আপত্তি করব না।
প্রস্তাব দিয়ে প্রণবকে পাঠাই, দেখি কী হয়। কার কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছি জানতে চাস না?
আমি জানি।
ফরিদের মামলার আজ রায় হয়েছে, এই খবর জানিস?
তো! মামলার বিষয়টাই আমি কিছু জানি না। মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে কিছু বলে না।
আমি নিষেধ করে দিয়েছি। আমার মতে পুরুষদের জগৎ আলাদা। মেয়েদের জগৎ আলাদা। মামলা মোকদ্দমা পুরুষদের বিষয়। ভালো কথা, তুই চিঠিটা আবার পড়া শুরু করেছিস কেন? মুখস্থ করবি? এটা তো কোনো পাঠ্যবই না।
নাদিয়া চিঠি নামিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকাল। হাবীব মেয়েকে চমকে দিয়ে বললেন, তোর স্যারকে আসতে বল। দেখি সে কীভাবে মানুষের মুখে বুলি ফোটায় নাদিয়া তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে বাবা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন।
নাদিয়া ক্ষীণ গলায় বলল, বাবা! সত্যি আসতে বলব?
হ্যাঁ। তোর কাছে আমার একটা উপদেশ আছে।
বলো কী উপদেশ?
কোনো মানুষকেই মহাপুরুষ ভাববি না। পৃথিবীতে মহাপুরুষ জন্মায় না।
নাদিয়া বলল, বাবা, পৃথিবীতেই মহাপুরুষ জন্মায়। অনেকেই জন্মেছে। ভবিষ্যতেও জন্মাবেন। কয়েকজনের নাম বলব বাবা?
হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। পিচ্চি মেয়ের সঙ্গে তর্কযুদ্ধ শুরু করার কিছু নেই।
প্রণব শুকনা পাতা জড়ো করে আগুন করেছেন। ঝাটা হাতে ছোটাছুটি করছে ভাদু! সে বাগান থেকে শুকনা পাতা নিয়ে আসছে। তার উৎসাহের সীমা নাই। প্রণব বললেন, আর লাগবে না। তুই তো শুকনা পাতার পাহাড় বানিয়ে ফেলেছিস। কাছে বস, আগুনে শরীর গরম কর।
শরীর গরম করব না স্যার।
করবি না কেন?
শরীর গরম করতে শরম পাই।
প্রণব হেসে ফেললেন। তাঁর মনে হলো ভাদুর মতো বুদ্ধিহীন হয়ে জন্মালে জীবনটা সুখের হতো। জগতের কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করত না। তিনি মাথা থেকে ফরিদের বিস্মিত চোখ সরাতে পারছেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন আগুনের দিকে। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে বাঁ-পাশে ফরিদ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাকালেন বাদিকে, মনে হলো ফরিদ এখন ঠিক তার পেছনে।
‘তদেতৎ কারণং পশ্য যদর্থং তুং ময়া হতঃ।’
কেন তোমাকে বধ করেছি তার কারণ শোনো…
প্রণবের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। যতই সময় যাবে যন্ত্রণা বাড়বে। এই যন্ত্রণা কতদিন থাকবে কে জানে।
ভাদু!
