কিছু কিছু মানুষের মনে হয় মনের বয়স বাড়ে না। কিশোরী অবস্থায় মার মন যেমন ছিল— এখননা সে রকমই আছে। শরীর বুড়িয়ে যাচ্ছে। চামড়ায় ভাজ পড়ছে, চোখের নিচ ঝুলে পড়ছে। মাথার চুল পাকতে শুরু করছে। মা নানান রকম ক্রিম ঘষাঘষি শুরু করেছেন। ভিটামিন E ক্রিম। জয়পুরের মাটি দিয়ে মাড ট্ৰিটমেন্ট। চন্দন বাটার প্রলেপ জিনিসগুলো যে একেবারেই কাজ করছে। না তা না। মাঝে মাঝে মার বয়স খুবই কম মনে হয়। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী, কিংবা ইউনিভার্সিটিতে সদ্য ভর্তি হয়েছে এ রকম মনে হয়। তবে ব্যাপারটা খুবই অল্প সময়ের জন্যে ঘটে। আমার ধারণা এটা প্ৰকৃতির একটা খেলা। প্রকৃতি মাঝে মাঝে বয়স্ক মানুষের চেহারা থেকে বয়সের সব চিহ্ন সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে তারুণ্য দিয়ে এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে। বিভ্রম তৈরির খেলা প্রকৃতির খুবই প্রিয় খেলা।
মার এর মধ্যে চলে আসার কথা। তিনি আসছেন না। হয়তো মত বদলেছেন। টেলিফোন রিসিভার হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি হাতের রং মুছে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার শেষ মাথায় বেতের চেয়ারে পা তুলে বাবা বসে আছেন। তাঁকে আসবাবপত্রের মতো মনে হচ্ছে। কাওসার স্যার ক্লাসে বলেছেন চোখ খোলা রাখবে। যা দেখবে চোখ খোলা রেখে দেখবে। তাহলে বুঝবে ফার্নিচারকে মাঝে মাঝে জীবন্ত মনে হবে। আবার কিছু কিছু মানুষকে ফার্নিচার মনে হবে।
স্যারের অনেক কথাই ঠিক না। তবে একটা কথা একশ ভাগ ঠিক।
মানুষ নিজেকে Conditioned করে নিতে পছন্দ করে। বারান্দার শেষ মাথায় তিনটা বেতের চেয়ার আছে। বাবা বসে আছেন মাঝেরটায়। এই চেয়ার ছাড়া তাঁকে কখনো অন্য চেয়ারে আমি বসতে দেখি নি। আমি এগিয়ে গেলাম। বাবা আমাকে দেখে নড়েচড়ে বসলেন। তিনি মনে হলে আমাকে আসতে দেখে খুশি হয়েছেন। অদ্রিার রোগী যখন রাত জাগে তখন যে-কোনো জাগ্রত মানুষকে দেখে খুশি হয়
আমি হালকা গলায় বললাম, বাবা, তোমার খবর কী?
কোনো খবর নেই।
ঘুম আসছে না।
না।
কেন ঘুম আসছে না?
জানি না কেন আসছে না।
ঘুমের অষুধ খেয়েছ?
পাঁচ মিলিগ্রাম ডরমিকাম খেয়েছি। কিছুক্ষণের জন্যে ঝিমঝিম ভাব এসেছিল– কেটে গেছে।
কোনো বিশেষ কিছু নিয়ে তুমি কি টেনশন করছ?
না।
ব্যবসা ভালো চলছে?
ভালো চলছে না, তবে টেনশান করার মতো কিছু না।
বসব তোমার পাশে?
বোস।
তাহলে একটা কাজ করো বাবা তুমি মাঝখানের চেয়ারটা ছেড়ে অন্য যে-কোনো চেয়ারে বস। মাঝখানের চেয়ারটা আমাকে ছেড়ে দাও।
বাবা কোনো প্রশ্ন করলেন না। মাঝের চেয়ারটা ছেড়ে দিলেন। আমি বসতে বসতে বললাম, আজহার চাচার আনা কাফনের কাপড়টা কি তোমার মধ্যে কোনো সমস্যা তৈরি করেছে?
