বুঝাতে চাচ্ছেন না কেন?
আপনি ধুরন্ধর মানুষ। ধুরন্ধর মানুষকে আমি কিছু বোঝাই না। এরা এমনিতেই বোঝে।
প্রণব অবাক হয়ে বললেন, আমি ধুরন্ধর আপনি কীভাবে বুঝলেন?
বিদ্যুত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, এক ঘণ্টা সতেরো মিনিট হলো আমি এসেছি। আপনি আমাকে এই ঘরে নিয়ে এসেছেন। চায়ের ব্যবস্থা করেছেন। বলেছেন নাশতা আসছে। আমার আসার খবরটা কাউকে দেননি। কারণ গতবারে আপনি দেখেছেন আমাকে নাদিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। নাদিয়ার বাবা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। এবার আপনি পরিস্থিতি আঁচ করার জন্যে সময় নিচ্ছেন। অতি ধুরন্ধররা এই কাজটা করে।
প্রণব পান মুখে দিলেন।
বিদ্যুত বললেন, আপনি যে ধুরন্ধর আমি কি প্রমাণ করতে পেরেছি?
প্রণব জবাব দিলেন না বিদ্যুত বললেন, আমাকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে পদ্ম নামে একটা মেয়ের সমস্যা সমাধানের জন্যে। সে নাকি কারও সঙ্গে কথা বলে না। আপনি পদ্মকে নিয়ে আসুন। তার সঙ্গে কথা বলব। আমার হাতে সময় কম। দশটার ট্রেনে চলে যাব। আমার মা অসুস্থ।
প্রণব উঠে গেলেন। তিনি বিদ্যুতের কথায় খুব বিচলিত হয়েছেন এরকম মনে হলো না।
নাদিয়ার সঙ্গে প্রণবের দেখা হলো। প্রণব বললেন, না, কী করে?
নাদিয়া বলল, এই মুহূর্তে কিছু করছি না। তবে লেখা নিয়ে বসব। দাদিজানের জীবন কাহিনী।
কতদূর লেখা হয়েছে।
চল্লিশ পৃষ্ঠা।
আমাকে পড়তে দিবে না?
লেখা শেষ না হলে কাউকে পড়তে দিব না।
হোসনা মেয়েটা কোথায় জানো মা? একটু প্রয়োজন ছিল।
নাদিয়া বলল, সে নিশ্চয়ই ছাদে আছে। আরেকটা কথা, মেয়েটার নাম পদ্ম। আপনি হোসনা ডাকবেন না।
প্রণব বললেন, স্যার নাম রেখেছেন হোসনা। আমি হোসলাই ডাকব। পদ্ম ফদ্দ তুমি ডাকবে।
বাবা কি আপনার ঈশ্বর?
কাছাকাছি।
বাবাকে আপনি এত পছন্দ করেন কেন?
কারণ আছে। কারণ তোমার না জানলেও চলবে।
প্রণব ছাদে উঠে গেলেন। নাদিয়াকে বিদ্যুত স্যারের বিষয়ে কিছুই বললেন। নাদিয়া তার দাদির ঘরে খাতা-কলম নিয়ে ঢুকল। পোট্রেট পেইন্টাররা মডেল সামনে বসিয়ে ছবি আঁকে। নাদিয়া তার দাদির জীবনী লেখে দাদিকে সামনে রেখে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুজব করে।
হাজেরা বিবি জেগে আছেন। তবে তার দৃষ্টি খানিকটা এলোমেলো। নাদিয়া বলল, কিছু লাগবে দাদি?
হাজেরা বিবি -সূচক মাথা নাড়লেন।
এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন?
হাজেরা বিবি হতাশ গলায় বললেন, আইজ তোর নাম বিস্মরণ হয়েছি। তোর নাম কী?
