কল্পনার বকুলগন্ধা তরুণী পাশে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় এক কাও—কানে এল ডিম ভাজার শব্দ। প্রতিটি রুম তালাবন্ধ। বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। এর মধ্যে একটা ঘরের ভেতর ডিম ভাজা হচ্ছে, এর অর্থ কী? কানে কি ভুল শুনছি? যে রুম থেকে ডিম ভাজার শব্দ আসছে আমি তার সামনে দাঁড়ালাম। চামচের টুং টাং শব্দ। পায়ে হাঁটার শব্দ। আমি দরজায় টোকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সব শব্দের অবসান। কিছু রহস্য অবশ্যই আছে। রহস্যটা কী? আমি নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। রহস্যের কিনারা করতে হবে। (পাঠক, মিসির আলির জন্মলগ্ন।) রহস্যের সমাধান করলাম। এখন সমাধানের ধাপগুলি বলি—
১. ওই ঘরে একজন বাস করে। তাকে লুকিয়ে রাখতে হয় বলেই বাইরে থেকে তালা দেওয়া।
২. সে ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে। ডিম ভাজার শব্দ তার প্রমাণ।
৩. সে বেশ কিছুদিন ধরেই ওই ঘরে আছে। ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে বাস করলে ডিম ভেজে খেত না।
৪. চামচের টুং টাং শব্দ থেকে মনে হয় সে একজন মেয়ে। মেয়েদের চামচের শব্দের ভঙ্গি আলাদা। পুরুষ জোরে শব্দ করে।
৫. তাকে কেউ আটকে রাখেনি। আমি দরজায় টোকা দিয়েছি, সে চুপ করে গেছে। বন্দি কেউ হলে নিজেকে ঘোষণা করত।
সন্ধ্যাবেলায় আমি গেলাম হাউস টিউটর অধ্যাপক ইমরানের কাছে। আমি তাকে ঘটনা খুলে বললাম। অধ্যাপক ইমরান চোখ কপালে তুলে বললেন, তোমার মাথা খারাপ। তুমি মাথার চিকিৎসা করাও।
আমি বললাম, জি আচ্ছা স্যার।
জি আচ্ছা না। কাল পরশুর মধ্যে ডাক্তার দেখাবে।
জি আচ্ছা স্যার।
ইমরান স্যার বললেন, পড়াশোনায় মন দাও। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তোমার মাথায় শয়তান কারখানা বানিয়েছে। যাও আমার সামনে থেকে বিদায়।
আমি বিদায় হলাম। রাত আটটায় ইমরান স্যার দু’জন অ্যাসিসটেন্ট হাউস টিউটর নিয়ে আমার ঘরে উপস্থিত। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কোন ঘরে মেয়ে আটকে রাখা হয়েছে আমাকে দেখাও? যদি কিছু না পাওয়া যায় তোমাকে আমি ইউনিভার্সিটি থেকে তাড়াব।
রুমটা স্ট্যাটিসটিক্সের ছাত্র আবু সুফিয়ানের। সে তার ঘরে ছিল। ইমরান স্যার দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, আমি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। রুম খালি, রুমে কেউ নেই। আমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। কী সর্বনাশ!
সুফিয়ান বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার কী ব্যাপার?
ইমরান স্যার বললেন, কোনো ব্যাপার না। রুটিন চেক। তুমি কি ঘরে ইলেকট্রিক হিটার ব্যবহার করো? ইলেকট্রিক হিটার দেখতে পাচ্ছি। হিটার জব্দ করা হলো। এখন নিব না। সকালে তুমি অফিসে জমা দিবে।
জি আচ্ছা স্যার।
পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে, নাকি মিটিং মিছিল নিয়ে আছ?
ঠিকমতো পড়ছি স্যার।
ইমরান স্যার উঠলেন। রুম থেকে বের হওয়ার সময় কাপড় রাখার কাবার্ড থেকে হঠাৎ কাচের চুড়ির টুং শব্দ পাওয়া গেল। ইমরান স্যার থমকে দাঁড়ালেন। কাবার্ড খুললেন। ষােল-সতেরো বছরের একজন তরুণী মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। তার চোখভর্তি পানি।
জানা গেল এই তরুণীকে সুফিয়ান বিয়ে করেছে। বিয়ে আত্মীয়স্বজন কেউ স্বীকার করেনি। মেয়েটির থাকার জায়গা নেই বলে সুফিয়ান তাকে হলে এনে তুলেছে। গত ছয় মাস ধরে সে এখানেই আছে। অমানবিক এক জীবনযাপন করছে। মেয়েটিকে পশুর এক জীবন থেকে আমি উদ্ধার করেছি এতে সন্দেহ নেই। আবার মেয়েটির স্বামীকে এই কারণেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাতেও সন্দেহ নেই।
মেধাবী এই ছাত্রকে গুরুতর অপরাধের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দু’বছরের জন্যে বহিষ্কার করে। সুফিয়ান দু’বছর পর আবার পড়াশোনায় ফিরে আসে। পড়াশোনা শেষ করে, দেশের বাইরে থেকে Ph.D ডিগ্রি এনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে।
আমার কাছে ‘৬৯-এর গণআন্দোলনের একটি দিক হলো বন্দিনী এক তরুণী।
হলের রিডিংরুমে দেশের সব কটা খবরের কাগজ আসে। আমি প্রতিটি খবরের নিবিষ্ট পাঠক। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি জানার জন্যে কাগজ পড়ি তা কিন্তু না। আমার প্রধান আকর্ষণ চন্দ্র অভিযান বিষয়ে। আমেরিকা চাদে মানুষ পাঠাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট কেনেডির স্বপ্ন পূরণের জন্যে আমেরিকা মরিয়া হয়ে উঠেছে। খবরের কাগজে রোজই কোনো-না-কোনো খবর ছাপা হয়। তৈরি হচ্ছে এপলো ১১, চন্দ্ৰতরীর নাম ইগল, পৃথিবী থেকে চাঁদে যেতে লাগবে চার দিন। নভোচারীদের একজনের নাম নীল আর্মস্ট্রং, তার পছন্দের খাবার ইতালির পিজা। তার বাচ্চা মেয়ে বাবাকে বলেছে—বাবা, চাঁদকে তুমি আমার হয়ে একটা চুমু দিবে। কেমন?
মজার মজার কত খবর। পড়লে অদ্ভুত লাগে। সত্যি সত্যি মানুষ দে পা দিবে। আমি দেখে যেতে পারব। আমি এত ভাগ্যবান?
চন্দ্র অভিযানের আনন্দময় খবরের পাশাপাশি ভয়ঙ্কর সব খবর। পড়লে দমবন্ধ হয়ে আসে। তবে মাঝে মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। পহেলা ফেব্রুয়ারি এরকম এক ঘটনা ঘটল। আয়ুব খান বেতার ভাষণে বললেন, শীঘই আলাপ আলোচনার জন্যে আমি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিবর্গকে আমন্ত্রণ জানাব।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কেমিস্ট্রির বইখাতা খুললাম। ধুলা ঝাড়লাম। সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এখন কেমিস্ট্রির বইখাতা খোলা যেতে পারে।
পনের দিনের মাথায় ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দি অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়, বন্দি পালাতে যাচ্ছিল বলে তাকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনা এখন ঘটলে বলা হতো ‘ক্রসফায়ার’। পাকিস্তান সরকারের মাথায় ক্রসফায়ারের বুদ্ধি আসেনি।