বেশির ভাগ মানুষের জন্যেই গভীর রাত— আমার জন্যে রজনীর শুরু। ডিজাইনের মূল কাজগুলো আমি এই সময় শুরু করি। আগামীকাল ডুপলেক্স বিল্ডিং-এর ফটোগ্রাফ দিয়ে করা একটা কোলাজ জমা দিতে হবে। বিল্ডিং-এর। ফটোগ্রাফ সাজানো হয়েছে। এদের মাঝখানে ফাক ভরার জন্যে রং দিতে হবে। রং তৈরির কাজটা রাত যত গভীর হয় তত ভালো হয়। দিন হলো কাজের সময়, প্রয়োজনের কাজ যেমন–ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালত। রাত হলে অপ্রয়োজনের কাজের সময়। কবিতা লেখা হবে, ছবি আঁকা হবে। ঔপন্যাসিক চোখ বন্ধ করে তাঁর চরিত্রদের নিয়ে খেলা করবেন। সাধু সন্তরা বসবেন ধ্যানে।
জীবনানন্দ দাশ নিশ্চয়ই চৈত্র মাসের দুপুরে গরমে ঘামতে ঘামতে লিখেন
নি
এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি
সারারাত দখিনা বাতাসে।
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাই হরিণীর ডাক শুনি,
কাহারে সে ডাকে।
আমার ধারণা এই লাইনগুলো তিনি লিখেছেন মধ্যরাত পার করে। তখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। বরিশালে তাঁর বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ের বাঁশ পাতা বাতাসে কাঁপছে। এবং তিনি কল্পনায় বনের ভেতর ঘাই হরিণীর ডাক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন।
আচ্ছা, ঘাই হরিণী ব্যাপারটা কী? চিত্রা হরিণ, শাম্বা হরিণ আছে। ঘাই হরিণ কোথেকে এসেছে। ঘাই কি নাম, নাকি বিশেষণ?
কাওসার স্যার ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ড বড় বড় করে তাঁর টেলিফোন নাম্বার লিখে বলেছিলেন, ডিজাইন সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় তোমরা যদি পড় তাহলে এই নাম্বারে যে-কোনো সময় আমাকে টেলিফোন করতে পারো। রাত দুটা, তিনটা, চারটা কোনো সমস্যা নেই।
আমি এখন ডিজাইন সংক্রান্ত জটিলতাতেই পড়েছি। মাথার ভেতর থেকে ঘাই শব্দ দূর না করা পর্যন্ত কাজে মন দিতে পারছি না। কাজেই স্যারকে টেলিফোন করার অধিকার আমার আছে। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। অধিকার কাজে লাগানো ঠিক হবে না। সব অধিকার কাজে লাগাতে নেই। তারচে মন অন্যদিকে নেবার ব্যবস্থা করা যাক।
আমি হাতে রিমোট কনট্রোল নিয়ে সিডি প্লেয়ার চালু করলাম। ঝড় বৃষ্টির একটা সিডি চালু হয়ে গেল। এই সিডিটা জন্মদিনে ফরিদা আমাকে দিয়েছে। গান বাজনা কিছু নেই শুধুই সাউন্ড এফেক্ট। বাতাসের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, মাঝে মাঝে বজ্ৰপাতও হচ্ছে। স্টুডিওতে তৈরি শব্দ না। মন্টানার এক বনের ভেতরে রেকর্ড করা ঝড়ের শব্দ। সিডির গায়ে সেরকমই লেখা। শুনতে ভালো লাগে।
টেলিফোন বাজছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। একটা চল্লিশ। এত রাতে টেলিফোন করার মতো আমার কেউ নেই। ট্র্যাংক কল হবার সম্ভাবনা। রিসিভার তুলতেই মার আবদারি গলা শুনা গেল— মৃ আজ আমি তোর সঙ্গে ঘুমাব।
আমি বললাম, আচ্ছা।
টেলিফোনের রিং পেয়ে কী ভেবেছিলি?
কিছু ভাবি নি মা।
পাশের কামরা থেকে আমি টেলিফোন করেছি এটা নিশ্চয়ই ভাবিস নি।
না তা ভাবি নি। আমার ঘরে ঘুমুলে চাইলে চলে এসো। তবে আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না। তুমি ঘুমাবে তোমার মতে, আমি বাতি জ্বালিয়ে কাজ করব।
মৃ তোর ঘর থেকে ঝড়ের শব্দ আসছে কেন?
