বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালিম গাছে মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে শার্ট
শহরে প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চুড়োয়
গমগমে এভেনর আনাচে কানাচে
উড়ছে উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
ঢাকার আন্দোলন ময়মনসিংহ শহরে সেদিন পৌঁছেনি। শহর শান্ত। শহরের কাজকর্ম ঠিকমতো চলছে। চায়ের দোকানে চা বিক্রি হচ্ছে। চিন্তিত পথচারী সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছে। কাধে বাঁদর নিয়ে বাঁদরওয়ালা ঘুরছে।
কোর্ট থেকে ফিরে হাবীব খাওয়াদাওয়া শেষ করে দুপুরে ঘুমাতে গেছেন। তার মধ্যে কোনো উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে না। পিয়ন চিঠি দিয়ে গেছে। তিনি চিঠি পড়ছেন। রশিদ তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাবীব বললেন, সফুরা কি ফিরেছে?
রশিদ বলল, তাকে প্রণব স্যার হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।
রায়ের খবর বাড়ির মহিলারা জানে?
জি-মা।
হাবীব বললেন, আমার পা টিপার প্রয়োজন নাই। সফুরাকে গিয়ে বললো, হতাশ হওয়ার কিছু নাই। আমরা আপিল করব। কাগজপত্র হাইকোর্টে যাবে। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
রশিদ নিচুগলায় বলল, স্যার, আসলেই কি ঠিক হবে?
হাবীব তাকালেন রশিদের দিকে রশিদ কখনো তাঁরচাখে। চালে তাকায় না। আজ একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে সত্যি কথা বলা প্রয়োজন। রশিদ তার অতি পছন্দের একজন অনেক কাছের। সব মানুষেরই একজন ছায়া লাগে। রশিদ তার ছায়া।
হাবীব বললেন, ঝামেলা হয়ে গেছে হাইকোর্ট সাজা বহাল রাখবে। খুনের মামলায় প্রত্যক্ষ সাক্ষী গুরুত্বপূর্ণ। কঠিন প্রত্যক্ষ সাক্ষী আছে।
রশিদ বলল, স্যার, সব তো মিথ্যা!
কিছু মিথ্যা আছে যা একসময় আর মিথ্যা থাকে না, সত্য হয়ে যায়।
একজন নির্দোষ মানুষ ফাঁসিতে ঝুলবে?
হাবীব বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, রশীদ মন দিয়ে শোনো তুমি আল্লাহ বিশ্বাস করো?
অবশ্যই করি স্যার।
তিনি কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, আমার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়বে। তুমি বলো, বলেছেন?
জি স্যার।
কাজেই যা ঘটছে আল্লাহর হুকুমেই ঘটছে, ঠিক?
রশিদ চুপ করে রইল। হাবীব বললেন, আরও পরিষ্কার করে বলি–পাঁচটা বিষয় আল্লাহপাক নিজের হাতে রেখেছেন। হায়াত, মউত, রিজিক, ধনদৌলত এবং বিবাহ। মউত কার কীভাবে ঘটবে তা উনি নির্ধারণ করেন। মানুষের এখানে কোনো হাত নাই। ফরিদ ফাঁসিতে ঝুলে মরবে নাকি পাতলা পায়খানা করতে করতে মারা যাবে তা পূর্বনির্ধারিত। এখন পরিষ্কার হয়েছে?
জি।
তাহলে যাও যা করতে বলেছি করো।
রশিদ চলে গেল। হাবীব চিঠি পড়তে বসলেন। একটা চিঠি এসেছে নাদিয়ার শিক্ষক বিদ্যুত কান্তি দে’র কাছ থেকে। হাবীব ভুরু কুঁচকে চিঠি পড়তে শুরু করলেন। এই লোক তাকে কেন চিঠি লিখবে?
জলাব,
আমি বিদ্যুত। আপনার মেয়ে নাদিয়ার শিক্ষক। আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্যে এই চিঠি।
আমি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এক ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ ভাকেন্সির চাকরি চলে যাওয়ায় বিরাট বিপদে পড়ি। প্রায় অনাহারে থাকার মতো অবস্থা। তখন হঠাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পাই। আমাকে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বলা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে জানতে পারি আমাকে Ph.D প্রোগ্রামের স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে। গভর্নর মোনায়েম খানের সুপারিশে এই কাজটি হয়েছে।
নাদিয়ার পড়াশোনায় বিরাট বিঘ্ন ঘটেছে। আপনি বিচক্ষণ মানুষ। বিঘ্ন দূর করে নাদিয়ার পড়াশোনা শুরুর ব্যবস্থা করুন। আমার বিনীত অনুরোধ।
আমি ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা করব। এরমধ্যে পাসপোর্ট ভিসার ঝামেলা শেষ করব।
আমি ঈশ্বর-ভগবান এইসবে বিশ্বাস করি না। তারপরেও ঈশ্বরের কাছে আপনার এবং আপনার পরিবারের সকল সদস্যের মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা করছি।
ইতি
কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ
বিদ্যুত কান্তি দে
হাবীব সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় চা খেতে বসে নাদিয়াকে ডেকে চিঠি পড়তে দিলেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, চিঠি হাতে নিয়ে নাদিয়া অল্প অল্প কাঁপছে। তার চোখ ছলছল করছে। হাবীব বললেন, কাঁদছিস কেন?
নাদিয়া বলল, স্যারের এত ভালো একটা খবর শুনে চোখে পানি এসে গেছে। স্যারকে আমরা কী যে পছন্দ করি! উনার সবচেয়ে বড় গুণ কী জানো বাবা? উনি মানুষের মধ্যে স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে পারেন।
তোর মধ্যে কী স্বপ্ন ঢুকিয়েছেন?
নাদিয়া জবাব না দিয়ে চিঠিটা আবার শুরু থেকে পড়তে শুরু করল। এখনো তার হাত কাঁপছে।
নাদিয়া।
জি বাবা।
হোসনা মেয়েটার কী অবস্থা? এখন কি কথা বলে?
না বেশির ভাগ সময় ছাদের চিলেকোঠায় বসে থাকে। তাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখি নাই। কঁদলে মনে হয় তার ভালো লাগত। বিদ্যুত স্যার যদি কিছুক্ষণ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতেন মেয়েটা ভালো হয়ে যেত।
উনি কি তোর কাছে মহাপুরুষ পর্যায়ের কেউ?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নাদিয়া বলল, বাবা, উনাকে চিঠি লিখে আসতে বলি? উনি পদ্মকে ঠিক করে দিয়ে যাক।
পদ্ম কে?
হোসনার নাম আমি পদ্ম রেখেছি।
হাবীব হাই তুলতে তুলতে বললেন, আমি তোর বিয়ের ব্যবস্থা করব। তোের দাদির শরীর এখন খুবই খারাপ, যে-কোনোদিন অঘটন ঘটে যাবে। তুই আপত্তি করিস না।