মা চোখ বড় বড় করে বললেন, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? এখনো তো ছেলেটার তোর সঙ্গে বিয়ের দলিল রেজেষ্ট্রি হয় নি। আগে হোক, তারপর রাগ করিস।
আমি বললাম, এইসব কী বলছ তুমি?
মা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তোর সঙ্গে ঠাট্টা করলাম। ঠাট্টাও করতে পারব না।
এই ঠাট্টাটা আমার ভালো লাগছে না।
ঠাট্টা তো করাই হয় ভালো না লাগার জন্যে। ঠাট্টা শুনে তুই যদি মজা পাস তাহলে তো আর এটা ঠাট্টা থাকে না। সেটা হয়ে যায় রসিকতা।
ঠিক আছে মা ঠাট্টা করো।
মা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তুই কিন্তু LSD ট্যাবলেট আমাকেও দিবি। আমি খেয়ে দেখব রঙের ব্যাপারটা কী। আয় আমরা মা মেয়ে দুজন এক সঙ্গে খাই।
আমি মার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মা বললেন, টেলিফোনের প্যারালাল কানেকশন তো। তুই যখন কারো সঙ্গে কথা বলিস তখন মাঝে মাঝে আমি শুনি।
যেন টেলিফোনে লুকিয়ে কথা শোনা কোনো ব্যাপার না। এমন ভঙ্গিতে মা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকে বললেন, তোকে তো আসল কথাই বলা হয় নি। নকল কথা নিয়ে ছোটাছুটি করছি। তোর আজহার চাচা তার ছেলের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এসেছেন। তোর বাবাকে বললেন। খুব খুশি। তার হাসি শুনতে পাচ্ছিলি না। ভোর জন্যে বিশাল এক গিফট প্যাকেট এনেছেন। এখন খুলবি না পরে খুলবি?
আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। মা গ্রিন টির মগে চুমুক দিচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে চা-টা খেয়ে তিনি খুব তৃপ্তি পাচ্ছেন।
ভাইয়া
গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে, যেখানে দারোয়ান এবং মালীরা সাধারণত বসে থাকে। ভাইয়া সেখানে বসে আছে। তার মুখ বিষণ্ণ। দেখেই মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। শরীর কি খারাপ করেছে? ভাইয়া এমন মানুষ যে শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করলেও কাউকে কিছু জানাবে না। হয়তো তার কাছে শারীরিক কষ্ট অরুচিকর ব্যাপার। যা অন্যদের কাছ থেকে গোপন রাখতে হয়।
ভাইয়া এ বাড়িতে থাকতে আসার দিন পনের পরের কথা— বাবা এক সকালবেলা গাড়ি বের করে আমাকে বললেন টগরকে ডেকে নিয়ে আয়তে। ওকে কিছু জামাকাপড় কিনে দেব। ওতো ফকির মিসকিনের কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছে। মৃন্ময়ী, তুইও চল আমাদের সঙ্গে। আমি ভাইয়াকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভার ঘটাং করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল। ভাইয়া গাড়ির দরজায়। হাত রেখেছিল, তার হাতের তিনটা আঙ্গুল থেতলে গেল। সে অস্পষ্ট গলায় শুধু বলল, উফ।
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
ভাইয়া বলল, কিছু হয় নাই।
বাবা বললেন, দরজায় হাত রেখে বসেছিলে কেন? গাড়িতে চড়ারও কিছু নিয়ম কানুন আছে। লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেই হয় না। ব্যথা পেয়েছ।
ভাইয়া চাপা গলায় বলল, না।
বাবা বললেন, ড্রাইভার চালাও, বনানী মার্কেটের দিকে যাও।
আমি বললাম, না। আগে কোনো ডাক্তারের কাছে চলে। ভাইয়া খুবই ব্যথা পেয়েছে, রক্ত পড়ছে। রক্তে তার সার্ট মাখামাখি হয়ে গেছে।
আমরা একটা ক্লিনিকে গেলাম। ক্লিনিকের ডাক্তার সাহেব বললেন, কী সর্বনাশ! এই ছেলের তো একটা আঙ্গুল ভেঙে গেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান, কিংবা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান।
বাবা বিরক্ত মুখে বললেন, একটা আঙ্গুল ভেঙে গেছে তারপরেও কোনো শব্দ করে নাই। এ তো ডেনজারাস ছেলে। একে তো সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখা দরকার।
টগর নামের অতি শান্ত অতি নম্র কিশোরটি একটি ডেনজারাস ছেলে এই চিন্তাটা বাবা মাথা থেকে কখনো দূর করতে পারেন নি। দূর কোনোদিন হবে বলেও আমার মনে হয় না। মানুষের প্রথম ধারণা সব সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়। ভাইয়াকে এ রকম অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে আমার খুবই মায়া লাগল। এইখানে একটা ভুল কথা বললাম— ভাইয়াকে দেখলেই আমার মায়া লাগে। তাকে অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখলেও মায়া লাগে, আবার সহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখলেও মায়া লাগে। আমি বললাম, শরীর খারাপ না-কি?
না। মৃ তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
এইখানে বলবে না ঘরে যেতে হবে?
ঘরে আয়।
কথা যা বলার এক মিনিটের মধ্যে বলে শেষ করতে হবে। আমার আজও ক্লাসে দেরি হয়ে গেছে।
তাহলে এখানেই বলি।
বলো।
ভাইয়া ইতস্তত করতে লাগল। আমি খুবই অবাক। এমন কী কথা যা আমাকে বলতে ভাইয়ার ইতস্তত করতে হচ্ছে। আমি ধমকের মতো বললাম, বলো তো কী বলবে।
আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবি?
আমি হ্যান্ডব্যাগ খুলতে খুলতে বললাম, অবশ্যই পারব। বলো কত লাগবে পাঁচ শ টাকায় হবে?
পাঁচ শ টাকায় হবে না। অনেক বেশি টাকা লাগবে। কারো কাছ থেকে জোগাড় করে দিতে পারবি?
অবশ্যই পারব। বাবার কাছ থেকে এনে দেব।
টাকাটা যে আমার দরকার এটা জানলে বাবা দেবেন না।
বাবাকে বলব না। এখন দয়া করে বলে কত টাকা?
ষাট হাজার টাকা।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ষাট হাজার টাকা! এত টাকা?
ভাইয়া নিচু গলায় বলল, হ্যাঁ। বিকাল চারটার আগে টাকাটা লাগবে। মৃ পারবি?
না পারার তো কোনো কারণ দেখি না।
বিকাল চারটার আগে টাকাটা দরকার।
আমার মনে আছে। আমি কি জানতে পারি বিকাল চারটার আগে এতগুলি টাকা কেন দরকার।
ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল— পরে বলি? এখন বলতে ইচ্ছা করছে না।
বলতে ইচ্ছা না করলে তোমাকে কখনো বলতে হবে না।
থ্যাংকু য়।
আমি গাড়িতে উঠেই মোবাইল ফোনে বাবাকে টেলিফোন করলাম। ষাট হাজার টাকা বাবার জন্যে কোনো ঘটনাই না। বাবা টেলিফোন ধরলেন। কিছুটা অবাক হয়েই বললেন, মা ব্যাপার কী?