বাবা আমার ওপর বিরক্ত হয়েছেন কি-না ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, আমি লক্ষ করেছি আজহার এলেই তুই খাতির যত্নের একটু বাড়াবাড়ি করি। এটা করবি না।
কেন আমি বললাম। বাবা, তুমি কি আজহার চাচাকে ভয় পাও?
বাবা থমথমে গলায় বললেন, ভয় পাবার প্রশ্ন আসছে কেন?
আমার মনে হচ্ছে তুমি ভয় পাও। আজহার চাচা না হয়ে যদি অন্য কেউ তোমাকে কাফনের কাপড় দিত তুমি তাকে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিতে।
আমি ভদ্রতা করেছি। তাটাকে তুই ভেবে বসলি ভয়।
তোমার মধ্যে দ্ৰতার বাইরেও কিছু ছিল।
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, স্মার্ট হওয়া ভালো। কিন্তু নিজেকে অতিরিক্ত স্মার্ট ভাবাটা ভালো না।
আমি স্মার্ট না বাবা। আমি যা করি তা হলো দুই-এর সঙ্গে দুই যোগ করে চার হয়েছে কি-না দেখি। সবার বেলায় তাই হয়। তোমার বেলায় দুই-এর সঙ্গে দুই যোগ করলে চারের কিছু কম হয়। সেই কমটা কোথায় যায় সেটা বুঝতে পারি না।
তুই কী বলতে চাচ্ছিস পরিষ্কার করে বল তো।
আমি শন্তি গলায় বললাম, ভাইয়ার কাছে যে ছেলেটা এসেছে বলে তুমি ভাবছ এই ছেলেটা কে?
আমি কী করে জানব সে কে?
আমার ধারণা তুমি তাকে চেন। তোমার সঙ্গে এই ছেলের কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে। নয়তো তুমি ভয়ে এত অস্থির হতে না।
বাবা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
আমি রওনা হলাম রান্নাঘরের দিকে। তস্তুরী বেগমকে ডেকে তুলে গরম ভাত রান্না করতে হবে। তস্তুরী বেগমের শাড়ির আঁচলে আলাউদ্দিনের চেরাগের একটা মিনি সাইজ দৈত্য বাস করে বলে আমার ধারণা। এই দৈত্য রান্নাবান্না ছাড়া অন্য কাজ পারে না। যে-কোনো রান্না এই দৈত্য অতি নিমিষে শেষ করে ফেলতে পারে। আমি আমার নিজের জন্যে রান্না করাচ্ছি না। ভাইয়ার ঘরে যে। ছেলেটি বসে আছে সে ক্ষিধেয় কাতর আছে। গরম ভাত তার জন্যে। অপ্রত্যাশিতভাবে গরম ভাত পেয়ে সে অভিভূত হবে। এই মজার ঘটনাটা সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবে এবং অনেক লোকের সঙ্গে গল্প করবে। এই ছেলে যদি বিয়ে করে তাহলে বাসর রাতে স্ত্রীর সঙ্গে এই গল্পটিও করবে। তার মেয়ে যখন বড় হবে কোনো এক রাতে পিতা-কন্যা ভাত খেতে বসে গল্প করার সময় এই গল্প উঠে আসবে। মেয়ের মা বিরক্ত গলায় বলবে— আচ্ছা এই এক গল্প তুমি কবার করবে? বন্ধ করে তো।
মেয়ে বলবে, বন্ধ করতে হবে না, আমার শুনতে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে। আচ্ছা বাবা যে মেয়ে তোমার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছিল তার নাম কী?
নাম তো মা জানি না। নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি।
মেয়েটা দেখতে কেমন?
