুপে চুমুক দিয়ে ঠোট বাঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ স্যুপের বাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, স্যুপে তেলাপোকার গন্ধ পাচ্ছেন?
আমি বললাম, না।
চট করে না বলে ফেললেন? তেলাপোকার গায়ের গন্ধ কেমন, সেটা জানেন?
না।
রুবিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যদি সত্যি সত্যি আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, তাহলে তেলাপোকা ধরে তার গায়ের গন্ধ আপনাকে শোকাব।
আচ্ছা।
আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অনেকের সঙ্গেই আমার বিয়ের কথা হয়েছে। কয়েকবার এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়ে গেছে, কিন্তু বিয়ে হয়নি। আমিও তাদের আংটি ফেরত দিইনি। এখন যে আংটি পরে আছি, সেটা এনগেজমেন্টের আংটি। আংটির পাথরটা হীরার। কত বড় হীরা, দেখেছেন?
হুঁ।
আসল হীরা না। নকল হীরা। আমেরিকান ডায়মন্ড। আশ্চর্য, আপনি তো দেখি তেলাপোকার গন্ধওয়ালা স্যুপ খেয়ে শেষ করে ফেলেছেন। আরেক বাটি খাবেন? আমারটা খেয়ে ফেলুন।
না।
খাবেন না কেন? আমি মুখ দিয়েছি সেই জন্য? আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আমার শরীরের জীবাণু আপনার শরীরে ঢুকে যাবে?
আমি চুপ করে রইলাম। রুবিনা বলল, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যখন গ্রহণ করে, তার জীবাণুসহই গ্রহণ করে। আমাকে বিয়ে করতে চাইলে, আমাকে জীবাণুসহই গ্রহণ করতে হবে। রাজি আছেন?
হ্যাঁ, রাজি আছি।
তাহলে আমার মুখ দেওয়া স্যুপটা খেয়ে ফেলুন। পুরোটা খেতে হবে না। কয়েক চামচ খেলেই হবে।
আমি স্যুপের চামচে মুখ দিলাম। হঠাৎ রুবিনার দিকে চোখ পড়তেই দেখি, সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমরা সাধারণত একজন আরেকজনের দিকে তাকাই না।
এই মুহূর্তে রুবিনা আমার সামনে। তার চোখে সেই পুরোনো অদ্ভুত দৃষ্টি। কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা বিস্ময়, অনেকখানি বেদনা। রুবিনা আমার কপালে হাত রাখল। সেই হাত শীতল, না উষ্ণ—বুঝতে পারলাম না। মৃত মানুষের হয়তো বা স্পর্শানুভূতি নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। মৃত মানুষ যদি দেখতে পারে, যদি শুনতে পারে, তাহলে স্পর্শানুভূতি তার কেন থাকবে না? আমি তো গন্ধও পাচ্ছি। কপালের ওপর রাখা তার হাত থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে।
রুবিনা বিড়বিড় করে বলল, গাধী নার্স। বলে কী, মনে হয় মারা গেছে। মানুষটা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। এই নার্সটাকে কাপড় খুলে পাছায় লাথি দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া দরকার।
রুবিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই নার্স ডাক্তার নিয়ে ঢুকল। ডাক্তার আমার নাড়ি ধরল। তাকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। সে চোখের পাতা খুলে চোখের মণিতে টর্চ ফেলল। চোখে টর্চ ধরলে আমরা আলো ছাড়া কিছুই দেখি না। কিন্তু আমার দেখতে সমস্যা হচ্ছে না। নার্সের ভীত মুখ দেখছি, রুবিনার কৌতূহলী মুখ দেখছি, ডাক্তারের নির্বিকার মুখ দেখছি।
ডাক্তার আমার বিছানার পাশে বসে ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে স্টেথোস্কোপ বের করে আবার রেখে দিল। খানিকটা ইতস্তত ভঙ্গি করে বলল, ম্যাডাম, পেশেন্ট মারা গেছে।
ডাক্তার মনে হয় রুবিনার কাছ থেকে আর্তচিৎকার আশা করেছিল। সে রকম কিছু না দেখে ডাক্তার বিস্মিত।
রুবিনা সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিতে নিতে বলল, আমাকে সিগারেট ধরাতে হবে।
ডাক্তার বলল, ধরান, সিগারেট ধরান। অসুবিধা নেই।
রুবিনা বলল, ওর চোখের পাতাটা বন্ধ করে দিন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
নার্স চোখের পাতা বন্ধ করল না, তবে চাদর দিয়ে আমাকে পুরোপুরি ঢেকে দিল। এতে আমার দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। সবকিছু আগের মতোই দেখছি। এর অর্থ, আমি দেখার জন্য আমার শরীর ব্যবহার করছি না। রুবিনা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে বলল, টাইম কত দেখুন তো ডাক্তার সাহেব? কখন মারা গেছে, সবাই জানতে চাইবে।
তিনটা ছয়চল্লিশ মিনিট।
রুবিনা বলল, কতক্ষণ আগে মারা গেছে বলে আপনার ধারণা?