ভালো করে দেখেছিস? খাটের নিচে বসে নেই তো?
খাটের নিচে বসে থাকবে কেন?
এরা ডেনজারাস ছেলে। খাটের নিচে বসে থাকবে। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। দরজার আড়ালে থাকবে। যা, আবার যা।
কোনো দরকার নেই বাবা।
দরকার আছে কিনা সেটা আমি বুঝব। তোকে দেখতে বলছি তুই দেখ।
আমি আবারো সিঁড়ির দিকে এগুলাম। ভাইয়ার ঘরে দ্বিতীয়বার যাবার কোনো অর্থ হয় না। একতলার বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে চলে আসব। বাবা নিশ্চয়ই দোতলার বারান্দা থেকে টেলিস্কোপ ফিট করে বসে থাকবেন না দেখার জন্যে যে আমি দায়িত্ব পালন করছি কি-না।
ভাইয়ার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাতি নেভানো। আমি নিঃশব্দে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। কান পাতলাম। ভাইয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। সে যে একা একা কথা বলছে তাও না। যে জবাব দিচ্ছে তার গলার স্বর ভারি। রেডিও-টিভির এ্যানাউনসারদের মতো গলা। কথাবার্তা হচ্ছে খুবই হাস্যকর বিষয় নিয়ে। মোটা গলার মানুষটা বলছে শিউলি ফুলের পাতা দিয়ে এক ধরনের ভাজি হয়। টগর তুই খেয়েছিস কখনো?
ভাইয়া বলল, না।
কচি পাতাগুলি কড়া করে তেলে ভাজা হয়, সঙ্গে থাকে প্রচুর পেয়াজ-রসুন আর শুকনা মরিচ। খেতে অসাধারণ হয়। গ্রামে যখন যাই এটাই হয় আমার প্রধান খাদ্য। দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য কি জানিস?
না।
দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হলো নাইল্যা পাতা ভাজি।
নাইল্যা পাতাটা কী?
পাট শককে বলে নাইল্যা পাতা। পাট শাক রান্নার দুটো পদ্ধতি আছে। একটা ঝোল ঝোল, আরেকটা শুকনা শুকনা। আগুন গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের ওপর শুকনা নাইল্যা পাতা ছড়িয়ে দিয়ে যদি ভাত খাস তাহলে তোর মুখে এই জিনিস ছাড়া কিছুই রুবে না। দেখি একটা সিগারেট দে।
সিগারেট তো নাই।
সর্বনাশ! সিগারেট ছাড়া এত বড় রাত কাটাবো কী করে?
দোকান থেকে নিয়ে আসব?
আরে না। তোর বাসার সামনে পুলিশের দুজন ইনফরমার বসে আছে। তোর বাবা তো সিগারেট খায় তার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ম্যানেজ করতে পারবি না?
না।
একটা কাগজ দলা পাকিয়ে সিগারেটের মতো বানিয়ে দে। এটাই টানি। কিছু ধোঁয়া যাক। এতে দুটা কাজ হবে সিগারেটের তৃষ্ণা মিটবে। ক্ষুধাটা কমবে।
আমি নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলাম। বাবা বেতের চেয়ারে ঝিম ধরে বসে। আছেন। তার গা থেকে হালকা গন্ধ আসছে। অর্থাৎ তিনি আড়াই পেগ থেকে তিন পেগ হুইস্কি খেয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশে মদ্যপান আইন করে নিষিদ্ধ। তবে বিত্তবানদের জনো আইনের ফাঁক আছে। বিত্তবানদের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের আবগারী ডিপার্টমেন্ট মদ খাওয়ার লাইসেন্স ইস্যু করে। সেখানে লেখা থাকে স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে এই পরিমাণ মদ্যপানের অনুমতি দেয়া হলো। বাবার এই লাইসেন্স আছে। বাবা বললেন, কী দেখলি?
