আবারও কেমিস্ট্রির বইখাতা বন্ধ। জমুক ধুলো কেমিস্ট্রির বইখাতায়।
১৬ ফেব্রুয়ারি খবর বের হলো, পিণ্ডিতে আয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি শেখ মুজিবুর রহমান প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সেই আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন।
আবার আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস। যাক সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এখন ভাসানী কোনো ঝামেলা না করলেই হলো। এই মানুষটা বাড়া ভাত নষ্ট করতে পারদর্শী। হে আল্লাহ, তাকে সুমতি দাও সব যেন ঠিক হয়ে যায়। দেশ শান্ত হোক। দেশ শান্ত হোক।
মাওলানা ভাসানীর সেই সময়ের কাণ্ডকারখানা আমার কাছে যথেষ্টই রহস্যময় মনে হচ্ছিল। আয়ুববিরোধী আন্দোলনে তিনি যাননি। আয়ুব খানের
(এর পরের একটা পেজ মিসিং আছে)
ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। একসময় মিছিলে ঢুকে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ভয় কেটে গেল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছি। বুক ফুলিয়ে হাঁটছি। মিছিল শুরু হয়েছে পল্টন ময়দানে। শহিদ মতিয়ুরের জানাজা শেষের মিছিল। মিছিল কোনদিকে যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানি না। মিছিলে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আমি একসঙ্গে এত মানুষ জীবনে দেখিনি। মিছিল ইকবাল হলে শেষ হলো। সেখানে বক্তৃতা করেন শহিদ মতিয়ুরের বাবা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এক মতিয়ুরকে হারিয়ে আমি হাজার মতিয়ুরকে পেয়েছি।
পুত্রহারা কোনো বাবার বক্তৃতা দেওয়ার মানসিকতা থাকার কথা না। তিনি দিতে পেরেছেন কারণ তিনি সত্যি সত্যি তার সামনে লক্ষ মতিয়ুরকে দেখেছিলেন।
মিটিং-এর পরপর চারদিকে নানান গণ্ডগোল হতে লাগল। পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাস। শুধু যে ঢাকায় গণ্ডগোল হচ্ছে তা-না। সারা পূর্বপাকিস্তানেই। গুজব রটল সেনাবাহিনী তলব করা হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে কার্ফ দেওয়া হবে।
আনিস ভাই বললেন, হলে ফিরে যাবে?
আমি বললাম, না।
আমরা এক মিছিল থেকে আরেক মিছিলে ঘুরতে লাগলাম। মেয়েদের একটা মিছিল বের হয়েছিল। নেতৃত্বে ছিল ইডেন কলেজের মেয়েরা। তাদের ভাবভঙ্গি অত্যন্ত উগ্র। মেয়েদের মিছিল দুই ট্রাক ইপিআরের সামনে পড়ল। মেয়েদের একজন এগিয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, গুলি করতে চান? করুন গুলি। যদি সাহস থাকে গুলি করুন।
তরুণীর দৃপ্ত ভঙ্গি, কণ্ঠের বলিষ্ঠতা এখনো চোখে ভাসে।
সন্ধ্যার পরপর ঢাকা শহরে সত্যি সত্যি সেনাবাহিনী নামল। গভর্নর মোনায়েম খান বেতার এবং টেলিভিশনে ঘোষণা করলেন, বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছে। শহরের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে কাফু জারি করা হয়েছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত কার্টু বলবৎ থাকবে।