ঝড়ের সিডি বাজছে এই জন্যে ঝড়ের শব্দ।
ঝড়ের সিডি আবার কী?
এসে শুনে যাও কী। এক্সপ্লেইন করতে পারব না।
তুই এত বিরক্ত হচ্ছিস কেন? সবাই দেখি আমার কথা শুনলে বিরক্ত হয়। আমার বাবা-মার ফ্যামিলির সবাই হয়। তোর বাবা হয়। তুই হোস। ব্যাপার কী?
টেলিফোনে এত কথা শুনতে ভালো লাগছে না মা। তুমি আসতে চাইলে চলে এসো।
আমার তো টেলিফোনে কথাবার্তা চালাতে খুবই ভালো লাগছে। খুব যারা ঘনিষ্ঠ তাদের মাঝে মাঝে উচিত টেলিফোনে কথা বলা। টেলিফোনে গলার শব্দ বদলে যায় তো– পরিচিত জনকে তখন মনে হয় অপরিচিত। খুব পরিচিত জনের সঙ্গে যত কথা বলা যায় মোটামুটি পরিচিত জনের সঙ্গে তারচে বেশি কথা বলা যায়। হ্যালো তুই কি টেলিফোন রেখে দিয়েছিল?
না।
মা গলার আওয়াজ নামিয়ে ফিসফিস পর্যায়ে নিয়ে এসে বললেন, তোকে টেলিফোন করার সময় মজার একটা কাণ্ড হয়েছে। তোর বাবা হঠাৎ ঘরে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ ভুরু টুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেছে।
এতে মজার কী হলো?
ওমা মজার না! তোর বাবা ভাবছে— গভীর রাতে হাসিহাসি মুখে কার সঙ্গে কথা? রহস্যটা কী? তোর বাবার মনে একটা কিন্তু তৈরি হয়েছে।
বাবার মনে এত সহজে কিন্তু তৈরি হয় না। বাবা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে কেন?
কয়েক রাত ধরেই তো এই অবস্থা। ঘুমাচ্ছে না, জেগে থাকছে। একটু পরপর বিছানা থেকে উঠে পানি খায়। কিছুক্ষণ বই পড়ার চেষ্টা করে, কিছুক্ষণ লেখার টেবিলে বসে হিসাব নিকাশ করে। বাকি সময়টা বারান্দায় হাঁটাহাটি করে।
কী ব্যাপার, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করো নি?
না। আমি কোনো প্রশ্ন করলেই তো তোর বাবা রেগে যায়। কী দরকার তাকে রাগিয়ে! মৃ তোর সিডি বন্ধ হয়ে গেছে, আবার দে। টেলিফোনে শুনছি তো আওয়াজটা রিয়েল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই ঝড় হচ্ছে। একটু আগে যে মট করে শব্দ হলে সেটা কি গাছ ভাঙার শব্দ? টেলিফোনে না শুনে সিডি প্লেয়ারের সামনে বসে যখন শুনব তখন আর রিয়েল মনে হবে না। এটা নিয়ে তোর সঙ্গে বাজি ধরতে পারি।
মা শোনো, টেলিফোন কানের কাছে ধরে ধরে কান ব্যথা করছে। তুমি আসতে চাইলে আস– একটাই শর্ত আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। আজ রাতের কাজের এখানেই ইতি। মা আমার ঘরে এসে সুবোধ বালিকার মতো ঘুমিয়ে পড়বেন তা কখনো হবে না। তার প্রধান চেষ্টাই থাকবে আমার সঙ্গে গল্প। করা। সেইসব গল্পেরও কোনো আগা মাথা নেই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গল্পগুলি লাফিয়ে যাবে। ইদানীং গল্পের নতুন এক প্রশাখা যুক্ত হয়েছে। প্যাকেজ নাটক বানায় এমন একজন মা-কে বলেছে তার নাটকে বড় খালার ভূমিকায় অভিনয় করতে। ভদ্রলোক নাটকের স্ক্রীপ্টও মা-কে দিয়েছেন। মার সব গল্প এখন বড় খালার চরিত্রে গিয়ে পড়ছে।