লেমেট্রি তাঁর রচনায় দেখান যে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির সমাধান দাবি করে মহাবিশ্ব প্ৰসরণশীল। সর্বদিকে তা ছড়িয়ে পড়বে। আইনস্টাইন ধমক দিয়ে বলেন, অঙ্ক দিয়ে সবকিছু বিচার করবে না। অন্ধের মতো অঙ্ক অনুসরণ করলে যে পদার্থবিদ্যা তোমরা বের করবে, তা হলো ঘেন্নাকর (অববামিনে ফিজিক্স)।
লেমেট্রি তার ডায়েরিতে লিখলেন, আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত অবস্থায় লেখার টেবিলে বসে ছিলাম। তখন একটা মশা এসে আমার কানের কাছে গুনগুন করতে লাগল। তার কাজ আমাকে বিরক্ত করা, কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, সে আমাকে সান্ত্বনার কথা বলছে। আমি কথাগুলো বুঝতে পারছি না। সে শুধু যে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তা না, আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিল।
তার দুবছর পরই অ্যাস্ট্রোনোমার হাবল সাহেব মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুরবিন দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘোষণা করেন, সব গ্যালাক্সির মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল।
আইনস্টাইন লজ্জিত হয়ে লেমেট্রিকে চিঠি লিখে জানালেন—তোমার থিওরি বিস্ময়করভাবেই সুন্দর। আমার অভিনন্দন।
জীবিত মানুষের জীবনের একটি অংশ কাটে সুন্দরের অনুসন্ধানে। কেউ জোনাক পোকার ঝাঁকের সৌন্দর্য খোঁজে, আবার লেমেট্রির মতো মানুষেরা বিগ ব্যাং থিওরির ভেতর সুন্দর খোঁজে।
পরকালের মানুষেরা নিশ্চয়ই সৌন্দর্য খুঁজবে। কী সৌন্দর্য খুঁজবে?
আমি আমার শবদেহের জন্য খোঁড়া কবর দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, দূরের মাইকিংয়ের শব্দ শুনছি। এদের মনে হয় কেউ খবর দেয়নি, ডেডবড়ি আসছে না।
একটি বিশেষ ঘোষণা-কলমাকান্দার কৃতী সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেচর’ ইফতেখার ইসলাম সাহেবের জানাজা…
দিনের আলো দ্রুত নিভে যাচ্ছে। আজও কি রাতে বৃষ্টি থামবে এবং ওই বিশেষ দিনটার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি বের হবে? মনে হচ্ছে তা-ই হবে।
আমি বা আমার চেতনা বা অন্য কিছু
আমি বা আমার চেতনা বা অন্য কিছু এখন দিলু রোডের বাড়িতে, আমার নিজের বাড়ি। এখানে কীভাবে উপস্থিত হয়েছি তা জানি না। আমার অবস্থা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো। স্রোত যেদিকে নিয়ে যাবে আমাকে যেতে হবে। নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় কিছু করার নেই। মনে হচ্ছে আমার চিন্তা নিয়ন্ত্রিত।
নিজের বাড়িতে এসে আমি আনন্দে অভিভূত হয়েছি। মনে হচ্ছে কত দীর্ঘ দিবস কত দীর্ঘ রজনীই না আমাকে বাইরে কাটাতে হয়েছে। এখন ফিরে এসেছি। সব আগের মতোই আছে। পলিন তার ঘরে ইন্টারনেটে কী যেন দেখছে। মনে হয় ফেসবুক আপডেট করছে। রুবিনা শাওয়ার ছেড়ে গোসল করছে। সকাল ১০টা বাজে। এই সময় সে একবার শাওয়ার নেয়। শাওয়ার নিয়ে সকালের নাশতা করে। আরেকবার শাওয়ার নেয় রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে আগে।
রান্নাঘরে নতুন একটা কাজের মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। সে রুবিনার ব্রেকফাস্ট রেডি করছে। এক স্লাইস রুটি, এক গ্লাস মালটার রস, এক কাপ দুধ, একটা সেদ্ধ ডিম। টি-পট ভর্তি হালকা লিকারের চা দেওয়া হবে। রুবিনা নাশতা করার ফাঁকে ফাঁকে চা খাবে। দিনের প্রথম সিগারেটটা অবশ্য শুরুতেই খাবে। মালটার রসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে।
কাদের রান্নাঘরে ঢুকেছে। সে গলা নিচু করে বলল, ড্রয়িংরুমে গেস্ট আছে, এক কাপ কফি দেন। চিনি-দুধ অফ, ব্ল্যাক কফি। চিনি-দুধ ছাড়া এই জিনিস মানুষে ক্যামনে খায় কে জানে!
সালমা বলল, কফি আপনি নিজে বানায়া নিয়া যান। আমার হাত বন্ধ।
কাদের বলল, গেস্ট কে আসছে শুনলে হাতের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। ডিবির ইন্সপেক্টর। ম্যাডামকে অ্যারেস্ট করতে আসছে।
কন কী?
মার্ডার চার্জ। ম্যাডাম আমাদের স্যাররে বিষ খাওয়ায়ে মেরেছে। পত্রিকায় খবর চলে এসেছে।
ও আল্লাহ।
আপনের তো ‘ও আল্লা’ বলার দরকার নাই। ম্যাডাম বলবে ‘ও আল্লা’। যত্ন করে কফি বানায়া দেন, নিয়া যাই।
কফির সঙ্গে আর কিছু দিব? কেক দিব?
শুধু কফি চেয়েছে, শুধু কফি নিয়া যাব। বাড়তি যত্ন করলে সন্দেহ করবে। পুলিশের লোক। আমি নিজেও বিপদের মধ্যে আছি। দুনিয়ার প্রশ্ন করতেছে। আপনি বেঁচে গেছেন। আপনি জয়েন করেছেন স্যারের মৃত্যুর পর। তার পরেও টুকটাক প্রশ্ন আপনারেও করবে। ডিবি পুলিশ নিজের বাপরেও ছাড়ে না। এমন খতরনাক জিনিস।
কাদের কফি নিয়ে অতি বিনীত ভঙ্গিতে ডিবি ইন্সপেক্টর খলিলের সামনে রাখল। খলিল বলল, থ্যাংক য়্যু।
কাদের বিয়ে ভেঙে পড়ে বলল, স্যার, নো মেনশন।
খলিল বলল, বসার ঘরে বেশ কয়েকটা অ্যাসট্রে দেখছি। এখানে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
জি, খাওয়া যায়। সিগারেট কি আপনার সঙ্গে আছে না এনে দিব?
সিগারেট সঙ্গে আছে।
স্যার, লাইটার কি আছে?
আছে, থ্যাংক য়্যু।
নো মেনশন, স্যার। ম্যাডাম এখন শাওয়ার নিতেছেন। শাওয়ার নিয়ে ব্রেকফাস্ট করবেন, তারপর আপনার কাছে আসবেন।
কোনো অসুবিধা নেই, আমি অপেক্ষা করব। ম্যাডামের মেয়েটি কি বাসায় আছে?
জি আছে। কী করতেছে জানি না, দেখে আসব?
দেখে আসতে হবে না। আপনি আমার সামনে বসুন। আপনার স্যারকে যে রাতে হাসপাতালে নিয়ে যান, সে রাতের ঘটনাটা আপনার মুখ থেকে শুনি। ঘটনা যা ঘটেছে তা-ই বলবেন। নতুন কিছু যুক্ত করবেন না, আবার কিছু বাদও দেবেন না। বলুন কী ঘটেছিল।