না।
আমার নিজের কিন্তু ধারণা করেছে। তোমার ঘুম না হওয়া রোগ শুরু হয়েছে এর পরই। এক কাজ করো কোনো ভিখিরিকে কাপড়টা দিয়ে দাও। কাফনের কাপড় এটা বলে দিতে হবে না বলো যে পায়জামা পাঞ্জাবি বানানোর জন্যে কাপড়। আজহার চাচার আনা এই বিশেষ বস্তুটা তুমি কেন। সিরিয়াসলি নিচ্ছ?
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, আজহার একটা গাধা। আমি কোন দুঃখে তার কথা সিরিয়াসলি নেব। গাধাটা গতকাল দুপুরে আমার অফিসে এসেছিল। কী বলতে এসেছিল জানিস? সে বনানী গোরস্তানে তার এবং তার স্ত্রীর কবরের জন্যে জায়গা কিনেছে। দুই লাখ টাকা লেগেছে। মহাআনন্দে এই খবর দিতে এসেছে। যেন রাজ্য জয় করেছে।
আমি বললাম, তাঁর কাছে এই খবরটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই তিনি এসেছেন। সবাই পৃথিবীটাকে দেখবে তার নিজের মতো করে। সেই দেখা ভুলও হতে পারে আবার শুদ্ধও হতে পারে। তোমার বন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে তোমার রাগ করা সাজে না। উনি গোরস্তানে জায়গা কিনছেন তাতে তুমি কেন রাগবে?
বাবা থমথমে গলায় বললেন, আমি রাগব কারণ গাধাটা আমার জন্যেও জায়গা কিনতে চায়। আমার কাছে এসেছিল এই জন্যে। জায়গার না-কি খুব টানাটানি। এখন না কিনলে পরে আর পাওয়া যাবে না। আজিমপুর গোরস্তানে যে অবস্থা হয়েছে। এখন আর জায়গা বিক্রি হচ্ছে না। ব্যাক ডোর দিয়ে জায়গা কেনাও বন্ধ। কিনলে এখনি কিনতে হবে।
তুমি কী বললে?
আমি বলেছি–কবরের জন্যে জায়গা কেনা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার কবর কোথায় হবে সেটাও ঠিক করা হয় নি। দেশের বাড়িতে হতে পারে। আমি খুব কঠিন গলায় আজহারকে বলেছি আমার কবরের জায়গা নিয়ে সে যেন মাথা না ঘামায়।
উনি মাথা ঘামালে ঘামাক। তুমি মাথা ঘামিও না। তুমি তোমার মতো থাকে।
তাই তো আছি।
না তা নেই। তুমি খুবই আপসেট হয়ে পড়েছ। এখন দয়া করে ডাউনসেট হও।
ডাউনসেটটা কী?
ডাউনসেট হলো আপসেটের উল্টোটা। বারান্দায় বসে না থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে শুয়ে পড়।
আমি বাবার ডান হাতটা ধরে নিজের কোলে রাখলাম। তিনি মনে হলে একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। আমার কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার পেয়ে তিনি অভ্যস্ত না। আমি আবারো বললাম, বাবা যাও ঘুমুতে যাও।
বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন, বসি আরো কিছুক্ষণ। ঘুমের প্রথম স্পেলটা কেটে গেলে সমস্যা আছে। এখন বিছানায় গেলে কাজের কাজ কিছু হবে না। তুই শুয়ে পড়।
আমার ঘুমুতে দেরি আছে। প্রজেক্ট শেষ করতে হবে। কাল জমা দেবার শেষ দিন।
রাত তিনটায় ঘুমুতে গিয়ে সকাল নটায় ক্লাস ধরতে অসুবিধা হয় না?
না হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। কফি খাবে বাবা? মধ্যরাতের কফির অন্য এক মজা আছে।