আমি হলে ফিরে এসেছি। বাইরের ঝড়ের জগৎ থেকে ব্যক্তিগত শান্তির জগতে। আমার হাতে টমাস হার্ডির প্রেমের উপন্যাস। আমি নীল নয়না এক তরুণীর দুঃখগাথা পড়ছি। আবেগে আমার চোখ ভিজে ভিজে উঠছে।
আজ হাসান রাজা চৌধুরীর বিয়ে
আজ হাসান রাজা চৌধুরীর বিয়ে।
এক লাখ টাকা কাবিন। অর্ধেক গয়নাতে উসুল। বাকি অর্ধেক কনের হাতে নগদ দেওয়া হবে। ব্যাংক থেকে টাকা এনে রেশমি রুমালে বেঁধে সিন্দুকে তুলে রাখা হয়েছে।
কনের নাম রেশমা।
বিয়ে হবে জুমার নামাজের পর। বিয়ে পড়াবেন মৌলানা তাহের উদ্দিন জৈনপুরী। ধর্মপাশা থেকে এই উপলক্ষে তাকে আনা হয়েছে। তিনি এসেই মসজিদে চিল্লায় বসেছেন। বিশেষ বিশেষ বিবাহে মৌলানা তাহের উদ্দিন জৈনপুরী আলাদা কিছু কর্মকাণ্ড করেন। হাসান রাজা চৌধুরীর বিয়ে একটি বিশেষ ঘটনা।
বিয়েতে বড় কোনো উৎসব হচ্ছে না। নাইওরিদের আনা হয়নি। হাসান রাজা চৌধুরীর বাবা হাজি সাহেব পুত্রের বিয়ের উৎসব পরে করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আজ রাতে অঞ্চলের বিশিষ্ট লোকজনদের জন্যে শাহি খানার ব্যবস্থা হচ্ছে। চারটা খাসি, একটা গরু জবেহ করা হয়েছে। পোলাও, খাসির মাংসের কোরমা, গরুর মাংস। বাবুর্চি নেত্রকোনা থেকে এসেছে। বাবুর্চির নাম মনা বাবুর্চি। মনা বাবুর্চিরও কিছু নিয়ম আছে। ডেগদ্ধি তার একটি। সে মন্ত্রপাঠ করে কাঁচা হলুদ, আদা এবং কাঁচা সরিষা দিয়ে ডেগ শুদ্ধি করে। এই প্রক্রিয়া মনা বাবুর্চি পেয়েছে তার ওস্তাদ হাজি গনি বাবুর্চির কাছ থেকে। হাজি গনি বাবুর্চি ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিখ্যাত বাবুর্চি। জ্বিনের বাদশা নাকি তার মেয়ের বিয়ের খানা পাকানোর জন্যে গনি বাবুর্চিকে কোহকাফ নগরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই গল্প প্রচলিত আছে। অনেকেই এই গল্প বিশ্বাস করে। গনি বাবুর্চিকে গল্পের সত্যতা বিষয়ে প্রশ্ন করলে জবাব দেন না। মাথা নিচু করে হাসেন।
ডেগশুদ্ধি প্রক্রিয়া এরকম—একটা থালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ডেগের ভেতর নামিয়ে দেওয়া হয়। থালায় থাকে কাঁচা হলুদ, আদা এবং রাই সরিষা। মনা বাবুর্চি গোসল করে নতুন লুঙ্গি পরে মন্ত্রপাঠ করে ফুঁ দিয়ে প্রদীপ নেভায়। ডেগ শুদ্ধ হয়।
মন্ত্রটা নিম্নরূপ-
আলির ডেগ, কালীর ডেগ
রসুল বলে দেখে দেখ
কালী দেখি আলি দেখে
ভূত প্রেত চেখে দেখে
ভূতের মায়ের তিন পুত
ডেগের ভিতরে লাল সূত
লাল সূতে গিটু।
ইত্যাদি…
বিয়ের কনে রেশমা সকাল থেকেই তার মা’র সঙ্গে আছে। রেশমা যথেষ্ট হাসিখুশি। তার মা রাশেদা মূর্তির মতো মেয়ের পাশে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর তার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। তারা দু’জন যে ঘরে আছে, তার দরজায় বড় একটা তালা ঝুলছে। রাশেদাকে বলা হয়েছে এজিন নেওয়ার জন্যে যখন সাক্ষীরা কাজি সাহেবকে নিয়ে আসবেন, তখনই তালা খোলা হবে; তার আগে না।