বাবা-মা দুজনই জেগে আছেন। ব্যাপার কী? আমি দরজা খুললাম। তস্তুরী বেগম বলল, বাড়ি ভর্তি পুলিশ আফা। চেকিং হইতেছে।
মা চেয়ারে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। বাবা বারান্দায় নেই। মনে হয় নিচে গেছেন।
মা আমাকে দেখে আঁৎকে ওঠার মতো করে বললেন, তোর গালে এটা কি মশার কামড় না পিম্পল?
বাড়ি পুলিশ ঘিরে আছে। প্রতিটি ঘর সার্চ করা হচ্ছে। এসব যেন কোনো বিষয়ই না। আমি বললাম, পুলিশ কেন মা?
মা হাই তুলতে তুলতে বললেন, আমি কী জানি পুলিশ কেন? তোর বাবা জানে। তোর বাবার সঙ্গে পুলিশ অফিসারের কথা হয়েছে।
বাবাকে জিজ্ঞেস করো নি?
না।
ভাইয়ার কোনো বন্ধুর খোঁজ করছে?
জানি না।
ভাইয়া কোথায় সেটা জানো? নাকি সেটাও জানোনা?
টগরকে তো পুলিশ আগেই নিয়ে গেছে।
আগেই নিয়ে গেছে মানে কী? কখন নিয়ে গেছে?
দশ-পনের মিনিট হলো নিয়ে গেছে। বেশ ভদ্রভাবেই নিয়েছে। পুলিশ এরেস্ট করার সময় হাতকড়া পরায়, কোমরে দড়ি বাঁধে। সেসব কিছুই করে নি।
আমি নিচে নামলাম। বাবা একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি ইশারায় আমাকে চলে যেতে বললেন। বাবাকে খুব বিচলিত মনে হলো না। তিনি কোনো বড় ঝামেলায় পড়েছেন এমন কোনো ছাপ তার মুখে নেই। আমি আবারও দোতলায় উঠে এলাম। মা শুকনো মুখ করে বললেন, রাতের ঘুমটা আমার দরকার ছিল। কাল শুটিং। না ঘুমালে মুখ চিমসা হয়ে থাকবে। আমি বরং তোর ঘরে শুয়ে থাকি।
শুয়ে থাকো।
ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকি। শুয়ে থাকলাম– ঘুম হলো না, এটাতো কাজের কথা না। কী বলিস।
তোমার যা ইচ্ছা করো মা। বিরক্ত কোরো না। প্লিজ।
তুই জেগে থেকে কী করবি? তুইও শুয়ে পড়। যা করার তোর বাবাই করবে। পুলিশকে টাকা খাওয়াতে হবে।
মা তুমি ঘুমাও। আমি বাবার জন্যে অপেক্ষা করব।
যা ইচ্ছা কর। আমাকে ঘুমাতেই হবে।
তস্তুরী বেগম খুব ভয় পেয়েছে। সে একটু পর পর বারান্দায় এসে আমাকে দেখে যাচ্ছে। ভীতু মানুষরা সাহসী মানুষদের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। সে হয়তো আমাকে খুব সাহসী ভাবছে। একবার একটা বই পড়েছিলাম, বইটার নাম Anatomy of fear, ভয় কত রকম কী তার ব্যাখ্যা। বইটার লেখক বলছেন, সব মানুষের ভেতর কিছু আদিম ভয় লুকিয়ে থাকে। সে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই ভয় লালন করে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই সেই আদিম ভয়ের মুখোমুখি হয়।
আফাগো, চা কফি কিছু খাইবেন?
চা খাব, আমার জন্যে আর বাবার জন্যে বানিয়ে নিয়ে এসো। তুমি কি খুব ভয় পেয়েছ?
পাইছি আফা। ভয়ে আমার শইল কাঁপতেছে। ভয় পাবার কিছু নেই। তোমাকে তো পুলিশ কিছু বলবে না।
পুলিশের কি কিছু ঠিক আছে আফা? এরা জালিম এরা করতে পারে না। এমন কাম নাই।
যাও চা নিয়ে এসো। পুলিশ কি এখনো আছে না চলে গেছে?
পুলিশের বড় সাব অখনো আছে। খালুজানের সঙ্গে কথা বলতেছে। উনারেও কি চা দিব আফা?
না। তুমি এখন যাও।
তস্তুরী বেগমের মনে হয় যেতে ইচ্ছা করছে না। সে নিতান্ত অনিচ্ছায় বারান্দা থেকে বের হলো।
রাত তিনটা চল্লিশ। এর মধ্যেও খবর হয়ে গেছে। বাড়ির চারপাশে লোক জমে গেছে। হৈচৈ হচ্ছে। প্রচুর রিকশা জড়ো হয়েছে। কয়েকজন আবার দেয়ালে চড়ে বসেছে। আমাদের দারোয়ান লাঠি উচিয়ে তাদেরকে নামাচ্ছে।
আমি জানি পুলিশ চলে যাবার পরও এই ভিড় কমবে না। বাড়তে থাকবে। নানান ধরনের গুজব মুখে মুখে ছড়িয়ে যাবে। সকাল নটা দশটা বাজতেই পত্রিকার লোকজন চলে আসবে।
বাবা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন। আমি বাবাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাবা বললেন, কী-রে জেগে আছিস।
হ্যা, জেগে আছি। হয়েছে কী বাবা?
তেমন কিছু না। পুলিশ টগরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ওর বন্ধু-বান্ধব তো ভয়ঙ্কর। বন্ধুদের কেউ হয়তো ধরা পড়েছে। টগরের নামে কিছু বলেছে।
তোমার মধ্যে কোনো টেনশন নেই কেন বাবা?
বাবা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, এ রকম ঘটনা যে ঘটবে তাতে আমি অনেক দিন থেকেই জানি। কাজেই বিস্মিত হই নি।
মৃত্যু যে ঘটবে তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। তারপরেও মৃত্যু যখন ঘটে তখন কিন্তু আমরা খুবই বিস্মিত হই। তোমার মধ্যে বিস্ময়ও নেই।
বিস্ময় নেই?
না নেই, বরং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুশি হয়েছ।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, আমাকে দেখে মনে হয়েছে আমি খুশি হয়েছি?
হ্যাঁ, সে রকমই মনে হচ্ছে। তোমার পরিকল্পনামতো একটা কাজ শেষ হয়েছে। সেই আনন্দে তোমাকে আনন্দিত মনে হয়েছে।
বাবা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরালেন। তস্তুরী বেগম চা নিয়ে এসেছে। বাবা বিরক্ত মুখে বললেন–চা খাব না। বলেই মত বদলালেন। তস্তুরী বেগমকে বললেন, আচ্ছা এনেছ যখন রাখো। বরফ আর গ্লাস আমার ঘরে দিয়ে এসো।
আমি তাঁর সামনেই বসে আছি। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন। এমনভাবে সিগারেট টানছেন যেন তার আশেপাশে কেউ নেই। চায়ের। কাপটাকে তিনি ছাইদানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। এই কাজও তিনি কখনো করেন না। একজন গোছানো মানুষ চায়ের কাপে সিগারেটের ছাই ফেলবে না। সে নিজে উঠে ছাইদানি নিয়ে আসবে কিংবা কাউকে আনতে বলবে।
বাবা আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছেন। রাগ দেখানোর পদ্ধতির মধ্যেও ছেলেমানুষি আছে। রাত প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে এই সময়ে তিনি তাঁর ঘরে বরফ দিতে বললেন। এটিও রাগ দেখানোর অংশ। মেয়েকে বুঝিয়ে দেওয়া আমি তোমার কথায় আহত হয়েছি। এখন মদ্যপান করব। যদিও এই কাজটা তিনি কখনো করবেন না। তার সব কিছুই পরিমিতির মধ্যে। মদ সপ্তাহে একদিন খাবেন। কখনো দু পেগের বেশি খাবেন না। কখনো হৈচৈ করবেন না। মাতাল হওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার। বাবার মতো মানুষরা সীমা অতিক্রম করার আনন্দ জানে না।