পদ্ম, ম্যাজিকটা কি পছন্দ হয়েছে? পছন্দ হলে মাথা নাড়ো।
পদ্ম মাথা নাড়ল।
বিদ্যুত বললেন, নাদিয়াকে মাজিকটা দেখিয়ো। খুব ভালোমতো প্রাকটিস করার পর দেখাবে। হুট করে দেখাবে না। এখন চলো আমার সঙ্গে, একটা গাছের সামনে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দেই। নাদিয়াদের বাগানে একটা বকুলগাছ আছে।
ওই গাছটা হোক তোমার প্রথম বন্ধু। আমার হাত ধরো। চলো যাই।
বিদ্যুতের হাত ধরে পদ্ম সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।
প্রণব দেখলেন বিদ্যুত হোসনা মেয়েটাকে একটা বকুলগাছের সামনে দাঁড় করিয়ে চলে আসছেন। মনে হচ্ছে হোসনা গাছের সঙ্গে কথা বলছে। ব্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
বিদ্যুত প্রণবের কাছে এসে বললেন, আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি চলে যাব। আমি যে এসেছি এই খবরটা মনে হয় নাদিয়াকে দেননি।
প্রণব জবাব দিলেন না। তার দৃষ্টি হোসনা মেয়েটার দিকে। বিদ্যুত বললেন, পদ্ম মেয়েটা হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আমার ধারণা আজ সন্ধ্যা থেকে কথা বলা শুরু করবে।
প্রণব বললেন, আপনি কি এখনই রওনা হবেন? রওনা হওয়া উচিত। দশটা বাজতে আধঘণ্টা বাকি। ট্রেন অবশ্য সময়মতো আসে না। লেট হয়।
আমি এখনই রওনা হন।
প্রণব বললেন, যদি আপত্তি না থাকে আপনাকে রেলস্টেশনে দিয়ে আসি। স্যারের গাড়ি আছে। গাড়িতে করে নিয়ে যাব। আপনার কি আপত্তি আছে।
আমার আপত্তি নাই। তবে গাড়ি লাগবে না।
ট্রেন এক ঘণ্টা লেট। বিদ্যুত টি স্টল থেকে চা কিনেছেন, হেঁটে হেঁটে চা খাচ্ছেন। তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছেন প্রণব। বিদ্যুত বললেন, আপনি চলে যান। আমার জন্যে সময় নষ্ট করছেন কেন?
প্রণব বললেন, আমার প্রচুর সময়। নষ্ট করলে কারও কোনো ক্ষতি হয় না।
বিদ্যুত বললেন, আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
আপনি আমাকে ধুরন্ধর বলেছেন। এটা সত্যভাষণ। সত্যভাষণের জন্যে ক্ষমা চাইতে হয় না।
আপনি দেশের অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন। দেশের অবস্থা বুঝিয়ে বলি?
বলুন।
দেশ এখন চলে গেছে ছাত্রদের হাতে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ চালাচ্ছে। তারা যা নির্দেশ দিচ্ছে সেইভাবে কাজ হচ্ছে। দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা বা ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। তারা ভুল করা শুরু করবে। তখন বড় সমস্যা তৈরি হবে। এক ভুল থেকে আরেক ভুল। ভুলের চেইন রিঅ্যাকশান।
পূর্বপাকিস্তান কি আলাদা হয়ে যাবে?
