পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে?
এখনো দেয় নাই। তদন্ত চলছে।
আপনার ছেলে কি পুলিশ কাস্টডিতে?
হাজি সাহেব বললেন, জি-না। পুলিশ তাকে খুঁজছে। কিন্তু সে পলাতক। তাকে শিলচর পাঠিয়ে দিয়েছি সেখানে আমার এক আত্মীয় আছে।
হাবীব বললেন, একটু আগে বললেন, আপনি মিথ্যা বলেন না। এখন তো মিথ্যা বললেন। ছেলে আপনার সঙ্গেই আছে। বোরকাপরাটা আপনার ছেলে।
ছেলের নাম কী?
হাসান রাজা চৌধুরী।
হাবীব কঠিন গলায় বললেন, হাসান রাজা চৌধুরী, বোরকা খেলো।
হাজি সাহেব বললেন, একগ্লাস পানি খাব।
প্রণব পানি আনার জন্যে উঠে গেলেন। হাবীব বিরক্তমুখে সিগারেট ধরালেন। হাসান রাজা চৌধুরী বোরকা খুলল। হাবীব অনেকক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে এমন রূপবান পুরুষ দেখেননি। কোরান শরিফে অতি রূপবান হিসেবে ইউসুফ নবীর কথা বলা আছে। সেই নবী কি সামনে বসে থাকা ছেলেটির চেয়েও সুন্দর ছিলেন?
হাবীব বললেন, মক্কেলের সঙ্গে আমি মামলা ছাড়া অন্য বিষয়ে আলাপ করি না। আজ অন্য একটা প্রসঙ্গে কথা বলব। হাজি সাহেব, আমি আপনার ছেলের মতো রূপবান পুরুষ দেখি নাই। প্রণব, তুমি কি দেখেছ?
প্রণব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, একবার দেখেছিলাম। শম্ভুগঞ্জ বাজারে কাপড়ের আড়তে সে বসা ছিল। জিজ্ঞেস করে জানলাম তার নাম মনীন্দ্র। তাকে দেখার জন্যে ভিড় জমে গিয়েছিল। ছয় ফুটের মতো লম্বা। ইংরেজ সাহেবদের মতো গাত্রবর্ণ। আমি যখন বললাম, আপনার নাম এবং পরিচয় কি জানতে পারি? তখন…
হাবীব বললেন, প্রণব, বাকিটা পরে শুনব। এখন একটু বাইরে যাও। রশিদ, তুমিও যাও। আমি এই দু’জনের সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা বলব।
প্রণব অপ্রসন্ন মুখে উঠে গেলেন। মামলা-মোকদ্দমার প্রাইভেট কথায় তিনি থাকবেন না কেন তা বুঝতে পারছেন না।
হাবীব বললেন, হাজি সাহেব, আপনার মামলা আমি নিব। ছেলের পলাতক থাকাটা ঠিক না। পলাতক থাকার অর্থ অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া। খুনের মামলায় পলাতক আসামির বেশির ভাগ সময় মৃত্যুদণ্ড হয়।
হাজি সাহেব বললেন, ছেলেকে কি পুলিশের হাতে তুলে দিব?
এখনো না। যখন বলব তখন। আরও মাসখানিক সে পলাতক থাকতে পারে। আমি মামলা গুছিয়ে আনার পর সে পুলিশের কাছে ধরা দিবে। তবে আপনি যে ছেলেকে বোরকা পরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাখছেন তা ঠিক না। আপনার দুই সঙ্গীও বিষয়টা জানে। এটাও ঠিক না। ছেলে এমন জায়গায় থাকবে যে আপনি ‘াড়া আর কেউ জানবে না।
হাজি সাহেব বললেন, আমার এমন কোনো জায়গা নাই। শিলচরে আমার খালাত ভাই থাকে। ছেলে সেখানে যেতে রাজি না।
আপনি কোথায় থাকেন?
আমি হোটেলে উঠেছি। হোটেলের নাম ‘আল হেলাল।
আপনার ছেলেও আপনার সঙ্গে থাকে?
