ফুচকার দাম দেয়ার মতো টাকা সঙ্গে নেই এটা কোনো বুদ্ধিমান মানুষের জন্যে বড় সমস্যা না। এই সমস্যার সমাধান বার করা যাবে। তিনি সুন্দর করেই এই সমস্যার সমাধান করবেন। তারপর কী হবে? তিনি চিন্তিত হয়ে বাসায় ফিরবেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইবেন কিন্তু করতে পারবেন না। আমার টেলিফোন নাম্বার তার কাছে নেই।
ড্রাইভার বলল, বাসায় যাব আপা।
আমি বললাম, না।
কোন দিকে যাব?
আপনার ইচ্ছামতো যে-কোনো জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে থাকুন। আধ ঘণ্টা এই রকম ঘুরবেন, তারপর বাসায় যাবেন।
ড্রাইভারের মুখ শুকিয়ে গেল। আমাদের ড্রাইভার তিনজন। তিন ড্রাইভারের একই অবস্থা হয়। যখনই বলি আপনার ইচ্ছা মতো কিছুক্ষণ গাড়ি নিয়ে চক্কর দিন। তখন তাদের দেখে মনে হয় তারা অথই সাগরে পড়ে গেছে। পরের ইচ্ছায় কাজ করতে এদের সমস্যা নেই। নিজের ইচ্ছায় তারা কিছু করতে পারে না।
নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় কাজ করার ক্ষমতা এদের নষ্ট হয়ে গেছে।
দোতলার টানা বারান্দায় বাবা বসে আছেন। বাবার পাশে আজহার চাচা। বারান্দায় চেয়ারগুলি এমনভাবে পাতা যে মুখোমুখি বসার উপায় নেই। দুজন পাশাপাশি বসে আছেন। কথা বলার সময় আজহার চাচা বাবার দিকে তাকাচ্ছেন–হাত-পা নাড়ছেন। বাবা মূর্তির মতো সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোট নাড়া দেখে আলাপের বিষয়বস্তু বোঝা যাচ্ছে না, তবে আজহার চাচার মুখ ভর্তি হাসি দেখে মনে হয় দারুণ মজার কোনো কথা হচ্ছে। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। যে-কোনো মুহূর্তে তিনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াবেন। সামনের বেতের গোল টেবিলটা লাথি দিয়ে ফেলে দেবেন। এতে যদি বিরক্তি কাটা যায় তাহলে কাটা যাবে। যদি কাটা না যায় তিনি হয়তোবা দোতলার বারান্দা থেকে লাফ দেবেন।
আমি সরাসরি তাদের কাছে গেলাম। আজহার চাচা আমাকে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, অনেক আগেই চলে যেতাম তুই আসবি, তোর সঙ্গে দেখা হবে এই জন্যেই বসে আছি। তার বাবা বলল তোর না-কি ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার টাইমের কোনো ঠিক নেই। কখনো দুপুর তিনটায় ফিরিস, কখনো রাত আটটা?
আমি হাসলাম। হঠাৎ আপনার দেখা পেয়ে খুবই আনন্দ পাচ্ছি জাতীয় হাসি। আমার আসলেই ভালো লাগছে।
চাচা আপনি না-কি কবরের জন্যে জায়গা কিনছেন?
হ্যাঁরে মা, কিনে ফেললাম। ধানমণ্ডিতে যখন এক বিঘার একটা প্লট কিনি তখন খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম। কবরের জায়গাটা কেনার পরও সমান আনন্দ পেয়েছি। তোর বাবাকে কিনে দিতে চাচ্ছি সে কিনবে না।
আপনি তো চাচা ডেনজারাস মানুষ।
ডেনজারসি কেনরে মা?
প্ৰথমে কাফনের কাপড় কিনে দিলেন। এখন কবরের জন্যে জায়গা কিনে দিচ্ছেন। কয়েকদিন পর কবরের জায়গাটা বাঁধিয়ে ফেলবেন। তারপর মৌলবি রেখে দেবেন সে প্রতি বৃহস্পতিবারে গিয়ে ওজিফা পাঠ করবে। এদিকে কবরে কোনো ডেডবডিই নেই। বাবা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আজহার চাচা শব্দ করে হেসে উঠলেন। তাঁর হাসি আর থামতেই চায় না। অনেক কষ্টে হাসি থামান, আবার হো হো করে ওঠেন। তিনি বাবার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বললেন তোমার মেয়ের কথাবার্তা শুনেছ? জোকারী ধরনের কথাবার্তা। এ রকম কথা কয়েকটা শুনলে তো হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। বলে কী কবরে কোনো ডেডডি নেই, এদিকে প্রতি বৃহস্পতিবার ওজিফা পাঠ হচ্ছে। হা হা হা।
বাবা বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। চোখের ভাষায় বলার চেষ্টা করলেন তুমি কেন বুঝতে পারছ না আমি এই লোকটার সঙ্গ পছন্দ করছি না? কেন তুমি তারপরেও মানুষটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছ? তার সঙ্গে রসিকতা করার কোনো দরকার নেই।
আজহার চাচা বললেন, মৃন্ময়ী মা আমার ছেলেটাকে আজ জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। ছোটবেলায় কত এসেছে এখন আর আসতে চায় না। তার কথা তোর মনে আছে তো মা— ডাক নাম শুভ। তোদের বসার ঘরে ও একা একা বসে আছে। ও চা-টা কিছু খাবে কিনা একটু জিজ্ঞেস করিতো। যা লাজুক ছেলে মুখ ফুটে কিছু বলবে না। একে নিয়ে বিরাট বিপদে আছি। তাকে এমন কোনো মেয়ের হাতে তুলে দিতে হবে যে তার নাকে দড়ি দিয়ে কেনি আংগুলে বেধে রাখবে।
আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা হতাশ দৃষ্টি দিয়ে ইশারায় বলার চেষ্টা করলেন খবরদার ঐ দিকে যাবি না। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলো–হতাশ দৃষ্টিটা আমি কি বুঝেছি! সে কারণেই হয়তো আজহার চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলে কি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেসে শুনেছি কঠিন ধর্ম পালন করে।
আজহার চাচা আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, মৃন্ময়ী মা তো বাইরের কেউ না। তার সঙ্গে কথা বলতে দোষ নাই।
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, একটা ছেলে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলবে তার জন্যে যদি দোষ-গুণ বিচার করতে হয় তাহলে কথা না বলাই উচিত। মৃন্ময়ী তোর যাবার দরকার নেই তোকে দেখে বেচারা হয়তো অস্বস্তিতে পড়বে। কী দরকার? তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই খুব টায়ার্ড। তুই একটা হট শাওয়ার নে— নাশতা খেয়ে রেস্ট নে। তোর পরিশ্রম বেশি হচ্ছে। তোর রেস্ট দরকার।
আমি তাদের সামনে থেকে চলে এলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। বড় কোনো ঝামেলা। বাবা মুখ শুকনা করে বসে আছেন। তিনি খুবই টেনশানে আছেন। আজহার চাচা তার ছেলে শুভকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। এটাই কি টেনশনের কারণ? তিনি কিছুতেই চাচ্ছেন না আমি আজহার চাচার ছেলের সামনে যাই।