সালমা বলল, রাইস কুকারে চাল দিয়ে রাখি আর ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বার করে রাখি। ম্যাডাম খানা দিতে বললে দশ মিনিটের মধ্যে খানা দিতে পারব। রান্না খাসির মাংস আছে, মাইক্রোওভেনে গরম করে দিব। চলবে না?
কাদের বলল, চলবে কি না জানি না। আমি বাঁচি না নিজের যন্ত্রণায়।
কাদের অবশ্যই নিজের যন্ত্রণায় অস্থির। সে পালিয়ে যাওয়ার ধান্ধায় আছে। বাগেরহাটে থাকে তার স্কুলজীবনের বন্ধু শামসুদ্দিন। শামসুদ্দিনের কাঠ চেরাইয়ের কল আছে। তার কাছে মাসখানিক পালিয়ে থাকা যায়। প্রয়োজনে সেখান থেকে ইন্ডিয়া চলে যাওয়া। ডিবি পুলিশের ভাবভঙ্গি তার কাছে মোটই ভালো লাগছে না। এই হারামজাদা অবশ্যই তাকে রিমান্ডে নিয়ে যাবে।
পালিয়ে যেতে হলে তাকে যেতে হবে এক কাপড়ে। ব্যাগ নিয়ে বের হলেই সবাই সন্দেহ করবে। খালি হাতেও যাওয়া যায় না, টাকা-পয়সা দরকার। কাদের তার মানিব্যাগ খুলে টাকা গুনল। এক হাজার টাকার একটা নোট আছে। ভাংতি টাকা আড়াই শয়ের মতো। এত অল্প টাকা নিয়ে রওনা হওয়া ঠিক না। কয়েকটা জরুরি জিনিস কেনা দরকার এই বলে সে কি ম্যাডামের কাছে টাকা চাইবে? ম্যাডাম এখন দুঃখ-ধান্ধায় আছে। এই অবস্থায় কত টাকা যাচ্ছে তা কেউ খেয়াল করে না।
রুবিনা আধঘন্টার ওপর শোবার ঘরের রকিং চেয়ারে বসে আছে। তার হাতে মোবাইল ফোন। আধঘণ্টা আগে সে রবিকে টেলিফোন করেছিল। খলিল ঠিকই বলেছে, রবির আসল নাম রবিউল। রুবিনা ছোট করে ডাকে রবি। রুবিনাকে ছোট করলে হয় রুবি, রবিউল ছোট করলে হয় রবি। রুবি রবিতেও মিল।
প্রথম দুবার কলে রবি ধরেনি। তৃতীয়বারে ধরল।
রুবিনা বলল, এক্ষুনি বাসায় আসো। পুলিশ ওর ডেডবডি বাসায় দিয়ে গেছে। এখন আর আমার মাথা কাজ করছে না। তোমাকে ব্যবস্থা করতে হবে।
রবিউল বলল, তোমার বাসায় আসা সম্ভব না। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে জানো? সেখানে আমার নাম আছে। খুবই ফালতু পত্রিকা, কেউ পড়ে—সাতসকাল নাম। হেডিং করেছে—স্ত্রী কর্তৃক অধ্যাপক স্বামী খুন। তোমাকে পড়ে শোনাব?
পড়ে শোনাতে হবে না। পত্রিকা নিয়ে চলে এসো।
বললাম তো আসা সম্ভব না। আবার নিউজ হয়ে যাবে। ডিবি পুলিশও আমাকে সন্দেহ করছে। কিছুক্ষণ আগে ডিবি পুলিশের এক ইন্সপেক্টর টেলিফোন করেছে, নাম খলিল।
তুমি তা হলে আসতে পারছ না?
