তার সঙ্গে কথা তো বলবেন। নাকি কথাও বলবেন না?
কথা বলব।
হাবীব, প্রণবকে পাঠালেন পদ্মকে নিয়ে আসার জন্যে।
পদ্ম বলল, আমি বাবার সঙ্গে দেখা করব না। তার সঙ্গে যাবও না।
নাদিয়া বলল, কেন যাবে না?
পদ্ম বলল, বাবা-মা দুজনেই আমাকে ত্যাগ করেছে। আমি তাদের ত্যাগ করেছি।
নাদিয়া বলল, তারা ভুল করেছে বলে তুমি ভুল করবে?
পদ্ম কঠিন গলায় বলল, আপনি যা-ই বলেন আমি যাব না। আপনার স্যার যদি এসে আমাকে বলেন তারপরেও যাব না।
নারায়ণকে টাকা দেওয়া হয়েছে। হাবীব বললেন, টাকা গুনে নিন।
নারায়ণ বললেন, প্রয়োজন নাই।
অবশ্যই প্রয়োজন আছে। টাকা গুনুন।
নারায়ণ টাকা গুনছেন, তাঁর হাত সামান্য কাঁপছে। প্রণব স্ট্যাপ পেপারে লিখছে। হাবীব বললেন, প্রণব! বাড়িটা লিখবে নারায়ণ বাবুর মেয়ের নামে। সীতা নামে না, নাদিয়া যে নাম দিয়েছে সেই নামে—পদ্ম। মেয়েটার তো কিছুই নাই—বাড়িটা থাকুক। নারায়ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ে তিনি বাক্যহারা। প্রণব স্বাভাবিক। শেষ মুহূর্তে এরকম একটা কাণ্ড যে ঘটবে তা তিনি জানতেন। হাবীব নামের মানুষটির মধ্যে খারাপ অংশ যতটা প্রবল, ভালো অংশও ঠিক ততটাই প্রবল। প্রণবের প্রধান সমস্যা, কোনো মানুষের খারাপ অংশ তার চোখে পড়ে না। ভালোটাই পড়ে।
অনেক রাত হয়েছে, হাবীব ঘুমাতে এসেছেন। স্ত্রীর জন্যে অপেক্ষা। স্ত্রী শোবার পর তিনি শোবেন। লাইলী পানের বাটা নিয়ে ঢুকলেন। হঠাৎ নিচু হয়ে স্বামীকে কদমবুসি করলেন।
হাবীব বললেন, ঘটনা কী?
লাইলী বললেন, প্রণব বাবুর কাছে শুনেছি পদ্ম মেয়েটার নামে আপনি বাড়ি কিনেছেন। আমি মন থেকে আপনার জন্যে আল্লাপাকের দরবারে দোয়া করেছি।
ভালো।
আপনার মেয়ে কী যে খুশি হয়েছে। সে কাদতেছিল। মাশাল্লাহ, আল্লাপাক আপনাকে একটা ভালো মেয়ে দিয়েছেন।
হাবীব বললেন, আমি মনস্থির করেছি হাসান রাজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিব। তারিখ ঠিক করেছি ২৫ ফেব্রুয়ারি। গভর্নর সাহেব ওই তারিখ দিয়েছেন। তিনি নানান ঝামেলায় আছেন। তার জন্যে সময় বার করা কঠিন।
বলো, আলহামদুলিল্লাহ।
লাইলী বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
তোমার মেয়ে কি জেগে আছে?
মনে হয় জেগে আছে। সে অনেক রাতে ঘুমায়।
রাত জেগে কী করে?
তার দাদির বিষয়ে কী যেন লেখে।
হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। লাইলী বললেন, কোথায় যান?
তোমার মেয়ের কাছে। বিয়ের তারিখ হয়েছে এটা তাকে বলি।
সকালে বলুন।
হাবীব বললেন, রাতে বলতে অসুবিধা কী?
