রুবিনা বলল, তারপর হাসিমুখে ফাঁসিতে ঝুলে পড়া।
খলিল বলল, মেয়েদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যাপারে আদালত নমনীয় থাকে। আপনি প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে আপনার স্বামী আপনাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। ঘরে রূপবতী স্ত্রী রেখে সে বেশ্যায় গমন করত। কাজের মেয়েদের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। এসব দেখেশুনে আপনার মাথা ঠিক ছিল না। ভেবে দেখবেন। ম্যাডাম, আমি উঠি। আগামীকাল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দেবেন। ছোট্ট একটা দুঃসংবাদ আছে। দুঃসংবাদটা কি দেব?
দিন। আপনার সুসংবাদগুলোও দুঃসংবাদের মতো।
খলিল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, খুব বড় দুঃসংবাদ অবশ্য নয়। আপনার স্বামীর ডেডবড়ি নিয়ে যে মাইক্রোবাসটি যাচ্ছিল, সেটি খাদে পড়ে গেছে। কাদেরের ঠ্যাং ভেঙে গেছে। সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
রুবিনা শব্দ করে হেসে ফেলল। আমার নিজেরও হাসি আসছে। রুবিনা হেসে ফেলার কারণ খলিল ধরতে পারছে না। তাকে খানিকটা কনফিউজড় মনে হচ্ছে। কাদের যে কয়বার মাইক্রোবাস বা বাসে করে ঢাকার বাইরে গেছে, সে কবারই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এবং প্রতিবারই তার পা ভেঙেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়, নাকি বোধের অগম্য অন্য কিছু?
রুবিনা গা দুলিয়ে হাসছে। এই হাসির একটা নাম আছে, শুধু ঠোটে হাসা না, সর্বাঙ্গে হাসা। শরীর হাসা।
খলিল বলল, আপনার মেয়ে পলিন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। সে কি আপনার আগের হাজব্যান্ডের সন্তান?
রুবিনা বলল, আমি একবারই বিয়ে করেছি। আমার আগের হাজব্যান্ড বলে কিছু নেই।
তাহলে পলিন কে?
পলিন আমার ছোট বোনের মেয়ে। আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়নি। পলিনের জন্ম তার জন্য বিরাট সমস্যা হয়েছিল। পলিনকে তার কাছ থেকে নিয়ে আমি আমার বোনকে মুক্তি দেই। পলিন জানে, আমি তার মা।
আপনার ছোট বোনের বিষয়ে বলুন।
সে আমেরিকায় থাকে। বিয়ে করেছে। সুখে আছে। এই হত্যা মামলায় সে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। কাজেই তার বিষয়ে কিছু বলব না।
আপনি পালিয়ে মা সেজেছেন। আপনার স্বামী কেন বাবা সাজলেন না। আমি চাইনি।
আমার স্বামী একজন পবিত্র মানুষ। অপবিত্র কোনো কিছুর সঙ্গে সে যুক্ত হোক, তা চাইনি।
অপবিত্র কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকতে আপনার আপত্তি নেই, না?
.
গাড়ি খাদে পড়েছে শুনলে মনে হয় গিরিখাদ। প্রথম যখন শুনলাম আমার ডেডবডি বহন করা মাইক্রোবাস খাদে পড়েছে, তখন ভেবেছিলাম, ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। এখন আমি অকুস্থলে আছি। তেমন কিছু ঘটেনি। রাস্তার পাশের নর্দমায় পড়ে গিয়েছিল। ধাক্কাধাক্কি করে গাড়ি তোলা হয়েছে। ড্রাইভার স্টার্ট নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইঞ্জিন কিছুটা ঘররর শব্দ করে থেমে যাচ্ছে।
কাদেরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে শুনেছিলাম, এটাও সত্যি নয়। সে কিছুক্ষণ পর পর পা চেপে ধরে গোঙানির আওয়াজ করছে। তার চেহারা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। অক্সিজেনের ঘাটতি হলে মানুষ নীল বর্ণ ধারণ করে। কাদেরের অবশ্যই অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার।
অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শালবনের ভেতরের রাস্তায়। আশপাশে কোনো লোকজন নেই, তবে পুলিশের একটা জিপ এসেছে। মাইক্রোবাস দড়ি দিয়ে জিপের সঙ্গে বাঁধা হচ্ছে। দড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।
মাইক্রোবাস যখন চলে যাবে, তখন আমিও কি তাদের সঙ্গে যাব? নাকি আমি একা পড়ে থাকব শালবনে? কী ঘটবে, কিছুই জানি না। আমার শীতভাব প্রবল ভাবছে। হিমশীতল হাওয়া একটা বিশেষ দিক থেকে আসছে। সেই দিক উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব না পশ্চিম, কে জানে!
পুলিশের জিপ মাইক্রোবাস নিয়ে চলে গেছে। মাইক্রোবাসের ভেতর আমার ডেডবডি। আমি (বা আমার চেতনা) একা পড়ে আছি। এর কোনো মানে হয়? কতক্ষণ থাকব এখানে?
মৃত্যুর পরের জগতে সময় থাকার কথা নয়। কাজেই কতক্ষণ একা পড়ে থাকব, এই চিন্তাও অর্থহীন। হয়তো অনন্তকাল পড়ে থাকব। সূর্য একসময় বামন নক্ষত্র হয়ে পৃথিবী গিলে খাবে, আমি এখানেই পড়ে থাকব।
যেদিক থেকে হিমশীতল হাওয়া আসছে, সেদিকে আকাশে একধরনের আভা দেখছি। এর মানে কী? হঠাৎ সেই আভার দিকে একধরনের টান অনুভব করলাম। খুব হালকাভাবে কিছু একটা আমাকে টানছে। আমার অনন্ত যাত্রা কি সেই দিকে? কোথায় যাব?
আমি হতাশ গলায় বললাম, এখানে কেউ কি আছেন, যিনি আমাকে সাহায্য করবেন? কথা শেষ হওয়ার আগেই বনের ভেতর থেকে শিয়াল ডাকতে লাগল। শিয়াল প্রহরে প্রহরে ডাকে। এখন কোন প্রহর?
কেউ একজন শিয়ালের ডাকের সঙ্গে মিলিয়ে ছড়া বলছে—
শিয়াল ডাকে হুক্কাহুয়া
তুহিনদের কাজের বুয়া
তাই পেয়েছে ভয়
তার যত সাহস ছিল
সব হয়েছে ক্ষয়।
জয় শিয়ালের জয়।
ছড়া পাঠ করছে খলিল। আমার অবস্থান এখন খলিলদের বাসায়। খলিলের সামনে পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়ে। এর নাম নিশ্চয়ই তুহিন। খলিল তার সদ্য লেখা ছড়া মেয়েকে পড়ে শোনাচ্ছে। তুহিনের ছড়া শোনার আগ্রহ নেই। সে রাক্ষসের ছবি আঁকছে।
খলিলের স্ত্রী রান্নাঘরে। সে রান্নার তদারকি করছে। আজ তাদের বাসায় পোলাও, খাসির রেজালা এবং রোস্ট রান্না হচ্ছে। খলিলের স্ত্রীর কিশোরী-কিশোরী চেহারা। নতুন শাড়ি পরায় তাকে সুন্দর লাগছে। আজ তাদের বিয়ের ছয় বছর পূর্তি।
মেয়েটি রান্নাঘর থেকে বলল, তুহিনের বাবা, আজ তুমি কাউকে খেতে বলনি? তোমার বন্ধুবান্ধব কেউ আসবে না?