খলিল বলল, কিছু কিছু অনুষ্ঠান শুধু স্বামী-স্ত্রীর জন্য। বাইরের কেউ সেখানে থাকবে না।
আমি একগাদা খাবার রান্না করেছি। সব বারই তো তুমি অন্যদের বলতে।
আর বলব না। শুধু তুমি আর আমি।
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, তুমি আসলে ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির কথা ভুলে গেছ। ঠিক বলেছি না?
হুঁ।
ইচ্ছা করলে এখনো বলতে পারো। মাত্র আটটা দশ বাজে।
এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না। পাশে এসে বসো।
রান্না দেখাচ্ছি তো।
রান্না কাজের বুয়া যা পারে, দেখবে।
তরুণী সামনে এসে বসল। তুহিন ছবি আঁকা বন্ধ করে মুখ তুলে বলল, বাবা, তোমরা কিন্তু হাত ধরাধরি করবে না। তাহলে আমি রাগ হব।
স্বামী-স্ত্রী দুজনই হাসছে। তুহিন মা-বাবার হাত ধরাধরি ছাড়াই রাগ হয়েছে। সে রাক্ষসের ছবি নিয়ে চলে গেল। খলিল বলল, এশা! বিবাহবার্ষিকী কী জন্য ভুলে গেছি শোনো।
এশা বলল, বাদ দাও তো। বিবাহবার্ষিকী ভুলে যাওয়া তোমার জন্য নতুন কিছু না। প্রথম দুই বছর ছাড়া সব বারই ভুলে গেছ। শেষ মুহূর্তে আমি মনে করিয়ে দিয়েছি।
এবার মনে করিয়ে দিলে না কেন?
সন্ধ্যা ছয়টার সময় অনেকবার টেলিফোন করেছি।
তখন মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। আমি ভয়ংকর এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
ভয়ংকর কেন?
সে তার স্বামীকে বিষ খাইয়ে মেরেছে। তার পরেও কোনো বিকার নেই। তার স্বামীর ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে সে সাজগোজ করছিল।
এশা বলল, বানিয়ে কথা বলবে না তো।
বানিয়ে বলছি না। আমার সামনে বসে নখে নেলপলিশ দিচ্ছিল। আমি হতভম্ব।
এশা বলল, হয়তো তোমাকে হতভম্ব করার জন্যই কাজটা করেছে। মেয়েটা যে খুন করেছে, তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ। সব সন্দেহ রুবিনার ওপর।
রুবিনা নাম?
হুঁ। তার গাঁজা খাওয়ার অভ্যাসও আছে। হোয়াট এ ক্যারেক্টর?
এশা বলল, সাধারণত দেখা যায়, সব সন্দেহ যার ওপর, সে খুন করেনি। যাকে কেউ সন্দেহ করছে না, সে খুন করেছে।
খলিল বলল, গল্প-উপন্যাসে এ রকম দেখা যায়। এ রকম না হলে ডিটেকটিভ গল্প দাঁড়ায় না। বাস্তবে সব সন্দেহ যার ওপর, সে-ই খুনি। রুবিনা কী করেছে শুনতে চাও?
না। বিবাহবার্ষিকীতে খুনখারাবির গল্প কেন শুনব?
খলিল বলল, তাও ঠিক। আচ্ছা যাও, বাদ।
এশা বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তোমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে। বললা, শুনি।
খলিল বলল, রুবিনা উইপোকা মারার বিষয় কিনে এনেছে। উইপোকার বিষয় হলো কঠিন বিষ। বেদানার জুসভর্তি গ্লাসে অর্ধেক বোতল ঢেলেছে। তার স্বামীকে খাইয়েছে।
এশা বলল, রুবিনা দেখতে কেমন?
খলিল বলল, খুনি হলো খুনি। দেখতে রাজকন্যার মতো হলেও খুনি, দাঁত-উঁচা তাড়কা রাক্ষসীর মতো হলেও খুনি।
তার মানে, তোমার এই খুনি খুবই রূপবতী?
