সজনে ডাঁটার কী ব্যবস্থা করা যায় অতি দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছি। ভাইয়া বাসায় থাকলে কোনো সমস্যা নেই যেখান থেকে হোক সে সজনে ডাঁটা জোগাড় করবে। কাঁচাবাজার বন্ধ থাকলে কোনো সজনে গাছের খোঁজ বের করে, গাছ থেকে পেড়ে আনবে।
মুশকিল হলো এই সময়ে ভাইয়ার বাসায় থাকার কোনোই কারণ নেই। রাত বাজে মাত্র আটটা।
ভাইয়া এখন কী একটা কম্পিউটার কোর্স নিচ্ছে। বাংলাদেশ একেক সময় একেক দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখন ঝুঁকেছে ইউনিভার্সিটি এবং কম্পিউটারের দিকে। পাড়ায় পাড়ায় ইউনিভার্সিটি। দুতলা বাড়ি। দুতলায় ইউনিভার্সিটি ক্লাস, এক তলায় এডমিনস্ট্রেটিভ বিল্ডিং। গ্যারেজে ভাইস চ্যান্সেলার সাহেবের অফিস। সেই ঘরে রং জ্বলে যাওয়া কার্পেট আছে। ঘড়ঘড় শব্দ হয় এমন এসি আছে। এসিতে গ্যাস নেই। বাতাস ঠাণ্ডা হয় না। একটা এসি চলছে, বিকট শব্দ হচ্ছে। এটাই যথেষ্ট। ভাইস চ্যান্সেলার সাহেবের ইজ্জত তো রক্ষা হচ্ছে।
একইভাবে শুরু হয়েছে কম্পিউটারের দোকান। যে দোকানের নাম আগে ছিল দিলখোেশ চটপটি হাউস, এখন তার নাম DIL Dot.com Computer Heaven.
ভাইয়া যে কম্পিউটার কোম্পানিতে কাজ শিখছে সেই কোম্পানির নাম International Net. কোর্স শেষ হবার পর এই কোম্পানি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব ছাত্রকে বিদেশে চাকরি যোগাড় করে দেবে। এই কোম্পানির ক্লাশ দুই ব্যাচে হয়। সেকেন্ড ব্যাচের ক্লাস শুরু হয় রাত আটটার পর। ভাইয়ার ফিরতে ফিরতে রাত বারটা একটা বাজে। আগে খাবার টেবিলে তার ভাত ঢাকা দেওয়া থাকত। সে ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত খেয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ত। অন্যদের ডিসটার্ব হবে এইজন্যে খাবার ঘরের বাতি পর্যন্ত জ্বালত না। বারান্দার বাতির আলো তার জন্যে যথেষ্ট। ভাত খেয়ে এটো থালাবাসন যে টেবিলে রেখে দিত তা না। সব কিছু ধুয়ে মুছে মিটসেকে তুলে রেখে যেত যাতে বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে না পারেন রাতে কেউ খেয়েছে। গত বুধবার থেকে বাবার হুকুমে টেবিলে ভাত রাখা বন্ধ হয়েছে। বাবা কঠিন গলায় বলেছেন, ভদ্রলোকের বাড়িতে একটা সিস্টেম থাকবে। রাত দুটার সময় বাড়ির বড় ছেলে একা একা ভাত খাবে এসব কী? এটা কি পাইস হোটেল? রাত এগারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরলে খাবার আছে। এগারোটার পরে কেউ যদি আসে তাকে বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হবে। ফ্ৰীজ খুলে এটা সেটা যে খেয়ে ফেলবে তাও হবে না। ফ্ৰীজ খোলা যাবে না। এই হুকুম আমার জন্যেও প্রযোজ্য। আমি রাত এগারোটার মধ্যে না ফিরলে আমার জন্যেও খাবার থাকবে না।
ভাগ্য ভালো ভাইয়া তার ঘরে। দরজা খোলা, বাতি নিভিয়ে সে শুয়ে আছে। আমি ঘরে ঢুকতে সে বলল, বাতি জ্বালাবি না খবরদার।
বাতি নিয়ে ভাইয়ার কিছু সমস্যা আছে। ইলেকট্রিকের আলো তার নাকি চোখে লাগে। চোখ কড়কড় করে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। বেশির ভাগ সময়ই ভাইয়া তার ঘরে বাতি নিভিয়ে রাখে। বারান্দার আলোই না-কি তার জন্যে যথেষ্ট।
আমি বাতি জ্বালালাম। ভাইয়া বিরক্ত মুখে উঠে বসতে বসতে বলল, কী চাস?
