আয়ুব খান বুঝে গেলেন মোনায়েম খানকে তার প্রয়োজন। তিনি শুরুতে তাঁকে করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিছুদিন পরেই গভর্নর।
মোনায়েম খানকে নিয়ে মজার মজার সব গল্প। যেমন, তিনি রাতে ঘুমানোর সময় বুকের ওপর একটা বই নিয়ে ঘুমান। বইটির নাম Friends Not Masters, বইটির লেখক আয়ুব খান।
তিনি না-কি টিভি এবং বেতারের দুই প্রধানকে গভর্নর হাউসে চা খেতে ডেকে নিয়ে বলেছেন, আমার সম্পর্কে কিছু অপপ্রচার আছে। আমি নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীত বিরোধী। অবশ্যই না। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে আমি চাই এখন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত আপনারা মুসলমান গীতিকারদের দিয়ে লেখাবেন। বেতার এবং টিভিতে মুসলমানদের লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।
আনন্দমোহন কলেজের প্রিন্সিপাল নিযুক্তি নিয়েও গল্প আছে। মোনায়েম খান ঠিক করলেন তিনিই প্রিন্সিপাল নির্বাচন করবেন। ঠিক মানুষকে নিতে হবে। নয়তো সমস্যা। দু’জন ক্যান্ডিডেটের একজনকে বললেন, সকালে কী দিয়ে নাশতা করেছেন।
তিনি বললেন, পরোটা ডিমভাজি।
এই ক্যান্ডিডেট সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে গেলেন। কারণ ডিম হিন্দুয়ানি শব্দ। যে ডিম বলবে সে ইসলামি তমুদ্দনের একজন হবে না।
অন্য ক্যান্ডিডেট বললেন, রুটি আর আন্ডাভাজি দিয়ে নাশতা করেছি।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হলেন। কারণ ‘আভা’ মুসলমানি শব্দ। তবে তাকেও মোনায়েম খান বললেন, আল্ডা না বলে আপনি যদি বইদা বলতেন তাহলে আমি আরও খুশি হতাম। বইদা হলো ডিমের খাস আরবি। অনেকেই বইদা বলে। আপনার বলতে অসুবিধা কী? এখন থেকে বইদা বলবেন।
মোনায়েম খান তার রাজত্বকালে অতি গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করলেন তা হলো, এনএসএফ নামের ছাত্র সংগঠনকে পুরোপুরি গুণ্ডাবাহিনীতে রূপান্তর করা। তিনি এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন। এনএসএফকে গুণ্ডামির অলিখিত লাইসেন্স দেওয়া হলো। বিষয়টা পুলিশ বাহিনীকেও জানানো হলো।
এই সরকারি দলের একজনের নাম পাচপাত্তুর। সে টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে থাকে। হাতে সাইকেলের চেইন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাতাল হাওয়া’ গ্রন্থে পাচপাত্তুরের ভূমিকা আছে বলেই তার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হচ্ছে। শুরুতে পাচপাণ্ডুর নামকরণের ইতিহাসটা বলা যাক। তার আসল নাম সাইদুর। তার বাবা বিএম কলেজের শিক্ষক। সে ছিল M.Sc. Part -র ছাত্র। তার ঘরের দরজায় নিজের নাম লেখা। নামের শেষে লেখা Pass Part Two.
‘পাস পার্ট টু’ থেকে হয়েছে পাচপাস্তুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে তার পূর্ণ ক্ষমতা যে ঘটনাটি দিয়ে দেখাল তা হলো, এক রাতে রেলওয়ে কলোনি থেকে অল্পবয়েসী দু’জন প্রসটিটিউট নিয়ে এল। শহীদুল্লাহ হলের মাঠে তাদেরকে দিয়ে নগ্ননৃত্যের ব্যবস্থা করল। সে নিজেও চেইন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ নাচল। শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র-শিক্ষকরা হতভম্ব হয়ে এই দৃশ্য দেখল।(২)
এনএসএফ নামক সংগঠনটির প্রেসিডেন্টের নাম জমির আলি। সেক্রেটারি মাহবুবুল হক দোলন। এই দু’জন খুব সম্ভব এসএম হলে থাকত। তবে এনএসএফ-এর মূল ঘাঁটি ছিল সদ্যনির্মিত মহসিন হল। এরা সহকারী হাউস টিউটরের জন্যে বানানো চমৎকার একটি উইং দখল করে ছিল। সাধারণ ছাত্রদের টাকায় কেনা খাবারদাবারের একটি অংশ চলে যেত তাদের কাছে। তাদের জন্যে আলাদা রান্না হতো।
মহসিন হলের পাশেই রেললাইন। রেললাইনের দু’পাশে বস্তি। বস্তির কিছু মেয়ে ছিল যৌনকর্মী। তাদেরকে প্রায়ই মহসিন হলে এনএসএফ-এর নেতাদের কাছে আসতে দেখা যেত। হলের প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটররা পুরো বিষয় জানতেন। কেউ কিছুই বলতেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব হয়তো ছিল না, সাহসের অভাব ছিল।
মহসিন হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে রসায়ন বিভাগের অতি নিরীহ একজন ছাত্র বাস করত। SSC এবং HSC-তে তার রেজাল্ট ভালো ছিল বলে তাকে একটি সিঙ্গেল সিটের রুম দেওয়া হয়েছিল। এই বেচারা এনএসএফের নেতাদের ভয়ে সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকত। একদিন কোনো কারণ ছাড়াই এনএসএফের নেতারা তার ঘরে ঢুকে রুম তছনছ করে দিল। তোষক জ্বালিয়ে দিল এবং বেচারার নিজের টাকায় কেনা Organic Chemistry’র Morrison and Boyed-এর লেখা বিশাল বইটাও ছিড়ে কুটিকুটি করে ফেলল। বই কুটিকুটি করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণে বইটা সে অনেক দাম দিয়ে স্কলারশিপের টাকায় কিনেছে। তার একটাই বই। কেমিস্ট্রির অন্য বইগুলি সে লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ত। নতুন করে আরেকটা তোষক কেনার টাকা তার ছিল না। খাটে পত্রিকার কাগজ বিছিয়ে ঘুমানো ছাড়া তার কোনো পথ রইল না।
গোবেচারা এই ছাত্রের নাম হুমায়ুন আহমেদ। তার ঘর তছনছ করার ঘটনার তদন্ত করতে এলেন হাউস টিউটর প্রফেসর এমরান (পদার্থবিদ্যার শিক্ষক)। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। ছাত্রদের প্রতি মমতার তার কোনো কমতি ছিল না।
স্যার আমাকে বললেন, কারা এই কাজ করেছে তাদের নাম বলো। কাগজে লিখে দাও। তদন্তে সত্যি প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তি হবে। হল থেকে বের করে দেওয়া হবে।
আমি নাম কাগজে লিখে স্যারের কাছে দিলাম।
তিনি নামের তালিকা পড়ে ঝিম ধরে গেলেন এবং বললেন, পলিটিকস ছেড়ে দাও। পলিটিকস করো বলেই এই ঘটনা ঘটেছে।