কী নিয়ে রওনা হব, ম্যাডাম?
তোমার স্যারের ডেডবডি।
কাদের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘জি ম্যাডাম।‘ এমনিতেই সে আতঙ্কে ছিল, এখন সেই আতঙ্ক দশ গুণ বাড়ল। চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হলো।
কাজের মেয়ে সালমা ফিরে এসেছে। যেন কিছুই হয়নি, এই ভাব নিয়ে সে রান্না বসাচ্ছে। একবার এসে বলে গেল, মরা বাড়িতে মাছ খাওয়া নিষেধ। ইলিশ মাছের বদলে ডিমের সালুন করি?
রুবিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যা ইচ্ছা করো।
ডিবি ইন্সপেক্টর খলিল আমার স্টাডিরুমে। সেখানে সে কী করছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই ঘরটা দেখতে পাচ্ছি না। রুবিনাকে দেখতে পাচ্ছি, সে সন্ধ্যাবেলার শাওয়ার নিচ্ছে। পলিনকে দেখছি, সে কম্পিউটারে গেম খেলছে। গেমের নাম ‘ডায়মন্ড রাশ’। পলিনের সঙ্গে এই খেলা আমিও অনেকবার খেলেছি। অ্যাংকরের গোপন গুহায় ঢুকে হীরা সংগ্রহ করতে হয়। নানা ঝামেলা আছে। মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ে, সাপ এসে ছোবল দেয়। আমি সব ঝামেলা এড়াতে পারি না। পলিন পারে।
আমি এখন শীতার্ত। শরীর থাকলে বলতাম, শীতে শরীর কাঁপছে। শরীর নেই, তার পরও শীতের অনুভূতি। ভয় হচ্ছে, এই শীত কি আরও বাড়বে? যদি আরও বাড়ে, তখন কী হবে? তার চেয়ে বড় চিন্তা, আমার ডেডবডি কবর হয়ে যাওয়ার পর আমার কী হবে? আমার অস্তিত্ব থাকবে, নাকি থাকবে না? কবরে নামানোর দৃশ্য কি আমি দেখতে পাব? এই দৃশ্যটা আমার দেখার শখ আছে।
ইন্সপেক্টর খলিল টেলিফোনে জানিয়েছিল, বড় মামা মারা গেছেন। আমার জন্য এটা ছিল অতি আনন্দের সংবাদ। বড় মামার নিশ্চয়ই আমার অবস্থা হয়েছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।
এখনো সেটা সম্ভব হয়নি। যে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে বড় মামার সঙ্গে আমাকে দেখা করায়নি। সে কি আমাকে নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা করছে? পরিকল্পনাটা কী?
পুরো স্মৃতিশক্তি আমাকে দেওয়া হয়নি। আমাকে বিষ খাওয়ানোর বিষয় আমার মনে নেই। জুঁই নামের যে মেয়েটি রাত তিনটায় রুবিনাকে টেলিফোন করেছিল, তার কথা মনে নেই। পলিনের বাবা কে, তা-ও মনে নেই।
এমনকি হতে পারে যে আমাকে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হচ্ছে? অপ্রয়োজনীয় তথ্য কম্পিউটারের ভাইরাসের মতো। অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রাম। দিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে। আদার রিয়েলিটি বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা—সবই হলো ম্যাট্রিক্স ছবিটার মতো, কম্পিউটারের খেলার মতো ভারচুয়াল গেম। আমরা একজন মাস্টার প্রোগ্রামের তৈরি বিনোদন খেলা।
রুবিনা মেয়েকে নিয়ে চা খেতে বসেছে। রুবিনা যথারীতি এক পট চা নিয়ে বসেছে। পিরিচে কাটা আপেল, মাখন লাগানো টোস্ট বিস্কুট। ছোট্ট গ্লাসে বেদানার রস। রুবিনা চোখমুখ কুঁচকে বেদানার রস খেল। পলিন বলল, বেদানার রস তুমি পছন্দ করো না?
করি তো?
তা হলে খাওয়ার সময় মুখ কুঁচকাও কেন?
রুবিনা বলল, কষ্টা, এই জন্য পছন্দ করি না।
তা হলে খাও কেন?
প্রচুর ভিটামিন-ই আছে, এই জন্য খাই। অ্যান্টি-এজিং প্রপার্টি আছে।
বেদানার রস খেলে তোমার বয়স বাড়বে না?
ধীরে বাড়বে।
তুমি কি অনেক দিন বেঁচে থাকতে চাও?
সবাই চায়।
আমি চাই না।
অল্প বয়সে মরে যেতে চাও?
হুঁ। ওই লোক বাবার স্টাডিরুমে এতক্ষণ ধরে কী করছে?
রুবিনা চমকে উঠে বলল, বাবা বলছ কেন? তুমি তো ওকে কখনো বাবা ডাকতে না।
মনে মনে ডাকতাম। এখন উনি মারা গেছেন, তাই মনে মনে না ডেকে ঠিকমতো ডাকছি।
তুমি তাকে পছন্দ কর?
হুঁ। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন? ওই লোকটা বাবার স্টাডিরুমে ঢুকে কী করছে?
তার কাগজপত্র, ডায়েরি—এই সব ঘাঁটাঘাঁটি করছে।
কেন?
সে ডিবি পুলিশের লোক। তার ধারণা, তুমি এখন যাকে বাবা ডাকছ, তাকে খুন করা হয়েছে। এই বিষয়ে তদন্ত করছে।
কে খুন করেছে?
এখনো সে বের করতে পারেনি।
বের করতে পারবে?
জানি না পারবে কি না।
শার্লক হোমস থাকলে পারত। শার্লক হোমসের অনেক বুদ্ধি। তুমিও পারবে, তোমার অনেক বুদ্ধি। মা, তুমি কি জান, কে খুন করেছে?
না।
ওই লোক কি জানে?
সে-ও জানে না। তবে তার ধারণা, আমি খুন করেছি।
মা, তুমি কি করেছ?
না, আমি খুন করিনি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করেছ?
পলিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, করেছি। কারণ, তুমি কখনো মিথ্যা বল না।
রুবিনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যাকে এখন বাবা ডাকছ, এই মানুষটা পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভালো মানুষ। বিবাহিত জীবনে কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে রাগ করেনি।
বাবা যে ভালো মানুষ, এটা আমি জানি। কম্পিউটার গেমের সাপগুলোও জানে। তারা সহজে বাবাকে ছোবল দিতে চায় না।
আমি এখন আর রুবিনা ও পলিনকে দেখতে পাচ্ছি না। রুবিনা ও পলিন এই মুহূর্তে যে কথাটি বলল, তা আমাকে জানানোর জন্যই হয়তো এই দুজনকে এতক্ষণ দেখছিলাম। আমাকে জানানো শেষ হয়েছে বলে এদের দেখছি না। আমি দেখছি খলিলকে। সে বইয়ের তাকের পেছন থেকে ছোট্ট একটা শিশি উদ্ধার করেছে। শিশির গায়ে লেখা, ‘উইপোকার বিষ’। শিশির অর্ধেকটা খালি। খলিল খুব সাবধানে পলিথিনের ব্যাগে শিশি ভরে পকেটে রাখল। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। যে বিষ খাইয়ে হত্যা করবে, সে বিষের শিশি ফেলে যাবে না। তবে অসম্ভব বুদ্ধিমতী রুবিনা এই কাজটি করতে পারে।