না। পাকিস্তান সরকার দেশ ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করবে। অবশ্যই দেশে মার্শাল ল আসবে। আয়ুব খান কোনো সহজ জিনিস না। সে নিউট্রন শোষক নামাবে। নিউট্রনের সংখ্যা কমাবে।
বিষয়টা বুঝলাম না।
অ্যাটমিক রিঅ্যাকটার থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। রিঅ্যাকটারে নিউট্রনের সংখ্যা বেড়ে গেলে বিস্ফোরণ হয়। পূর্বপাকিস্তান এখন অ্যাটমিক রিঅ্যাকটার। নিউট্রনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিস্ফোরণ বন্ধ করতে নিউট্রন শোষক লাগবে।
আয়ুব খান তা জানেন।
প্রণব বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারি নাই। বুঝার কথাও না। জ্ঞানের কথা মূর্খ মানুষ বুঝবে না—এটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, আমি স্টেশনে আপনার সঙ্গে এসেছি জ্ঞানের কথা শোনার জন্যে না। আপনাকে একটা বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্যে।
কী বিষয়।
নাদিয়া মা’কে আপনার সঙ্গে কেন দেখা করতে দেই নাই সেই বিষয়।
ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই।
আপনার দিক থেকে হয়তো প্রয়োজন নাই। আমার দিক থেকে আছে।
বিদ্যুত বললেন, ব্যাখ্যাটা মনে হচ্ছে আমি জানি। তারপরেও আপনার কাছ থেকে শুনি।
প্রণব বললেন, নাদিয়া মা’কে আমি কোলেপিঠে করে বড় করেছি। তার পিতা তাকে যতটা স্নেহ করেন, ভগবান সাক্ষী আমি তারচেয়ে কম করি না। আমি চিরকুমার মানুষ। আমার কেউ নাই। নাদিয়া মাকে আমি কন্যা জ্ঞান করি।
মূল কথাটা বলুন।
নাদিয়া মা আপনাকে দেখলে পাগলের মতো হয়ে যেত। এটা আমি হতে দিতে পারি না। আপনি জ্ঞানী মানুষ। আপনি কি আমার কথা বুঝেছেন?
হ্যাঁ।
আমি কি অন্যায় করেছি?
উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ এবং না। বিজ্ঞানে কিছু কিছু সমস্যার উত্তর এরকম হয়। উত্তর আসে পজেটিভ এবং নেগেটিভ। দুটা উত্তরই সত্য। আপনি কাঁদছেন নাকি?
কাঁদছি না। চোখে ধুলাবালি কিছু পড়েছে।
বিদ্যুত বললেন, অনাত্মীয়া একটি মেয়ের প্রতি আপনার মমতা দেখে ভালো লাগল। অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, নাদিয়াদের বাগানে মহিষের মতো বলশালী একজনকে দেখলাম। মানুষটা কে?
ওর নাম ভাদু। পাহারাদারের চাকরি করে।
লোকটা কিন্তু ভয়ঙ্কর। আমি পদ্মকে নিয়ে অনেকক্ষণ বাগানে ছিলাম। লোকটা একবারও আমার দিকে বা পদ্মের দিকে তাকায়নি। যেসব মানুষ কারও চোখের দিকে তাকায় না তারা অসুস্থ।
প্রণব বললেন, আপনি জ্ঞানী মানুষ কিন্তু একটা ভুল করেছেন। ভাদু মহা বোকা একজন মানুষ। ভালো মানুষ। ভালো মানুষেরা বোকা হয়।
বিদ্যুত বললেন, আমার ভুল হতেও পারে। মানুষ মাত্রই ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক।
ট্রেন এসে গেছে। বিদ্যুত একটা খবরের কাগজ কিনে ট্রেনে উঠলেন। খবরের কাগজে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক ঘোষণা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। তারা দেশ থেকে চোর-ডাকাত নির্মূল করতে বলছে। তারা চোর-ডাকাতের এই আইডিয়া হয়তোবা মাওলানা ভাসানীর কাছ থেকে পেয়েছে।
সময় দুপুর।
নাদিয়ার মাছ মারার শখ হয়েছে। সে বড়শি ফেলে পুকুরঘাটে বসে আছে। প্রণব বড়শির ব্যবস্থা করেছেন। চারের ব্যবস্থা করেছেন। পচা গুড় এবং পচা গোবরের চার। টোপ ফেলা হয়েছে পিঁপড়ার ডিমের। তিনি ট্রেনার হিসাবে নাদিয়ার পাশে বসে আছেন। পদ্ম এসে নাদিয়ার সামনে দাঁড়াল। নাদিয়াকে অবাক করে দিয়ে বলল, আপা ম্যাজিক দেখবেন? এটা কী? একটা কাগজ না? আমি দিলাম ফু। এখন কী? পাঁচ টাকার নোট।