বাবা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আজহার যেটা ধরে সেটা ছাড়ে না। বিয়ের ব্যাপারটা সে ছাড়ল না। যখনই বড় কোনো বিপদে পড়ি সে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে তারপর তার ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দেয়। আমি বলি, সব ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই। তারপর একদিন। আজহার বলল, এক কাজ করি মওলানা ডাকিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেই। আমি বললাম, তা কী করে হয়? দুজনই শিশু–এদের বিয়ে হবে কীভাবে? সে বলল, বাপ-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে হবে। বাবা-মার জন্যেই এরা পৃথিবীতে এসেছে। বাবা-মার অধিকার আছে তাদের বিয়ে দেবার। ফালতু যুক্তি।
আমি শান্ত গলায় বললাম, তারপর কী হলো? মওলানা এসে বিয়ে পড়িয়ে দিল।
অনেকটা সেরকমই। বিয়ে বিয়ে খেলা। বিড়ালের বিয়ে হয় না? সে রকম আর কি?
মা বিয়েটা মেনে নিল?
তোর মা খুবই চিঙ্কার চেঁচামেচি করেছে। বিয়েটাকে আমি তেমন গুরুত্ব দেই নি। তার মার চেঁচামেচিকেও গুরুত্ব দেই নি।
এখন বিয়েটাকে গুরুত্ব দিচ্ছ?
পাগল হয়েছিস না-কি? গুরুত্ব দেব কী জন্যে? আইনের চোখে এ বিয়ে অসিদ্ধ। আজহার একটা খেলা আমার সঙ্গে খেলেছে। ব্যাপারটা আমার বুঝতে সময় লেগেছে। একেবার যে মহাবিপদে পড়েছি বিপদগুলিও তারই তৈরি করা। সে আমাকে ফেলেছে, আবার সে-ই টেনে তুলেছে। দাবা খেলায় হারজিৎ কোথায় ঠিক হয় জানিস? এন্ড গেম-এ। মিডল গেমে আমি ধরা খেয়েছি। এন্ড গেমে আজহার ধরা খাবে। তুই কি ভেবেছিস সে শুধু শুধু আমাকে কাফনের কাপড় দিয়েছে? কবরের জন্যে জায়গা কিনে দিয়েছে। সে একটা ম্যাসেজ আমাকে দেবার চেষ্টা করছে। সে আমাকে একটা ওয়ার্নিং দিল।
বাবা আরেকটা সিগারেট ধরালেন। আমি বাবার সামনে থেকে উঠে গেলাম। ছাদে যাব। অনেক দিন ভোর হওয়া দেখা হয় নি। আজ সুযোগ পাওয়া গেছে।
এই মুহূর্তে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। খুব কাছের কোনো মানুষ— Sentinental friend.
আকাশে মেঘ করেছে
আকাশে মেঘ করেছে। শহরের মানুষ চারদিকে তাকায়, আকাশের দিকে তাকায়। না। কখন আকাশে মেঘ করে কখন মেঘ কেটে যায় বুঝতেই পারে না। আজ মেঘ করেছে আয়োজন করে। যেন মেঘমালা উঁচু গলায় বলছে হে নগরবাসী! তাকাও আমার দিকে।
নগরবাসী মেঘ দেখছে কি-না আমি জানি না। তবে আমি দেখছি। মনে হচ্ছে আজ ঘন বৰ্ষণ হবে। এই বৰ্ষণ দিয়েই কি আষাঢ়ের শুরু?
আমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছি। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। শহরে খুব ডেঙ্গুর উপদ্রপ। জ্বর হলেই সবাই আঁতকে উঠে ভাবে ডেঙ্গু না-কি? আমার সে রকম কিছু হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে ডেঙ্গু হলে ভালোই হয়। কিছু দিন হাসপাতালে কাটিয়ে আসা যায়। সম্পূর্ণ নতুন কোনো পরিবেশ। এই পরিবেশে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না। দম বন্ধ লাগছে।
নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের নানান অবস্থা থাকে শুককীট, মূককীট, পতঙ্গ। একটা অবস্থার সঙ্গে অন্য অবস্থার কোনো মিল নেই। মানুষের জন্যে এ রকম ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। কিছু দিন সে একটা অবস্থায় থাকল, একদিন হঠাৎ বদলে অন্য রকম হয়ে গেল। অন্য একটা জীবন। আগের জীবনের সঙ্গে কোনো মিল থাকল না।
বাড়িতে আমি একা। বাবা সিলেটে, তার চা বাগানে কী যেন সমস্যা হয়েছে। তিনি গেছেন সমস্যা মিটাতে। এক সপ্তাহ সেখানে থাকবেন। মা গেছেন শুটিং-এ। আজ তার মোজা বোনার অংশটা রেকর্ড করা হবে। কাজ কী রকম হচ্ছে একটু পরে পরেই তিনি টেলিফোন করে জানাচ্ছেন বুঝলি মৃ, মেকাপ দিয়েছে। ঠোঁটে দিয়েছে কড়া লাল লিপস্টিক। আমি বললাম, একজন বয়স্ক মহিলা এমন গাঢ় রঙের লিপস্টিক পরবেন? আমার কথায় মেকাপম্যান। এমনভাবে তাকাল যেন আমি ব্লাসফেমি করেছি। তারপর বলল ঠোঁটে লিপস্টিক না দিলে টিভির পর্দায় ঠোট শাদা দেখাবে। আমি চুপ করে রইলাম। ওদের কাজ ওরাই তো ভালো জানবে। স্টিল ক্যামেরাম্যান ছবি তুলেছে। আমি তাকে বলেছি আমার একটা ছবি টেন টুয়েলভ সাইজ করে আমাকে দিতে। অভিনয়ের স্মৃতি থাকুক। কী বলিস?
মার কথা শুনে আমার হিংসা হচ্ছে। তিনি তাঁর জীবনটা সুখেই কাটিয়ে দিচ্ছেন। সব কিছুর মধ্যে থেকেও তিনি কোনো কিছুর মধ্যেই নেই। ভাইয়া হাজতে আছে, তাকে একদিনও দেখতে যান নি। তার প্রসঙ্গে একটি কথাও বলেন নি। যেন এ রকম কিছুই ঘটে নি। সংসার আগে যেমন চলছিল এখনো
সে রকমই চলছে।
আমি একদিনই ভাইয়াকে দেখতে গিয়েছি। পুলিশ অফিসার আমার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেছেন। আমাকে হাজতে লোহার শিক ধরে ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলতে হয় নি। একটা আলাদা ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছে। ভাইয়াকে আনা হয়েছে সেখানে। আমাদের জন্যে কেক এবং চা দেওয়া হয়েছে।
ভাইয়া আমাকে দেখে হাসল। আমি বললাম, কেমন আছ?
ভাইয়া তার জবাবেও হাসল। তার গালে খোচা খোঁচা দাড়ি। চুল আঁচড়ানো নেই। তারপরেও তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। ভাইয়ার কারণে যেন ঘরটা আলো হয়ে গেছে। আমি বললাম, তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না?
ভাইয়া বলল, না। তবে রাতে খুব মশা কামড়ায়। এখানে মশারির ব্যবস্থা নেই। কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। এতে কাজ হয় না। কয়েলের গন্ধে দল বেঁধে মশা আসে।
আমি বললাম, তুমি তস্তুরী বেগমকে একটা জিনিস রাখতে দিয়েছিলে সেটার কী হবে?
ভাইয়া আবারো হাসল। এই হাসির নিশ্চয়ই কোনো মানে আছে। আমি মানে বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এই প্রসঙ্গ নিয়ে সে কথা বলতে চাচ্ছে না।