আলিমুর রহমান বললেন, দুপুরে বেশি খেয়ে ফেলেছি বলে এই অবস্থা। ঠিক হয়ে যাবে।
এ রকম কি প্রায়ই হয়?
যেদিন বেশি খেয়ে ফেলি সেদিন হয়।
ঠিক হতে কতক্ষণ লাগে?
কোনো কোনো দিন চট করে ঠিক হয়। কোনো কোনো দিন চার-পাঁচ দিন। লাগে।
ঘরে কি অক্সিজেনের সিলিন্ডার আছে?
না। দরজা জানালা সব খুলে দে। এতেই হবে।
দাদাজান আমার কথা শোন। চল ঢাকায় চলে যাই। তোমাকে কোনো একটা ক্লিনিকে ভর্তি করি।
আলিমুর রহমান হাপাতে হাপাতে বললেন, ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে।
তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হলো রাত একটায়। তিনি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, বলেছিলাম না ঠিক হয়ে যাবে। আর কালাম গাধাটাকে বল এক কাপ লেবু চা আর কাগজ-কলম আনতে।
কাগজ কলম দিয়ে কী হবে?
আমি উইল করব।
চা খাও। খেয়ে ঘুমাও। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
উইল করে তারপর ঘুমাব। অবস্থা তো দেখছিস। যে কোনো একদিন মরে যাব। আর তখন আমার গাধাপুত্র সব দখলকরে বসে থাকবে। দু হাতে টাকা উড়াবে। ছবি কিনবে। দুই কোটি তিন কোটি টাকা দিয়ে জমি কিনবে জমির দখল নিতে পারবে না।
মৃন্ময়ী বলল, উইল করা হবে। এখন না, কাল ভোরে।
আমি এখনই করব।
মৃন্ময়ী বলল, আচ্ছা এখন আগে চা খাও। চা খেয়ে চোখ বন্ধ করে দশ মিনিট রেস্ট নাও। তারপর যদি মনে কর উইল করা দরকার উইল করবে।
তেরি কী চাই বল?
দাদাজান আমার কিছুই চাই না। তুমি অনেকবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছ তোর কী চাই? আমি প্রতিবারই বলেছি আমার কিছুই চাই না। এখনও আমার একই উত্তর।
আলিমুর রহমান হঠাৎ হাসতে শুরু করলেন। শিশুর হাসির মতো সরল আনন্দময় হাসি।
মৃন্ময়ী বলল, হাসছ কেন দাদাজান?
মজার একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে এই জন্যে হাসছি। তোর বাবাকে চূড়ান্ত শিক্ষা দেয়ার আইডিয়া।
বল শুনি।
তোর বাবা তো শিল্পবোদ্ধা হয়েছে। ছবি কিনে ঘর বোঝাই করবে। উইল করে তোর বাবাকে একটা ছবি দিয়ে যাব। সে আর কিছুই পাবে না।
কোন ছবি দেবে?
আজ যে আর্টিস্ট এসেছিল তাকে দিয়ে আঁকাব। আমার ছবি। আমি কঠিন চোখে তাকিয়ে আছি এ রকম ছবি। আইডিয়া কেমন?
আইডিয়া ভালো।
তোর বাবার শিক্ষা সফর হয়ে যাবে না?
হবার কথা।
আর্টিস্টকে টেলিফোন কর সে যেন এক্ষুনি রং-তুলি নিয়ে চলে আসে।
দাদাজান রাত বাজে দুটা। এ সময় কাউকে টেলিফোন করা যায় না। তাছাড়া আমি উনার টেলিফোন নাম্বারও জানি না। আমি ব্যবস্থা করে দেব যেন কালই উনি চলে আসেন।
আলিমুর রহমানের মাথায় আরও একটা আইডিয়া চলে এল। তিনি মৃন্ময়ীর দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তোর বাবা এখন যে বাড়িটায় থাকে সেই বাড়িটার ব্যাপারে কী করা যায়? তোর বাবা ধরেই নিয়েছে যে বাড়িটা তার। উইল যখন পড়া হবে তখন তার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাবে। বাড়িটা কাকে দিলে তার ব্রহ্মতালু জ্বলবে।
এটা তো বুঝতে পারছি না।
আলিমুর রহমান বললেন, ঐ বাড়ির অতি তুচ্ছ কাউকে দিতে হবে, মালী দারোয়ান, কাজের বুয়াটুয়া কাউকে। যাকে তোর বাবা দু চোখে দেখতে পারে না।
মৃন্ময়ী বলল, বিন্তিকে দেয়া যায়।
বিন্তিটা কে?