আমি সহজ গলায় বললাম, সজনে চাই। ছোট মাছ দিয়ে সজনের তরকারি রান্না হবে। তুমি অতি দ্রুত সজনে কিনে আনবে। এই নাও টাকা। কুড়ি টাকায় হবে না?
শার্ট গায়ে দিতে দিতে ভাইয়া টাকাটা নিল। অন্য যে-কোনো ছেলের সঙ্গে এইখানেই ভাইয়ার তফাত। অন্য যে-কোনো ছেলে বলত, এত রাতে সজনের তরকারি কেন? সজনে এমন কোনো তরকারি না যে রাত দুপুরে খুঁজে এনে রাঁধতে হবে।
ভাইয়াকে কোনো কিছু করতে বললে সে সেই বিষয়ে একটা প্রশ্ন করে না। রাত তিনটার সময় ঘুম ভাঙিয়ে যদি তাকে বলা হয়, দুটা দেশী মুরগির ডিম কিনে আনতে, কোনো প্রশ্ন না করেই সে বের হবে। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডিম হাতে উপস্থিত হবে। একবারও জিজ্ঞেস করবে না, রাত দুটার সময় ডিমের দরকার কেন?
তোমার আজ কম্পিউটার ক্লাশ নেই।
না।
ছুটি না-কি? কম্পিউটারের ইন্সট্রাক্টারদের কেউ কি মারা গেছে?
না, আমিই ছেড়ে দিয়েছি।
কেন ছেড়ে দিয়েছ?
কম্পিউটার স্ক্রীনের আলো চোখে লাগে। চোখ জ্বালা করে। মাথা দপদপ করে। তা ছাড়া কিছু বুঝিও না। সব কিছু আউল লাগে।
কম্পিউটারের পড়াশোনা তাহলে বাতিল?
হুঁ।
ছয় হাজার টাকা ভৰ্তি ফি জলে গেল?
হুঁ গেল।
চোখের জন্যে ভালো একজন ডাক্তার দেখাও না কেন? যত দিন যাচ্ছে। তোমার সমস্যাটা মনে হয় বাড়ছে।
ভাইয়া জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল। তার চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখ উঠলে যেমন হয় ঠিক সে রকম অবস্থা।
ভাইয়া আমার আপন ভাই না, সৎ ভাই। আমার বাবা ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়তেন তখন যে মেয়েটিকে প্রাইভেট পড়াতেন তাকে বিয়ে করে ফেলেন। তাদের একটা ছেলে হয় তার নাম রাখা হয় হাসানুল করিম। বাবা পড়াশোনা শেষ করে কী একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে স্ত্রী-পুত্ৰ কেলে ইংল্যান্ড চলে যান।
সেখান থেকেই দু বছরের মাথায় তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেন। বাবা দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারের চাকরি পেয়ে যান। আবার বিয়ে করেন। তাদের একটি মেয়ে হয়। মেয়ের নাম রাখা হয় মৃন্ময়ী। আমি সেই মৃন্ময়ী।
আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন বার তের বছরের একটা ছেলে সুটকেস, ব্যাগ এবং বইপত্র নিয়ে আমাদের বাসায় থাকতে আসে। বাবা গম্ভীর মুখে সেই ছেলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এর নাম হাসানুল করিম। ক্লাশ ফাইভে পড়ে। এ আমার ছেলে। আমার প্রথম পক্ষের সন্তান। এখন থেকে এই বাড়িতে থাকবে।