কী সর্বনাশ!
চমকায়ে উঠলেন কেন? চমকায়ে উঠার মতো কিছু বলি নাই। বাস্তব কথা বলেছি। আমি বাস্তব লোক।
প্রণব ইতস্তত করে বললেন, তালাক হওয়া পাত্রের সঙ্গে স্যার মেয়ে বিবাহ দিবেন এটা মনে হয় না। এটাও একটা বাস্তুব কথা। আমার সারও বাস্তুব লোক।
হাজি সাহেব বললেন, অবশ্যই বাস্তব কথা। হাবীব খান সাহেব সব ঘটনা জানার পর যদি মেয়েকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন আমি বলব, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি না দেন তাহলেও বলব, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
সবকিছুতে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বললে তো ঝামেলাই শেষ।
হাজি সাহেব বললেন, আমি ঝামেলা শেষ করতে পছন্দ করি। ঝামেলা হলো মরা লাশ। মরা লাশ কবর দিতে হয়। পুষতে হয় না।
দুপুরে খাওয়ার পর হাজি সাহেব রাশেদাকে ডেকে পাঠালেন। রাশেদা কঠিন মুখ করে তার সামনে বসলেন। তার চোখ লাল। নাকের পাতা ফুলে ফুলে উঠছে। তিনি কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। হাজি সাহেব বললেন, জোর করে আমি তোমার মেয়ের সঙ্গে হাসানের বিয়ে দিয়েছি। আমি শরমিন্দা। এটা একটা বড় ভুল হয়েছে। তবে সব ভুলের সংশোধন আছে।
রাশেদা বললেন, এই ভুলের সংশোধন নাই।
হাজি সাহেব বললেন, তুমি ঠিক বলো নাই। এই ভুলেরও সংশোধন আছে।
কী সংশোধন।
বিবাহ বাতিলের ব্যবস্থা করলেই সংশোধন হয়। তালাকের ব্যবস্থা করা যায়।
রাশেদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তালাক!
হুঁ।
আপনি নতুন খেলা কী খেলতে চান আমি বুঝতে পারলাম না।
খেলা ভাবলে খেলা। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে যা পেয়েছি তা হলো, এই বিবাহ সুখের হবে না। কাজেই তালাকই ভালো।
চিন্তাভাবনা আগে করতে পারতেন।
তা পারতাম। এইখানে আমি ভুল করেছি। আরও বড় ভুল যেন না হয় তার জন্যেই তালাকের ব্যবস্থা। তুমি এখন মেয়ের কাছে যাও। মেয়েকে বলো তালাক দিতে। আমি আমার ছেলেকে চিনি। সে তালাকে রাজি হবে না।
আমার মেয়ে রাজি হবে?
হাজি সাহেব বললেন, তোমার মেয়েও সহজে রাজি হবে না। আমি অনুসন্ধানে পেয়েছি, তোমার মেয়ে হাসানকে পছন্দ করে। যাই হোক, তোমার দায়িত্ব মেয়ের হাতেপায়ে ধরে মেয়েকে রাজি করানো।
রাশিদা বললেন, তালাকের পিছনে অন্য কী ঘটনা আছে সেটা বলেন।
অন্য কোনো ঘটনা নাই। তবে দুপুরে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমায়ে পড়েছিলাম, তখন একটা খোয়াব দেখি। সেটাও একটা কারণ হতে পারে। কী খোয়াব দেখেছি শুনতে চাও?
শুনতে চাই না। আমার কাছে খোয়াবের কোনো দাম নাই।
আচানক কথা বললা। অনেক বড় বড় ঘটনার বিষয়ে খোয়াবের মাধ্যমে ইশারা আসে। মানুষকে সাবধান করার জন্যে আল্লাপাক খোয়াবের ব্যবস্থা করেন।
কী খোয়াব দেখেছেন?
