এই বলে বাবা গল্প থামাতেই আমি বললাম, তারপর?
বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।
আমি বললাম, ফুড়ুৎ কী?
বাবা বললেন, ফুড়ুৎ করে আরেকটা পাখি চলে গেছে।
আমি বললাম, তারপর?
বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।
তারপর কী?
ফুড়ৎ।
আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, তারপর?
বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।
আমি বললাম, সবগুলো পাখি কখন বের হবে?
বাবা বললেন, যেদিন তুই মারা যাবি, সেদিন। তার আগে না।
আমি মারা গেছি।
বাবার কথানুসারে সব পাখি জাল থেকে বের হয়েছে। তবে তাদের ফুড়ুৎ করে ওড়ার শব্দ রেখে গেছে। টয়লেটের কল ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করেই যাচ্ছে। শব্দটা মিষ্টি লাগছে। গাছের পাতা থেকে শিশির পড়ার মতো। আলো যেমন কোমল হয়ে গেছে, শব্দও কোমল হয়েছে। যত সময় যাবে, ততই মনে হয় কোমল হবে।
আলো ও শব্দ—দুটোই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। মৃত মানুষের ইন্দ্রিয় কোথায়? আলো কীভাবে দেখছি? শব্দই বা কীভাবে শুনছি? আমার আলাদা অস্তিত্বও নেই। আমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছি না। জীবিত অবস্থায় ভূত-প্রেতের ছবি রুবিনার সঙ্গে দেখেছি। হরর ছবি তার খুব পছন্দ। দ্য হুইপ অ্যান্ড দ্য ফ্লেশ, ওমেন, ফ্রাইডে দ্য থারটিনথ—এসব ছবিতে ভূত-প্রেতের আলাদা অস্তিত্ব আছে। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে। তাদের গায়ে কাপড় থাকে। নগ্ন ভূত-পেত্নী কখনো দেখিনি।
এখন বুঝতে পারছি, এই অংশগুলো ঠিক না। যার কোনো অস্তিত্ব নেই, তার জামাকাপড় পরারও কিছু নেই।
পাশের বিছানায় খচমচ শব্দ হচ্ছে। রুবিনা উঠে বসেছে। চোখ ডলছে। মেঝেতে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনসেট উঠিয়ে নিয়ে হাই তুলে কী যেন দেখল। সময় দেখল। বড় করে হাই তুলে ঘুমাতে গিয়েও গেল না; টয়লেটের দিকে রওনা হলো। হাতে সিগারেটের প্যাকেট।
সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি। প্রথমবার যেমন তীব্র লেগেছিল, এখন তেমন লাগছে না; বরং ভালো লাগছে। রুবিনা নিজের মনে কথা বলছে। তার একা একা কথা বলার বাতিক আছে। সে বলছে, গাধাটার কানে মলা দেওয়া দরকার। গাধার বাচ্চা গাধা। চৌদ্দগুষ্টি গাধা।
রুবিনা বিশেষ কাউকে গাধা বলছে, নাকি নিজের মনে এমনি কথা বলছে? এখন বুঝতে পারছি, রুবিনা গাধা বলছে কাদেরকে। কাদের আমাদের বাসার কেয়ারটেকার। সে সম্ভবত চোর, তবে গাধা না। গাধারা চোর হতে পারে না।
মৃত মানুষ অন্যের মনের কথা ধরতে পারবে, এটা জানা ছিল না। টেলিপ্যাথি নিয়ে অনেক কথা হয়। আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে তো টেলিপ্যাথি নিয়ে গবেষণার জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে। গবেষণার ফলাফল শূন্য। তারা বলতে বাধ্য হয়েছে মানুষের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা নেই। এখন বুঝতে পারছি, টেলিপ্যাথি মৃত্যুর পরের ব্যাপার।
দরজা খুলে একজন নার্স ঢুকেছে। সে চোখমুখ কুঁচকে বলল, কে সিগারেট খাচ্ছে?
বাথরুম থেকে রুবিনা বলল, আমি খাচ্ছি।
কেবিনে সিগারেট খেতে পারবেন না।
কেবিনে তো খাচ্ছি না। টয়লেটে খাচ্ছি।
টয়লেটেও খেতে পারবেন না। সিগারেট খেতে হলে হসপিটালের বাইরে গিয়ে খেতে হবে।
রুবিনা বলল, রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশে আমি হাসপাতালের বাইরে কোথায় যাব! গুন্ডারা ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে যদি রেপ করে, তখন উপায় কী হবে?
এই নার্স আজই প্রথম ডিউটিতে এসেছে, রুবিনার কথা বলার ভঙ্গির সঙ্গে সে পরিচিত নয়। নার্স খানিকটা হকচকিয়ে গেল। আমি লাইটার জ্বালানোর শব্দ শুনলাম। পর পর দুটা সিগারেট রুবিনা খায় না। দ্বিতীয় সিগারেট সে ধরাল নার্সকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। রুবিনা গলা উঁচিয়ে বলল, সিস্টার, এক কাজ করুন, আমার বিরুদ্ধে একটা কমপ্লেইন করে দিন।
নার্স মুখ শক্ত করে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। ক্যানোলা দেখল, স্যালাইনের টিউব নেড়েচেড়ে দেখে হঠাৎ চিৎকার করল, ম্যাডাম, রোগী মনে হয় মারা গেছে।
রুবিনা এই আর্তচিঙ্কারের কোনো জবাব দিল না। নার্স আবার বলল, ম্যাডাম, আসুন। রোগী মনে হয় মারা গেছে।
রুবিনা বলল, মনে হয় মনে হয় বলছেন কেন? ডিউটি ডাক্তারকে ডেকে আনুন। ডাক্তার দেখে বলুক।
নার্স দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হতে গিয়ে দরজায় বাড়ি খেল। টয়লেট থেকে রুবিনা বলল, ক্যালাস লেডি! দরজা-জানালা ভেঙে ফেলছে।
আমি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। আমার অবস্থা এখন সবাই জানবে। অন্য রকম উত্তেজনা, অন্য রকম কর্মকাণ্ড শুরু হবে।
রুবিনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে দেখে মনে মনে অনেকবার বলা একটি বাক্য আবারও বললাম, একজন তরুণী এত সুন্দর হয় কীভাবে!
এই অতি রূপবতীর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেন বড় মামা হাবিবুর রহমান। মগবাজারে তার একটা ফার্মেসি আছে। ফার্মেসির সঙ্গে মোবাইল ফোনের ব্যবসা। এই ফার্মেসিতে রুবিনা এক সন্ধ্যাবেলায় এসে বলল, কুড়িটা কড়া ঘুমের ওষুধ দিন তো।
বড় মামা বললেন, এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিয়ে কী করবেন?
রুবিনা বলল, সুইসাইড করব। কুড়িটায় হবে না?
এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিতে পারব না।
একটা দিতে পারবেন? একটা দিন। কুড়িটা ফার্মেসিতে যাব, সবার কাছ থেকে একটা করে কিনব। পরিশ্রম বেশি হবে, কী আর করা? ওয়ার্ক ফর ডেথ। কাজের বিনিময়ে মৃত্যু। আপনি এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কেন? নাকি একটা ঘুমের ওষুধও বিক্রি করবেন না।
বড় মামা একটা ট্যাবলেট দিলেন। রুবিনা ট্যাবলেট মুখে দিয়ে তার সামনেই পানি ছাড়া গিলে ফেলল। ট্যাবলেটের দাম দিয়ে গেল না। রুবিনা পরদিন নিজ থেকেই এল ট্যাবলেটের দাম দিতে।