জে সার।
একটা গল্প বল।
ভাদু সঙ্গে সঙ্গে গল্প শুরু করল—এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজা তিনটা শাদি করেছে কিন্তু পুত্রসন্তান হয় নাই। খালি কন্যাসন্তান হয়। রাজা হইল বেজার। হাঁক দিয়া মন্ত্রী ডকিল। বলল, ও মন্ত্রী। মন্ত্রী বলল, জে। রাজা বলল, আমার মন বেজার হইছে…।
ভাদু গল্প বলে যাচ্ছে। হাত-পা নেড়ে গল্প। গল্পে অভিনয় অংশও আছে। প্রণব তাকিয়ে আছেন। তার কাছে মনে হচ্ছে ভাদু কী সুখেই না আছে।
———–
আমানুল্লাহ মোহম্মদ আসাদুজ্জামান।
আসাদের মৃত্যুর পর তার এম, এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। ইতিহাসে মেধা তালিকায় স্থান করে দ্বিতীয় শ্রেণী লাভ করেন।
বাবা : এম, এ তাহের। শিবপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক।
মা : মতিজাহান খাদিজা খাতুন। প্রধান শিক্ষিকা, নারায়ণগঞ্জ আই. টি. স্কুল।
এ পেয়ার অব ব্লু আইজ
মহসিন হলে আমার সিঙ্গেল সিটের রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি জানালার দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। জানালা বিশাল। শীতের হাওয়া আসছে। গায়ে চাদর দিয়েছি। চাদরের ওম ওম উষ্ণতা। আমার হাতে টমাস হার্ডির লেখা বই এ পেয়ার অব ব্লু আইজ। মূল ইংরেজি বই না, অনুবাদ। আমি মুগ্ধ হয়ে প্রেমের উপন্যাস পড়ছি।
হল ছাত্রশূন্য। প্রতিদিনই মিটিং মিছিল চলছে। রাস্তায় নামলেই মিছিলে ঢুকে যেতে হয়। দেড় দু’মাইল হাঁটা। মিছিলে হিংস্রভাব চলে এসেছে। পুলিশের পাশাপাশি নেমেছে ইপিআর। পুলিশ রাস্তায় থাকে। ইপিআর ট্রাকের ওপর। পুলিশের চোখে থাকে আতঙ্ক, পাশাপাশি ইপিআরদের দেখায় যমদূতের মতো। কী প্রয়োজন এইসব ঝামেলায় যাবার! আমি দু’টি নীল চোখ নিয়ে ভালোই তো আছি। ‘য পলায়তি স জীবিত’। যে পালিয়ে থাকে সে-ই বেঁচে থাকে। আমি পালিয়ে আছি। তবে খুব যে সুখে আছি তা না। আমার প্রচণ্ড চিন্তা আমার পুলিশ অফিসার বাবাকে নিয়ে। মানুষজন আধাপাগলের মতো হয়ে গেছে। পুলিশ দেখলেই ইট মারছে। ধাওয়া করছে।
একদিন ডাইনিং হলে খেতে বসেছি, আমার ঠিক সামনে বসা এক ছাত্র গল্প করছে—কী করে তারা দৌড়ে এক পুলিশ কনস্টেবলকে ধরে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। মাথা থেঁতলাবার আগে আগে সে নাকি বলছিল—বাবারা, আস্তে বাড়ি দিয়ো। আস্তে। গল্প শুনে আশেপাশের সবাই হেসে উঠল। আমি স্পষ্ট চোখের সামনে দেখলাম, আমার বাবার মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হচ্ছে। বাবা বলছেন, আস্তে মারো। আস্তে। আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম।
জনতার আক্রোশ সরকারের দিকে। সরকারকে তারা হাতের কাছে পাচ্ছে। পাচ্ছে ঠোল্লা অর্থাৎ পুলিশকে। তাদের স্লোগানে আছে–একটা দুইটা ঠোন্না ধরো, সকাল বিকাল নাশতা করো।
‘৬৯ সনে ছাত্রজনতার ঘৃণা এবং রাগের কেন্দ্রবিন্দুর পুলিশরাই আবার মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকসেনার বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্রধারী। ইতিহাসের কী আশ্চর্য খেলা!
থাক এই প্রসঙ্গ, হলের গল্পে ফিরে যাই। এ পেয়ার অব ব্লু আইজ অনেকক্ষণ পড়া হয়েছে। এখন ব্যক্তিগত মিছিলে অংশ নেওয়া যায়। আমার ব্যক্তিগত মিছিল হলো, করিডরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়া। এই হাঁটাহাঁটির সময় অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে ভালো লাগে। বয়সের কারণেই হয়তো আমার চিন্তায় একজন তরুণী থাকে। যে সারাক্ষণই আমার হাত ধরে থাকে। তরুণীর গা থেকে বালি বকুল ফুলের সৌরভ ভেসে আসে।