আমি গাড়িতে উঠতে যাব–দোতলার বারান্দা থেকে মা হাত ইশারায় ডাকলেন। খুবই ব্যস্ত ভঙ্গি। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোনো দুর্ঘটনা বাসায় ঘটে গেছে। আমি গাড়ি থেকে নামলাম, আবার দোতলায় উঠলাম। মা বললেন, যাচ্ছিস কোথায়?
এ ধরনের প্রশ্নের কোনো মানে হয়? মা জানে না আমি কোথায় যাচ্ছি? সকাল নটায় তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বের হবার উদ্দেশ্য তো একটাই।
ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি মা।
আজ না গেলে হয় না?
তেমন ভয়ঙ্কর কোনো কিছু ঘটে গেলে না গেলে হয়। ভয়ঙ্কর কিছু কি ঘটেছে?
আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি?
সেই এক জায়গাটা কোথায়? তাড়াতাড়ি করে বল তো মা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মা ঝলমল করে উঠলেন। উত্তেজিত গলায় বললেন, মৌচাক মার্কেট। সিল্ক শাড়ির একটা এগজিবিশন হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।
তুমি দাওয়াতের কার্ড পেয়েছ?
আমি কার্ড পাব কেন? আমি কি মহিলা এমপি? জাস্ট দেখতে যাব। পছন্দের কোনো শাড়ি পেলে কিনব। তুই পছন্দ করে দিবি। অনেক শাড়ি এক সঙ্গে দেখলে আমার মাথা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়! যে রঙটা সেখানে সবচে ভালো মনে হয়, বাসায় এনে দেখি সেটাই সবচে খারাপ।
তুমি শাড়ি কিনবে এইজন্য আমি ক্লাস মিস দেব?
একদিন দিবি। একদিনে তো তুই এমন কিছু পণ্ডিত হয়ে যাবি না। শাড়ি এগজিবিশনে প্রথম দিনেই যেতে হয়। ভালো ভালো শাড়ি প্রথম দিনেই শেষ হয়ে যায়।
আমি যাব না মা।
এরকম করিস কেন? তুই তো জানিস আমি একা একা কোথাও যেতে পারি না। আমার একা যাওয়া ঠিকও না।
ভাইয়াকে নিয়ে যাও। ও ঘরে বসে আছে।
ছেলেমানুষ সে, শাড়ির কী বুঝবে?
না বুঝলে না বুঝবে – মা আমি গেলাম। আজও আমার দেরি হয়ে গেল— ফজলু মিয়ার কফি খাওয়া হলো না।
মা উৎসাহী গলায় বললেন, ফজলু মিয়ার কফি ব্যাপারটা কীরে? তোর মুখে আগেও কয়েকবার শুনেছি।
আমি জবাব না দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামছি। মা-ও নামছেন। তাঁকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি টেনশনে পড়েছেন। ফজলু মিয়ার কফির রহস্য ভেদ না হওয়া পর্যন্ত টেনশন কমবে না। আমি নিশ্চিত গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার মোবাইল বেজে উঠবে। মা জিজ্ঞেস করবেন ফজলু মিয়ার কফি ব্যাপারটা কী-রে? ফ্লাঙ্কে করে আমার জন্যে নিয়ে আসিস তো।
মোবাইল টেলিফোনের ঝামেলা ক্লাসের মধ্যেও চলতে থাকবে। মা যদি শেষ পর্যন্ত শাড়ির এ এগজিবিশনে যান তাহলে সেখান থেকে সাজেশান চেয়ে। টেলিফোন আসবে, হালকা গোলাপি রঙটা তোর কাছে ভালো লাগে না হালকা আকাশি? গাঢ় রঙের কোন শাড়ি কিনব? মোটা মানুষদের নাকি গাঢ় রঙ মানায়। তাদের চিকন দেখা যায়। সত্যি না-কি?
