রাশেদা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, অনেক জালিম দেখেছি এমন জালিম দেখি নাই।
রেশমা বলল, কয়টা জালিম দেখেছ মা?
রাশেদা জবাব দিলেন না। রেশমা বলল, তুমি কোনো জালিমই দেখো নাই। কথার কথা বল।
চুপ থাক।
আমি চুপ থাকব। তুমি কান্দন থামাও।
এজিন নিতে যখন আসবে, তুই খবরদার এজিন দিবি না। দেখি বিয়া কীভাবে হয়।
রেশমা বলল, এজিন না দিলেও বিয়ে হয়ে যাবে। কীভাবে?
রেশমা বলল, সাক্ষীরা বলবে মেয়ে ফিসফিস করে কবুল বলেছে, আমরা শুনেছি। তারপর রাতে বাসরঘরে ঢুকিয়ে দিবে। বিয়ে না করেও পরপুরুষের সঙ্গে শুতে হবে। এরচেয়ে বিয়ে হওয়া ভালো না?
রাশেদা মেয়ের গালে সশব্দে চড় বসালেন। রেশমার কোনো ভাবান্তর হলো। তার হাসিমুখ হাসিহাসি থাকল। রাশেদা চাপা গলায় বললেন, ঠিক করে বল তুই খুনিটারে বিয়ে করতে চাস?
রেশমা তার মাকে চমকে দিয়ে বলল, চাই।
কী জন্যে চাস?
উনারে আমার ভালো লাগে।
মাকাল ফল দেখস নাই? মনে হয় কী সুন্দর, ভিতরে বিষ।
রেশমা বলল, একটা ভালো জিনিস কী জানো মা? উনি বাইরে সুন্দর ভিতরে বিষ এইটা আমরা জানি। অন্যের বিষয়ে জানব না। আগে থেকে জানা থাকা ভালো না মা?
রাশেদা চাপা গলায় মেয়েকে অতি কুৎসিত কিছু কথাবার্তা বললেন। যার সারকথা হচ্ছে রূপবান ছেলে দেখে রেশমার শরীর উজায়ে গেছে। শরীরে জ্বলুনি হচ্ছে। জ্বলুনি কমানোর জন্যে কাউকে দরকার। সেটা যদি পশু হয় তাতেও তার মেয়ের কোনো সমস্যা নাই। বরং পও হলেই সে খুশি।
রেশমা বলল, খুব খারাপ কথাও যে তুমি এত সুন্দর করে বলতে পারো আমি জানতাম না। তোমার কাছ থেকে খারাপ কথা শিখব মা। বিয়ের পর খারাপ কথা বলায় দোষ নাই। বিয়ের আগে দোষ।
বিয়ের জন্যে হাসান রাজাকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। নাপিত এসে ভোরবেলায় তার চুল কেটে নতুন ধুতি নিয়ে গেছে। নিমপাতা এবং কাঁচা হলুদ দিয়ে তাকে গোসল দেওয়া হয়েছে। গোসলের পানিতে সোনা-রুপা রাখা হয়েছে। হাসানের গোসলের পর কনের গোসল দেওয়া হবে। কনের গোসলের নিয়মকানুন ভিন্ন। তাকে গোসল দিবে তিন সধবা। গোসলের দৃশ্য কোনো বিধবা দেখতে পারবে না। কাজেই রেশমার মা গোসলের সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
গোসলের পর হাসানকে হাজি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। হাসান বাবার সামনে জলচৌকিতে বসে আছে। হাজি সাহেব তামাক খাচ্ছেন। তাকে কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে।
হাজি সাহেব বললেন, তুমি কি আমার উপর অসন্তুষ্ট?
