আমি কথা বাড়ালাম না। চুপ করে রইলাম। উনার যদি নেমে যেতে ইচ্ছা করে উনি নেমে যাবেন। এই কথা বারবার শোনানোর কিছু নেই। তবে একটি তরুণী মেয়ের সঙ্গে তার বাসায় যাবার জন্যে গাড়িতে ওঠা এবং মাঝপথে হঠাৎ নেমে যাওয়া তরুণী মেয়েটির জন্যে অপমানসূচক। মেয়েটি অপমানিত বোধ করবেই। আমি করব না। কারণ যে-কোনো ঘটনা আমি যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। যে সবকিছু যুক্তি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে সে সহজে অপমানিত বোধ। করে না, রাগ করে না। যুক্তিবিদ্যা মানুষকে যন্ত্রের কাছাকাছি নিতে সাহায্য করে। মানুষ বদলাচ্ছে। নতুন শতকের মানুষ যন্ত্রের কাছাকাছি যাবে এটাই স্বাভাবিক।
মৃন্ময়ী।
জ্বি।
আমি যখন বললাম, তুমি কোন দিকে যাচ্ছ–তখন তুমি উত্তর দিলে–দিক জানি না। উত্তরটা কি ঠিক হয়েছে?
হ্যাঁ ঠিক হয়েছে কারণ আমি দিক জানি না।
স্থাপত্য বিদ্যার কোনো ছাত্রী বলবে কি জানি না এটা হতেই পারে না। সূর্য কোন দিকে উঠছে, কোন দিকে অস্ত যাচ্ছে এটা তাকে সব সময় জানতে হবে। শীতের সময় সূর্য যে জায়গা থেকে উঠে গরমের সময় ঠিক সে জায়গা থেকে উঠে না। সামান্য সরে যায়। বলতে পারবে কতটুক সরে যায়?
স্যার, আমরা তো এখন ক্লাসে বসে নেই। ক্লাসের বাইরে আছি। গাড়ির ভেতর বসেও যদি ভাইভা পরীক্ষা দেই তাহলে কীভাবে হবে?
স্যার হেসে ফেললেন। আমি বললাম আপনি সব সময় ক্লাসে বলেন, আমি তোমাদের শিক্ষক না। আমি নিজেও একজন ছাত্র। কিন্তু আপনি কখনো ভুলতে পারেন না যে আপনি একজন শিক্ষক। আমি লক্ষ করেছি ক্লাসের বাইরেও আপনি সারাক্ষণই কোনো না কোনো প্রশ্ন করছেন।
আর করব না।
এখন ঠিক করে বলুনতো আপনি কি সত্যি আমার সঙ্গে চা খেতে যাচ্ছেন, না পথে নেমে যাবেন?
বুঝতে পারছি না।
আচ্ছা মনে করুন আমাদের ক্লাসেরই অন্য কোনো একটা ছেলে কিংবা মেয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে তখনন কি তাকে এসে বলতেন পথে আমাকে। নামিয়ে দিতে পারবে? আমার মোটর সাইকেলের চাকা পাংচার হয়েছে?
না।
না কেন?
গাড়িতে যাওয়া আমার জন্যে জরুরি কিছু না। কার সঙ্গে যাচ্ছি সেটা জরুরি। তোমাকে তো আমি প্রথম দিনই বলেছি তোমাকে আমার পছন্দ। তোমার মতো মেয়েরা আমান্তে হিসেবে খুব ভালো হয়।
আমান্তে কী?
আমান্তে শব্দটা স্প্যানিশ। এর অর্থ হলো সেন্টিমেন্টাল ফ্রেন্ড। তুমি না চাইলেও তোমাকে আমি দেখছি একজন আমান্তে হিসেবে।
আমান্তেকে নিয়ে কি আপনি সাইকোলজির খেলা খেলেন?
মাঝে মাঝে খেলি। তবে সাইকোলজির খেলা না। ম্যাজিকের খেলা।
তার মানে?