সেটাও বলতে পারছি না। অন্ধকার ছিল তো। ভালোমতো দেখতে পাই নি।
এই পর্যায়ে মেয়ের মা মহা বিরক্ত হয়ে বলবে ঐ মেয়ে মা রূপবতী ছিল। রূপবতী না হলে এই এক গল্প তোর বাবা পাঁচ লক্ষবার করে।
ভাইয়ার ঘরে বসে যে নিচু গলায় গল্প করছিল সে রাতে অবশ্যই ভাইয়ার ঘরে ঘুমুবে না। সে ঘুমুবে ছাদে। ছাদে চিলেকোঠার মতো আছে। চিলেকোঠাটা স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তারই এক কোণায় চাদর পেতে শোবার ব্যবস্থা আছে। বিপদজনক পরিস্থিতিতে এক ছাদ থেকে লাফিয়ে অন্য ছাদে যাওয়া যায়। এবং অতি দ্রুত পালিয়ে যাওয়া যায়। ভাইয়ার বন্ধুদের অনেকেই এই কাজটা অতীতে করেছে।
ট্রে হাতে আমি চিলেকোঠার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, খেতে আসুন। ছাদ এবং চিলেকোঠা অন্ধকার হলেও সিড়ি ঘরে বাতি জ্বলছে। তার আলোয় কাজ চলার মতো দেখা যাচ্ছে। চিলেকোঠায় বাতি আছে। তার সুইচ বাইরে। ইচ্ছা করলেই আমি বাতি জ্বালাতে পারি। তা না করে আবারো বললাম ভাত নিয়ে এসেছি খেতে আসুন। তিন চার সেকেন্ড কোনো রকম শব্দ হলো না। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ভাইয়ার বয়েসী এক যুবক বের হয়ে এল। তার চোখ ভর্তি বিস্ময়। আমি বললাম, আপনি কি অন্ধকারে খেতে পারবেন, না বাতি জ্বালাতে হবে?
সে কিছুই বলল না। আমি বললাম, ঘরে খাবার কিছু ছিল না। গরম ভাতের ওপর ঘি দিয়ে দিয়েছি। শুকনা মরিচ ভেজে দিয়েছি। বেগুন ভাজা আছে। আর আপনার একটা পছন্দের খাবারও আছে। পাট শাক ভাজি। আমাদের বুয়ার দেশ ময়মনসিংহের ফুলপুর। সে দেশ থেকে টিন ভর্তি করে পাট শাক শুকিয়ে নিয়ে আসে।
টগরের সঙ্গে আমি যখন কথা বলছিলাম তখন আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন?
জি শুনছিলাম। বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে দুটা সিগারেটও আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি।
থ্যাংক য়ু।
আমি যদি আপনাকে একটা অনুরোধ করি আপনি রাখবেন?
অবশ্যই রাখব।
ভাইয়ার কাছে কখনো আসবেন না। ভাইয়া বোকা মানুষ। সে কোনো কিছুতে না থেকেও মহা বিপদে পড়ে যাবে।
তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি আর এ বাড়িতে আসব না।
আপনি খাওয়া শুরু করুন। আপনার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি থাকব। কেউ খুব আগ্রহ করে ভাত খাচ্ছে এই দৃশ্য দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। হাত ধোয়ার পানি এনেছি। নিন হাত ধোন।
ভাইয়ার এই বন্ধুর নাম আমি জানি না। আগে দেখেছি কি-না মনে করতে পারছি না। সে হাত ধুয়ে খেতে বসেছে। ভাতের দলা মাখিয়ে মুখে দিতে গিয়ে নামিয়ে রেখে তাকাল আমার দিকে।
আমি বললাম, আরাম করে খান তো।
সে খুবই তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে। একজন ক্ষুধার্ত মানুষ খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে এই দৃশ্য জগতের মধুর দৃশ্যের একটি কার যেন কথা? বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। কথাটা বাবার কাছ থেকে শুনেছিলাম।
প্রথম ক্লাস
প্রথম ক্লাস সকাল সাড়ে নটায়। এই ক্লাসটায় আমি রোজ লেট করি। এবং রোজই ভাবি আজ থেকে ক্লাস শুরু হবার দশ মিনিট আগেই ইউনিভার্সিটিতে চলে যাব। ফজলু মিয়ার ক্যান্টিনে কফি খাব। ফজলু মিয়ার কফি এমন অসাধারণ কিছু না। তবে খুব তাড়াহুড়া করে খেলে অসাধারণ লাগে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে এক্ষণি ক্লাসে ঢুকতে হবে, অথচ হাতে মগভর্তি কফি তখন কফিটা লাগে অসাধারণ।