নাদিয়া।
ও আচ্ছা। এখন স্মরণ হয়েছে, তোর নাম তোজল্লী।
নাদিয়া লেখা শুরু করল। নাম ভুলে যাওয়ার অংশটা লিখল—
হাজেরা বিবির স্মরণশক্তি তীক্ষ্ণ। তিনি কোনো কিছুই ভোলেন না। ভর নাকের ডগায় যদি কোনো মাছি বসে, তিন বছর পরেও তিনি তা মনে রাখবেন। তবে ভুলে যাওয়ার খেলা তিনি খেলেন। তাঁর অনেক অস্ত্রের একটি অস্ত্র হলো, ভুলে যাওয়া অস্ত্র। মনে করা যাক তিনি ভয়ঙ্কর কোনো কথা বলেছেন। সংসারে বিরাট অশান্তি শুরু হয়েছে। তখন যদি তার পুত্র এসে বলে, মা, এমন একটা কথা কীভাবে বললে? সঙ্গে সঙ্গে হাজেরা বিবি চোখ কপালে তুলে বলবেন, এই কথা কখন বললাম? বিস্মরণ হয়েছি।
বিদ্যুতের সামনে পদ্ম বসে আছে। পদ্ম মাথা নিচু করে আছে। বিদ্যুত বললেন, তোমার নাম খুব সুন্দর, পদ্ম!
পদ্মের ভাবভঙ্গি পাথরের মূর্তির মতো। মনে হচ্ছে সে নিঃশ্বাস ফেলছে না।
বিদ্যুত বললেন, নাদিয়া লিখেছে তোমার জীবনে বিরাট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তুমি তারপর থেকে কথা বলা বন্ধ করেছ। ভালো করেছ। হড়বড় করে কথা বলার কিছু নেই। আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে না। আমি যদি হা-না জাতীয় কিছু জানতে চাই মাথা নেড়ে জবাব দেবে। আমি নাদিয়ার শিক্ষক, কাজেই তোমারও শিক্ষক। শিক্ষকের কথা মানতে হয়। যে বিরাট দুর্ঘটনা তোমার জীবনে ঘটেছে, তা কি তোমার কারণে ঘটেছে?
পদ্ম না-সূচক মাথা নাড়ল।
অন্যের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই তুমি অন্যদের ওপরে রাগ করে কথা বন্ধ করেছু। খুব ভালো করছ। গাছপালার ওপর তোমার কি কোনো রাগ আছে?
পদ্ম বিস্মিত হয়ে তাকাল। না-সূচক মাথা নাড়ল। বিদ্যুৎ বললেন, গাছপালার ওপর যখন রাগ নেই, তখন গাছপালার সঙ্গে কথা বলতেও বাধা নেই। যে দুর্ঘটনা তোমার জীবনে ঘটেছে, তুমি বাগানের গাছগুলিকে সেই দুর্ঘটনার কথা বলবে। গাছ কিন্তু মানুষের কথা শোনে। গাছের অনুভূতি আছে—এটা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বলে গেছেন। গাছ তোমার সব কথা শুনবে। তোমার রাগ দুঃখ কষ্ট তখন কমতে থাকবে। কথা বলবে গাছের সঙ্গে?
পদ্ম চুপ করে রইল। মাথা নাড়ল না। বিদ্যুত বললেন, আমি এখন তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাব। ম্যাজিকটা তোমার যদি পছন্দ হয়, তোমাকে শিখিয়ে দেব। তারপর তোমাকে একটা গাছের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমি চলে যাব। তুমি প্রথমে গাছটাকে ম্যাজিক দেখাবে। তারপর তোমার কষ্টের গল্প তাকে বলবে।
বিদ্যুত পকেট থেকে এক টুকরা সাদা কাগজ বের করলেন। কাগজ উল্টেপাল্টে পদ্মকে দেখালেন। পদ্ম কাগজ হাতে নিয়ে দেখল। বিদ্যুত পদ্মের হাত থেকে কাগজ নিয়ে ফুঁ দিতেই কাগজটা পাঁচ টাকার একটা নোট হয়ে গেল। পদ্ম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে—এটা বোঝা যাচ্ছে। সে টাকাটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে। বিদ্যুত ম্যাজিকের কৌশল শেখালেন এবং লক্ষ করলেন, মেয়েটা বুদ্ধিমতী, কৌশলটা সুন্দর ধরতে পেরেছে।