ঢং করতে হবে না। তুমি সেজে গুজে সামনে যাও। শুধু একটা রিকোয়েস্ট মা–কালচে টাইপ লিপস্টিক ঠোঁটে দেবে না। তোমাকে মানায় না।
ঐ শাড়ি পরব কী করে? ব্লাউজ বানানো হয় নি।
কাছাকাছি কোনো ব্লাউজ নেই?
খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে।
তুমি খুঁজতে থাক মা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ প্রথম পরীক্ষা, আধা ঘণ্টা আগে যেতে হবে। সীট কোথায় পড়েছে খুঁজে বের করতে হবে।
ঐ শাড়িটাই বা হঠাৎ করে পরতে বলছে কেন?
ঐ শাড়ি নিয়ে তোমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই রোমান্টিক কিছু ব্যাপার ট্যাপার আছে। তোমাদের ঝগড়ার ব্যাপারগুলি আমি জানি। রোমান্টিক ব্যাপারগুলিতে জানি না।
আমি মার সামনে থেকে চলে গেলাম। মা গেলেন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ খুঁজতে। তিনি ঠিকই শাড়ি পরে সেজে গুজে বাবার সামনে যাবেন এবং শুকনো গলায় বলবেন, পরলাম তোমার শাড়ি। এখন কী করতে হবে? নাচব?
আমার অতি বুদ্ধিমান বাবা তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলবেন ঘটনা কী। তিনি নিজেকে সামলে নেবেন এবং হাসি মুখে বলবেন, বাহু, তোমাকে খুব মানিয়েছে তো। একটু নাচ, খারাপ কী?
আমার মা যে খুবই বোকা টাইপ একজন মহিলা তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। যে-কোনো বিষয় নিয়ে তিনি বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। তাঁর কথা শুনলে মনে হয় ঐ বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান আছে। আসলে তা না, মা জগতের বেশির ভাগ বিষয় সম্পর্কে কিছু জানেন না। জানার আগ্রহও নেই। তবে এই ঘটনা বাইরের কারোর বোঝর সাধ্যও নেই। উদাহরণ দিয়ে বলি, একবার আমাদের ড্রয়িংরুমে বাবার কিছু বন্ধু (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এদের সঙ্গে বাবার সামান্য যোগাযোগ আছে। দু তিন মাস পরপর দাওয়াত করে খাওয়ান। মিলে আড়া জমিয়েছে। মা-ও আছেন তাদের সঙ্গে। তুমুল আলোচনা চলছে। আলোচনার বিষয় ব্ল্যাক হোল। মাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শুনছেন। এবং ব্ল্যাকহোলের রহস্যময়তায় তিনি চমৎকৃত। স্টিফান হকিং লোকটির মেধায় অভিভূত।
আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভয়াবহ। সে সবকিছুই টেনে নিজের ভেতর নিয়ে নেয়। আচ্ছা, এখন যদি সমান ক্ষমতার দুটা ব্ল্যাক হোল সামনাসামনি চলে আসে তখন কী হবে? দুজনই তো চেষ্টা করবে অন্যজনকে নিজের ভেতর নিয়ে আসতে।
আজ্ঞা কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেল। তারপর সবাই কথা বলতে শুরু করল মার দেয়া সমস্যা নিয়ে। সবাই মহাউৎসাহী। শুধু বাবা বিরক্ত মুখে মার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কারণ তিনি জানেন মা ভেবেচিন্তে কিছু বলেন নি। মনে একটা কথা এসেছে, বলে ফেলেছেন— এখন আবার যাবেন চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে। দুটা সমান শক্তির ব্ল্যাক হোল মুখোমুখি থাকলে মার কিছুই যায় আসে না। ওরা ওদের মতো দড়ি টানাটানি করুক। দুইজন একটা সময় দুইজনকে গিলে ফেলুক। চায়ের সঙ্গে নাস্তা ঠিকমতে দিতে পারলেই তিনি খুশি।
অস্থির ভঙ্গিতে টানা বারান্দায় বাবা হাঁটাহাঁটি করছেন। আমাকে দেখে এমনভাবে তাকালেন যেন চিনতে পারছেন না। এর একটাই অর্থ কোনো একটা বিষয় নিয়ে বাবা খুব চিন্তিত। আমি বললাম, বাবা ঘুম আসছে না?
