আজহার চাচা বাবার দিকে তাকিয়ে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, নবীজীর কবর মোবারক ছোয়ায়ে এনেছি। তিন সেট আনলাম আমার জন্য একসেট, আমার শ্বশুর সাহেবের জন্যে একসেট আর তোমার জন্যে একসেট।
বাবা বললেন, ভালো করেছ। অতি উত্তম করেছ।
আজহার চাচা বললেন, ধর্মকর্মের দিকে তোমার টান তো সামান্য কম, এইজন্যে ইচ্ছা করেই কাফনের কাপড়টা আনলাম। চোখের সামনে এই জিনিস থাকলে কালের চিন্তা মাথায় আসে। তাছাড়া চলে যাবার সময় তো আমাদের হয়েই গেছে। তোমার কত চলছে ফিফটি টু না থ্রি?
টু।
তাহলে তো খবর হয়ে গেছে। সিগনাল ডাউন। আজরাইলকে নিয়ে ট্রেন রওনা দিয়েছে। মেল ট্রেন, পথে থামবে না।
বাবা শুকনা গলায় বললেন, ঠিক বলেছ।
আজহার চাচা বললেন, কাপড়টা পছন্দ হয় কি-না দেখ। সাধারণ মার্কিন লং ক্লথ না। হাইকোয়ালিটি পপলিন। সৌদি রাজপরিবারের সবার এই কাপড়ের কাফন হয়। খোঁজ-খবর নিয়ে কিনেছি।
মনে হয় অনেক ঝামেলা করেছ।
পছন্দ হয়েছে কি-না বল। এইসব গিফট সবাই আবার সহজে নিতে পারে না। আমার শ্বশুর সাহেব তো খুবই রাগ করলেন। আমাকে কিছু বলেন নি। আমার শাশুড়ি আম্মার সঙ্গে গজগজ করেছেন। তুমি আবার রাগ করো নি তো?
বাবা গা দুলিয়ে নকল হাসি হাসতে হাসতে বললেন, রাগ করার কী আছে? তার মুখের হাসি আরো ঝুলে গেল। আজহার চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা মৃন্ময়ী, তোমার জন্যেও সামান্য উপহার আছে। মক্কার মিষ্টি তেতুল আর একটা তসবি।
আমি বললাম, থ্যাংক ইউ চাচা।
তসবির গুটিগুলা প্লাস্টিকের না, আকিক পাথরের। তুমি জান কি-না জানি না, আকিক পাথর হলো আমাদের নবীজীর খুব পছন্দের পাথর। পবিত্র কোরান মজিদেও আকিক পাথরের উল্লেখ আছে। তেতুল একটু খেয়ে দেখে তো মা। চিনির মতো মিষ্টি। এক বোতল জমজমের পানিও এনেছি। ভালো জায়গায় তুলে রাখে। অসুখ-বিসুখ হলে চায়ের চামচে এক চামচ খাবে। তবে খেতে হবে। খুবই আদবের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবে না। বসে খাবে, এবং বিসমিল্লাহ্ বলে খাবে। ভালো কথা নাপাঁক অবস্থায় খাবে না।
আমি বললাম, আপনি কি চা খাবেন চাচা? আপনার তো মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। আদা দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে আসি।
নিয়ে আয় এক কাপ চা। সন্ধ্যার পর চা খেলে আমার অবশ্য ঘুমের সমস্যা হয়। ঠিক আছে তুই যখন বলছিস তুই তো জানিস না মা, তোকে অত্যন্ত পছন্দ করি। নবীজীর রওজা মোরকে যে কয়জনের জন্যে দোয়া করেছি তুই আছিস তাদের মধ্যে। চা নিয়ে আয়, খেয়ে বিদায় হই।
আজহার চাচা একটু আগে আমাকে তুমি তুমি করে বলছিলেন। এখন দুই তুই করছেন। এর মানে হলে তিনি এখন আমার প্রতি খুবই মমতা পপাষণ করছেন। বাবাকেও মাঝে মাঝে তিনি তুই বলার চেষ্টা করেন। বাবা পাত্তা দেন না।
আমি বললাম, রাতে খেয়ে যান না চাচা। আপনার প্রিয় তরকারি রান্না হয়েছে।
আজহার চাচা অবাক হয়ে বললেন, আমার যে প্রিয় তরকারি আছে তাইতো জানি না। আমার প্রিয় তরকারি কী?