হাসান বলল, না।
তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহের ব্যবস্থা করেছি, অসন্তুষ্ট হবার কথা। আমার কিছু যুক্তি আছে। যুক্তিগুলো শোনো।
হাসান বলল, আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি এটাই যথেষ্ট। যুক্তি শোনার প্রয়োজন নাই।
প্রয়োজন আছে। মন দিয়ে শোনো। তুমি যে অপরাধ করেছ তার পাপ এই বিয়েতে কিছু কাটা যাবে।
হাসান বলল, পাপ কাটাকাটি তো আপনি করছেন না। আপনি কীভাবে জানেন পাপ কাটা যাবে? আরও পাপ যুক্ত হতে পারে।
কথার মাঝখানে কথা বলবা না। বেয়াদবি করবা না।
আর কথা বলব না। আপনার যা বলার বলুন।
তোমার মামলা যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল সেভাবে অগ্রসর হয় নাই। আমি যথেষ্ট চিন্তায় আছি। উকিল সাহেব বলেছেন উচ্চ আদালতে ফরিদ ছাড়া পাবে।
ছাড়া পেলে ভালো। না পেলেও ক্ষতি নাই। আমি সুখে সংসার করব।
তোমার কথাবার্তার ধরন ভালো লাগল না। তুমি অস্থির আছ। অস্থির মানুষ এমন কথা বলে। বিবাহের পর তোমার অস্থিরতা কমবে ইনশাল্লাহ।
আপনার কথা শেষ হয়েছে, নাকি আরও কিছু বলবেন?
আরও কথা বলার ইচ্ছা ছিল। তোমার যে অবস্থা আমার কথা মন দিয়া শুনবা না।
আপনার কথা বলার কথা, আপনি কথা বলেন। আমার মতো আপনি নিজেও অস্থির। কথা বললে আপনার অস্থিরতাও কমবে।
স্ত্রী স্বামীর জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তোমার স্ত্রী তোমার জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে আসবে! তোমার সৌভাগ্যের প্রয়োজন আছে।
হাসান রাজা হাসল।
আমাকে কদমবুসি করে দোয়া নাও। তোমার মায়ের কবর জিয়ারত করো। পিতামাতার দোয়া নাও। বিবাহ হয়ে যাক, একসঙ্গে খানা খাব।
কনের গোসল দেওয়া হচ্ছে।
তিনজন সধবা গোসল দিচ্ছেন। একটু দূরে বিয়ের গান হচ্ছে।
পিড়িতে বসিছে কন্যা
গোসল করিবায়
কইন্যার নানি দূরে বইসা
এইদিক ওইদিক চায়
জলে ভেজা কন্যার চোখে
তিন সাগরের পানি
চোখ মুছ সিনান কইন্যা
এখন নাও দৌড়ানি…
রাশেদ তার ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় আছেন। কেঁদে তিনি চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। তার ইচ্ছা করছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দরজায় তালা লাগানো বলে তা সম্ভব হচ্ছে না।
বাদ জুমা বিয়ে পড়ানো হলো। তার পরপরই নৌকা নিয়ে প্রণব উপস্থিত হলেন। হাজি সাহেবের হাতে হাবীব খানের চিঠি দিলেন। হাজি সাহেব চিঠি পড়লেন। প্রণবকে বললেন, পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছেন। সিনান করেন। আসেন একসঙ্গে খানা খাই। চিঠিতে কী লেখা আপনি কি জানেন?
প্রণব বললেন, জানি না। চিঠিটা জরুরি এটা শুধু জানি।
উকিল সাহেব তার কন্যার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমার জন্যে অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। একটু ঝামেলা আছে, সেটা বড় কিছু না। সামান্য ঝামেলা।
কী ঝামেলা?
কিছুক্ষণ আগে আমার ছেলের বিয়ে পড়ানো হয়েছে।
প্রণব অবাক হয়ে বললেন, এটা কোনো বড় ঝামেলা না? সামানা ঝামেলা? আপনি বলেন কী?
হাজি সাহেব বললেন, বিয়ে হয়েছে কিন্তু ছেলের সঙ্গে মেয়ের সাক্ষাৎ হয় নাই। দুজন আলাদা আছে। এই অবস্থায় তালাক হয়ে যাবে।