বাবা বললেন, এখনো বিছানায় যাই নি। কাজেই ঘুম আসছে কি আসছে না বুঝতে পারছি না।
এনি প্রবলেম?
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, টগরের ঘরে একটা ছেলে এসেছে। ছেলেটাকে আমি চিনি। পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছেলেটা মনে হয় রাতে থাকতে এসেছে। আমি নিশ্চিত। আগেও কয়েক রাত এ বাড়িতে কাটিয়েছে।
আমি বললাম, এটা এমন কোননা সমস্যা না। আমি ভাইয়াকে গিয়ে বলছি ছেলেটাকে বিদায় করে দিতে।
ছেলেটির সামনে কিছু বলবি না। এদের ঘটানো ঠিক না। তুই বরং টগরকে ডেকে নিয়ে আয়। যা বলার আমি বলব।
ভাইয়ার ঘরের দরজা খোলা। ঘরে বাতি জ্বলছে। ভাইয়া চেয়ারে বসে কী যেন লিখছে। এত রাতে আমাকে ঢুকতে দেখে সে কিছু মাত্র অবাক হলো না। যেন। সে আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। লেখা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, কী ব্যাপার।
আমি বললাম, কোনো ব্যাপার না। তোমার কাছে কেউ কি এসেছিল? ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, না তো!
বাবার ধারণা কেউ তোমার কাছে এসেছিল। বাবা এটা নিয়ে খুব চিন্তিত। ভাইয়া তুমি খুব খেয়াল রাখবে কেউ যেন তোমার কাছে না আসে। আর যদি এসেও পড়ে, চেষ্টা করবে তৎক্ষণাৎ বিদায় করতে।
তাই তো করি।
বাবার ধারণা তুমি উল্টোটা করে। মাঝে মাঝে তোমার দু একজন বন্ধু তোমার ঘরে রাত কাটায়।
আর কিছু বলবি?
বলব। কথাগুলো শুধু যে বাবার তা না। আমারও কথা। ভাইয়া, সাবধান। থাক। সময়টা খুব খারাপ।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তুমি কী লিখছ?
ভাইয়া চট করে খাতা বন্ধ করে বলল, কিছু লিখছি না। তোর কথা শেষ হয়ে থাকলে চলে যা।
কাউকে চিঠি লিখছ না-কি?
ভাইয়া মাথা নিচু করে হাসল। তার হাসি মুখ দেখে আমার আবারো মনে হলো ঢাকা শহরের প্রথম তিনজন রূপবান যুবকের মধ্যে ভাইয়া একজন। শৈশবে যাদের খুব সুন্দর দেখায় যৌবনে তারা কেমন যেন ভোতা টাইপ হয়ে যায়। ভাইয়ার বেলায় ঘটনা অন্যরকম। যত দিন যাচ্ছে, সে ততই সুন্দর হচ্ছে। আমার বুকে ধাক্কার মতো লাগল। প্ৰকৃতি রূপবান পুরুষ পছন্দ করে না। তাদের মধ্যে বড় ধরনের কিছু সমস্যা দিয়ে দেয়। ভাইয়ার ভেতর কোননা সমস্যা দিয়ে দেয় নি তো?
বাবা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, টগরকে বলেছিস?
কিছু বলতে হয় নি বাবা। ভাইয়ার ঘর ফাঁকা। মশামাছি পর্যন্ত নেই। দেয়ালে একটা কালো রঙের টিকটিকি ছাড়া কিছু নেই।