আমাকে দেখাশোনা করে। নতুন এসেছে। বাবা কি কারণে যেন তাকে সহ্যই করতে পারে না।
ঠিক আছে বিন্তি। তোর বাবা এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে বিন্তি বিশাল বাড়ির মালিক। আর শিল্পবোদ্ধা শাহেদুর রহমান আমার একটা ওয়েল পেইনটিং হাতে নিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছেন। হা হা হা।
অতিরিক্ত হাসির কারণেই আলিমুর রহমানের বুকের ব্যথা আবার শুরু হলো। ভয়াবহ শ্বাস কষ্ট। সকাল আটটায় ব্যথা কমল। তিনি ঘুমুতে গেলেন। মৃন্ময়ী চলে এল ঢাকায়।
মীনা তার মেয়েকে গোসল দিচ্ছে
মীনা তার মেয়েকে গোসল দিচ্ছে। যথেষ্ট আয়োজনের গোসল। প্লাস্টিকের বেবি বাথটাব কেনা হয়েছে। বাথটাব ভর্তি ফেনা। টুনটুনি বাথটাবে বসে আছে। বাথটাবটা আট হয়ে তার গায়ে বসে গেছে।
জহির এসে পাশে বসতে বসতে বলল, ভোম্বা মেয়েকে এমন পিচকি গামলায় ঢুকিয়ে দিলি। বের করবি কীভাবে?
মীনা মুখ কালো করে বলল, এরচে বড় সাইজ বাথটাব নেই। আমি কী করব?
বাথরুমে নিয়ে গোসল করাবি।
এইবারে মীনার চোখে পানি এসে গেল। সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, বাথটাব কিনে তোমার টাকা নষ্ট করেছি তো, এই টাকা আমি দিয়ে দিব।
জহির বিরক্ত হয়ে বলল, ঠিক আছে দিবি। এখন কান্না বন্ধ কর। দিনের মধ্যে দশবার চোখের পানি। অসহ্য!
মীনা বলল, আমার সব কিছুই তো অসহ্য। আমাকে অসহ্য। আমার মেয়েকেও অসহ্য। কত সহজে বলে ফেললে ভোম্বা মেয়ে। একদিন দেখলাম না কোলে নিয়ে আদর করতে। গালে একটা চুমু খেতে।
জহির উঠে পড়ল। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। বিরক্তির প্রধান কারণ ড্রয়ারে বাজার খরচ হিসেবে রাখা পনেরশো টাকা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঐ টাকা দিয়ে টিয়া এক কার্টুন সিগারেট আরো কি কি যেন কিনেছে। তার নাকি ডেইলি এক থেকে দেড় প্যাকেট সিগারেট লাগে।
ড্রয়ারের পনেরশো টাকা ছিল জহিরের শেষ সম্বল। আবার তাকে টাকার সন্ধানে বের হতে হবে। টাকা পাওয়া যাবে কি না কে জানে। একটা পত্রিকার অফিসে ইলাসট্রেটর হিসেবে যোগ দেবার কথা ছিল। পত্রিকার মালিক জানিয়েছেন আপাতত তারা নতুন কাউকে নিচ্ছেন না। পরে যোগাযোগ করতে।
অনেক ছবির দোকানে ছবি দেয়া আছে। কোথাও কিছু বিক্রি হয় নি। শ্রাবণী গ্যালারির মালিক কুদ্দুস সাহেব গলাটা খাটো করে বলেছেন, কামরুল হাসানের তুলির টান রপ্ত করেন। তারপর উনার ঢংয়ে কয়েকটা ছবি একে নিয়ে আসেন। আমাদের লোক আছে অবিকল কামরুল হাসানের নকল করে সিগনেচার করে দেবে। পার পিস আপনাকে দেব পাঁচ হাজার। রাজি থাকলে ছবি আঁকেন। এস এম সুলতান কপি করতে পারলে পার পিস পনেরো করে দেব। জয়নুল নকল করতে পারলে পার পিস কুড়ি পাবেন। আপনার প্রতিভা আছে আপনি পারবেন। আমি খোলা মানে আপনাকে আমার অফার দিলাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছা। না খেয়ে মরবেন, না নকল ছবি আঁকবেন সেটা আপনার বিবেচনা।