দেখলাম কেউ নেই।
খাটের নিচ, বাথরুম সব দেখেছিস।
হ্যাঁ।
আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছি একটা ছেলে বিড়ালের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝাঁ করে ওর ঘরে ঢুকল। স্ট্রাইপ শার্ট গায়ে।
তুমি তো মানসিকভাবে উত্তেজিত এই জন্যে এসব দেখেছ।
মানসিকভাবে উত্তেজিত হব কী জন্যে?
আজহার চাচা তোমাকে কাফনের কাপড় দিয়েছে এরপর থেকেই তুমি মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েছ। তোমার চিন্তা কাজ করছে না।
চিন্তা ঠিকই কাজ করছে, আমি শুধু ভাবছি একটা লোক কী করে কাফনের কাপড় উপহার হিসেবে নিয়ে আসে।
উনার কাছে মনে হয়েছে ভালো উপহার। বাবা যাও তুমি শুয়ে পড়। রাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ করে।
তুই শুবি না?
আমার সামান্য দেরি হবে।
দেরি হবে কেন?
রাতে ভাত খাই নি। এখন দেখি প্ৰচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। ফ্রীজের ঠাণ্ডা ভাত খাব না। নতুন করে ভাত রাঁধব। তুমি বিড়বিড় করছ কেন?
কাফনের কাপড়টা দিয়ে গাধাটা আমার মেজাজটা খারাপ করে দিয়েছে। আর তোর মার তো বুদ্ধির কোনো সীমা নেই! সে কাপড়টা রেখে দিয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের উপরে, যেন ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়ে।
এক কাজ করো কাপড়টা তুমি আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি ওয়ার্ডডোবে রেখে দেব।
আরে না। তুই বাচ্চা মানুষ। তুই কেন তোর ঘরে কাফনের কাপড় রাখবি।
বাবা তুমি ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করে ঘুমুতে যাও। রাতে না ঘুমালে তোমার খুবই শরীর খারাপ করে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার প্রেসার বেড়েছে। প্রেসার মেপে দেব?
দরকার নেই। গাধাটা কী করেছে শোন, কাফনের কাপড়ে আর মাখিয়ে রেখেছে। নাক থেকে আতরের গন্ধটা যাচ্ছে না। সাবান পানি দিয়ে নাক ধুয়েছি, তারপরেও যাচ্ছে না। তুই গন্ধ পাচ্ছি না?
না, পাচ্ছি না।
মানুষের সামান্য সেন্সও থাকবে না।
আমার হঠাৎ ইচ্ছা করল বাবাকে একটা বিপদে ফেলতে। কাজটা ঠিক না, অন্যায়। তারপরেও মনে হলো— আচ্ছা দেখি তো কী হয়। আমি বললাম, বাবা সরু নদীর ইদ্দিস ভাষা কী?
বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, আজহার চাচাকে তুমি সরু নদীর ইদ্দিস ভাষাটা বলছিলে।
কী বলেছিলাম?
বলেছিলে মেরাং গা। ছেরাং হচ্ছে সরু, গা হলো নদী।
ঠাট্টা করছিলাম। ইদ্দিস ভাষা আমি জানি না।
তুমি ঠাট্টা করে বলছিলে না। খুবই সিরিয়াসভাবে বলছিলে। আজহার চাচা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছে।
আমি যে এই ছোট্ট মিথ্যাটা বলেছি তার পেছনে ভালো যুক্তি আছে। যুক্তিটা শুনবি?
এর পেছনে তোমার কোনো যুক্তি নেই বাবা। যুক্তিটা তুমি এখন ভেবে ভেবে বের করবে। আমি নিশ্চিত তুমি বেশ ভালো যুক্তিই বের করবে। যাই হোক তুমি ভেবে চিন্তে ভালো একটা যুক্তি বের করো। আমি ভোর বেলা শুনব। এখন দয়া করে ঘুমুতে যাও।