না। সম্ভব না। তোমাকে বাস্তব বুঝতে হবে। তোমার বাড়ির সামনে নিশ্চয় সাংবাদিক ঘুরঘুর করছে।
আমার বাড়ির সামনে কোনো সাংবাদিক ঘুরঘুর করছে না।
ওরা আড়ালে-আবডালে থাকে। সুযোগমতো উদয় হয়। এদের আমি সুযোগ দেব না।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
রুবিনা, সরি।
সরি হওয়ার কিছু নেই।
রুবিনা মোবাইল হাতে রকিং চেয়ারে দুলছে। বেচারিকে দেখে মায়া লাগছে। কেউ তার পাশে নেই, অবশ্য সে চাচ্ছেও না কেউ তার পাশে থাকুক। তার বাবা-মা আমেরিকায় থাকলেও বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন ঢাকায় থাকেন। পুলিশের একজন অ্যাডিশনাল আইজি তার চাচাতো ভাই। রুবিনা কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করছে না।
রকিং চেয়ারের দুলুনি বন্ধ করে রুবিনা ডাকল, কাদের!
কাদের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হলো। এখন তার হাতে তসবি। সে তসবি ঘোরাচ্ছে, কিন্তু মনে মনে কিছু পড়ছে না। পড়লে আমি বুঝতে পারতাম। কাদেরের কর্মকাণ্ডে আমি মজা পাচ্ছি। মৃত্যুর পরেও মজা পাওয়ার বিষয়টা নষ্ট হচ্ছে না, এটা ভালো।
কাদের! সিগারেট নিয়ে আসো।
এক কার্টুন নিয়ে আসি, ম্যাডাম?
আনো।
সালমা দুই-একটা টুকটাক জিনিস চেয়েছে। চা-পাতা, চিনি, কফি। আনব?
আনো।
দুপুরে কি ঘরে পাক হবে, ম্যাডাম?
পাক হবে না কেন? মানুষের মৃত্যু হয়, ক্ষুধার মৃত্যু হয় না।
কাদের বলল, আপনার আর কিছু লাগবে ম্যাডাম?
একটা পত্রিকা নিয়ে আসতে পারো, সকাল না কী যেন নাম?
সাতসকাল।
হ্যাঁ, সাতসকাল। থাক, পত্রিকা আনতে হবে না।
টাকা দেন, ম্যাডাম। দুই হাজার দিলেই চলবে।
আমার খাটের ডান দিকের ড্রয়ারে টাকা আছে। তাড়াতাড়ি আসবে। আমার সিগারেট শেষ।
ড্রয়ার খুলে কাদের ৫০ হাজার টাকার একটি বান্ডিল পেল। ব্যাংকের সাটা কাগজ নেই, বান্ডিল থেকে কিছু হয়তো খরচ হয়েছে। কাদের বান্ডিল নিয়ে বের হচ্ছে। আমি ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করছি। আমার চিক্কার রুবিনার কানে গেল না। যাওয়ার কথাও না।
আমি কাদেরের সঙ্গে আছি। কাদের লক্ষ্য করছে না আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন তাকে অনুসরণ করছে। সে ইন্সপেক্টর খলিলের লোক। তাকে রাখা হয়েছে বাড়ির ওপর নজরদারির জন্য। সে মোবাইলে খলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
কাদের রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ানো। চায়ের অর্ডার দিয়েছে। কাদের সিগারেট খায় না। একটা সিগারেটও সে ধরিয়ে খুক খুক করে কাশল। সে ভয়াবহ আনন্দে আছে। মুক্তির আনন্দ।
খুব ইচ্ছে ছিল কাদেরের সঙ্গে সঙ্গে থাকার। সেটা সম্ভব হলো না। আমি এখন পলিনের ঘরে। পলিন তার ফেসবুকে ইংরেজিতে তথ্য দিচ্ছে। তথ্যের বাংলাটা এমন:
আমার সত্ত্বাবার শবদেহ এখন বারান্দায় রাখা আছে। কফিনের ভেতর তিনি আছেন। আমার খারাপ লাগছে। কান্না পাচ্ছে। আমার এই সবাবা আমাকে খুব আদর করতেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ছিলেন। আমাকে বিজ্ঞানের অনেক কিছু বলতেন। তিনি অঙ্ক করে একবার আমাকে দেখিয়েছেন যে ৩ সমান ২ হতে পারে। তিনি কীভাবে করেছিলেন আমার মনে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর কাছে শিখে নিতাম।