তিনি উলের মোজা নিয়ে কী যেন বললেন। আসলে আমি মন দিয়ে তাঁর কথা শুনি নি।
আমি দোতলায় উঠে এলাম। দোতলার বারান্দায় গামলা ভর্তি গরম পানিতে পা ডুবিয়ে মা বসে আছেন। তাঁর পায়ে সমস্যা আছে। সামান্য হাঁটাহাটি করলেই পা ফুলে যায়। তখন জল চিকিৎসা চলে। তাঁর হাতে উলের কাটা। তিনি মোজা বুনা শুরু করেছেন।
মা আমাকে দেখে হাসিমুখে তাকালেন। আমি কঠিন গলায় বললাম, ভাইয়াকে তুমি টাকাটা দাও নি মা?
না।
তাহলে আমাকে কেন বললে দিয়েছ?
তুই খুবই মন খারাপ করে ছিলি। তোর মন ভালো করার জন্যে মিথ্যা করে। বলেছি। মানুষের মন ভালো করার জন্যে দু একটা ছোটখাট মিথ্যা বলা যায়। এতে কোনো পাপ হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে পুণ্য হয়।
আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মোজা বুনে। যাচ্ছেন। কাজটায় অতি অল্প সময়ে তিনি দক্ষতা অর্জন করেছেন এটা বোঝা যাচ্ছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন ভালো হচ্ছে না? মোজা বানানোর আসল রহস্য খুব সোজা। ঘর তোলা আর হিসেব করে ঘর বন্ধ করা। এই দুটা জিনিস জানলেই হলো। তুই যদি চাস তোকে আমি মোজা বানানো শিখিয়ে দিতে পারি। তোর বুদ্ধি বেশি তো। তুই খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলবি। শিখবি?
তোমার কাছ থেকে কিছুই শিখব না মা।
কার কাছে থেকে শিখবি তোর বাবার কাছ থেকে? দাড়িয়ে আছিস কেন, বোস। এতে আমার খুব লাভ হবে।
কী লাভ হবে?
নাটকে আমার সিকোয়েন্সটা হচ্ছে আমি শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকে উল বুনব। তুই যদি আমার সামনে বসিস তাহলে আমি তোর দিকে তাকিয়ে উল বুনব। এতে প্র্যাকটিসটা হবে।
আমি মার সামনের মোড়ায় বসলাম। মা মাথা নিচু করে অস্পষ্টভাবে হাসলেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। অত্যন্ত রূপবতী একজন মহিলা বয়সের কোনো ছাপ যার চেহারায় নেই। শুধু বয়স কেন, কোনো কিছুর ছাপই তার চেহারায় নেই। দুঃখের ছাপ নেই, শোকের ছাপ নেই, আনন্দের ছাপ। নেই।
মৃন্ময়ী, তোর বাবার সঙ্গে কি তোর দেখা হয়েছে?
না।
সে ঘরে আছে। মেজাজ খুবই খারাপ।
কেন?
তোর বাবা তো বলবে না কেন তার মেজাজ খারাপ। তবে আমি অনুমান করতে পারি। দড়ি টানাটানি খেলা হঠাৎ শুরু হয়েছে। তার বাবা সবসময় ভেবেছে তার শক্তি ভালো। দড়ি টানাটানি শুরু হলে সে অনায়াসে জিতবে। এখন বুঝতে পারছে জেতা দূরের কথা, তার ফেল নিয়েই টানাটানি।
কী বলতে চাচ্ছি পরিষ্কার করে বলো তো মা।
ফেল নিয়ে টানাটানির ব্যাপারটা আগে বলি। এক ছেলে ক্লাস ফোরের ছাত্র। পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়েছে। রেজাল্ট এতই খারাপ হয়েছে যে হেডমাস্টার সাহেব বলেছেন এই ছেলেকে ক্লাস ফোরে রাখার দরকার নেই। এক ক্লাস নিচে নামিয়ে দিন। ছেলের বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছেন, কী-রে বাবা পাশ করেছিস? ছেলে বিরক্ত হয়ে বলল, রাখো তোমার পাশ– আমার ফেল নিয়েই টানাটানি।
মা তুমি কী বলতে চাচ্ছ পরিষ্কার করে বলে। গল্পগুলি বাদ দাও। দড়ি টানাটানির ব্যাপারটা কী?
তোর বাবা এবং আজহার সাহেব এই দুজনের মধ্যে দড়ি টানাটানি হচ্ছে। অনেকদিন থেকেই হালকাভাবে হচ্ছিল, এখন প্রবল টানাটানি আরম্ভ হয়েছে। তোর বাবার অবস্থা কাহিল আজহার সাহেব বলতে গেলে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তোর বাবা মাটিতে পা রাখতেই পারছে না, দড়ি কী টানবে। হি হি হি।
হাসি বন্ধ করে মা।
তুই না বললেও হাসি বন্ধ করতাম। হাসতে গিয়ে আমার উল বোনায় গণ্ডগোল হয়ে গেছে। দুইটা ঘর ফেলে দিয়েছি। কী সর্বনাশ!
দুটা ঘর ফেলে দিয়েছ, তোমার বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাই না মা! জগৎ সংসার আউলে গেছে! ছোট মানুষের ছোট জগৎ ছোট ব্যাপারেই আউলে যায়। মোজার দুটা ঘর ফেললে কারোর জগৎ আউলায়। আবার কেউ কেউ আছে কোনো কিছুতেই জগৎ আউলায় না।
মার বকবকানি শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি উঠতে যাচ্ছি মা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেললেন। চাপা গলায় বললেন, তোর বাবা শেষ পর্যন্ত কবরের জায়গা কিনেছে। আজহার সাহেবের হাত থেকে তোর বাবা বের হয়ে যাবে এটা অসম্ভব। তোর বাবা জানে না। আমি জানি।
বাবা কবরের জায়গা কিনেছেন?
হ্যাঁ।
সত্যি কথা বলছ মা?
মা জবাব দিলেন না— তিনি মোজার ফেলে যাওয়া দুটা ঘর খুঁজে পেয়েছেন। তিনি ঘর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মা যে সত্যি কথা বলছেন তা বোঝা যাচ্ছে। সত্যি বলে তিনি থেমে গেছেন, কিন্তু আমাকে একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন। মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন আজহার নামের বোকা টাইপের মানুষটা আমার অতি বুদ্ধিমান বাবাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাবা বুঝতেও পারছেন না। তিনি নিজেকে রেলের ডিজেল ইঞ্জিন ভাবছেন— অতি দ্রুত এগুচ্ছেন কিন্তু যে রেল লাইনের ওপর দিয়ে তিনি যাচ্ছেন সে রেল লাইন যে অন্য একজন পেতে দিচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না।
রাতে খেতে বসে খুব সহজ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তুমি কবরের জন্যে জায়গা কিনেছ না-কি?
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, কে বলেছে?
তার মানে তুমি কিনেছ?
হ্যাঁ কিনেছি। প্রতিদিন এসে ঘ্যানর ঘ্যানর–ভালো লাগে না।
মা হাসি মুখে বললেন, তোমার তো সব ব্যবস্থাই হয়ে গেল। কাফনের কাপড় আছে, কবরের ব্যবস্থাও হয়ে গেল।
বাবা খাওয়া বন্ধ করে বললেন, আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না।
মা অবাক ভাব করে বললেন, কী ফাজলামি করলাম? যেটা সত্যি সেটা বলেছি। না-কি এ বাড়িতে সত্য বলা নিষেধ?