কোনো ব্যাপার না বাবা, আমার কিছু টাকা দরকার।
কখন দরকার?
আমি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরব একটার সময়। তখনই দরকার। তুমি কাউকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিও।
তেমন প্রয়োজন মনে করলে আমি রহমতকে দিয়ে তোর ইউনিভার্সিটিতেও পাঠাতে পারি।
ইউনিভার্সিটিতে পাঠাতে হবে না। বাড়িতে পাঠাও।
এমাউন্ট বল। এমাউন্টটা বেশি। আমার দরকার ষাট হাজার টাকা। Sixty thousand.
হঠাৎ এত টাকা। কী জন্যে দরকার বল তো?
সেটা এখন বলতে পারব না। ষাট হাজার টাকা তোমার জন্যে দেয়া কি কোনো সমস্যা?
না, সমস্যা না।
বাবা টাকাটা অবশ্যই দেড়টার মধ্যেই পাঠাবে। আমার দরকার চারটার আগে। তারপরেও কিছু সময় হাতে থাকা ভালো।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মৃ টাকাটা তোর দরকার না। অন্য কারোর দরকার। আমার ধারণা তোর কাছে টাকাটা চেয়েছে টগর। ধারণা কি ঠিক?
আমি বললাম, টাকাটা আমি তোমার কাছে চাচ্ছি। এটাই মূল বিষয়।
বাবা শান্ত গলায় বললেন, এটা অবশ্যই মূল বিষয় না। তুই আমাকে খোলাখুলি বল – টাকাটা কি টগরের দরকার?
হ্যাঁ।
কী জন্যে দরকার?
বাবা আমি জানি না। আমাকে ভাইয়া বলে নি।
ঠিক আছে আমি টেলিফোন করে টগরের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি।
তুমি অবশ্যই ভাইয়াকে টেলিফোন করবে না। ব্যাপারটা সে তোমাকে জানাতে চাচ্ছে না।
কেন জানাতে চাচ্ছে না? সে তোমাকে ভয় পায়।
পুরো ব্যাপারটায় ফিসি কিছু আছে। ফিসি কোনো ব্যাপারই আমার পছন্দ না। মৃন্ময়ী মা শোন, এই টাকাটা আমি দেব না।
আমি খুবই বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি দেবে না!
বাবা শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, না। টগরকে আমার কাছে আসতে হবে। ওকে এক্সপ্লেইন করতে হবে।
না দিলে দিও না, কিন্তু ভাইয়াকে এ বিষয়ে দয়া করে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
আচ্ছা। জিজ্ঞেস করব না।
বাবা টেলিফোন রেখে দিলেন।
আমি একটা ধাক্কার মতো খেলাম। বাবা অতি বুদ্ধিমান একজন মানুষ। বুদ্ধিমান মানুষ কখনো তার প্রিয়জনদের সঙ্গে এমন রূঢ় আচরণ করে না। আমি একটা ছোট্ট ভুল করেছি। আমার বলা উচিত ছিল— টাকাটা আমার নিজের ব্যক্তিগত কোনো কারণে দরকার। কারণটা এখন ব্যাখ্যা করতে পারছি না। পরে ব্যাখ্যা করব। মিথ্যা বলা হতো। আমি নিজে মিথ্যা বলার জন্যে নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকতাম। কিন্তু বেচারা ভাইয়া উদ্ধার পেত। সে নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়েছে।
মোবাইল ফোন বাজছে। বাবা টেলিফোন করেছেন। ফোন সেটে তাঁর নাম্বার ভাসছে। প্রচণ্ড রাগ লাগছে। টেলিফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। এই অভদ্রতাটা করা কি ঠিক হবে? হয়তো বাবা টেলিফোন করেছেন সরি বলার জন্যে। হয়তো তিনি মত বদলেছেন। রহমত চাচাকে টাকা দিয়ে পাঠাচ্ছেন। মানুষের ভেতর সব সময় জোয়ার ভাটার খেলা চলে। এই রাগ এই ভালোবাসা। এই মেঘ এই রৌদ্র।
মৃন্ময়ী।
হ্যাঁ বাবা।
তুই কি এখনো পথে।
হ্যাঁ জামে আটকে পড়েছি।
ক্লাসের দেরি হয়ে গেল না?
রোজই হচ্ছে। তুমি কী বলার জন্যে টেলিফোন করেছ সেটা বলে ফেল।
মৃন্ময়ী শোন, তুই মনে হয় আমার ওপর রাগ করেছি। পুরো ব্যাপারটা তোকে ঠাণ্ডা মাথায় দেখতে হবে।
বাবা আমার মাথা এখন মোটেই ঠাণ্ডা না, কাজেই ঠাণ্ডা মাথায় আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। পরে তোমার সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করি।
আলোচনার কিছু নেই। আমার যা বলার আমি এখনি বলে শেষ করব। আমার ধারণা আমার কথা শোনার পর কথার পেছনের লজিক তুই ধরতে পারবি। জগতটা আবেগের না মা। জগতটা লজিকের। পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে কোনো আবেগে ঘুরছে না। লজিকে ঘুরছে।
এই লজিক সৃষ্টির পেছনে কিন্তু কাজ করেছে আবেগ।
সেটা তো আমরা জানি না। লজিকটা আমরা জানি। যা জানি কথা হবে তার ভিত্তিতে।
বেশ বলো তোমার লজিক।
বাবা শান্ত গলায় বললেন, টগর হলো এমন এক ছেলে যার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। ডিগ্রি পরীক্ষা দুবার দিয়েছে। এই তার যোগ্যতা। প্রতি মাসে আমার কাছ থেকে যে টাকাটা হাত খরচ হিসেবে পায় এটাই তার বর্তমানের রোজগার এবং হয়তোবা ভবিষ্যতের রোজগার। এই পর্যন্ত যা বলেছি ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
তার কিছু বন্ধু বান্ধব আছে যারা ছায়া জগতের বাসিন্দা। দু একজনের পেছনে পুলিশ ঘুরছে। যা বলছি ঠিক আছে মা?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
এখন টগর নামের অপদার্থ ছেলেটার হঠাৎ ষাট হাজার টাকার দরকার পড়ে গেল। বাবা হিসেবে আমি প্রথম যে চিন্তাটা করব তা হলো সে বড় কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে। টাকা দিয়ে ঝামেলা মেটানো যায় না। টাকায় ঝামেলা বাড়ে। টাকাটা না দিয়ে আমার উচিত খোঁজখবর করা ঘটনা কী?
তোমার টাকা দিতে হবে না। তোমার প্রতি আমার একটাই অনুরোধ তুমি এই নিয়ে কোনো খোঁজখবর করবে না। ভাইয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
তোর অনুরোধ রাখব। এবং আশা করব তুইও আমার কথা রাখবি।
তোমার কী কথা?
টগরের টাকাটা অন্য কোনো সোর্স থেকে জোগাড় করার চেষ্টা করবি না।
আমার আর কোনো সোর্স নেই।
তুই বুদ্ধিমতী মেয়ে। সোর্স বের করা তোর জন্যে কোনো সমস্যা না।
থ্যাংক য়ু ফর দি কমপ্লিমেন্ট। বাবা টেলিফোন রাখি?
টেলিফোন রাখার আগে তুই কি স্বীকার করৰ্বি আমি যে কথাগুলি বলছি তার পেছনে যুক্তি আছে?
হ্যাঁ স্বীকার করছি।
বাবা টেলিফোন রেখে দিলেন।
পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাস। আমি উপস্থিত হলাম চল্লিশ মিনিট পর। ক্লাসে ঢুকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। টিচার নেই। কাওসার স্যার ক্লাস নিতে আসেন নি। যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। কেউ কেউ ডিজাইন টেবিলে বসে কাজ করছে। তবে বেশির ভাগই গল্প করছে। ফরিদা বলল-ইউনিভার্সিটির কারেন্ট গুজব শুনেছি? আমাদের বিখ্যাত গরু স্যার রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়েছেন।