ছোট মাছ দিয়ে সজনী।
তুই মনে করে বসে আছিস? আশ্চর্য কাণ্ড! কবে তোক বলেছিলাম, আমার নিজেরই তো মনে নাই। মাইন দেখেছ তোমার এই মেয়ে তো বড়ই আশ্চর্য! আচ্ছা ঠিক আছে, রাতের খানা খেয়েই যাই।
বাবা বিরক্ত মুখে তাকাচ্ছেন। আজহার চাচার রাতে ভাত খাবার জন্যে থেকে যাবার ব্যাপারটা তিনি পছন্দ করছেন না। বুদ্ধিমান মানুষ অল্প বুদ্ধির মানুষদের সঙ্গ পছন্দ করে না। অল্প বুদ্ধির মানুষদেরকে দিয়ে অনেক কাজ আদায় করা যায় বলেই তাদের সহ্য করা হয়। ব্যবসা বাণিজ্য বাড়াবার জন্যে। এক সময় আজহার চাচার বুদ্ধি পরামর্শ এবং অর্থের বাবার প্রয়োজন ছিল। এখন প্রয়োজন নেই। আজহার চাচা ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। তাঁর হয়তো ধারণা হয়েছে বাবা তার হজের গল্প খুবই আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। বাবার চোখে মুখে মোটা দাগের বিরক্তি কিছুই আজহার চাচার চোখে পড়ছে না। তিনি বাবার দিকে ঝুঁকে এসে হজের গল্প শুরু করলেন
কাবা তোয়াফের সময় কী ঘটনা ঘটেছে শোনো। আমার পাশাপাশি হাঁটছে এক আফ্রিকান মহিলা। চার পাঁচ মণ ওজন। হাতির মতো থপথপ শব্দ করে হাঁটে। পায়ের ওপর পাড়া দেয়। কনুই দিয়ে তা দেয়, পিঠে ধাক্কা দেয়। আল্লাহর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তো আমি মেয়েছেলের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারি না। এমন বিপদে পড়লাম! দোয়া টোয়া সব ভুলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে দেখি এই মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকা করে বলল, ছেরেং ছেরেং। একটু পর পর বলে, বলে আর মুখ বাঁকা করে হাসে। ছেরেং মানে কী জানি না নিশ্চয়ই কোনো গালাগালি। মই তুমি কি ছেরেং শব্দের মানে জানো?
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, ইদ্দিস ভাষায় ছেরেং মানে হলো সরু, যেমন ধর ছেরেং গা। গা হলো নদী। ছেরেং গা হলো সরু নদী। তোমার রোগা পাতলা চেহারা দেখে রসিকতা করছিল।
চিন্তা করো অবস্থা— কাবা ঘরে এসে ঠাট্টা মশকরা শুরু করেছে। কাবা শরীফের কাছে এসে মানুষ আল্লাহ্ ভয়ে ভীত হয়— আমি এক মেয়েছেলের ভয়ে ভীত হয়ে গেলাম।
বাবা বললেন, ভীত হওয়ার কী আছে?
আজহার চাচা বললেন, তুমি কিছু জানো না বলে এমন কথা বলতে পারলে। এই মহিলা যদি একবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত, তাহলে আর আমাকে উঠতে হতো না। হাজার হাজার হাজি আমার গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যেত ইনস্টেন্ট ডেথ। বহু মানুষ এইভাবে মারা গেছে। যাই হোক, ঐ মহিলাকে কীভাবে শায়েস্তা করেছি শোনো। ভুল বললাম শায়েস্তা আমি করি নাই। আমাকে কিছু করতে হয় নাই। ব্যবস্থা আল্লাহপাকই নিয়েছেন। আমি