মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন, সব ফল মানুষ খেয়ে ফেললে পাখিরা কী খাবে? বুরবাক।
তুমিও বুরবাক। পশুবন্ধু সাজছে।
চুপ।
তুমি চুপ।
মাইকের ঘোষণা শুনে থালা হাতে ফকির-মিসকিন আসতে শুরু করেছে। তাদের চোখেমুখে আনন্দ। দুটা গরু জবেহ করা হবে। লাশ দাফনের পর ফকির-মিসকিন খাওয়ানো হবে।
ফকির-মিসকিনদের জন্য একটা গরু, দ্রদের জন্য আরেকটা গরু। যারা গরু খান না তাদের জন্য খাসির মাংস।
আমার মৃত্যুর কারণে যে তিনটি অবোধ প্রাণী মারা যাচ্ছে, তাদের দেখলাম। দুটা গরুই মহানন্দে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। ছাগলটা কিছু খাচ্ছে না। মৃত্যুর পর এই প্রাণীদের কি আলাদা কোনো জগৎ আছে? তাদের কি আত্মা আছে?
আমার ইচ্ছে করছে গ্রামের বাড়িতে যেতে। অনেক দিন এই বাড়ি দেখি না। বাড়ির পেছনের সবুজ শ্যাওলা ঢাকা পুকুরটা অদ্ভুত। এই পুকুরে প্রকাণ্ড দুটা গজার মাছ আছে। মাঝেমধ্যে গজার মাছ ধরার চেষ্টা চালানো হয়। কখনো ধরা যায় না। অনেকের ধারণা, এই দুটা মাছ না, জিন। মাছের রূপ ধরে পুকুরে বাস করে।
এই পুকুরের আরও রহস্য আছে। হঠাৎ হঠাৎ পুকুর ভর্তি হয়ে যায় পদ্মফুলে। তখন বুঝতে হবে, আমাদের বাড়ির কারও মৃত্যু হবে। ছোট চাচা যখন মারা গেলেন, তখন পদ্মফুলে পুকুর ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। আমার বড় ভাই যখন জামগাছের ডালে দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁস নিলেন, তখনো পুকুর ভর্তি ছিল পদ্মফুলে। দাদাজান তখন বেঁচে, তিনি হুকুম দিলেন, সব পদ্ম শিকড় ছিঁড়ে তুলে আন। একটা পদ্মও যেন না থাকে। আমার মৃত্যুতে কি আবার পদ্মফুলে পুকুর ভর্তি হয়েছে? একবার যদি দেখতে পারতাম! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
ইচ্ছে করলেও বাড়িতে যেতে পারছি না। মৃতের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। অন্যের ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। সেই অন্যটা কে?
.
আমার ডেডবডি আসছে না, এই খবর মনে হয় পৌঁছে গেছে। গোরখোদক এবং মুয়াজ্জেন চলে গেছেন। অনেকেই চলে যাচ্ছে, শুধু ফকির মিসকিনদের দল যাচ্ছে না। তারা হতাশ, কী করবে বুঝতে পারছে না। এদের লিডারশ্রেণীর একজন ক্ষুব্ধ গলায় বলছে, খবর দিয়া আইন্যা কি ফাইজলামি?
লিডারের কথায় সবাইকে সায় দিতে হয়। বাকি ফকির-মিসকিনরা তা-ই করছে। সায় দিচ্ছে। লিডার বলল, আইজ খানা দিবে না মানলাম, কবে দিবে সেটা তো বলা লাগবে।
লিডারের পাশের জন বলল, অবশ্যই অবশ্যই। প্রয়োজনে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হবে। এমন বদদোয়া দিব গুষ্টিমুদ্দা মইরা সাফ হয়ে যাবে।
মহিলা ফকির বলল, ন্যায্য কথা বলেছেন। অতি ন্যায্য।
লিডার বলল, ন্যায্য কি বলেন? এই কথা ন্যায্যের ওপরে দিয়া যায়। কোনো খোঁজখবর না দিয়া আয়োজন যারা করছে তারারে মাইর দেওয়া দরকার।
সমবেত আওয়াজ, অবশ্যই। অবশ্যই।
আয়োজক কারা বোঝা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বেশ কিছু গাড়ি ঢাকা থেকে চলে এসেছে। একটা মাইক্রোবাস ভর্তি করে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কলিগ চলে এসেছে। দীর্ঘ পথভ্রমণে তারা ক্লান্ত। ফকির-মিসকিনদের মতোই ক্ষুধার্ত। তারাও ফুডের কী ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। তাদেরকেও কিছুটা ক্ষিপ্ত মনে হচ্ছে। ক্ষুধা সব মানুষকে এক কাতারে ফেলে। মৃত্যুর পরের জগতে ক্ষুধা নেই। সেখানে এই কারণেই হয়তো সবাইকে এক কাতারে ফেলা যাবে না।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমাদের অঞ্চলের বিখ্যাত ঝুম বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই খোঁড়া কবরে পানি জমে গেল। বেশ কিছু ব্যাঙ পানিতে ঝাঁপাঝাপি করে আনন্দ প্রকাশ করছে। অপ্রত্যাশিতভাবেই তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা হয়েছে, তাদের আনন্দিত হওয়ারই কথা।
শহরের ঝুম বৃষ্টি আর গ্রামের ঝুম বৃষ্টি আলাদা। শহরে ঝুম বৃষ্টি মানেই দুর্ভোগ। রাস্তায় একহাঁটু পানি। তীব্র যানজট, দূষিত বিষাক্ত পানিতে পা ডুবিয়ে পথচারীর বাড়ি ফেরা। গ্রামের ঝুম বৃষ্টি মানে বিশুদ্ধ আনন্দ।
অনেক দিন আগে বাড়ির পুকুরঘাটে বসে আছি, শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। দীঘির পানিতে বৃষ্টি পড়ছে, বুদ্বুদ উঠছে—দেখে মনে হচ্ছে পুকুরটা আনন্দে খলখল করে হাসছে। বাতাসে গাছের ডালপালা দুলছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টির আনন্দে তারা নাচতে শুরু করেছে।
বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বিকেলে। আমি ঠিক করলাম, বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত ঘাটে বসে থাকব। বৃষ্টি থামল এশার আজানের পর। তখন এক অদ্ভুত দৃশ্যের সূচনা হলো—হাজার হাজার জোনাক পোকা বের হয়ে এল। তারা সবাই একত্র হয়ে একটা বলের মতো বানাচ্ছে, আবার মুহূর্তের মধ্যে বল ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার বল তৈরি করছে। একসময় তারা আমার চারদিকে ঘুরতে লাগল, সেই ঘুরাও বিচিত্র। কিছুক্ষণ ক্লকওয়াইজ, আবার কিছুক্ষণ অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ। আমার মনে হলো, এই জোনাকিরা আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। নিম্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গের সঙ্গে আমাদের মানসিক যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা প্রকৃতি রাখেনি।
খ্রিষ্টান ধর্মযাজক লেমেট্রি একবার প্রার্থনা শেষ করে তার লেখার টেবিলে বসে ছিলেন। বেচারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কারণ, সেদিন সন্ধ্যায় তিনি মহান পদার্থবিদ আইনস্টাইনের ধমক খেয়েছেন। ১৯২৭ সালের কথা। ব্রাসেলসের সলভে কনফারেন্সে এই ধর্মযাজক আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর একটি রচনা পাঠ করেন। যেহেতু আইনস্টাইন স্বয়ং সেই সভায় উপস্থিত, লেমেট্রির আগ্রহের সীমা ছিল না।