রাত অনেক।
কিছুক্ষণ আগে দরুদে শেফা পাঠ শেষ হয়েছে। তালেবুল এলেমের দল চলে গেছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটাকা করে দেওয়া হয়েছে।
সারা দিনের ক্লান্তি কাটানোর জন্যে প্রণব পুকুরঘাটে বসেছেন। তার সামনে ভাদু। ভাদুর হাতে তালপাখা। সে প্রণবকে বাতাস দিচ্ছে।
প্রণব বললেন, বাতাস লাগবে না। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।
ভাদু হাওয়া করতেই থাকল।
প্রণব বললেন, বিরাট ঝামেলা গেছে। এখন শান্তি। ভাদু বলল, স্যার আমি বিরাট কষ্টে আছি। কষ্টের কথা কাউরে বলতে পারতেছি না।
প্রণব বললেন, আমাকে বল।
আপনারে বলতে শরম লাগে।
শরম লাগলেও বল। তুই বোকা মানুষ, তোর আবার শরম কী?
ভাদু বলল, বড় স্যারের আম্মারে কী ডাকব বুঝতেছি না বইল্যা মনে কষ্ট।
প্রণব বললেন, অনেক বড় বড় বোকা আমি দেখেছি। তোর মতো বোকা দেখি নাই। বিরাট জ্ঞানী দেখার মধ্যে যেমন আনন্দ, বিরাট বোকা দেখার মধ্যেও আনন্দ।
ভাদু মাথা নিচু করে আছে। মনে মনে ভাবছে, তুই এক মহাবোকা। তোরে দেখে আমি সবসময় আনন্দ পাই। আমি কী সেই পরিচয় যখন পাবি তখন নিজেই নিজের হাত চাবায়া খায়া ফেলবি।
আসাদের শার্ট
জানুয়ারির কুড়ি তারিখ। বুধবার।
ভোরবেলা এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া শীতল। গারোপাহাড় থেকে কনকনে হাওয়া আসছে। ডিসট্রিক্ট জজ আবুল কাশেম এজলাশে বসেছেন। তাঁর গায়ে কোট। গলায় মাফলার। এই মাফলার তার মেয়ে শাহেদা নিজের হাতে বুনেছে। অতিরিক্ত ঠান্ডা পড়েছে বলে কোর্টে রওনা হওয়ার সময় মাফলার গলায় দিয়েছিলেন। কাজটা ভুল হয়েছে। মাফলারটা তার কাছে সাপের মতো লাগছে। যেন রঙিন একটা সাপ তার গলা পেঁচিয়ে আছে। মাফলারটাকে সাপের মতো মনে হওয়ার কারণ আছে। শাহেদা নামের যে মেয়ে মাফলার বুনেছে, সে রবিবার ভোরে পালিয়ে কুমিল্লায় চলে গেছে। তিনি খবর পেয়েছেন কুমিল্লায় সে বিয়ে করেছে। বিয়ে করেছে তার গানের টিচারকে। হারামজাদার নাম কিসমত।
আবুল কাশেম গলা থেকে মাফলার খুলতে খুলতে চাপা গলায় বললেন, বদমাইশ কোথাকার!
চাপরাশি বলল, কিছু বললেন স্যার?
আবুল কাশেম বললেন, পানি দাও। পানি খাব। মাফলারটা নিয়ে যাও।
আবুল কাশেম ঝিম ধরে বসে আছেন। আদালতও ঝিম ধরে আছে। ফরিদের মামলার আজ রায় হবে। খুনের মামলার রায়। আদালত ঝিম ধরে থাকারই কথা।
আবুল কাশেম অস্ফুট স্বরে বললেন, হারামজাদি! এইবার মেয়েকে উদ্দেশ করে বলা। মেয়ে সবার সামনে তাকে বেইজ্জত করেছে। মেয়ের কারণে তাকে সবার কাছে মিথ্যা বলতে হয়েছে। জটিল মিথ্যা—’বাধ্য হয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে মেয়েকে কুমিল্লায় তার এক ফুপুর কাছে পাঠিয়েছি। পাত্রের বিষয়ে একটা উড়োচিঠি পেয়েছিলাম। আমি কোনো গুরুত্ব দেই নাই। কিন্তু মেয়ের মা অন্যরকম মহিলা। মেয়ে তার অতি আদরের।
আবুল কাশেম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তার অতি আদরের মেয়ে বিয়ে উপলক্ষে বানানো চল্লিশ ভরি সোনার গয়না এবং নগদ ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এই কাজটা বুদ্ধিমতীর মতো করেছে।
দুই পয়সার গানের টিচার বৌকে খাওয়াবে কী? সাত-আটটা টিউশনি করে কয় পয়সা পাবে?
একবার মনে হয়েছিল মেয়ের নামে মামলা করে দেন। চুরির মামলা। ফৌজদারি মামলা, ৪৫৫/৩৮০ ধারা। পুলিশ মেয়েকে ধরে হাজতে কাক। বদ মেয়ে। মানুষ যা ভাবে তা করতে পারে না। সামাজিকতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
কত স্বপ্ন ছিল! ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিবেন। বিয়েতে অতিথি হিসাবে গভর্নর সাহেব উপস্থিত থাকবেন। পুলিশ লাইন থেকে পুলিশের ব্যান্ডপার্টি আনাবেন, তারা ব্যান্ড বাজাবে। বর রেলস্টেশন থেকে হাতিতে চড়ে আসবে। সুসং দুর্গাপুর থেকে হাতি আসবে। কিছুই হলো না। হারামজাদি চলে গেছে হারামজাদার কাছে। যা বেটি গানবাজনা কর। নাকি সুরে বাকিজীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘খোলা খোলো দ্বার, রাখিও না আর…।’
আবুল কাশেম আদালতের কার্যক্রম শুরু করলেন। রায় পড়ে শোনালেন। দশ পাতা রায়ের মূল বিষয়–
সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু না। আসামির খুন পূর্বপরিকল্পিত। তাকে নগ্ন করে ভাটিপাড়ায় ঘোরানোর অপমানের শোধ নেওয়ার জন্যেই সে খুনের পরিকল্পনা করে। সে নিজেই খুনের উদ্দেশ্যে বুলেট সংগ্রহ করে। খুনের পরিকল্পনার কথাও অতি ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে প্রকাশ করে। তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো…
কোর্টরুম নিস্তব্ধ। ফরিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সফুরা হঠাৎ মাথা ঘুরে বেঞ্চে পড়ে গেল।
রায় পড়া হলো দুপুর একটায়। ঠিক একই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি গেটের সামনে আসাদুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পিস্তল দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করে পুলিশের এক ডিএসপি, নাম বাহাউদ্দিন
উত্তরের উত্তাল গণআন্দোলনের সেদিনই শুরু। ঢাকা শহরের মানুষ তীব্র রোষে ফেটে পড়ে। শহর হয়ে যায় সমুদ্র, যে সমুদ্রে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ সুনামি।
শহিদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে লাখো মানুষের মিছিল হলো রাজপথে। স্বতঃস্ফুর্ত গণজাগরণ।
পরের দিনের দৈনিক আজাদ পত্রিকার হেডলাইনে লেখা হলো—মৃত্যুর জানাজা মোরা কিছুতেই করিব না পাঠ। জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট!
রক্তমাখা শার্ট নিয়ে কবি শামসুর রাহমান তার বিখ্যাত কবিতা লিখলেন—
আসাদের শার্ট
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।