হ্যাঁ, রূপবতী। রূপবতীদের নানান ফ্যাকড়া থাকে। স্বামীর বন্ধুদের সঙ্গে প্রেম তাদের একটি। মোটিভ এটাই হবে।
আলোচনার এ পর্যায়ে আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, এশা। তোমার স্বামীর কথা বিশ্বাস করবে না। উইপোকার বিষের বিষয়টা আমার মনে পড়েছে। বিষ আমি আনিয়েছি। বড় মামার ফার্মেসির একটি ছেলেকে দিয়ে কিনিয়েছি। বিষ কিনিয়েছি আর একটা স্প্রে কিনিয়েছি। আমার বইয়ে উইপোকা ধরেছে। উইপোকা মারার জন্য। উইপোকার ওষুধ যেখানে পাওয়া গেছে, স্প্রেটাও সেখানে ছিল।
আমি কথা শেষ করলাম। কথা শেষ করা না-করায় কিছু যায়-আসে না। এশা মেয়েটির সঙ্গে বা জীবিত কারও সঙ্গেই আমার যোগাযোগের ক্ষমতা নেই।
এশা আমাকে চমকে দিয়ে তার স্বামীকে বলল, উইপোকার ওষুধ কেনা হয়েছে বইপত্রে দেওয়ার জন্য।
খলিল বলল, তুমি জানলে কোত্থেকে? তোমাকে কে বলেছে?
এশা বলল, আমাকে কে আবার বলবে? এ রকম মনে হচ্ছে বলে বলছি। ওষুধ যেখানে ছিল, সেখানে স্প্রে ছিল না? থাকার তো কথা।
খলিল চিন্তিত মুখে বলল, হ্যাঁ, ছিল। এখন মনে পড়েছে। তুমি কীভাবে বলছ?
এশা হাসতে হাসতে বলল, আমি প্রায়ই মন থেকে এমন সব কথা বলি, তা সত্যি হয়। তুমি তো এটা জানো।
খলিল হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ল। আমি বললাম, এশা! প্লিজ তোমার স্বামীকে বলল, রুবিনা তার স্বামীকে খুন করেনি। কেউ খুন করেনি। এটা ছিল সাধারণ মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাক বা অন্য কিছু। বলো এশা, বলো।
এশা বলল, রান্না হতে দেরি হবে। তুমি কি এক কাপ চা খাবে?
না।
খাও, এক কাপ চা। দুজন বারান্দায় বসে চা খাই, চলো। এক কাপ চা বানাব। তুমি একবার চুমুক দেবে। আমি একবার।
আচ্ছা যাও, চা বানাও।
আমি বললাম, চা পরে বানাবে এশা। আগে রুবিনা নির্দোষ, এটা বলো। দেরি করছ কেন?
এশা বলল, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, রুবিনা মেয়েটা নির্দোষ। তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
ভিসেরা রিপোর্টে অরগ্যানো ফসফরাস পাওয়া গেছে।
রিপোর্ট ভুল হয়েছে। আবার পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করো।
দেখা যাক।
দেখা যাক না। ব্যবস্থা করতেই হবে। একটা নির্দোষ মেয়ে ফাঁসিতে ঝুলবে নাকি?
খলিল বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক।
এশা বলল, না, থাকবে না। রুবিনা মেয়েটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর কষ্টে আছে। তুমি তার কষ্ট দূর করো।
কীভাবে?
টেলিফোন করে বলল যে তুমি নিশ্চিত, তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
আমি নিশ্চিত না।
এশা বলল, তুমিও এখন নিশ্চিত। মুখে বলছ, নিশ্চিত না।
আমি বললাম, এশা, তুমি তোমার স্বামীকে বলল, রুবিনার মতো ভালো মেয়ে খুব কম জন্মেছে। তার চেয়ে বড় কথা, সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী। সে যদি তার স্বামীকে খুন করত, তাহলে এমনভাবে করত যে তোমার স্বামীর সাধ্যও হতো না খুনের রহস্য উদ্ধারের। এই কথাটা তাকে বলে তারপর চা বানাতে যাও।