যথারীতি আজও ক্লাসে দেরি হলো। নতুন একজন টিচার এসেছেন। রোল কল শুরু হয়েছে। তিনি ডাকলেন, রোল ফিফটিন। আমি ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, ইয়েস স্যার। পুরো ক্লাস এক সঙ্গে হেসে উঠল। আমাদের এই ক্লাসের হাসি রোগ আছে। অতি তুচ্ছ কারণে সবাই আমরা এক সঙ্গে হাসি। নতুন টিচার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তোমার নাম কী?
মৃন্ময়ী।
নামটা রেজিস্টার খাতায় আছে, তারপরেও আলাদা করে নাম জিজ্ঞেস করায় আনন্দ আছে। তাই না?
জ্বি স্যার।
ভদ্রলোক বললেন, আমাকে স্যার ডাকবে না। স্যার ডাক আমার খুবই অপছন্দের। ডিজাইন ক্লাসে আমরা সবাই ছাত্র। ঠিক আছে?
জ্বি, ঠিক আছে।
যাও বোস। তুমি বসার পর ক্লাশ শুরু হবে।
আমি ফরিদার দিকে এগুচ্ছি। ফরিদার পাশের চেয়ারটা আমার। সব সময় সেখানেই বসি। কিছু একটা সমস্যা মনে হয় হয়েছে। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একজন ছাত্রী সামান্য দেরি করে ক্লাসে এসেছে। সে তার জন্যে নির্দিষ্ট করা চেয়ারটায় বসতে যাচ্ছে এটা এমন কোনো দৃশ্য না যে দম বন্ধ করে তাকিয়ে থাকতে হবে। এটা তো আলফ্রেড হিচককের ছবির সেট না। আর্কিটেকচার বিভাগের ফোর্থ সেমিস্টারের ডিজাইন ক্লাস। নতুন টিচার যে তাকিয়ে আছেন সেটা উনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি। মেয়েদের মাথার পেছনে ছটা অদৃশ্য চোখ থাকে। কোনো পুরুষ যদি পেছন থেকে তার দিকে তাকায় তাহলে সে অদৃশ্য চোখ দিয়ে দেখতে পায়।
মৃন্ময়ী।
জ্বি।
তুমি কি সব সময় এই চেয়ারটায় বস?
জ্বি।
আজ প্রথমদিন, কাজেই আমি কিছু বলছি না। সবাই আজ তাদের পছন্দের জায়গায় বসবে। কাল থেকে এই নিয়ম থাকবে না। একই চেয়ারে কেউ দ্বিতীয় দিন বসবে না। মানুষ Conditional হতে পছন্দ করে। খাবার টেবিলে দেখবে প্রত্যেকের জন্যে জায়গা ঠিক করা। এই চেয়ারটা মার। এই চেয়ারটা বড় মেয়ের। খেতে বসলে ঐ চেয়ার ছাড়া কেউ বসবে না। মানুষ খুবই স্বাধীন প্রাণী কিন্তু অদ্ভুত কারণে সে ভালোবাসে শিকল পরে থাকতে। আমরা যারা ডিজাইন ক্লাসের ছাত্র তাদেরকে শিকল ভাঙতে হবে সবার আগে। মৃন্ময়ী কী বলছি বুঝতে পারছ?
পারছি স্যার।
আগে একবার বলেছি। আবারো বলি আমাকে স্যার ডাকবে না।
ফরিদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার না ডাকলে আপনাকে কী ডাকব?
নাম ধরে ডাকবে। আমার নাম কাওসার। বোৰ্ড লিখে দিচ্ছি।
ভদ্রলোক বোর্ডের কাছে গিয়ে বড় করে লিখলেন
COW-SIR
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। নামের বিচিত্র বানান দিয়ে তিনি কি সবাইকে অভিভূত করতে চাইছেন? নাম নিয়ে এই রসিকতা তৈরি করতে তাঁর নিশ্চয়ই বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। এই রসিকতায় নিশ্চয়ই অতীতে অনেকে মজা পেয়েছে। আমি পাচ্ছি না। আমার বিরক্তি লাগছে। আচ্ছা আমি কি আমার নাম নিয়ে এমন কিছু করতে পারি? Mrinmoye-কে লেখা যেতে পারে