খলিল ভাবছে, এই মহিলার সঙ্গে কথাবার্তায় আরও সাবধান হতে হবে। ছোটখাটো ফাঁদ পেতে একে ধরা যাবে না। তার জন্য লাগবে বড় ফাঁদ। এনায়েতের ব্যাপারটা এই মেয়ে যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে, তা বিস্ময়কর।
খলিল এখন আমার ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছে। এখানে সে কিছুই পাবে না। আমি ডায়েরিতে ব্যক্তিগত কিছুই লেখি না। কোয়ান্টাম জগতের রহস্যময়তা নিয়ে লেখি। অঙ্কের কিছু প্যারাডক্স লেখা হয়েছে। প্যারাডক্সগুলো পলিনের জন্য লেখা। সে অত্যন্ত পছন্দ করে। এই মুহূর্তে খলিল আগ্রহ নিয়ে অঙ্কের একটা প্যারাডক্স দেখছে। আমি লিখেছি:
৩৬ ইঞ্চি=১ গজ
উভয় পক্ষকে ৪ দিয়ে ভাগ দিলাম
৯ ইঞ্চি = ১/৪ গজ
উভয় পক্ষে বর্গমূল করা হলো
৯ = ১/৪
তাহলে দাঁড়ায়
৩ = ১/২
অর্থাৎ ৬ ইঞ্চি = ১ গজ
একটু আগে দেখানো হয়েছে, ৩৬ ইঞ্চি সমান এক গজ। এখন অঙ্কে প্রমাণ করা হলো ৬ ইঞ্চি সমান এক গজ। কী করে সম্ভব?
খলিল মাথা চুলকাচ্ছে। কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। প্যারাডক্স মাথায় ঢুকে গেছে। অতি সামান্য প্যারাডক্সে সে অস্থির, আর আমি ঢুকে গেছি প্যারাডক্সের মহাসমুদ্রে।
.
খলিল ও রুবিনা বসার ঘরে। রুবিনা ব্যস্ত নখে নেলপলিশ দেওয়া নিয়ে। অ্যাশট্রের এক কোনায় তার ধরানো সিগারেট পুড়ছে। সিগারেটের ভেতর গাঁজা ভরা আছে। বিকট গন্ধ আসছে। রুবিনার হাতে নেলপলিশের ব্রাশ। আমি দুজনকে দেখছি। রুবিনা কী ভাবছে, বুঝতে পারছি না। খলিলের চিন্তা ধরতে পারছি। রুবিনার চিন্তা-কল্পনা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় কি আসবে যে আমি দেখতে পাব; কিন্তু কে কী বলছে, তা শুনতে পাব না? মৃতের জগৎ পরাবাস্তব জগৎ। বাস্তবতা ব্যাপারটাই অবশ্য অত্যন্ত ধোঁয়াটে।
ক্লাসে বাস্তবতা নিয়ে আমি একবার একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল বাস্তবতার বিষয়টি মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি করে। রেটিনা থেকে ইনফরমেশন মস্তিষ্কে যায়। মস্তিষ্ক তা প্রসেস করে আমাদের যা দেখায়, তা-ই আমাদের কাছে রিয়েলিটি। প্রসেসিং প্রক্রিয়ায় সামান্য ত্রুটি হলে রিয়েলিটি অন্য রকম হবে। আমরা যা দেখছি, তা-ই বাস্তব মনে করার কিছু নেই। আমাদের মস্তিষ্ক যা ভাবতে বাধ্য করছে, তা-ই বাস্তব।
ক্লাসের একটি মেয়ে প্রশ্ন কলল, স্যার, আমি যে ক্লাসে বসে আছি, এটা কি বাস্তব?
আমি বললাম, তোমার নাম কী?
সে বলল, বকুল।
আমি বললাম, আমাদের মস্তিষ্ক এমন ট্রিক করতে পারে যে ফুলের নামে যাদের নাম, তাদের দেখামাত্র সেই ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম করতে থাকবে। মস্তিষ্ক এই রিয়েলিটি তৈরি করছে, যা মূল রিয়েলিটির বাইরে।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাসের একজন ছাত্র মুখ শুকনা করে বলল, স্যার, ওর গা থেকে গোবরের গন্ধ আসছে। সে কি তাহলে গোবর?
সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করল। সবার আগে হাসল বকুল। আমার হাসি এল না। ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রীর হাসির শব্দে মাথা গমগম করতে লাগল।
এখন আবার হাসির শব্দ শুনছি। ত্রিশ-চল্লিশজন ছাত্রছাত্রীর হাসির শব্দ নয়। হাজার হাজার মানুষের চাপা হাসি। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। আমি কি অন্য কোনো বাস্তবতায় ঢুকতে যাচ্ছি? হাসির শব্দ ছাপিয়ে রুবিনার গলা শুনলাম, স্টাডিরুমে কিছু পেয়েছেন?
ইনসেকটিসাইডের একটা বোতল পেয়েছি। বোতলে কী আছে, তা জানার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠাব।
খাতাপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু পাননি?
না। আমি আপনার মেয়ে পলিনকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
আজ বাদ থাক। আরেক দিন করুন। তার বাবার ডেডবডি সারা দিন বারান্দায় পড়ে ছিল। সে সংগত কারণেই আপসেট।
খলিল বলল, আমি যত দূর জানি, ইফতেখার সাহেব তার বাবা নন।
বাবা না হলেও পলিন তাকে বাবা ডাকা শুরু করেছে। আগে ডাকত না। আজ থেকে ডাকছে। পলিনকে প্রশ্ন না করে আপনি আমাকে প্রশ্ন করুন। যত ইচ্ছা করুন। আমি মিথ্যা কথা বলি না।
যারা মিথ্যা বলে না, তারা খুবই বিপজ্জনক।
কোন অর্থে?
তারা যখন একটা-দুটো মিথ্যা বলে, তখন সেই মিথ্যাকে সত্য ধরা হয়। এক হাজার ভেড়ার পালে একটা নেকড়ে ঢুকে পড়ার মতো। এক হাজার সত্যির মধ্যে একটা মিথ্যা। ভয়ংকর মিথ্যা।
রুবিনা হাসল। খলিলের উপমা তার পছন্দ হয়েছে। খলিল বলল, আপনার সঙ্গে রবিউল সাহেবের যে বন্ধুত্ব, তা আপনার স্বামী কীভাবে দেখতেন?
কোনোভাবেই দেখত না। সে জানত, রবির সঙ্গে আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই। রবি অতি কর্মঠ একজন। সর্বকর্মে পারদর্শী। তাকে দিয়ে আমি নানা কাজ করিয়ে নিতাম। বিনিময়ে সামান্য অভিনয়।
‘বিনিময়ে সামান্য অভিনয়’ ব্যাপারটা বুঝলাম না।
ভাব করা যে, আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করি। হয়তো বা গোপনে ভালোবাসি। বিবাহিত হওয়ায় বাধা পড়ে গেছি। নয় তো তার সঙ্গে ভেগে যেতাম।
অভিনয় করে আপনি কাজ আদায় করে নেন?
অভিনয় ছাড়াও আমি কাজ আদায় করতে পারি, অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারি। যেমন, আপনাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিলাম। আপনি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করলেন, একজন পুলিশ দিলেন। কোনো সমস্যা ছাড়াই আমার স্বামীর ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়ে গেল।
আপনার স্বামী যে রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সে রাতের ঘটনা বলুন। কোনো কিছু বাদ দেবেন না বা কোনো কিছু যুক্ত করবেন না।