হতভম্ব নাদিয়া বলল, তুমি তো ফড়ফড় করে কথা বলছ। বিদ্যুত স্যারের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে? স্যার কি এসেছেন?
পদ্ম হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
নাদিয়া বলল, প্রণব কাকা! বিদ্যুত স্যার কোথায়?
প্রণব জবাব দিলেন না। বড়শিতে মাছ বেঁধেছে। বড়সড় মাছ। তিনি মাছ নিয়ে ব্যস্ত
নাদিয়া অস্থির ভঙ্গিতে বলল, কথা বলছেন না কেন? স্যার এসেছিলেন?
হুঁ। ঘণ্টা দুই ছিলেন।
আমি জানলাম না কেন?
প্রণব বললেন, উনার কারণেই জানতে পারো নাই। উনি বললেন, নাদিয়া আমাকে একটা বিশেষ কাজে আসতে বলেছে। কাজটা করে আমি চলে যাব। আমি যে এসেছি নাদিয়া যেন না জানে।
এমন কথা কেন বললেন।
প্রণব হতাশ গলায় বললেন, সেটা মা আমি কীভাবে বলব? আমি অন্তর্যামী। উনার মনের ভিতরে ঢোকার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেন নাই।
নাদিয়ার চোখে পানি টলমল করছে। সে চোখের পানি আড়াল করার জন্যে দ্রুত বাগানের দিকে চলে গেল।
বিদ্যুত ট্রেন থেকে নামলেন সন্ধ্যার পর। স্টেশনের বাইরে পা দিতেই একজন বলল, বিদ্যুত ভাই না? তাড়াতাড়ি বাড়িতে যান। দৌড়ান। আপনার মহাবিপদ।
কী বিপদ?
কী বিপদে পরে শুনবেন, এখন দৌড় দেন।
বিদ্যুত দূর থেকে দেখলেন উঠানে অসংখ্য মানুষ। প্রত্যেকের হাতে বাঁশের লাঠি। কারও কারও হাতে মশাল। হল্লার শব্দ দূর থেকে কানে আসছে। তার বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। বিদ্যুত হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির উঠানে উঠলেন আর তার চোখের সামনে জ্বলন্ত আগুনে বিদ্যুতের বাবা হরিকান্তিকে ফেলে দেওয়া হলো। ঘটনা ঘটল চোখের নিমিষে। হরিকান্তি ও বউ গো, বউ’ বলে পশুর মতো আর্তচিৎকার করলেন। বিদ্যুত বাবাকে উদ্ধারের জন্যে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর উঠতে পারলেন না।
চোর নির্মূল অভিযানের মাধ্যমে বিদ্যুত কান্তি দে উপাখ্যানের সমাপ্তি হলো। কোনো মহৎ আন্দোলনই ভুল-ভ্রান্তি ছাড়া হয় না। স্বর্ণের খাদের মতো ভুলগুলিও স্বর্ণেরই অংশ।
আশার কথা, মাওলানা ভাসানী চোর-ডাকাত নির্মূলের সংগ্রাম থেকে সরে এসেছেন। শেখ মুজিব প্যারোলে আয়ুব খানের গোলটেবিলে যাবেন—তার প্রবল বিরোধিতা শুরু করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, প্রয়োজনে ফরাসি বিপ্লবের কায়দায় জেলখানা ভেঙে মুজিবকে নিয়ে আসা হবে।
২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন। তিনি ছাত্রদের ১১ দফাকেই সমর্থন করেন এবং বলেন, ১১ দফার মধ্যেই আছে আওয়ামী লীগের ছয় দফা।
পরের দিন রেসকোর্সের ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।
উনসত্তরের গণআন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন একজন নেতা খুঁজে বের করা। নেতাশূন্য দেশে একজন নেতার উত্থান হলো–বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশরক্ষা আইন
দেশরক্ষা আইনে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা সবাই ছাড়া পেয়েছেন। ময়মনসিংহ থেকে কয়েকজনের মধ্যে নারায়ণ চক্রবর্তী ছাড়া পেয়েছেন। এই অল্প কয়েক মাসের হাজতবাসে তিনি কুঁকড়ে গেছেন। গাল মুখের ভেতর ঢুকে গেছে। নাক ঝুলে পড়েছে। তিনি হাঁটছেনও কুঁজো হয়ে। রাত নটার দিকে তিনি চাদরে নিজেকে ঢেকে হাবীবের বাড়িতে ঢুকলেন। হাবীব চেম্বারে ছিলেন। প্রণব নারায়ণ বাবুকে সরাসরি চেম্বারে নিয়ে গেলেন।
হাবীব বললেন, আপনি দুপুরে ছাড়া পেয়েছেন খবর পেয়েছি। শরীরের অবস্থা কাহিল দেখছি। মারধোর করত?
নারায়ণ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চাপা গলায় বললেন, আমার মেয়েটা কেমন আছে?
হাবীব বললেন, ভালো আছে। আপনি বসুন।
নারায়ণ বসেই কাশতে শুরু করলেন। তাঁর হাঁপানির টান উঠে গেল। হাজত থেকে তিনি এই ব্যাধি শরীরে নিয়েছেন। ঠান্ডা মেঝেতে রাতের পর রাত একটা কম্বলে শোয়াই তঁার কাল হয়েছে।
চা খাবেন? চা দিতে বলি।
চা খাব না।
মেয়েটার সঙ্গে কথা বলবেন? ডেকে দিব?
আগে আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ করব।
করুন পরামর্শ।
নারায়ণ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই দেশে থাকব। ইন্ডিয়ায় চলে যাব।
হাবীব বললেন, আপনাদের সুবিধা আছে। ঝামেলা মনে করলে পাশের দেশে চলে যেতে পারেন। আপনারা ইন্ডিয়াকেও আপনাদের দেশই মনে করেন। আমার সেই সুবিধা নাই। পাকিস্তানই আমার দেশ।
নারায়ণ কাশতে কাশতে বললেন, আমার এক বিঘা জমির উপর যে বাড়িটা আছে সেটা বিক্রি করতে চাই। আমার নগদ টাকা প্রয়োজন। আপনি কি খরিদ করবেন?
আজই ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছেন?
যেদিন বিক্রি করব তার পরদিনই চলে যাব। শিলচর দিয়ে যাব, ব্যবস্থা করা আছে।
আপনার বাড়ি আমি কিনতে রাজি আছি। আপনারা তো একই জায়গা তিনচারজনের কাছে বিক্রি করেন। আপনার জমি আর কার কার কাছে বিক্রি করেছেন?
আমি দুপুর তিনটায় ছাড়া পেয়েছি। সরাসরি আপনার কাছেই এসেছি।
দাম কত চান?
আপনি নগদ যা দিতে চান তা-ই আমি নিব। স্ট্যাম্পে সই করে বাড়ি আপনার নামে লিখে দিব।
মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন না
নিয়ে যাব। ওই দেশে আমার মেয়ের বিষয়ে কেউ কিছু জানে না।
হাবীব বললেন, চার হাজার টাকা নগদ দিতে পারব। এতে চলবে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নারায়ণ বললেন, চলবে। পানির দাম বলেছেন, কিন্তু চলবে।
হাবীব বললেন, চেম্বারে স্ট্যাম্প পেপার আছে। প্রণব লিখে ফেলবে। আমি টাকাটা নিয়ে আসি। মেয়েটাকে কি আজই নিয়ে যাবেন?
আজ না, যেদিন শিলচর যাব সেদিন নিয়ে যাব।