প্রথম দিন যা করেছি সেটা হলো খুব সহজ একটা ম্যাজিক দেখিয়েছি। আমি চারটা কাগজে চার রকম লেখা লিখেছি। একটাতে লিখেছি— মৃন্ময়ী মোটর সাইকেলে চড়তে রাজি হবে না। সেই কাগজটা রেখেছি এক জায়গায়। আরেকটাতে লিখেছি—মোটর সাইকেলে চড়তে সে খুশি মনে রাজি হবে। সেটা রেখেছি অন্য জায়গায়। তুমি যাই করতে আমি সেই কাগজটা বের করে তোমাকে দেখিয়ে বলতাম তুমি কী করবে তা আমি আগে থেকেই জানি।
এতে আপনার লাভ কী হয়েছে?
তোমাকে চমকে দিতে পেরেছি—এটাই লাভ।
আপনি কি সবাইকে চমক দিয়ে বেড়ান?
না। সবাইকে চমকাতে ইচ্ছা করে না। কাউকে কাউকে করে। আমান্তেকে করে।
আপনি যে ভঙ্গিতে আমাকে বলেছেন তার থেকে আমার মনে হয়েছে–এ ধরনের কথা আপনি অবলীলায় বলতে পারেন এবং আমার আগে আরো অনেককে আমান্তে বলেছেন। বলেন নি।
হ্যাঁ বলেছি। তুমি বলো নি? মুখে বলার কথা বলছি না। বাঙালি মেয়ে এ ধরনের কথা অবলীলায় বলতে পারে না। আমি মনে মনে বলার কথা বলছি।
না আমি মুখে বা মনে মনে কখনো বলি নি।
বলতে ইচ্ছা করে নি।
না আমার ইচ্ছাও করে নি।
তুমি এমন কঠিন গলায় কথা বলছ কেন? তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে খুবই অপ্ৰিয় কোনো প্রসঙ্গে তুমি কথা বলছ।
প্রসঙ্গটা আমার অপ্রিয়। কোনো একটা ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হবে। আমান্তে টাইপ পরিচয়। রাত বারটার পর নিচু গলায় তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলব। ছুটি ছাটার দিন ফুচকা খেতে যাব এবং কিছুক্ষণ পর পর চমকে চমকে রাস্তার দিকে তাকার কেউ দেখে ফেলল কি-না–এটা আমার খুবই অপছন্দ। স্পেনে কী হয় আমি জানি না। ঐ দেশে কখনো যাই নি তবে আমাদের দেশে প্রেমের ব্যাপারে কিছু সেট রুলস আছে। জানতে চান?
হ্যাঁ জানতে চাই।
প্রেমে পড়লে ছেলে-মেয়ের ফুচকা খেতে হবে।
কারণটা কী?
ফুচকা বিক্রি হয় পার্কে। এবং মেয়েরা খেতে পছন্দ করে। দামে সস্তা বলে ছেলেদের জন্যে খুব সুবিধা হয়।
স্যার হাসতে হাসতে বললেন তোমার কথা শুনে মজা পাচ্ছি। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আমার ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে। কোনো একটা পার্কে আমাকে নিয়ে চলে তো। ফুচকা খাব। আজ আর তোমাদের বাসায় যাব না। ফুচকা খেয়ে বিদায়।
আপনি সত্যি ফুচকা খাবেন?
হ্যাঁ খাব। প্রেমে পড়ার যে সব সেট রুলস এ দেশে আছে তার প্রতিটি আমি মানতে চাই। টেলিফোন কখন করতে হয় বললে রাত বারটার পর?
স্যার ঠাট্টা করবেন না।
আমি ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস। আমরা কি ফুচকার দোকানের দিকে যাচ্ছি।
হ্যাঁ যাচ্ছি।
ফুচকা খেতে খেতে তোমাকে একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলব।
এখনই বলুন।
সব কথা সব জায়গায় বলা যায় না। জনসভায় যে কথা বলা যায়, শোবার। ঘরে সে কথা বলা যায় না। চলন্ত গাড়িতে যে কথা বলা যায় সে কথা বটগাছের নিচে বসে বলা যায় না। কথা হলো পেইন্টিং-এর মতো। জয়নাল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি তুমি তোমার ডাইনিং রুমে টানাতে পারে না। আমি বোধহয় আবার টিচার হয়ে যাচ্ছি।