বাবা কি চা বাগান কিনেছে না-কি?
উদাহরণ দিচ্ছিরে মা। উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর জন্যে চা বাগানের কথাটা বললাম। তোদর ইউনিভার্সিটির টিচাররা জটিল বিষয় উদাহরণ দিয়ে সহজ করে না? আমিও করেছি।
মা হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে বললেন উদাহরণ দিয়ে বুঝানো নিয়ে খুবই অশ্লীল একটা জোক আছে। অশ্লীল হলেও দারুণ হাসির। তার বিয়ে হোক তারপর বলব।
বিয়ে হোক আর না হেকি তোমার মুখ থেকে অশ্লীল রসিকতা শোনার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।
মা আবার শুয়ে পড়লেন। আমি মায়ের গায়ে হাত রেখে বললাম, ঘাই হরিণী কী তুমি জানো?
মা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জানি। কিন্তু তোকে বলা যাবে না। ঘাই হরিণী ব্যাপারটাও অশ্লীল। মা হয়ে আমি মেয়ের সঙ্গে অশ্লীল কথা বলব? ভাবিস কি তুই আমাকে? আমি কি জীবনানন্দ দাশ।
মা হঠাৎ বালিশে মুখ গুঁজে হাসতে শুরু করলেন। আমি বললাম, হাসছ কেন?
হাসি আসছে এই জন্যে হাসছি।
কেন হাসি আসছে জানতে পারি?
তুই নাকি একজনের প্রেমে পড়েছিস এই ভেবে হাসি আসছে।
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, আমি কারো প্রেমে পড়ি নি। আর যদি পড়েও থাকি এখানে হাসির কী হলো?
কোনো ছেলের প্রেমে পড়িস নি? আমাকে যে বলল তোদের একজন টিচারের সঙ্গে তোর প্রেম হয়েছে। সবাই তাকে গরু স্যার ডাকে। হি হি হি।
হাসি থামাও তো মা। এইসব কে বলেছে?
ঐ দিন ফরিদাদের বাসায় গিয়েছিলাম। সে বলল।
আমি চুপ করে গেলাম। মার অনেক বিচিত্র স্বভাবের একটা হলো আমার সব বান্ধবীর সঙ্গে তার খুব ভালো যোগাযোগ। তিনি নিয়মিত তাদের বাসায় যাবেন। সমবয়সীদের মতো হৈচৈ করবেন এবং ব্যাপারটা আমার কাছ থেকে গোপন রাখবেন।
মা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, মৃন্ময়ী তুই তোর গৰু স্যারকে একদিন বাসায় নিয়ে আসিস তো। আমি লন থেকে কাঁচা ঘাস কেটে রাখব। হি হি হি।
মা পাগলের মতো হাসছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে মা মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ না।
মৃন্ময়ী!
বলো।
আমার মনে হচ্ছে তার বিয়ে হবে আজহার সাহেবের ছেলের সঙ্গে। আমার সিক্সথ সেন্স তাই বলছে। বিয়েটা যেহেতু ঠিক হয়েই আছে কাজেই গরু স্যারের সঙ্গে প্রেমটা না হলেই ভালো হয়। টিচার মানুষ হাফসোল খাবে। কাজটা ঠিক হবে না।
মা, চুপ করো তো!
এই রসিকতা মা প্রায়ই করে। আজহার চাচার ছেলেটাকে নিয়ে রসিকতা। ছেলেটা জড়ভরতের মতো। মানসিকভাবে হয়তোবা সামান্য অসুস্থ। কোথাও বসে আছে তো বসেই আছে। কোনো দিকে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে।
ছোটবেলায় আমাদের বাসায় আসত। ঘরের কোনো অন্ধকার কোণ খুঁজে বসে থাকত। কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দিত না। শুধু যদি মা বলতেন, এই শোন মৃন্ময়ীকে বিয়ে করবি?
সে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে নরম গলায় বলত, করব।
মা হেসে ভেঙে পড়তেন। রাগে আমার গা জ্বলে যেত। এখনো রাগ লাগছে। মানুষের অসুস্থতা নিয়ে রসিকতা করার কোনো মানে হয় না।
মা বললেন, তোর আজহার চাচার এই ছেলে তো খারাপ না। স্বামী হিসেবে আদর্শ হবে। যেখানে বসিয়ে রাখবি বসে থাকবে। তোর দিকে প্রেমপূর্ণ নয়নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। খেতে দিলে খাবে। খেতে না দিলে খাবে না। হি হি হি।
আমি কঠিন গলায় বললাম, মা প্লিজ হাসবে না।
মা বললেন, আজহার সাহেবকে তোর বাবা চিনতে পারে নি। আজহার সাহেব কচ্ছপ রাশি। কচ্ছপ রাশির মানুষ একবার কোনো কিছু কামড়ে ধরলে ধরেই থাকবে। দেখিস সে ঠিকই তোর বাবার কাছে কবরের জায়গা বিক্রি করবে। তোর সঙ্গেও তার ছেলের বিয়ে দিয়ে দিবে।
আমার সঙ্গে কি তিনি তার ছেলের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?
অবশ্যই চাচ্ছে।
মা আবারও হাসি শুরু করলেন। তিনি কেন হাসছেন কে জানে?
বিব্রতকর পরিস্থিতি
আমি যে পরিস্থিতিতে পড়েছি–সংবাদপত্রের ভাষায় তাকে বলা হয় বিব্রতকর পরিস্থিতি। যতটুক বিব্রত বোধ করা উচিত তারচেয়ে বেশি বোধ করছি। চেষ্টা করছি আমাকে দেখে যেন আমার মানসিক অবস্থাটা বোঝা না যায়। এই অভিনয়টা আমি ভালো পারি। তবে সবদিন পারি না। আজ পারছি কিনা বুঝতে পারছি না।
ঘটনাটা এ রকম – ক্লাস শেষ হয়েছে। আমি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি। পেছন থেকে কাওসার স্যার ডাকলেন হ্যালে মিস।
আমি পেছন ফিরলাম। স্যার বললেন, তুমি কোন দিকে যাচ্ছ?
আমি বললাম, দিক বলতে পারব না। বাসা যে দিকে সে দিকে যাচ্ছি।
পথে আমাকে নামিয়ে দিতে পারবে? আমার মোটর সাইকেলের চাকা পাংচার হয়েছে। একটা এক্সট্রা চাকা আছে। চাকা কীভাবে বদলাতে হয় আমি জানি না।
আমি বললাম, আসুন। আপনি কোথায় যাবেন বলুন আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি।
আমি কোথাও যাব না। তোমার সঙ্গে গাড়িতে উঠব। হঠাৎ কোথাও নেমে যেতে ইচ্ছা করলে নেমে যাব। আর যদি নেমে যেতে ইচ্ছা না করে তোমার সঙ্গে তোমাদের বাসায় যাব। এক কাপ চা খেয়ে আসব।
স্যারের সঙ্গে কথাবার্তার এই পর্যায়ে হঠাৎ আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। নিঃশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকল। যদিও তার কোনোই কারণ নেই। কোনো অপরিচিত ভদ্ৰলোক আমার কাছে লিফট চাইছে না। যিনি লিফট চাইছেন তিনি আমার খুবই পরিচিত। তিনি হয়তো আজ আবার নতুন ধরনের কোনো খেলা খেলার চিন্তা করছেন। আবারো হয়তো সাইকোলজির কোনো পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার এক পর্যায়ে আমি রেগে যাব এবং আমার নিজেকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হবে।
তোমার সঙ্গে যে তোমার বাসা পর্যন্ত যাবই তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। পথে নেমে যেতে ইচ্ছা করলে নেমে যাব।