দেখলাম হাসান আর তোমার মেয়ে ছাদে হাঁটছে। তোমার মেয়ে আনন্দে আছে। হঠাৎ হাসান তাকে ধাক্কা দিল। তোমার মেয়ে ছাদ থেকে পড়ে গেল। খোয়াব এই পর্যন্তই।
আপনার ছেলে একটা খুন করেছে। আপনার মাথায় আছে খুনের বিষয়। এই কারণে খোয়াকে আরেকটা খুন দেখেছেন।
তোমার জ্ঞান বেশি হয়েছে বিধায় জ্ঞানের কথা বলা শুরু করে। আমার জ্ঞান অল্প যে কারণে আমি খোয়াবকে দেখি আল্লাপাকের ইশারা হিসাবে। কথা বলে তুমি অনেক সময় নষ্ট করেছ, এখন যাও মেয়েকে রাজি করাও
রাশেদা বললেন, যা হওয়ার হয়েছে। তালাকের প্রয়োজন নাই। রেশমার কপালে যা আছে তা-ই ঘটবে।
হাজি সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, তোমাকে যা করতে বলেছি করো। পানশি প্রস্তুত আছে। তালাকের পরই তুমি মেয়ে নিয়ে চলে যাবে। কাবিনের টাকা তোমার মেয়ের থাকবে। গয়না যা দিয়েছি তাও থাকবে। গয়নার মধ্যে হাসানের মায়ের একটা চন্দ্রহার আছে। সেটা শুধু ফেরত দিবা। আরেকবার যখন হাসানের বিবাহ হবে তখন এই হারের প্রয়োজন হবে। এটা মায়ের একটা স্মৃতি।
সন্ধ্যাবেলা রাশেদা মেয়েকে নিয়ে নৌকায় উঠলেন। তালাকপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
প্রণবও ভিন্ন নৌকায় সন্ধ্যাবেলায় দু’টা প্রকাণ্ড চিতল মাছ নিয়ে রওনা হলেন। তাঁর সঙ্গে হাজি সাহেবের চিঠি। চিঠিতে লেখা–
জনাব হাবীব খান সাহেব,
আসসালামু আলায়কুম। পর সমাচার আপনার পত্র পাইয়া অতি সন্তোষ লাভ করিয়াছি। আপনার প্রস্তাব আমার পুত্রের প্রতি বিরাট দোয়াস্বরূপ। আপনার কন্যাকে পুত্রবধূ হিসাবে পাওয়াও আমার জন্যে মহাসৌভাগ্যের ব্যাপার। বাকি
আল্লাপাকের ইচ্ছা।
সামান্য ঝামেলা অবশ্য আছে। এই ঝামেলার বিষয়টা আপনি প্রণব বাবুর নিকট জানিবেন।
আমি প্রস্তুত আছি। আমার পুত্রও প্রস্তুত আছে।
ইতি
হাজি রহমত রাজা চৌধুরী
প্রণবের সঙ্গে আরেকটি চিঠি আছে। চিঠিটা নাদিয়ার জন্যে। পত্ৰলেখকের নাম হাসান রাজা চৌধুরী। হাসান লিখেছে—
নাদিয়া,
আপনি কেমন আছেন? আপনি বলেছিলেন, আমাদের কইতরবাড়ি দেখতে আসবেন। প্রণব বাবুকে হঠাৎ দেখে মনে হলো আপনিও এসেছেন। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, নাদিয়া কোথায়? আমি ভেবেছিলাম আপনি প্রণব বাবুকে নিয়ে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন।
অজি দুপুরে আমার বিয়ে হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা বিয়ে ভেঙে গেছে। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার নাম রেশমা। মেয়েটা বালিকা স্বভাবের। এই ধরনের মেয়েরা বৃদ্ধা হওয়ার পরেও তাদের বালিকা স্বভাব থেকে যায়।
আপনাকে এই চিঠিটা লেখার উদ্দেশ্য একটা আশ্চর্য ঘটনা জানানো। ঘটনা ঠিক না, অভিজ্ঞতা। বিয়ে এবং বিয়ে ভাঙার অভিজ্ঞতা।
রেশমা (যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার নাম) এবং তার মা বিয়েতে রাজি ছিল না। তাদের রাজি না হওয়ার কঠিন কারণ ছিল। বিয়ে জোর করে দেওয়া হয়। আমি নিজে আপত্তি করতে পারতাম। আপত্তি করিনি। আমার মধ্যে গা ছেড়ে দেওয়া ভাব চলে এসেছে। যা হওয়ার হবে এই ভাব। ঘটনা প্রবাহে বাধা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা কারও নেই এই বিষয়টা আমার মাথায় ঢুকে গেছে।