আমি জবাব দিলাম না। ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার মোটেই ভালো লাগছে। না। নিজের ওপর রাগ লাগছে। আমি তো এরকম ছিলাম না। যা মনে এসেছি বলেছি। আজ কেন এরকম হলো? মোটর সাইকেলে চড়তে আমার খুবই আপত্তি আছে। অথচ বললাম, আপত্তি নেই। কেন বললাম? আমিও কি এই ভদ্রলোকের মতোই নিজেকে আলাদা ভাবছি? না তা ভাবছি না। আমি জানি আমি কী। আমি চাচ্ছি যেন এই জ্বলোক মনে করেন আমি আলাদা। আমি বিশেষ কেউ।
স্যার বললেন, মৃন্ময়ী তুমি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছ। ব্যাপারটা কী বলো তো?
কোনো ব্যাপার না স্যার।
আমার কী ধারণা জানো? আমার ধারণা তুমি ঝোঁকের মাথায় মোটর সাইকেলে চড়তে রাজি হয়েছিল। এখন ঝোক কেটে গেছে। এখন আর রাজি নও। আমার ধারণা কি ঠিক?
হ্যাঁ ঠিক।
স্যার হাসি মুখে বললেন, আমার আসলে সাইকোলজি পড়া উচিত ছিল। দেখ কত সহজে তোমার মনের অবস্থাটা ধরে ফেললাম। তোমার অস্বস্তি বোধ করার কোনোই কারণ নেই। আমি একদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে চা খেয়ে আসব। চা পাওনা রইল। ঠিক আছে?
জ্বি ঠিক আছে। স্যার আমি যাই?
আচ্ছা যাও। তোমাকে আলাদা করে ডেকে এনে ব্ৰিত করেছিতুমি কিছু মনে করো না।
আমি কিছু মনে করি নি।
আমার ওপর রাগ লাগছে না তো?
লাগছে না।
একটা ব্যাপার জানতে পারলে তুমি অবশ্যি রাগ করবে। ব্যাপারটা না জানানোই ভালো। কিন্তু আমি লোভ সামলাতে পারছি না। বলেই ফেলি।
স্যার তার সামনের টেবিলে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া একটা কাগজ বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি প্রথমে আমার পেছনে মোটর সাইকেলে চড়তে রাজি হবে। তারপর মত বদলাবে। এই ব্যাপারটা আগেই জানতাম। কাগজে লিখে রেখেছি। পড়ে দেখ।
আমি কাগজ হাতে নিলাম। সেখানে পরিষ্কার লেখা— মৃন্ময়ীকে (রোল ফিফটিন) যখন বলা হবে আমার সঙ্গে মোটর সাইকেলে চড়তে সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হবে। পরে বলবে না।
আমি কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে স্যারের ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
আমার প্রচণ্ড রাগ লাগছে। নিজেকে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
কেউ যখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে সময়ের সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। চারা গাছ যেমন জল হাওয়ায় বিশাল মহীরুহ হয়। ক্ষুদ্রতার ব্যাপারটাও সে রকম। যত সময় যাচ্ছে নিজেকে ততই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।
বাসায় ফিরে মনে হলো আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি খুবই সাধারণ একজন। আলাদা কেউ না। সারাজীবন নিজেকে আলাদা ভেবেছি। এই ভাবার পেছনে কোনো কারণ নেই। নিজেকে অন্যরকম ভাবার একটা খেলা খেলেছি। আমি খুব শক্ত ধরনের মেয়ে। কে কী বলল বা কে আমাকে নিয়ে কী ভাবল তা নিয়ে আমি কখনো ভাবি না তা ঠিক না। আমি ভাবি। না ভাবলে স্যারের পেছনে মোটর সাইকেলে চড়তে পারতাম। কোনোই সমস্যা হতো না।
তস্তুরী বেগম আমাকে চা দিতে এসে বলল, আফা আপনের কী হইছে?
আমি বললাম, কিছু হয় নি তো। কেন আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমার জীবনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে?
তস্তুরী বেগম ফিক করে হেসে ফেলে বলল, না গো আফা। আপনেরে বড়ই সৌন্দর্য লাগতেছে।
থ্যাংক য়্যু।
তস্তুরী মাথা নিচু করে হাসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, হাসছ কেন?
তস্তুরী বেগম নরম গলায় বলল, আমরার গেরাম দেশে একটা কথা আছে। কন্যার যে দিন বিবাহ ঠিক হয় হেই দিন আল্লাহপাক তার রূপ বাড়ায়ে দেন। তিন দান বাড়ে।
বিয়ার কন্যা সুন্দরী
তিন দিয়া গুণন করি।
তার মানে তোমার ধারণা আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? রূপ তিন গুণ বেড়েছে?
হ আফা।
বিয়ে ঠিক হয় নি তস্তুরী, মন খুব খারাপ হয়ে আছে।
আমার অস্থিরতা কমছে না। একটা সময় ছিল— অস্থির লাগলে ছাদে যেতাম। অস্থিরতা কমতো। এখন তা হয় না। ছাদে গেলে উল্টোটা হয়। অস্থিরতা বেড়ে যায়। মনে হয় ছাদ থেকে একটা লাফ দিলে কেমন হয়? নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির হাতেনাতে প্রমাণ নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায়। জীবনের শেষ সময়ে একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। পৃথিবী তার মহা শক্তি দিয়ে আমাকে আকর্ষণ করবে, আমিও আমার যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে পৃথিবীকে আকর্ষণ করব।
রাতে খাবার টেবিলে বাবা বললেন, তোর কী হয়েছে রে?
আমি বললাম, কিছু হয় নি তো।
তোকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।
অন্যরকমটা কী?
দেখে মনে হচ্ছে মুখের শেপে কোনো কিছু হয়েছে। চুল কাটার পর ছেলেদের চেহারা যেমন হঠাৎ খানিকটা বদলে যায় সেরকম। চুলে কি কিছু করেছিস?
না, চুলে কিছু করি নি। আমার খুব বেশি মন খারাপ। মন খারাপ হলে হয়তো মানুষের চেহারা বদলায়।
মন খারাপের কারণ কী?
তেমন কোনো কারণ নেই।
আমাকে বলা যাবে না?
বলার মতো কিছু হয় নি।
আমাকে বলতে না চাইলে তোর মাকে বল। Open up. মন খারাপের ব্যাপারটা হলো একটা খারাপ গ্যাসের মতো। দরজা জানালা বন্ধ ঘরে এই গ্যাসটা আটকে থাকে। কাউকে মন খারাপের কথা বললে বন্ধ ঘরের জানালা খুলে যায়। তখন গ্যাসটা বের হতে পারে। জানালা খুলে দে।
বাবাকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। জ্ঞানের কথা বলতে পারার আনন্দ। শিক্ষক হবার এই সমস্যা–জ্ঞানের কথা বলতে ইচ্ছা করে। উদাহরণ দিয়ে কোনো জ্ঞানের কথা বলতে পারলে ভালো লাগে। বাবা তার চেহারায় ভালো লাগা ভাব নিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী ইদানীং টগর কী করছে না-করছে সে সম্পর্কে কিছু জানি।
আমি বললাম, না।
কম্পিউটারের কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, সেটা তো যতদূর জানি সে করছে। না।