এশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, রুবিনা মেয়েটা অতি বুদ্ধিমতী। সে খুন করলে এমনভাবে করত যে তুমি ধরতে পারতে না।
রুবিনা অতি বুদ্ধিমতী, তোমাকে কে বলেছে?
কেউ বলেনি। আমার মন বলছে।
কথা সত্যি। শি ইজ ভেরি স্মার্ট।
.
খলিল তার স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে। তাদের সামনে এক কাপ চা। সেই কাপে একবার খলিল চুমুক দিচ্ছে, একবার এশা চুমুক দিচ্ছে।
তুহিন রাক্ষসের ছবি নিয়ে বারান্দায় ঢুকল। গাল ফুলিয়ে বলল, তোমরা হাত ধরাধরি করে বসে আছ কেন? হাত ছাড়ো। আমি খুব রাগ করেছি।
খলিল হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এশা বলল, কোথায় যাচ্ছ?
খলিল বলল, রুবিনা ম্যাডামকে একটা টেলিফোন করব।
.
রুবিনা তার মেয়ের ঘরে বসে আছে। পলিন হীরক সংগ্রহের খেলা খেলছে। একটা ভয়ংকর জায়গা পার হতে পারছে না। দুটা সাপ ছোবল দিয়ে মেরে ফেলছে। পলিন বলল, বাবা থাকলে এই সাপের জায়গাটা পার করে দিত। বাবা পারে, আমি পারি না।
রুবিনা বলল, সে এখন নেই। সাপখোপের জায়গা তোমাকে একাই পার হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গান আছে, একলা চলো, একলা চলো রে। রবীন্দ্রনাথকে চেনো না?
চিনি। সাদা দাড়ি আছে।
রুবিনার টেলিফোন বাজছে। সে টেলিফোন ধরল।
ম্যাডাম, আমি খলিল।
রুবিনা বলল, জানি। আপনার নাম উঠেছে।
আপনাকে টেলিফোন করলাম একটা কথা জানানোর জন্য। আপনি সন্দেহের তালিকায় নেই।
কে আছে, পলিন?
কেউ নেই। আপনার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল থেকে দেওয়া ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেটে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কথা লেখা। ভিসেরা রিপোর্ট মনে হয় ঠিক নয়। ভিসেরা পরীক্ষা নতুন করে করার ব্যবস্থা করছি।
রুবিনা বলল, আমি এখন খেতে যাব। আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
সামান্য বাকি আছে। আজ আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। এই উপলক্ষে আমার স্ত্রী প্রচুর খাবারদাবার রান্না করেছে। মৃত বাড়িতে বন্ধুবান্ধবের খাবার পাঠানোর প্রাচীন রীতি আছে। আমি কিছু খাবার পাঠাতে পারি?
রুবিনা বলল, পারেন। হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।
হঠাৎ একটা ধাক্কা অনুভব করলাম। সব অস্পষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। যে পরিকল্পনায় আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছে, সে পরিকল্পনার সমাপ্তি হয়েছে।
বুঝতে পারছি, আমাকে চলে যেতে হবে। কোথায় যাব? জানি না। মানুষ কোত্থেকে এসেছে, তা-ই সে জানে না। কোথায় যাবে, সেটা জানবে কীভাবে?
ইশ, আমার যদি শরীর থাকত, আমি রুবিনার হাতে হাত রাখতে পারতাম। পলিনের কপালে একটা চুমু খেতাম। মেয়েটা সাপের জায়গা নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে, তাকে সাপের জায়গাটা পার করে দিতাম।
ঘণ্টার শব্দ হচ্ছে। ঘণ্টা বেজেই থেমে যাচ্ছে না, অনেকক্ষণ ধরে রিনরিন করছে। ভয়াবহ শৈত্য আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে।
পলিনের আনন্দিত গলা শুনলাম। যে বলল, মা দেখো, আমি সাপের জায়গাটা পার হয়ে গেছি।
রুবিনা কী যেন বলল, তার কথা শুনতে পেলাম না। আমার শব্দ শোনার শক্তি কি নিয়ে নেওয়া হয়েছে? তাহলে ঘণ্টাধ্বনি শুনছি কীভাবে?
চারদিক কেমন জানি গুটিয়ে সিলিন্ডারের মতো হয়ে যাচ্ছে। সিলিন্ডারের শেষ প্রান্তে আলোর বন্যা। সেই আলোর ভয়াবহ চৌম্বক শক্তি। আমি ছুটে যাচ্ছি। আমি পেছন ফিরে বললাম, পৃথিবীর মানুষেরা! তোমরা ভালো থেকো। সুখে থেকো! আমি ছুটে যাচ্ছি আলোর দিকে। আমি জানি, আমাকে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। অসীম কখনো শেষ হয় না। তাহলে যাত্রা শেষ হবে কীভাবে?
কে বলে দেবে আমাকে?
.
পরিশিষ্ট
চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর
জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তরা।।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর