বাবা বললেন, তুমি কবে থেকে সত্যবাদী হয়ে গেলে?
তোমার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে সত্যবাদী হয়েছি। তুমি সব সময় সত্যি বলো তো। তোমাকে দেখে দেখে সত্যি বলা শিখেছি।
তুমি কী বোঝাতে চেষ্টা করছ?
আমি কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছি না। শুধু বলেছি তোমার সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে আমি সত্যি কথা বলা শিখেছি। এর আগে প্রচুর মিথ্যা বলতাম। ক্লাস টেনে বান্ধবীরা নববর্ষে সবাইকে উপাধি দেয়— আমার উপাধি কী ছিল জানো– মিথ্যারাণী!
বাবা আগুন চোখে তাকিয়ে রইলেন। মা বললেন, মনে হচ্ছে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। ক্লাস টেনে সাফিয়া নামের একটা মেয়ে পড়ত। ওর টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি। ওকে জিজ্ঞেস করো।
বাবা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাতের এক ঝটকায়। টেবিলে রাখা ডালের বাটি মেঝেতে ফেলে দিলেন। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে মা বললেন, করেছ কী? ডালের বাটিটাই ফেলে দিলে। ডালটাই সবচে ভালো হয়েছিল। মুরগির মাংসের বাটিটা ফেলতে। খেতে জঘন্য হয়েছে।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা দয়া করে নিজেকে সামলাও। এবং খাওয়া শেষ করো।
বাবা বসে পড়লেন। মা বললেন, আমাকে সরি বলার কোনো দরকার নেই।
বাবা শীতল গলায় বললেন, সরি।
আমি তাকিয়ে আছি বাবার দিকে। বাবা নিজের ওপর কন্ট্রোল পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন। ভাত মুখে দিচ্ছেন, কিন্তু তার হাত কাঁপছে। বাবা নিচু গলায় বললেন, নানান টেনশানে থাকি। নিজের ওপর কনট্রোল কমে যাচ্ছে। আমি আসলেই দুঃখিত। এরকম আর কখনো হবে না।
সংবাদপত্রের ভাষায় এ ধরনের বক্তব্য হলো নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা। ক্ষমা প্রার্থনার পর আর কিছু থাকে না। মার মুখে বিজয়ীর হাসির পরিবর্তে বোকা বোকা হাসি দেখা যাচ্ছে। তিনি কিছু বলবেন এটা বুঝতে পারছি অনেকক্ষণ ধরেই। তিনি মনে মনে কিছু গোছাচ্ছেন। মা বাবাকে আবারো আক্রমণ করবেন এরকম মনে হচ্ছে না। টম এন্ড জেরী খেলার এইখানেই ইতি হবার কথা। কিন্তু মাকে বিশ্বাস নেই। মা বাবার দিকে তরকারির বাটি বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার পায়ের মাপটা দিও তো।
বাবা বললেন, কেন?
মা বললেন, আমি মোজা বানানো শিখেছি। তোমার জন্যে উলের মোজা বানিয়ে দেব। চা বাগান কিনেছ। শীতের সময় ঐ সব অঞ্চলে খুব শীত পড়ে। উলের মোজা পায়ে থাকলে শীতের হাত থেকে বাঁচবে।
বাবা মার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, থ্যাংক য় ফর দ্যা কাইন্ড থট।
আমি মোজা বানানো কার কাছ থেকে শিখেছি জানলে তুমি খুবই অবাক হবে।
বাবা খাওয়া বন্ধ করে মার দিকে তীক্ষ চোখে তাকালেন। আমিও তাকলাম। টম এন্ড জেরী খেলা এখনো শেষ হয় নি। মার মুখে আনন্দময় হাসি। মা হাসি হাসি মুখে বললেন, মোজা বানানো শিখেছি টগরের মার কাছে। টগরের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে উনাকে খুঁজে বের করলাম। খুব গুণী মহিলা। অনেক কিছু জানেন। ছোট মাছ আর জলপাই দিয়ে একটা টক করেন। তুমি না-কি সেই টক খুব শখ করে খেতে।
বাবা তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। পরিস্থিতি বিচার করছেন। মা বললেন, এখন শিখে এসেছি তোমার যখন খেতে ইচ্ছা করে বলবে বেঁধে খাওয়াব।
বাবা বললেন, থ্যাংক যা এগেইন।
মা বললেন, আরেকজনের কাছে মুরগি রান্নার একটা রেসিপি জোগাড় করেছি। এটাও না-কি তোমার খুব প্রিয়।
বাবার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। মার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। তিনি এখন আর বাবার দিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
মৃ শুনে রাখ। তোর যা বুদ্ধি একবার শুনলেই মনে থাকবে। তখন তুই তোর প্রিয়জনকে বেঁধে খাওয়াবি। তোর গরু স্যারকে বেঁধে খাওয়াতে পারিস। রেসিপিটা হচ্ছে একটা মাঝারি সাইজের মুরগি নিবি। আস্ত মুরগিটার চামড়া খুলে ফেলবি। তারপর মুরগিটার গায়ে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটার মতো ফুটা করবি। প্রতিটা ফুটায় একটা করে রসুনের কোয়া ঢুকিয়ে দিবি। তারপর টক দই দিয়ে মুরগিটা মাখিয়ে একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্রিজে রেখে দিবি। মুরগি ফ্রিজে থাকবে বার ঘণ্টা…
বাবা কঠিন গলায় বললেন, স্টপ ইট।
মা চুপ করে গেলেন।
আফাগো আফা
কে যেন চাপা গলায় ডাকছে, আফাগো আফা।
তস্তুরী বেগমের গলা। বালিশের নিচে আমার হাতঘড়ি। রেডিয়াম ডায়ালের চল উঠে গেছে। রেডিয়াম স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। সময় দেখতে হলে বাতি জ্বালাতে হবে। বাতি জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। ঘড়ি না দেখেই বুঝতে পারছি অনেক রাত। আমি ঘুমুতে গেছি রাত একটায়। অনুমান করছি দুঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছি, কাজেই রাত তিনটা হবে। রাত তিনটায় তস্তুরী বেগম আমাকে কেন ডাকবে? কোনো ইমার্জেলি? বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? কিছুদিন পর পর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। বিছানায় ছটফট করতে থাকেন। তখন চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। বারান্দার সব বাতি জ্বালানো হয়। কয়েকজন ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়। এ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। অক্সিজেন চলে আসে। তখন বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন। বিছানায় উঠে বসে স্বাভাবিক গলায়। বলেন, এক গ্রাস পানি দেখি। নরমাল পানির সঙ্গে এক টুকরা বরফ দিও।
ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তখন বাবা বলেন, দেখি একটা সিগারেট।
আজকেও এরকম কিছু কি হয়েছে?
তস্তুরী বেগম আবার ডাকল, আফাগো আফা। দরজা খুলেন।
আমি দরজা খুললাম না। ব্যাপার আঁচ করতে চাচ্ছি। বারান্দায় হাঁটার শব্দ পাচ্ছি। চটি পায়ে হাঁটা। বাবা হাঁটছেন। তার অর্থ হলো তিনি সুস্থ আছেন। আমার ঠিক ঘরের সামনে চেয়ার টেনে কে যেন বসল। সম্ভবত মা। মা বসার আগে চেয়ার একটু সরাবেন। চেয়ারটা যেখানে আছে ঠিক সেখানে বসবেন না।