বাবার সিগারেট খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় হনহন করেই ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি একা বারান্দায় বসে রইলাম। আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমাদের বাসায় ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে। আমার ভাইকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে এ জাতীয় কথা না। অন্য ধরনের কথা। আমি জেগে আছি, একা বারান্দায় বসে আছি— এই খবরটা কাউকে জানানো। অন্তত একজন কেউ জানুক আমার মন ভালো নেই। কী জন্যে ভালো নেই সেটা জানানোর কোনোই প্রয়োজন নেই। মন ভালো নেই এই খবরটা শুধু জানান। কিছু অর্থহীন কথা বলা। কী বলা হচ্ছে তা জরুরি না, গলার শব্দ শোনানোটা জরুরি। কথা বলা-কথা বলা খেলা।
তস্তুরী আবারো এসেছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আফা ঘুমাইবেন না?
না ঘুমাব না। তুমি শুয়ে পড়।
ভাইজানরে নিয়া মারধোর করতেছে কি-না কে জানে!
না মারধোর করবে না। বাবা অবশ্যই এই ব্যবস্থা করেছেন। তুমি ঘুমুতে যাও।
আফনেরে একটা কথা বলব আফা। বলতে ভয় লাগতেছে। না বইল্যাও পারতেছি না।
বলো।
পুলিশ যখন বাড়ি ঘেরাও দিছে তখন ভাইজান কাপড় দিয়া পেঁচাইয়া একটা জিনিস রাখতে দিছে। জিনিসটা কী করব আফা?
কী জিনিস?
তস্তুরী বেগম চুপ করে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি বললাম, বোমা পিস্তল জাতীয় কিছু? তস্তুরী বেগম জবাব দিল না। এখন সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।
রেখেছ কোথায়?
চাউলের টিনের ভিতরে।
থাকুক সেখানেই। সকাল হোক তখন একটা ব্যবস্থা হবে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি আগের জায়গাতেই বসে আছি। বাবা যে জেগে আছেন সেটা বুঝতে পারছি। বাবার ঘরে আলো জ্বলছে। তিনি আমার সব ধারণা ভেঙে দিয়ে প্রায় মাতাল অবস্থায় ঘর থেকে বের হলেন। আমাকে জেগে বসে থাকতে দেখে খুবই অবাক হলেন। কাছে এসে কোমল গলায় বললেন, এখনো জেগে আছিস না-কি রে মা! দুশ্চিন্তা করছিস। দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। সব আমার হাতের মুঠোর মধ্যে আছে। যা দেখছিস সবই পাতানো খেলা।
পাতানো খেলা মানে!
বাবা আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, পুলিশকে আমিই খবর দিয়ে এনেছি। আমার কথামতোই তারা টগরকে ধরে নিয়ে গেছে। তুই যে বলেছিলি, আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি আনন্দিত। আসলেই আমি আনন্দিত। বুঝলি মৃ, তোর বুদ্ধি ভালো। শুধু ভালো বললে কম বলা হয়–খুব ভালো। আমি তোর বুদ্ধি দেখে খুবই অবাক হয়েছি। বলতে গেলে চমকেই গেছি।
আমি সহজ গলায় বললাম, পুলিশ ডেকে ভাইয়াকে এরেস্ট করিয়েছ কেন?
বাবা গলা নিচু করে বললেন, ও যেন নিরাপদে থাকতে পারে। এইজন্যেই কাজটা করিয়েছি। ষাট হাজার টাকা সে চেয়েছে–তার মানে সে বিরাট বিপদে আছে। হাজতে ঢুকিয়ে তাকে আমি বিপদ থেকে আলাদা করে ফেললাম।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না বাবা।
সব তোর বোঝার দরকার নেই। নানান ধরনের খেলা এই পৃথিবীতে চলে। সব খেলা বুঝতে হবে এমন কোনো কথা আছে? সব খেলা বোঝার চেষ্টাও করতে নেই।
বাবা তৃপ্তির হাসি হাসছেন। নেশাগ্রস্ত মানুষরা অল্পতেই তৃপ্তি পায়। তৃপ্তি প্রকাশ করে ফেলে। চেষ্টা করেও গোপন রাখতে পারে না। বাবা আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, কিছু খেলা থাকে সাধারণ। উদাহরণ হলো তোর মা। ছোটখাট খেলা সে খেলে–খুবই নিম্ন মানের।
তুমি খুব উঁচু মানের খেলা খেল?
অবশ্যই।
খেলাটা তুমি কার সঙ্গে খেলছ? নিজের সঙ্গে নিশ্চয়ই খেলছ না। তোমার একজন প্রতিপক্ষ আছে। সেই প্রতিপক্ষটা কে? আজহার চাচা?
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ঠিকই ধরেছি। আজহার খুবই ওস্তাদ খেলোয়াড়। তবে সে বোকা। আসলেই বোকা।
বোকা হলেও তুমি কিন্তু বাবা তার হাতের মুঠোয়।
বুঝলি মা এটাও আমার খেলার একটা স্ট্রাটেজি। আমি ইচ্ছা করে তার হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছি।
মার কাছে শুনলাম আজহার চাচা তার ছেলের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এসেছিলেন। খেলার স্ট্রাটেজি হিসেবে তুমি নিশ্চয়ই তারিখও ঠিক করেছ। তারিখটা কী?
বাবা চুপ করে গেলেন। সিগারেট ধরালেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, তারিখ ঠিক করার কথা ভোকে কে বলেছে? নিশ্চয়ই তোর মা। সে আর কী বলেছে?
না। আর কিছু বলেন নি। আরো কিছু কী বলার আছে?
বাবা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ব্যাপারটায় সামান্য জটিলতা আছে। খুবই সামান্য।
বলো শুনি।
তোর মা তোক কিছু বলে নি?
না।
আচ্ছা তোক ব্যাপারটা বলি–ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নেমে পড়লাম। ভয়াবহ রিস্ক নিলাম। এই সময় আজহার আমাকে সাহায্য করল। বোকা হলেও ওর ব্যবসা বুদ্ধি ভালো। এই লাইনে তার চিন্তা-ভাবনা খুবই পরিষ্কার। একবার ব্যবসার একটা বড় ঝামেলা থেকে সে আমাকে বাঁচাল। আমি বললাম, আজহার তুমি বিরাট বিপদ থেকে বাঁচিয়েছ আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি বলো। আজহার বলল, তোমার মেয়েটাকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দাও। মেয়েটাকে আমার বড়ই পছন্দ। আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই। এই মেয়ে তোমার। এই হলো ঘটনা।
আমি বললাম, বড় কোনো ঘটনা তো না। সব বাবা মা-ই ছেলেমেয়ে ছোট থাকলে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলে। তুমি এটাকে এত গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছ কেন?
গুরুত্বের সঙ্গে তো নিচ্ছি না। গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি তোকে কে বলল?
বলার ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে তুমি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছ।