উসিলা মাত্র। সেই ঘটনাও বিস্ময়কর।
আজহার চাচা এই পর্যন্ত বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা, তুই এখন একটু অন্য ঘরে যা। গল্পের এই অংশটা তোর শোনা ঠিক না।
আমি বললাম, অশ্লীল না-কি চাচা?
শ্লীল-অশ্লীল কিছু না। সব গল্প সবার জন্যে না। মা তুই যাতত। আমাকে। আদা চা খাওয়াবি বললি – আদা চা কই?
আমি বললাম, স্টোরীর আসল মজার জায়গাটা না শুনে আমি নড়ব না চাচা। আমি একটা আন্দাজ করেছি। দেখি আন্দাজটা মেলে কি-না।
মৃন্ময়ী মা, যা রান্নাঘরে যা।
আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। রান্নাঘরে মা নিচু গলায় আমাদের বুয়া তস্তুরী বেগমকে শায়েস্তা করছেন। তস্তুরী কী অপরাধ করেছে বোঝা যাচ্ছে না। মায়ের শাসানি শুনে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু করেছে, যদিও তস্তুরী বেগমের ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধ করার ক্ষমতাই নেই। সবচে বড় অপরাধ যা সে নিয়মিত করে তা হলো তরকারিতে লবণ বেশি দিয়ে দেয়। তারপর সেই লবণ কমানোর জন্যে কাঠকয়লা দেয়। লবণের তাতে কোনো উনিশ বিশ হয় না। খেতে বসে কৈ মাছের সঙ্গে এক টুকরো কয়লা উঠে আসে। মা আমাকে দেখে বিরক্ত মুখে বললেন, মওলানা গিয়েছে?
আমি বললাম, যান নি।
এখনো যায় নি, মানে কী? ছয়টার সময় এসেছে, এখন বাজে আটটা। বাড়িতে গিয়ে এশার নামাজ পড়বে না? মানুষ এমন বেআক্কেল হয় কীভাবে? আর কতক্ষণ থাকবে?
আরো ঘণ্টা দুই থাকবেন। তুমি দেখা করে এসোনা। আমি কেন দেখা করব?
দেখা করলেই উপহার পাবে। উনি সবার জন্যে উপহার নিয়ে এসেছেন। আমার জন্যে এনেছেন আকিক পাথরের তসবি। আরবের মিষ্টি তেতুল।
তোর বাবার জন্যে কী এনেছে?
বাবার জন্যে খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস এনেছেন। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন জিনিস। বাবা যা খুশি হয়েছেন। আনন্দে ঝলমল করছেন। উপহার কোলে নিয়ে বসে আছেন। আর দাঁত বের করে আসছেন।
মা উত্তেজিত গলায় বললেন, কার্পেট না-কি? ওখানে খুব ভালো পিরশিয়ান কার্পেট পাওয়া যায়। আমার বান্ধবী রীতা হজ করতে গিয়ে একটা বেড় সাইড কার্পেট এনেছিল। কী যে সুন্দর। উপহার, গিফট এই জাতীয় শব্দগুলি শুনলেই মা কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
আমি বললাম, কার্পেট না। অন্য কিছু। সেটা কী?
পাঁচটা প্রশ্ন করে বের করে নাও হিন্ট দিচ্ছি। এটি একটি পরিধেয় বস্ত্র তবে যে পরিধান করে সে এই বস্ত্ৰ চোখে দেখতে পারে না।
এত কথা পেঁচাচ্ছিস কেন? জিনিসটা কী বল।
জিনিসটা দেখে তোমার চোখ যদি কপালে না উঠে যায় তাহলে আমি ফার্স্ট ক্লাস মেজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করিয়ে আমার নাম বদলে ফেলব। মৃন্ময়ীর বদলে নাম হবে ঘৃন্ময়ী। আমার ডাক নাম তখন মৃ থাকবে না, ডাকনাম হবে ঘৃ।
এত কথা বলিস না তো।
মা কৌতূহল সামলাতে পারছেন না—বসার ঘরের দিকে রওনা হলেন। আমি বললাম, সদ্য হজফেরত মানুষের কাছে যা— স্নীভলেস ব্লাউজ পরে যাওয়া কি ঠিক হবে?
মা রাগী গলায় বললেন, পাগলের মতো কথা বলছিস কেন? এটা স্পীভলেস ব্লাউজ?
হাতা বেশি ছোট তো, এইজন্যেই বললাম।
তোর বাবার সঙ্গে তো তুই এত ফাজলামি করিস না। আমার সঙ্গে কেন করিস? আমি তোর বান্ধবীও না, বয়ফ্রেন্ডও না।
আমি মিষ্টি করে হাসলাম। কেউ যখন হাসে সে বুঝতে পারে না তাঁর হাসি কেমন হচ্ছে। আমি বুঝতে পারি। কারণ আমি আমার সব হাসি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন দেখেছি। এখনো সময় পেলে দেখি। কোন হাসিতে আমাকে কেমন দেখায়, তা আমি জানি। আমি মোটামুটি পাঁচ ক্যাটাগরীর হাসি রপ্ত করেছি।
১. Non commital হাসি। এই হাসিতে কিছুই বোঝা যাবে না।
২. দুঃখময় হাসি। মন কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে হাসি।
৩. বিরক্ত হাসি। অন্যের বোকামি দেখে বিরক্তির হাসি।
৪. আনন্দের হাসি। এই হাসি খুব সাধারণ। কোনো বিশেষত্ব নেই।
৫. মোনালিসা হাসি। বিশেষ কারোর জন্যে।
মা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তস্তুরী বেগম বলল, আফা কতবেলের ভর্তা খাইবেন?
আমি বললাম, না।
দিন দশেক আগে একবার কতবেলের ভর্তা খেয়ে বলেছিলাম, বাহ্ খেতে চমৎকার তো! এরপর থেকে রোজই সে দুতিনবার জিজ্ঞেস করে, আফা কতবেলের ভর্তা খাইবেন?
তস্তুরী বেগম আজ রাতের খাবার কী?
ইলিশ মাছের ডিমের ভাজি। ইলিশ মাছ আর পটলের তরকারি। ইলিশ মাছের মাথা আর কাটাকুটা দিয়া লাউ।
ইলিশে ইলিশে দেখি ধূল পরিমাণ। ইলিশের একই অঙ্গে এত রূপ? সজনে দিয়ে ছোট মাছের কোনো তরকারি রান্না হয় নি?
জে না।
রান্না করা যাবে না?
ফিরিজে ছোট মাছ আছে, কিন্তুক সইজনা নাই।
সজনে আনিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। তুমি অতি দ্রুত ছোট মাছের তরকারি রান্নার ব্যবস্থা কর।
জে আচ্ছা।
তোমার জন্যে একটা উপহার আছে। আকিক পাথরের তসবি। মক্কা শরীফের জিনিস এই নাও।
এখন নিতে পারব না আফা, অজু নাই।
টেবিলের ওপর রেখে দিচ্ছি, অজু করে এসে এক সময় নিয়ে যে।
তস্তুরী বেগম আনন্দিত মুখে ঘাড় কাত করল। আমার পরিচিত খুব কম মানুষকেই আমি পছন্দ করি তস্তুরী বেগম সেই অতি অল্প সংখ্যক মানুষের একজন। তার মধ্যে মাতৃভাব অত্যন্ত প্রবল। সে যখন আমার সঙ্গে কথা বলে। তখন মনে হয় মা তার ছোট মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়ের প্রতিটি আন্সার শুনে মজা পাচ্ছে। আবার তস্তুরী বেগম যখন আমার মার সঙ্গে কথা বলে তখন মনে হয় সে তার রাগী বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। বড় মেয়ে অন্যায়ভাবে কথা বলছে তা সে বুঝতে পারছে। বুঝতে পারলেও কী আর করা হাজার হলেও মেয়ে।