জি।
আপনার দুই সঙ্গীকে না জানিয়ে ছেলেকে আমার এখানে দিয়ে যাবেন। সে মামার এখানে লুকিয়ে থাকবে। আপনি একা পারবেন না। আমার পাংখাপুলার রশিদকে পাঠাব। সে অতি বিচক্ষণ। আমার এখানে ছেলেকে রাখতে আপনার আপত্তি আছে?
হাজি সাহেব বললেন, জি-না জনাব। ছেলের মত আছে কি না একটু জেনে নেই।
হাবীব কঠিন গলায় বললেন, আপনার ছেলের মতামত বলে এখন কিছু নাই। যেদিন মামলার রায় হয়ে যাবে, হাইকোর্ট থেকে আপিলের ফলাফল হাতে আসবে, তখন তার মতামত শুরু হবে।
হাজি সাহেব বললেন, আমি খবর নিয়েছি অনেক খুনের আসামিকে আপনি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। আমার ছেলেকে কি ছাড়িয়ে আনতে পারবেন?
হাবীব বললেন, ছেলে যদি বলে আমি খুন করেছি তাহলে ছাড়িয়ে আনতে পারব না। তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।
এই প্রথম হাসান রাজা চৌধুরী মুখ খুলল। সে শান্ত গলায় বলল, আমি মিথ্যা কথা বলব না।
হাবীব বললেন, তাহলে তো বাবা আমার কাছে খামাখা এসেছ। সত্যি কথা বলে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ো। তোমাকে আমি একটা কথা বলি, তুমি কঁসিতে ঝুলিলে আমার কিছু যায় আসে না। আবার তুমি খালাস পেয়ে নৌকাবাইচ খেললেও কিছু যায় আসে না। বুঝেছ?
হাসান বলল, জি।
হাবীব বললেন, আমার অনুমানশক্তি ভালো। তুমি খুনটা কেন করেছ সেটা আমি অনুমান করতে পারি। বলব আমার অনুমান?
হাসান বলল, না।
হাবীব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, চিন্তাভাবনা করে ঠিক করুন কী করবেন?
হাজি সাহেব বললেন, আপনি কি চলে যাচ্ছেন।
হাবীব বললেন, জি। গভর্নর মোনায়েম খানকে আজ বার কাউন্সিল থেকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আমি বার কাউন্সিলের প্রধান।
সময় ১৯৬৮, এশিয়ার লৌহমানব বলে স্বীকৃত আয়ুব খান হাসি হাসি মুখে পাকিস্তানের সব ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছেন। পূর্ব এবং পশ্চিম, দুই পাকিস্তানেই তার উন্নয়নের দশ বছর পালিত হচ্ছে। বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনা।
পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংহতি আরও প্রবল করার বাসনায় তিনি এক সভায় ঘোষণা করলেন, বাংলা-উর্দু মিলিয়ে এক নতুন ভাষা পাকিস্তানে তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতের পাকিস্তানিরা এই ভাষাতেই কথা বলবে।
সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ঘোষণা করল বাংলা বর্ণমালা লিখন রীতির সংস্কার করা প্রয়োজন।(১)
পূর্বপাকিস্তানে মোনায়েম খান নামের একজনের রাজত্বকাল। তার উত্থানের গল্পটি এরকম—তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ বারের অতি সাধারণ একজন ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার। আয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি নামের অদ্ভুত পদ্ধতিতে এমএলএ হন। নির্বাচিত এমএলএ-রা যাবেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে সংসদ বসবে। এয়ারপোর্টে ছাত্ররা তাদের ঘিরে ধরল। তাদের দাবিদাওয়া যেন সংসদে পেশ করা হয়। সবাই চুপ করে থাকলেন, শুধু মোনায়েম খান বললেন, এইসব দাবিদাওয়া কোনো কাজের কথা না। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হাতে। লাগল। এক পর্যায়ে কিছু ছাত্র তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধাক্কা খেয়ে মোনায়েম খানের টুপি উড়ে গেল। এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা হলো। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে ছবিটি ছাপা হলো।