যাই হোক বিয়ে হলো। আয়নায় তাকে দেখানো হলো। দেখলাম মেয়েটা কাঁদছে কিন্তু তার ঠোট হাসিমাখা। হঠাৎ আমার মনে অদ্ভুত আনন্দ হলো। মনে হলো, এই মেয়ে আমার একটি অংশ। সে আমার সঙ্গে হাসবে, আমার সঙ্গে কাঁদবে। খুব ইচ্ছা করল বলি, এই মেয়ে, আর কঁদবে না। এখন থেকে শুধু হাসবে।
সন্ধ্যাবেলা, মাগরেবের আজানের পরপর আমাকে জানানো হলো—রেশমা আমাকে তালাক দিয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, মেয়েটা ঠিক করেছে। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে আমার বাবার ইচ্ছায় বিয়ে করেছে। আবার নিজের ইচ্ছায় বিয়ে বাতিল করেছে। সাহসী মেয়ে। কিন্তু আমার মনটা এতই খারাপ হলো, মনে হলো হঠাৎ আমার জগতটা ছোট হয়ে গেছে। আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ মরে গেছে। বিরাট পৃথিবীতে আমি একা হয়ে গেছি।
কয়েক ঘণ্টার জন্যে একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। এই কয়েক ঘণ্টা তার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারিনি। তার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি।
নাদিয়া, আপনাকে বিষদভাবে এত কথা কেন বলছি জানেন? একজন কাউকে আমার মনের কথাগুলি বলতে ইচ্ছা করছিল। চিঠি লেখার সময় মনে হচ্ছিল আপনি আমার সামনে বসে আছেন।
প্রণব বাবু বললেন, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে। এই কথা তিনি কেন বললেন আমি জানি না। যদি দেখা হয় আমি এবার আপনার জন্যে একটা উপহার নিয়ে আসব, চোঙা দুরবিন। এই দুরবিনের কোনো স্ট্যান্ড থাকে না। হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে হয়। দুরবিনটা আমি পেয়েছি গুদামঘরে। দুরবিনের গায়ে লেখা–
Victorian Marine Telescope
Maker w. Ottway and co.
London 1915
আপনাকে এই টেলিস্কোপটি দিতে চাচ্ছি, কারণ আপনি আমাকে টেলিস্কোপ বিষয়ে একটি গল্প বলেছিলেন। গল্প বলার এক পর্যায়ে হঠাৎ দেখলাম, আপনার চোখ ছলছল করছে। গল্পটা মনে করিয়ে দেই। শেষজীবনে জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও খুবই আগ্রহ করে নিজেই একটা টেলিস্কোপ বানিয়ে যখন আকাশের দিকে ধরলেন, তখন তিনি কিছুই দেখলেন না। কারণ রাতের পর রাত তারা দেখে এবং দিনে সূর্যের দিকে তাকিয়ে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
লম্বা একটা চিঠি আপনাকে লিখলাম। বানান ভুল করেছি কি না এই নিয়ে চিন্তা করছি। আপনি ভালো থাকবেন।
ইতি
হাসান রাজা চৌধুরী
রাত নয়টা। হাবীব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। এখান থেকে নবজাত শিশুর কান্নার শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সফুরার পুত্রসন্তান হয়েছে। যে পৃথিবীতে এসেছে সে নিজেকে প্রবলভাবেই জানান দিচ্ছে।
হাজেরা বিবি তার ঘর থেকে ডাকলেন, হাবু কইরে! হাবু। ও হাবু।
হাবীব জবাব দিলেন না। হাজেরা বিবি ডেকেই যাচ্ছেন, হাবু রে ও হাবু, হাবু। বাধ্য হয়ে হাবীব বললেন, মা আমি বারান্দায়। জটিল একটা বিষয় নিয়া চিন্তায় আছি। এখন তোমার কথা শুনতে পারব না।
হাজেরা বিবি বললেন, অতি জটিল কথা আমার পেটে ঘুরপাক খাইতেছে। তাড়াতাড়ি কাছে আয়।
বিরক্ত মুখে হাবীব তার মা’র ঘরে ঢুকলেন। হাজেরা বিবি বললেন, খবর পাইছস তোর পুলা হইছে?
হাবীব কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগল। তিনি থমথমে গলায় বললেন, মা, যে কথাটা বলল, এই কথা যদি আর কোনোদিন বলো…
বললে কী করবি? গলা টিপ্যা মারবি? মারলে ভালো হয়। পুত্রের হাতে মায়ের মৃত্যু হইল সুখের মরণ। এখন যা বারান্দায় খাড়ায়া পুলার কান্দন হোন। তোর পুলার গলা দিয়া বুলন্দ’ আওয়াজ আসতাছে। মাশাল্লাহ্।
হাবীব বললেন, চুপ!
হাজেরা বিবি বললেন, আমারে চুপ বলবি না। যারার সাহস নাই তারা সবসময় অন্যরে বলে, চুপ। সাহসীরা বলে না। তুই সাহস দেখা, যা পুত্র কোলে নে। বাপ বইল্যা তার গালে ঠাশ কইরা চুমা দে।
মা, খবরদার!
হারামজাদা পুলা তুই খবরদার!
হাবীব মার সামনে থেকে সরে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন। কিছুক্ষণ একা বাগানে হাঁটবেন একতলায় নামতেই রশিদের সঙ্গে দেখা হলো। রশিদ বলল, একটা খারাপ খবর আছে স্যার।
হাবীব বললেন, সন্তান প্রসব করতে গিয়ে সফুরা মেয়েটা কি মারা গেছে?
জি।
আমার জুনিয়র উকিল আব্দুল খালেকরে খবর দাও
সে মরা বাড়িতে তোলা খাবার পাঠাতে চেয়েছিল। সুযোগ পেয়ে গেল।
হাবীব বাগানের দিকে গেলেন। শিশুর কান্না এত দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে।
নাদিয়া এখনো জানে না
নাদিয়া এখনো জানে না তার স্যার দু’টা আনারস নিয়ে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন। তাকে তোলা হয়েছে অতিবাড়িতে। তাকে চা দেওয়া হয়েছে। প্রণব তার দেখাশোনা করছেন।
প্রণব বললেন, আপনার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। আমি মুসলমান হলে বলতম মাশাল্লাহ। মুসলমান না হওয়ার কারণে বলতে পারলাম না।
বিদ্যুত বললেন, আমি যে এসেছি নাদিয়া জানে?
প্রণব বললেন, আমি ছাড়া কেউ জানে না। যথাসময়ে জানবে। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। জাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাড়াহুড়ার কারণে। সবকিছুতে তাড়া। আপনার চায়ে চিনি ঠিক আছে?
আছে।
এখন চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেশের অবস্থা কী বলেন?
ভালো।
এককথায় সেরে দিলেন? ভালোটা কোনদিকে? আপনি শিক্ষক মানুষ, বুঝয়ে বলেন।
ফিজিক্স দিয়ে বুঝাব?
প্রণব আগ্রহী গলায় বললেন, বুঝান।
বিদ্যুত বললেন, জগতে দুটা বিষয় আছে, শৃঙ্খলা এবং বিশৃঙখলা। এনট্রপি হলো বিশৃঙ্খলার সূচক। দেশের এনট্রপি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ের। কিছু বুঝেছেন?
না।
ইচ্ছা করলে খুব সহজভাবে আমি আপনাকে বোঝাতে পারি। বোঝাতে চাচ্ছি না।