নাদিয়া পদ্মকে ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। এন্টিগ্র্যাভিটি ম্যাজিক। পদ্ম মুগ্ধ হয়ে দেখছে। নাদিয়া বলল, এর কৌশলটা আমি তোমাকে শেখাব না। নিজে নিজে বের করতে পারো কি না দেখো। এই নাও বোতল, এই নাও দড়ি।
হাবীবকে ঘরে ঢুকতে দেখে পদ্ম বের হয়ে গেল। নাদিয়া অবাক হয়ে বলল, বাবা, এত রাতে তুমি?
একটা সুসংবাদ দিতে এসেছি রে মা।
কী সুসংবাদ?
তোর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি। গভর্নর সাহেব ওই দিন সময় দিয়েছেন। উনাকে ছাড়া বিয়ে হয় কীভাবে? তুই ঝিম ধরে আছিস কেন? কিছু বলবি?
একজন বুনির সঙ্গে আমার বিয়ে?
হাসান রাজা চৌধুরী কোনো খুন করে নাই। যে খুন করেছে তার ফাঁসির হুকুম হয়েছে।
নাদিয়া মাথা নিচু করে হাসল।
হাসছিস কেন?
এমনি হাসলাম। তুমি ২৫ ফেব্রুয়ারি বিয়ে ঠিক করেছ। আমি ওইদিন বিয়ে করব। আমি কখনো তোমাকে ছোট করব না। আমার যখন এগারো বছর বয়স, তখন প্রণব কাকা তোমার বিষয়ে একটা গল্প বলেছিলেন। তখন ঠিক করেছি, আমি কখনো তোমার অবাধ্য হব না।
গল্পটা কী?
আমার টাইফয়েড় হয়েছিল। এক রাতে এমন অবস্থা হলো, সবাই ভাবল আমি মারা যাচ্ছি। তুমি আমাকে কোলে করে বাগানে চলে গেলে। চিৎকার করে বললে, আল্লাপাক তুমি আমার জীবনের বিনিময়ে আমার মেয়ের জীবন রক্ষা করো।
হাবীব বললেন, সব বাবাই এরকম করবে।
তা হয়তো করবে। পরের অংশটা করবে না। চার দিন চার রাত তুমি আমাকে কোলে নিয়ে বসে রইলে। পঞ্চম দিনে আমার জ্বর কমল। তুমি আমাকে মায়ের পাশে রেখে ঘুমাতে গেলে।
হাবীব বললেন, ঘুমের কথা বলায় ঘুম পাচ্ছে। মা উঠি। বাবা একটু বসো।
হাবীব বসলেন। নাদিয়া বলল, আমার মনে মস্ত বড় একটা কনফিউশন আছে। কনফিউশন দূর করো।
কী কনফিউশন?
নাদিয়া ইতস্তত করে বলল, সফুরা নামের মায়ের কাজের মেয়ের একটা ছেলে আছে। ছেলেটা কি আমার ভাই?
না। আমার অনেক ত্রুটি আছে। এ ধরনের ত্রুটি নাই।
দাদি এ রকম কথা কেন বলে?
জানি না কেন বলে।
নাদিয়া ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হাসান রাজা চৌধুরী বিষয়ে তুমি যে কথা বলেছ সেটা মিথ্যা বলেছ। সফুরার ছেলের বিষয়ের কথাটা সত্যি বলেছ। বিদ্যুত স্যার আমাদের শিখিয়েছেন মিথ্যা বলার সময় মানুষের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন হয়। এই বিদ্যার একটা নাম আছে—Physiognomy analysis. বাবা! ঘুমাতে যাও।
হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। নাদিয়া বলল, যার সঙ্গে তুমি আমার বিয়ে ঠিক করেছ আমি তাকেই বিয়ে করব। তুমি জেনেশুনে একজন খুনির সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছ, নিশ্চয়ই তোমার কোনো কারণ আছে।
মহসিন হলের ছাদে
আমি এবং আনিস সাবেত মহসিন হলের ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ছাদে রেলিং নেই। দমকা বাতাস দিলে নিচে পড়ে যাব। এই নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। নিজেদের খুব এলোমেলো লাগছে। এলোমেলো যে লাগছে তার প্রমাণ আমাদের কথাবার্তা। কথাবার্তার নমুনা